নিউইয়র্ক ০৯:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সংলাপ যেমন ছিল

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:১৯:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ নভেম্বর ২০১৮
  • / ৫৯২ বার পঠিত

ঢাকা: বৃহস্পতিবার (০১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাতটা। গণভবনে চোখ বাংলাদেশের। একই টেবিলে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী জোটের নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য। সাড়ে তিন ঘন্টা খোলামেলা আলোচনা। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য। শুরুতে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন মনে করিয়ে দেন অতীতের কথা। বলেন, ৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙেই নির্বাচন হয়েছিলো।

সাত দফা উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন দুই দফায়। আলোচনায় আসে প্রায় সব ইস্যুই। তবে নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দেয়া, খালেদা জিয়ার মুক্তির মতো বড় তিনটি ইস্যুতে আলোচনায় কোন অগ্রগতি হয়নি। অগ্রগতি বলতে সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। সংলাপ আরো হবে কি-না তা খোলাসা হয়নি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ঐক্যফ্রন্ট চাইলে আরো আলোচনা হবে। তবে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সংলাপের জন্য ঐক্যফ্রন্টকে ডাকা হবে না।
সংলাপ শেষে আলাদা প্রতিক্রিয়া দেয় দুই পক্ষ। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, সংলাপে বিশেষ কোন সমাধান মিলেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপে সন্তুষ্ট নন বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধানের মধ্যেই আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় সাতটায় শুরু হওয়া সংলাপের প্রারম্ভে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই আলোচনায় অংশ নেন। নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনের তফসিল, খালেদা জিয়ার মামলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা ও সভা সমাবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয় আলোচনায় আসে।
দুই পক্ষের নেতাদের বক্তব্য শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে এই নিশ্চয়তা তিনি দিচ্ছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি তোলা হলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? খালেদা জিয়ার মামলার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এটিকে আইনী বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচনের তফসিলের বিষয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটি নির্বাচন কমিশনের বিষয়। রাজবন্দির মুক্তি ও রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করেন ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন রাজবন্দি কারা? দেশে কোন রাজবন্দি আছে কিনা? তিনি বলেন, কোন মামলা রাজনৈতিক তার তালিকা দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংবিধানে এ ধরনের সরকারের কোন বিধান নেই।
সংলাপে অংশ নেয়া মাহমুদুর রহমান মান্না আলোচনার বিষয়ে জানিয়েছেন, সভা সমাবেশের বিষয়ে এক ধরণের প্রতিশ্রুতি ছাড়া তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। উনারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। নির্বাচনে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সংলাপে অংশ নেয়া আরেকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংলাপে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি খুব একটা হয়নি। এখন আমরা আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো। আলোচনায় অংশ নেয়া আরেক নেতা বলেন, আলোচনায় সরকারি দলের সুর ছিলো- পারলে আন্দোলন করে দাবি আদায় করেন।
সংলাপে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের ২৩ জন এবং ঐক্যফ্রন্টের ২০ জন নেতা অংশ নেন। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির নীতিনির্ধারণ ফোরাম স্থায়ী কমিটির ৬ সদস্য ছিলেন। তবে আমন্ত্রণ পেলেও বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সংলাপে যাননি। ২০০৬ সালে নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচিত সংলাপের পর এই প্রথম দুই পক্ষের নেতারা এক টেবিলে বসলেন। ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ আহ্বানে আওয়ামী লীগের সাড়া দেয়ার পর থেকেই রাজনীতি ক্ষেত্রে এক ধরনের আশার আলো দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবারের বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ ঘিরে পুরো দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল গণভবনে।
গণভবনে সংলাপে অংশ নেয়ার আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তারা গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণভবনে পৌঁছান। সন্ধ্যা ৭টায় দুই পক্ষের সংলাপ শুরু হয়। গণভবনের ব্যাংকুইট হলে দুই পক্ষের নেতারা সামনা সামনি বসে আলোচনা করেন। বৈঠকের শুরুতে নেতাদের আপ্যায়িত করা হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের ২৩ নেতা: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে ১৪ দলীয় জোটের ২৩ নেতা অংশ নেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্লাহ, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, মাইনুদ্দিন খান বাদল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের ড. আবদুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন।
ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলে ২০ নেতা: ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২০ সদস্য অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সহ-সভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান, জগলুল হায়দার আফ্রিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিক উল্লাহ। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, এসএম আকরাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফররুল্লাাহ চৌধুরী, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আ ব ম মোস্তফা আমিন। বৃহস্পতিবার শেষ মুহূর্তে যে পাঁচজনের নাম পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাড়া অন্য চার জন সংলাপে অংশ নেন।
সূচনা বক্তব্যে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী: সংলাপের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে গণভবনে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আজকে এই অনুষ্ঠানে আপনার এসেছেন গণভবন ও জনগণের ভবনে। আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য যে আর্থসামাজিক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই দেশটা আমাদের সবার, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি এটা বিচারের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দেবো। দীর্ঘ নয় বছর ১০ মাস হতে চললো আমরা এই সময়ের মধ্যে দেশে কত উন্নয়ন করতে পেরেছি সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে; তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে। দিনবদলের যে সূচনা আমরা করেছিলাম সেই দিনবদল হচ্ছে এটাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গণভবনের সামনে মোমবাতি নিয়ে মানববন্ধন: সংলাপ অর্থবহ করতে গণভবনের সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাকর্মীদের মোমবাতি নিয়ে মানববন্ধন করেন। সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে পৌঁছান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তার আগে গণভবনের সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মীরা গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের হাতে মোমবাতিও দেখা যায়। ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মীরা প্ল্যাকার্ডে সংলাপের সফলতা কামনা ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবির আদলে বিভিন্ন স্লোগান তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, গত রোববার আওয়ামী লীগের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তার চিঠির জবাবে পরের দিন সংলাপে সাড়া দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার সকালে ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণপত্র নিয়ে যান আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
সংলাপে করণীয় ঠিক করতে এদিনই বিকালে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। বৈঠকে ৭ দফার ভিত্তিতে আলোচনার লক্ষ্য ঠিক করার পাশাপাশি ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নাম চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে পাঠানো হয়। পরে বৃহস্পতিবার আরো পাঁচজনের নাম পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। নির্বাচন সামনে রেখে আজ বিকল্প ধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসছে। সোমবার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি সঙ্গে সংলাপের সংলাপ হবে। বাম গণতান্ত্রিক জোটও সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, জাকের পার্টি, নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বিএনএসহ আরো কয়েকটি দল ও জোট সংলাপের আগ্রহ দেখিয়েছে। সময় কম থাকায় এসব দল এবং জোটের সঙ্গে একক বা যৌথভাবে সংলাপ হতে পারে। (মানবজমিন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

সংলাপ যেমন ছিল

প্রকাশের সময় : ০৭:১৯:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ নভেম্বর ২০১৮

ঢাকা: বৃহস্পতিবার (০১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাতটা। গণভবনে চোখ বাংলাদেশের। একই টেবিলে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী জোটের নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য। সাড়ে তিন ঘন্টা খোলামেলা আলোচনা। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য। শুরুতে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন মনে করিয়ে দেন অতীতের কথা। বলেন, ৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙেই নির্বাচন হয়েছিলো।

সাত দফা উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন দুই দফায়। আলোচনায় আসে প্রায় সব ইস্যুই। তবে নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দেয়া, খালেদা জিয়ার মুক্তির মতো বড় তিনটি ইস্যুতে আলোচনায় কোন অগ্রগতি হয়নি। অগ্রগতি বলতে সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। সংলাপ আরো হবে কি-না তা খোলাসা হয়নি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ঐক্যফ্রন্ট চাইলে আরো আলোচনা হবে। তবে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সংলাপের জন্য ঐক্যফ্রন্টকে ডাকা হবে না।
সংলাপ শেষে আলাদা প্রতিক্রিয়া দেয় দুই পক্ষ। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, সংলাপে বিশেষ কোন সমাধান মিলেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপে সন্তুষ্ট নন বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধানের মধ্যেই আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় সাতটায় শুরু হওয়া সংলাপের প্রারম্ভে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই আলোচনায় অংশ নেন। নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনের তফসিল, খালেদা জিয়ার মামলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা ও সভা সমাবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয় আলোচনায় আসে।
দুই পক্ষের নেতাদের বক্তব্য শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে এই নিশ্চয়তা তিনি দিচ্ছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি তোলা হলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? খালেদা জিয়ার মামলার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এটিকে আইনী বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচনের তফসিলের বিষয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটি নির্বাচন কমিশনের বিষয়। রাজবন্দির মুক্তি ও রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করেন ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন রাজবন্দি কারা? দেশে কোন রাজবন্দি আছে কিনা? তিনি বলেন, কোন মামলা রাজনৈতিক তার তালিকা দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংবিধানে এ ধরনের সরকারের কোন বিধান নেই।
সংলাপে অংশ নেয়া মাহমুদুর রহমান মান্না আলোচনার বিষয়ে জানিয়েছেন, সভা সমাবেশের বিষয়ে এক ধরণের প্রতিশ্রুতি ছাড়া তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। উনারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। নির্বাচনে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সংলাপে অংশ নেয়া আরেকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংলাপে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি খুব একটা হয়নি। এখন আমরা আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো। আলোচনায় অংশ নেয়া আরেক নেতা বলেন, আলোচনায় সরকারি দলের সুর ছিলো- পারলে আন্দোলন করে দাবি আদায় করেন।
সংলাপে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের ২৩ জন এবং ঐক্যফ্রন্টের ২০ জন নেতা অংশ নেন। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির নীতিনির্ধারণ ফোরাম স্থায়ী কমিটির ৬ সদস্য ছিলেন। তবে আমন্ত্রণ পেলেও বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সংলাপে যাননি। ২০০৬ সালে নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচিত সংলাপের পর এই প্রথম দুই পক্ষের নেতারা এক টেবিলে বসলেন। ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ আহ্বানে আওয়ামী লীগের সাড়া দেয়ার পর থেকেই রাজনীতি ক্ষেত্রে এক ধরনের আশার আলো দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবারের বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ ঘিরে পুরো দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল গণভবনে।
গণভবনে সংলাপে অংশ নেয়ার আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তারা গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণভবনে পৌঁছান। সন্ধ্যা ৭টায় দুই পক্ষের সংলাপ শুরু হয়। গণভবনের ব্যাংকুইট হলে দুই পক্ষের নেতারা সামনা সামনি বসে আলোচনা করেন। বৈঠকের শুরুতে নেতাদের আপ্যায়িত করা হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের ২৩ নেতা: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে ১৪ দলীয় জোটের ২৩ নেতা অংশ নেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্লাহ, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, মাইনুদ্দিন খান বাদল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের ড. আবদুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন।
ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলে ২০ নেতা: ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২০ সদস্য অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সহ-সভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান, জগলুল হায়দার আফ্রিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিক উল্লাহ। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, এসএম আকরাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফররুল্লাাহ চৌধুরী, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আ ব ম মোস্তফা আমিন। বৃহস্পতিবার শেষ মুহূর্তে যে পাঁচজনের নাম পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাড়া অন্য চার জন সংলাপে অংশ নেন।
সূচনা বক্তব্যে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী: সংলাপের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে গণভবনে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আজকে এই অনুষ্ঠানে আপনার এসেছেন গণভবন ও জনগণের ভবনে। আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য যে আর্থসামাজিক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই দেশটা আমাদের সবার, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি এটা বিচারের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দেবো। দীর্ঘ নয় বছর ১০ মাস হতে চললো আমরা এই সময়ের মধ্যে দেশে কত উন্নয়ন করতে পেরেছি সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে; তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে। দিনবদলের যে সূচনা আমরা করেছিলাম সেই দিনবদল হচ্ছে এটাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গণভবনের সামনে মোমবাতি নিয়ে মানববন্ধন: সংলাপ অর্থবহ করতে গণভবনের সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাকর্মীদের মোমবাতি নিয়ে মানববন্ধন করেন। সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে পৌঁছান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তার আগে গণভবনের সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মীরা গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের হাতে মোমবাতিও দেখা যায়। ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মীরা প্ল্যাকার্ডে সংলাপের সফলতা কামনা ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবির আদলে বিভিন্ন স্লোগান তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, গত রোববার আওয়ামী লীগের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তার চিঠির জবাবে পরের দিন সংলাপে সাড়া দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার সকালে ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণপত্র নিয়ে যান আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
সংলাপে করণীয় ঠিক করতে এদিনই বিকালে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। বৈঠকে ৭ দফার ভিত্তিতে আলোচনার লক্ষ্য ঠিক করার পাশাপাশি ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নাম চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে পাঠানো হয়। পরে বৃহস্পতিবার আরো পাঁচজনের নাম পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। নির্বাচন সামনে রেখে আজ বিকল্প ধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসছে। সোমবার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি সঙ্গে সংলাপের সংলাপ হবে। বাম গণতান্ত্রিক জোটও সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, জাকের পার্টি, নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বিএনএসহ আরো কয়েকটি দল ও জোট সংলাপের আগ্রহ দেখিয়েছে। সময় কম থাকায় এসব দল এবং জোটের সঙ্গে একক বা যৌথভাবে সংলাপ হতে পারে। (মানবজমিন)