নিউইয়র্কে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : সাংবাদিকরাও আইনের উর্ধ্বে নয়, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার

- প্রকাশের সময় : ০৭:৪১:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮
- / ৮৫৫ বার পঠিত
সালাহউদ্দিন আহমেদ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনস্বার্থেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করা হয়েছে। এতে সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধ করা হয়নি। এই আইনে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের কোন ভয়ের কারণ নেই। আর সাংবাদিকরাও আইনের উর্ধ্বে নয়। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান মোতাবেক বর্তমান সরকারের অধীেেনই জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো চাইলে তাদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি কোন দূর্নীতি করে থাকলে তা খুঁজে বের করুন। আর যারা তাকে অর্থ সহ অন্যান্যভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন তাদের ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রবাসী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি উপরোক্ত কথা বলেন। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশন শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে। জনকীর্ণ এই সাংবাদিক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ, এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
শুক্রবার বেলা ১১টায় আহুত সাংবাদিক সম্মেলনে শুরু করার কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে আসেন বেলা ১১টা ৫৬ মিনিটে। এর আগে তিনি মিশনেই বসে ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া)-এর প্রতিনিধিকে স্বাক্ষাৎকার দেন। সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠসহ প্রশ্নোত্তর পর্বে যোগদানের আহ্বান জানালে প্রধানমন্ত্রী সময় বাঁচাতে তার দীর্ঘ বক্তব্য পাঠ না করে ‘তা পাঠিত বলে গণ হবে’ উল্লেখ করে সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যান। সাংবাদিক সম্মেলন সঞ্চলনা করেন প্রধানসন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারী ইহসানুল করীম। তাকে সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ মিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) নূর এলাহি মিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র লিখিত বক্তব্যে তার জাতিসংঘ সফল ও বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার কথা তুলে ধরে বলেন, এবারের অধিবেশন আর বিভিন্ন ইভেন্টে রোহিঙ্গা সমস্যা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিউইয়র্ক সফরকালীন সময়ে ইউএস সিনেটর জেফরি এ্যালান মর্কলেই-এর সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক, প্রবাসীদের সংবর্ধনায় যোগদান, শরনার্থী হাইকমিশনের উচ্চ পর্যায়ের সভা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মাদক বিরোধী অনুষ্ঠান ও নেলসন ম্যান্ডেলা পিস সামিটে যোগদান এবং পিস সামিটে ৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করার কথা উল্লে করেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আমন্ত্রণে মিশু ও শিক্ষা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সভা, ইউএস চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত ব্যবসায়ীদের সেমিনার ও সভায় যোগদান ছাড়াও ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল করাপশন’ বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সভায় যোগদান, জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে ‘অ্যাকশন ফর পিসকিপিং’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের সভা ও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর প্লেনারি সভা, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এবং ওআইসি সচিবায় ও সৌদি আরবের যৌথ সভায় রোহিঙ্গা সমস্যা উত্থাপন ছাড়াও লিথুনিয়ার প্রেসিডেন্ট নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সভায় যোগদানের কথা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্টার প্রেস সার্ভিস নিউজ এজেন্সী রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনুকরণীয়, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভসেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং গ্লোবাল হোপ কোয়ালিশন কর্তৃক ‘২০১৮ স্পেশিয়াল রিকগনেশন ফর আউটস্ট্যান্ডিং লীডারশীপ অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তির কথা জানিয়ে বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি আমি জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক সকল দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণের জন্য আয়োজিত মধ্যাহ্ন ভোজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আয়োজিত অভ্যর্থনা সভায় যোগ দেই। এছাড়া, এস্তোনিয়ার প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সভাপতি, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস কমিটির সভাপতি, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত, নেদারল্যান্ডের রানী ম্যাক্সিমা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়িনের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভাপতি এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে আমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়টি উঠে আসে। তিনি বলেন, এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি সম্পর্কিত একটি, বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত ২টিসহ সর্বমোট ৫টি যৌথ ঘোষণাপত্র অনুমোদন করেছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এবারের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান ফলপ্রসু হয়েছে। বিভিন।ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা সমস্যা বারবার উঠে এসেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে আমরা বিশ্ববাসীর সহযোগিতা কামনা করেছি। চীন-ভারত সহ অন্যান্য দেশ তাদের মতো করে এই সমস্যা দেখছে, আলোচনা করছে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সকল দেশের সাথেই আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনস্বার্থেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করা হয়েছে। এতে সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধ করা হয়নি। এই আইনে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের কোন ভয়ের কারণ নেই। আর সাংবাদিকরাও আইনের উর্ধ্বে নয়। এছাড়াও সাইভার সিকিউরিটি নিয়ে জাতিসংঘে বৈঠক হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের পরে এখন সাইবার ক্রাইম বড় সমস্যা। এই সমস্যা বিশ্বের সকল দেশেরই সমস্যা। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারই দেশে এতো বিপুল মিডিয়া প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ করে দিয়েছে। দেশে প্রায় ১৩ হাজারের মতো পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এরমধ্যে ৭ হাজারের মতো দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। জেলায় জেলায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। টিভি মিডিয়া বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব টিভি-তে যারা টক শো করে তারা কথায় কথা টক বানিয়ে নিজেরাও টক হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, অপরাধ কি শুরু রাজনীতিকরাই করে। সাংবাদিকদের দায়িত্বের সাথে সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হবে, উস্কানীমূলক খবর বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেনম সরকারের সমালোচনা করুন।
পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও এক মন্ত্রীপুত্রের নিউইয়র্কে বাড়ী ক্রয় ও দূর্নীতি সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিউইয়র্কে সহজেই বাড়ী কেনা যায়। আপনাদের কাছে প্রমাণ থাকলে দেন ব্যবস্থা নেবো। প্রসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, তিনি (বিচারপতি সিনহা) কিভাবে বই লিখলেন, কার পরামর্শে লিখলেন, অর্থ কোথায় পেলেন খোঁজ-খবর নেন, আমরাও নিচ্ছি। তার সাথে কোন সাংবাদিক বা মিডিয়া জড়িত আছে কিনা তাও খুঁজে দেখুন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দূর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন। তারা মন্ত্রী-এমপিকেও ছাড়ছেন না। কারো বিরুদ্ধে দূর্নীতির প্রমাণ পেলে সরকার সহযোগিতা করবে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমারাই বাংলাদেশ মিশন ক্রয় করেছি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ভবন ক্রয়ের চেষ্টা চলছে। তবে ভবন ক্রয় সহজ নয়, অনেক অর্থের প্রয়োজন। আর ‘নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্ক’ রুটে বিমান চলাচলের জন্য সঙ্কটগুলো কাটিয়ে উঠেছি, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শর্তগুলো পূরণ করেছি। জেএফকে’র অনুমতি পেতে চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই ৬টি বিমান ক্রং করা হয়েছে, আরো একটি বিমান ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বিমানের ব্যাপারে কিছু পত্রিকায় নেগেটিভ রিপোর্ট করার কারণে বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাতে আমরা অনেক পিছিয়ে গেলেও কে, কেনো, কিসের জন্য এসব রিপোর্ট করছে তা আমরা জেনেছি, সময় হলেই ব্যবস্থা নেবো। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে বলেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের মিশন ও কনস্যুলেটকে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন। তাই বেশী সেল খোলার প্রয়োজন নেই। প্রবাসীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ খোলা হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ঐক্যজোট’ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বিরুদ্ধে গড়া জোটে আমি যাই কি করে। আর জাতীয় নির্বাচনে অতীতের মতো তরুনদেরকে মূল্যায়ন করা হবে।
সাংবাদিক সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তার উপস্থিতিতে মিশনে কেক কাটা হয়। মিশনে উপস্থিত শিশুরা কেক কাটে। এসময় কনসাল জেনারেল মিজ সাদিয়া ফয়জুননেসা সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।