টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য দশ টাকার নোটের আতিয়া মসজিদ এখন জীর্ণ দশায় : সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন
- প্রকাশের সময় : ০৬:১৭:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০১৮
- / ১১৫৪ বার পঠিত
রাশেদ খান মেনন (রাসেল), টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য দশ টাকার নোটে স্থান পাওয়া আতিয়া মসজিদ এখন জীর্ণ দশায়। টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে প্রায় ৭/৮ কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ার উপজেলা। এ উপজেলার দক্ষিণে আরো ৫ কি ৭ কিলোমিটার রিকশা বা ভ্যানের পথ পেরিয়ে আতিয়া গ্রাম। ওই গ্রামে রয়েছে লৌহজং নদী। আর এই নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত বাংলাদেশের মুসলিম ঐতিহ্যের প্রাচীন একটি নিদর্শন আতিয়া জামে মসজিদ। যা স্থানীয়দের ভাষায় ‘আটিয়া মসজিদ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালীন সময়ে লুৎফর রহমান সরকার ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে মুদ্রিত দশ টাকার নোটে স্থান পায় এই বিখ্যাত মসজিদের ছবি। স্থানীয়রা একে দশ টাকার নোটের ‘আটিয়া’ (আতিয়া) মসজিদও বলে থাকেন। নানা কারণে ঐতিহাসিক ও বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রাচীন পুরাকীর্তি সংযুক্ত সৃষ্টিকর্মের ধারক বাহক এই বিখ্যাত মসজিদটির বর্তমানে জীর্ণ দশায় রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত দর্শনার্থীদের ভীর। এদেও কেউ কেউ বিভিন্ন নিয়তে নামায আদায় করছে, কেউবা সেজদা করছে, কেউ বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলায় ব্যস্ত, আবার কেউবা দেয়ালের বিভিন্ন রকমের কারুকাজের অংশ চিমটি কেটে তুলে বিভিন্ন মানত করে খাওয়ায় ব্যস্ত। একজন মহিলাকে দেখলাম মসজিদের কারুকাজের অংশে চিমটি কেটে পোড়ামাটির অংশ তুলে তার সাথে নিয়ে আসা শিশু বাচ্চাটিকে খাওয়াচ্ছেন। সেইসাথে মসজিদেও দেয়ালে দুইহাত ঘষে আবার সেই দুইহাত তার বাচ্চাটির সারা গায়ে মালিশ করে দিচ্ছেন। তার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলা থেকে এসেছি। আমি লোকমুখে বিভিন্ন উপকারের কথা শুনে একটা মানত করে এসেছি। এই রকম অনেকেই আসেন । যারা মসজিদের বিভিন্ন অংশ মানতের নামে , রোগমুক্তির নামে ও সওয়াবের নামে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। অথচ, এ বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন সময়ে দর্শনার্থীরা আসেন, যার যেভাবে খুশি মানতের নামে এই কারুকার্য শোভিত ঐতিহাসিক মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট করছে। অযতœ অবহেলায় এ মসজিদ এখন এতটাই জরাজীর্ণ, যে যার মতো দেওয়াল লিখন, পোড়ামাটির দেওয়ালে কাটা-ছেঁড়া করাসহ অবাধ ঘোরাঘুরি, ছবি তোলাসহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এ নিয়ে কেউই কিছু বলেন না। ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের আওতায় এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি সংরক্ষিত। আর এ আইনেরই চতুর্দশ ধারার অধীনে বলা হয়েছে, প্রাচীন ঐতিহ্য কেউ বিনষ্ট করতে পারবে না, করলে এক বছরের জেল সঙ্গে জরিমানাও ভোগ করতে হবে। কিন্তু এখানে কে শোনে কার কথা। নোটিশ সম্বলিত সাইনবোর্ডে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর কোনো একটি অংশে আচড় কাটলেও আইনানুগ শাস্তি পেতে হবে এমন কথা লেখা থাকলেও, বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রায় আড়াই থেকে তিন ফুটের প্রাচীর দিয়ে এই ঐতিহাসিক কারুকার্য শোভিত মসজিদটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা টপকে প্রায় সময়ই কুকুর, বিড়ালসহ নানা প্রাণী ভেতরে যাচ্ছে, এছাড়াও রয়েছে মানুষের অবাধ যাতায়াত। নূন্যতম নিরাপত্তা বলয় নেই দর্শনীয় এই মসজিদে। মসজিদের গেটে নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী বা বিশেষ ব্যবস্থা। ফলে এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আগামীতে কেবল ইতিহাসের পাতাতেই রয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে, দেওয়ালের ওপরের যে চিত্রফলক ছিল সেগুলোর বেশিরভাগ অংশ। জনসাধারণের অবাধ যাতায়াতে থাকছে না মসজিদর পবিত্রতাও।
উপস্থিত এলাকাবাসীর মধ্যে কেউ কেউ বলেন, মুরব্বীদের কাছে শুনেছি একদিন হটাৎ করেই এই মসজিদটি মাটির নিচ থেকে জেগে উঠেছিল। এরকম অনেকেই ওই মসজিদ নিয়ে মনগড়া অনেক গল্পই বলে থাকেন। কেন এবং কিজন্য এই মসজিদ বিখ্যাত, নির্মাণ হয়েছে কোন আমলে? কে নির্মাণ করেছিলেন? সে বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা পর্যন্ত নেই। এছাড়াও, মসজিদের মেঝেতে গজিয়েছে ঘাস, দেওয়ালের রঙ চলটে উঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পোড়ামাটির ঐতিহ্য। মসজিদ কর্তৃপক্ষও দায়িত্ব পালনে প্রায় উদাসীন। নামাজ আদায় করতে তাদের কাছে এটি শুধুই একটি মসজিদ, ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্যের অংশ নয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলো বিভিন্ন উপজেলা থেকে ঘুরতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের একজন বলেন, অবসর সময়ে এখানে আসি ঘুরতে। আমাদের মতো অসংখ্য দর্শনার্থীই এখানে আসেন।
প্রতিটি প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি ইতিহাস থাকে। এসব ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অংশ ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলোর বাইরে ফলক আকারে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই বাংলার মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন, পুরাকীর্তি আতিয়া মসজিদের ভেতরে, বাইরে তেমন কোনো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা দিকনির্দেশনার উল্লেখ নেই। যা দর্শনার্থীদেÍ জন্য অত্যন্ত হতাশার। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় দর্শনার্থীদেÍ জন্য এই কারুকার্য শোভিত ঐতিহাসিক মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিলবোর্ডের মাধ্যমে সংযুক্ত করা পয়োজন।
মধ্য যুগের মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ আতিয়া জামে মসজিদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। লাল ইটে তৈরি এ মসজিদে রয়েছে অত্যন্ত চমৎকার স্থাপত্যশৈলী। আতিয়া মসজিদটি বর্গাকৃতির গম্বুজবিশিষ্ট। এর পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট তিন গম্বুজবিশিষ্ট বারান্দা আর সে বারান্দা থেকে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে ৩টি দরজা। নামাজ কক্ষে সর্বোচ্চ ছয় কাতার মুসল্লি এক সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের কেবলা দেয়ালে রয়েছে ৩টি অলঙ্কৃত মেহরাব। আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়ালে রয়েছে চমৎকার সব পোড়ামাটির নকশা। এই মসজিদের পূর্ব আঙ্গিনার মধ্যে একটি পাকা কবর আছে এবং কবরের পাশে একটি পাকা করা সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যার স্থানীয় নাম ‘আন্ধার মানিক’। এ সুড়ঙ্গ পথটি বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ এলাকায় প্রবেশের আগেই রয়েছে স্বচ্ছ পানির বড় একটি পুকুর।প্রায় অস্পষ্ট কয়েকটি শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, খুব সম্ভবত ১৬০৮-১৬১১ শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় আতিয়া মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।
আরবি ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দটি এসছে। যার অর্থ ‘দান করা’। আলী শাহান শাহর বাবা আদম কাশ্মিরী (র.) কে সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ দিলে এ অঞ্চলে তিনি থাকতে শুরু করেন। সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগান শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকা দান বা ওয়াকফ হিসেবে লাভ করেন। সেই থেকেই এ অঞ্চলটির নাম আতিয়া হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শক্রমে সাঈদ খান পন্নী নামক সূফিজীর এক ভক্তকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এই সাঈদ খান পন্নীই ১৬০৮ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করে।
মুহাম্মদ খাঁ নামক তৎকালিন এক প্রখ্যাত স্থপতি এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এছাড়া রওশন খাতুন চৌধুরাণী ১৮৩৭ সালে এবং আবুল আহমেদ খান গজনবী ১৯০৯ সালে মসজিদটির সংস্কার করেন।লাল ইটের তৈরি এ মসজিদটি আকারে বেশ ছোট এবং এতে সুলতানি ও মুঘল, এই দুই আমলেরই স্থাপত্যরীতির সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এটি দৈর্ঘ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ২৯ মিটার (৫৯ ফুট), প্রস্থে ১২ দশমিক ১৯ মিটার (৪০ ফুট) এবং দেয়ালের পুরুত্ব ২ দশমিক ২৩ মিটার বা সাড়ে ৭ ফুট)। মসজিদের চারকোণে ৪টি আটকোনা মিনার রয়েছে, যার ওপরের অংশটি ছোট গম্বুজের আকৃতি ধারণ করেছে। আবুল কালাম মো. জাকারিয়া সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি’ (মুসলিম যুগ) ও মো. মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘বেড়াই বাংলাদেশ’ বইয়ে এমনই তথ্য মেলে। প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের প্রাচীন ঐতিহ্য মণ্ডিত এই মসজিদটি বর্তমানে সংস্কার করা খুব জরুরী। সেইসাথে প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য দশ টাকার নোটে স্থান করে নেয়া নিপুণকারুকার্য শোভিত আতিয়া মসজিদটি জীর্ণ দশা থেকে দ্রুত সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষন করা প্রয়োজন। টাঙ্গাইলবাসীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর দাবী দশ টাকার নোটের ওই বিখ্যাত আতিয়া সমজিদটি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অতি দ্রুত সংস্কার করে এর রক্ষণাবেক্ষণে সরকারী লোক নিয়োগ প্রয়োজন। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।