নতুন বছরে প্রবাসীদের ‘স্বদেশ ভাবনা’ : হানাহানিমুক্ত ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ’
- প্রকাশের সময় : ০৪:১০:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৫
- / ১৩৫৬ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: বিদায় ২০১৪। স্বাগতম ২০১৫। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে অবস্থান করছেন অসংখ্য বাংলাদেশী। বলা হয়ে থাকে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির অন্যতম হাতিয়ার প্রবাসীরা। নানা-সময়ে নানা কারণে প্রবাসে বসবাসকারি এসব বাংলাদেশীদের মন-প্রাণ জুড়ে থাকে মাতৃভূমি বাংলাদেশের দিকে। সোনার বাংলা গড়ার নতুন বাণী শোনাবেন আমাদের রাজনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্র নায়কেরা। কিন্তু বিধি বাম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হিংসা, ক্ষমতার মোহে অন্ধ নোংরা রাজনীতির স্বীকার হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। হামলা-মামলা যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী। আইনের রক্ষকরা যেখানে ভক্ষক! এমন আশঙ্কা থেকে দেশে যাওয়া কিংবা বিনিয়োগ বন্ধ করেছেন অনেক প্রবাসী। বাংলা পত্রিকার নতুন বছরে প্রবাসীদের ভাবনা শীর্ষক প্রতিবেদনে এমনটি উঠে আসে বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিটস, পেশাজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের মুখে। নতুন বছরের প্রত্যাশায় প্রসঙ্গে তারা এসব আশঙ্কার কথা জানান।
একটি বছর শেষে আসে এরেকটি নতুন বছর। ক্যালেন্ডারের পাতা পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেকে স্বপ্ন দেখেন। কারো আবার ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন। দিনে সূর্য উঠে, সূর্য ডোবে। কখনো জোছনা, কখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে রাত। ¯েœায়ের দেশের সামার কাহিনীও এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা এখানকার প্রবাসীদের কাছে। আর এই ভাবেই মুহূর্ত পার হয়, পার হয় মিনিট, ঘন্টা। চব্বিশ ঘন্টায় দিন। এরপর মাস। মাসের পর বছর। শেষ হয়ে যায় একটি সাল কিংবা বছর (২০১৪)। আবার শুরু হবে নতুন বছর (২০১৫)। মুহূর্ত, মিনিট, ঘন্টা, মাস, বছর। এইভাবেই চক্রাকারে ঘুরবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষের মানবকুল। আসলে সময় কি পাল্টায়? মাস, বছর কি নতুন হয়? নাকি পাল্টায় মানুষের মন, অবস্থান আর পরিবেশের রূপ? চির পুরাতন সময়কেই মানুষ নতুন বছর, নতুন যুগ, নতুন শতাব্দীর ব্যানারে সাজায়। সেই আদিম যুগে পাথর ঘঁষে আগুন জ্বালানো মানুষ আর আজকের আধুনিক সভ্যতার মানুষের মনের গতিধারা কি এক? পাথরেরর ফলা দিয়ে যে মানুষ একদিন শিকার করতো সে মানুষ আজকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে প্রযুক্তির সফল সব ধরণের কৌশল। তাবৎ পৃথিবীকে বন্দি করেছে মুঠোফোনের ভেতর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌরাতœ তো রয়েছে। মুহুর্তের খবরা-খবর পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় মানব জাতির কাছে প্রতিনিয়ত উদ্ভাসিত হচ্ছে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার। যা পুরাতন তাকেও মানুষ সাজিয়ে নিচ্ছেন নতুন করে। নতুন বছর পুরনো সময়েরই নতুন সংস্করণ। পুরাতনের মাঝে নতুন কোলাহল। তবে পৃথিবীর সব মানুষ কিন্তু একটি মাত্র নতুন বছর পালন করে না। জাতিভেদে, দেশ ভেদে নতুন বছর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শুরু হয়। যেমনি রয়ছে আরবী (আরবী মুসলিমদের), বাংলা নববর্ষ (বাঙালীদের)। ইংরেজী হচ্ছে সর্বজন স্বীকৃত।
হিজরী সনে নতুন বছর শুরু হয় ‘মহরম’ মাসে। কিন্তু এই মাসটিতে রয়েছে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার ইতিহাস। কাজেই মুসলমানদের কাছে নতুন বছরের নতুন মাসটি আনন্দের কোন ¯্রােতস্বিনী নয়। ইরানে নতুন সালের উৎসব ‘নওরোজ’। চীন দেশেও ঘটা করে পালন করা হয় তাঁদের নিজস্ব (চাইনিজ লুনা’র নিউ ইয়ার) নামের নতুন বছর। বাংলাদেশের মানুষ পহেলা ‘বৈশাখ’কে বরণ করে নানা আয়োজনে। বাংলা নববর্ষকে আপন ঐতিহ্যের মাধুরী মিশিয়ে ঘটা করে পালনও করে থাকে। দেশে দেশে নানা জাতি, নানাভাবে, তাঁদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির আবর্তে নতুন বছরকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে স্বাগত জানায়। তবে সারা পৃথিবী জুড়ে যে নতুন সালটি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে এবং বলতে গেলে পৃথিবীর তাবৎ দেশগুলিই পালন করে তাহলো খ্রিস্ট সাল বা ‘ঈশায়ী’ সাল । যাকে আমরা ‘ইংরেজী’ সাল হিসেবে বলে থাকি। এই সালটি পালনে সারা পৃথিবীর মানুষ হয় উম্মাতাল। আনন্দের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস নামে পৃথিবীর আনাচে, কানাচে। সেই আনন্দের রূপ প্রকাশটি নানা ক্ষেত্রে অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ। তবু এই সালকে ঘিরে শত প্রার্থনা, স্বপ্ন আর শুভেচ্ছার পাহাড় গড়ে উঠে আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ ভাবনা।
আমাদের সামনে অগত খ্রিস্ট সাল ২০১৫। আমাদের দেশেও এই খ্রিস্ট সালটি পালন করা হয় মহাধুম ধামে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিভিন্ন শহর-উপশহরের নাইট-ক্লাব কিংবা অভিজাত হোটেলে চলে নানা উৎসব। এছাও চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। যদিও অভিযোগ রয়েছে অপসংস্কৃতির নামে বখে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। স্বপ্ন এবং প্রার্থনার কথা বলা হবে। দেশ গড়ার নতুন বাণী শোনাবেন আমাদের রাষ্ট্র নায়কেরা। কিন্তু যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া দেশের অর্থনীতির চাকা; তাদের অবস্থা নিয়ে কেউ কী ভাবছেন? তাদের দেশে রাখা পরিবারের নিরপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে যেখানে প্রশ্ন। কেমন আছেন উত্তর আমেরিকা প্রবাসী এসব বাংলাদেশীরা? দেশ ছেড়ে যারা প্রবাসে আছেন তাঁরাও নতুন বছরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন নতুন ভাবনায়। মনের গভীরে স্বজন-পরিজনের ভাবনার সাথে যুক্ত থাকে স্বদেশ ভাবনাটিও। বাংলাদেশী অভিবাসীদের কাছে প্রশ্ন ছিল-
১) নতুন বছরে বাংলাদেশকে কিভাবে দেখতে চান ?
২) প্রবাসে কমিউনিটির অবস্থান এবং এক্য নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
৩) দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া কী?
৪) এসব চাওয়া পাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রবাসীদের করণীয় কী?
৫) বিএনপি-জামায়াত ও বর্তমান ক্ষমাতাসীন সরকারের কাছে প্রবাসীদের প্রত্যাশা কী?
৬) সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্ভর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ দেশগড়ার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ভূমিকা কী? ইত্যাদি প্রশ্ন।
নতুন বছরে প্রবাসীদের দেশ ও প্রবাস ভাবনা নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন। অনেকে স্ব-শরীরে, টেলিফোনে কিংবা ই-মেইলে পাঠানো আবেগ, অনুভূতি, শুভেচ্ছা ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন যা নি¤œরূপ:
এ ইসলাম মামুন
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ব্রঙ্কস
শুধু নতুন বছরে নয়! প্রতিদিনই দেখতে চাই সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ হোক। মানুষের ভোটের অধিকার ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা চাই।
আব্দুস শহীদ
সভাপতি, বাংলাদেশ আমেরিকান ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক সোসাইটি
রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ চাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে চাই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায়।
মুজাফফর হোসাইন
ব্যবসায়ী, ম্যানহাটন
ভারতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। স্বাধীন ভূ-খন্ড আমাদের। এটা কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পদ নয়।
আসাদুল ইসলাম
ব্যবসায়ী
দেশের গণতন্ত্র ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশা করছি। প্রবাসীদের জন্য ইমিগ্রেশন পদ্ধতির স্বচ্ছতা চাই।
আ. বাছির খান
সাবেক সহ-সভাপতি, জালালাবাদ এসোসিয়েশন
প্রবাসে বাংলাদেশী ব্যাংক চাই। বিমানের পরিসেবা চালু হোক সেই প্রত্যাশা করছি।
মনির সর্দার
কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট
বাংলাদেশী-আমেরিকান নতুন প্রজন্মের শিক্ষার মান-উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার’সহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করছি।
ডা. আব্দুল লতিফ
সহ-সভাপতি, নর্থ-বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
কমিউনিটির সকল মানুষ ও সমিতির ঐক্য চাই। একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়ার অভিপ্রায় বন্ধ হোক।
দিদারুল ইসলাম
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশে সোসাইটি অব ব্রঙ্কস
প্রবাসীদের সেবায় কন্স্যুলেট’সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সেবার মান-উন্নয়ন চাই।
বাবুল মজুমদার
কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট
বাংলাদেশী পণ্যের অবাদ আমদানি শুল্কমূক্ত পরিসেবা চালু হোক।
আ. মুকিত চৌধুরী
লেখক, কলামিষ্ট
দেশ গড়ার প্রত্যয়ে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
আবুল খায়ের আখন্দ
সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, কুমিল্লা সোসাইটি অব ইউএসএ
প্রবাসে শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে সবার সমন্বিত উদ্যোগ আশা করছি।
সাহেদ আহম্মদ
দক্ষিণ সুরমা এসোসিয়েশন, নিউইয়র্ক
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রবাসীদের মাঝে তুলে ধরা হোক। প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মর্যাদা চাই।
মোহাম্মদ শামীম মিয়া
কমিউনিটি এক্সিভিষ্ট, নিউ ইয়র্ক
রাজনীতিবিদরা ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ করুন। দেশকে ভালোবাসুন। সমাজকে প্রতিষ্ঠা করুন।
শেবুল খান মাহাবুব
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
বিশ্বনাথ প্রবাসী কল্যাণ সমিটি, নিউ ইয়র্ক
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি, বন্ধ হোক। মেধাবীদের নিশ্চিত লেখা-পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হোক।
এরকম অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী আসছে নতুন (২০১৫) বছরকে ঘিরে তারা তুলে ধরেছেন তাদের না বলা অনেক কথা। যার চম্বুক অংশ তুলে ধরা হয়েছে। আমেরিকা’সহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশী প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৯০ শতাংশের অধিক দেশে প্রেরণ করে থাকেন। আর এ জন্যই বাংলাদেশ শত প্রতিকূলতার মাঝেও এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের চলমান রাজনৈতি সহিংসতা বন্ধ হলে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীরা আরো বড় ধরনের বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন বলেও জানিয়েছেন। কিন্তু দেশ ও বিদেশে অবস্থানকারি প্রবাসীদের অবদান ম্লান হয়ে যায় তখনই; যখন দেখা যায় এরা নিজ দেশেই পরবাসি। সরকারি কিংবা (বিরোধী দল) প্রধান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নোঙরা রাজনীতি দেখে। নেতৃস্থানীয়দের বিদেশে সম্মান জানানোর পরিবর্তে কালো পতাকা প্রদর্শন, আপত্তিকর স্লোাগান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান ও বক্তব্য, দেশ-প্রেমিকদের অসম্মান ও অশ্রদ্ধা, বিচারের নামে প্রহসন যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ম্লান করে দিয়েছে। এধরনের অসম্মান ও অশ্রদ্ধা প্রবাসী ও দেশের মর্যাদার জন্য হানিকর। তাই আর যাই হোক, স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসীদের রাজনৈতিক ভাবনা যেন সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আবদ্ধতায় দেশের মর্যাদার হানি না ঘটায় এটাই হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা। সবাই কে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)