নিউইয়র্ক ১১:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বৃহত্তর সিলেট ভিত্তিক সংগঠনে আধিপত্য ও মর্যাদার লড়াই

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৩:১৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৫
  • / ১৩৪৪ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: বলা হয়ে থাকে উত্তর আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের সবচে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের। অর্থনৈতিক শক্তি এবং ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে সিলেট হচ্ছে সবচে ক্ষমতাধর কমিউনিটি। তেমন একটা দলীয় কোন্দল না থাকলেও রয়েছে আধিপত্য ও মর্যাদার লড়াই। আর এই আধিপত্যের লড়াইকে ঘিরেই একে একে গড়ে উঠছে অঞ্চল কেন্দ্রীক বিভিন্ন সংগঠন। প্রবাসে বৃহত্তর সিলেটবাসীর এসব সংগঠন বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে সভা সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট। যাতে রয়েছে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল, যা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট সদর’সহ এই চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। চারটি জেলার একটি বিভাগের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারি সিলেট প্রবাসীরা গড়ে তুলেছেন অসংখ্য আঞ্চলিক সংগঠন। বলা হয়ে থাকে উত্তর আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘আমব্রেলা খ্যাত’ সংগঠন ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’ হলেও সদস্য সংখ্যার দিক থেকে কখনও ছাড়িয়ে যায় জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা। যা বৃহত্তর সিলেটবাসীর  ‘আমব্রেলা খ্যাত’ সংগঠন হিসেবে পরিচিত। মূলত এই সংগঠনটির ব্যানারেই কিংবা সম্মিলিত উদ্যোগে মহান একুশে ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’সহ নানা জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয়ে থাকে। এত কিছুর পরও প্রশ্ন উঠছে একই নামে কিংবা অঞ্চল ভিত্তিক এতগুলো সংগঠনের গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। বাংলা পত্রিকার সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে আসে সিলেট প্রবাসী নানা জনের নানা মত। অনেকে অভিযোগ করেন, ‘শুধুমাত্র ক্ষমতার মোহ আর কমিউনিটির পত্রিকায় শিরোনামে তৃপ্ত হতেই এসব সংগঠনের উত্থান’। কেউ বা বলছেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা এসব সংগঠনগুলোর ভালো কাজের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন কোন্দলেও। ক্ষমতার দম্ভ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য, পদ-পদবী এবং অঞ্চল ভেদে একটি ভেঙ্গে গড়ছে আরেকটি সংগঠন। যার প্রভাব পড়ছে এখানকার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নতুন প্রজন্মের মধ্যে। একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়ার এসব নেতিবাচক মনোভাবে বাংলাদেশী প্রবাসীরা এখানকার মূলধারার কাছে পরিণত হচ্ছে হাসির পাত্রে। যদি একই ছাদের নীচে পুরো সিলেটবাসী থাকতো তাহলে মুলধারায় আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো সুদৃঢ় হতে পারতো। আমরা পরিশ্রমী ও সাহসি জাতি। জাতি হিসেবে আমাদের এইতুটু আত্মসম্মানবোধ নেই বলেই আজকে একটি গড়ে আরেকটি সংগঠনের উৎপত্তি’।
জালালাবাদ এসোসিয়েশন ছাড়াও সিলেট সদর ও মহানগরের নামে রয়েছে একাধিক সংগঠন। এছাড়াও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আছে অসংখ্য সমিতির অবস্থান। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে শুরু হওয়া এসব সংগঠনের বিভাজনের সৃষ্টিতে মূখ্য ভুমিকা হচ্ছে কর্তৃত্বের লড়াই। এক নজরে দেখা নেয়া যাক বৃহত্তর সিলেট বিভাগের কিছু সংখ্যক থানা কিংবা উপজেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সংগঠনের তালিকা। (১) জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা, (২) সিলেট ডিস্ট্রিক্ট সোসাইটি, (৩) সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইন্ক। (৪) সিলেট সদর থানা সমিতি, (৫) সিলেট মহানগর উন্নয়ন পরিষদ, (৬) হবিগঞ্জ জেলা সমিতি, (৭) হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক, (৮) হবিগঞ্জ সদর সমিতি, (৯) বৃন্দাবন কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন, (১০) নবিগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (১১) মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, (১২) মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক, (১৩) মৌলভীবাজার জেলা সমিতি (নিস্ক্রিয়), (১৪) মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থা (নিস্ক্রিয়), (১৫) সুনামগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (১৬) সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ, (১৭) ফেঞ্চুগঞ্জ সমিতি, (১৮) বালাগঞ্জ ওসমানী নগর প্রবাসী কল্যাণ সমিতি ইউএসএ, (১৯) বড়লেখা জুড়ি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি, (২০) কুলাউড়া বাংলাদেশী এসোসিয়েশন অব ইউএসএ, (২১) বিশ্বনাথ প্রবাসী কল্যাণ সমিতি, (২২) জকিগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইন্্ক, (২৩) বিয়ানীবাজার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, (২৪) বিয়ানীবাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ ইন্ক, (২৫) রাজনগর উন্নয়ন পরিষদ, (২৬) সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি, (২৭) ফেঞ্চুগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (২৮) বিশ্বনাথ কল্যাণ সমিতি, (২৯) গোলাপগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইন্্ক।  কয়েকজন বন্ধু কিংবা পরিবার কেন্দ্রীক গড়ে উঠা নামে বেনামে এরকম আরো অসংখ্য সমিতি রয়েছে উত্তর আমেরিকার’সহ নিউ জার্সি ও নিউইয়র্কে।
বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠা এসব সংগঠন বিষয়ে কথা হয় সিলেটবাসীর সর্ববৃহৎ সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ সোসাইটির নব-নির্বাচিত সভাপতি আজমল হোসেন কুনু’র সাথে। তিনি বলেন, ‘দেখুন আপনার যে প্রশ্ন করেছেন তা ঠিক অনেক ক্ষেত্রে। তবে, বৃহত্তর সিলেটের ঐক্য এখনো রয়েছে। কিছু কিছু ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ হচ্ছে মতের অমিল। ক্ষমতার মোহ যে নেই সেটাও বলা যাবে না। কারণ বিষয়গুলো আপেক্ষিক। একেক জন একেক ভাবে চিন্তা করে থাকেন। আর বিভাজনের সবচে বড় কারণ হেচ্ছ নেতৃত্ব সঙ্কট। উত্তরণের উপায়ও রয়েছে আমাদের। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। প্রবাসে আমাদের গ্রহণযোগ্য বৃদ্ধিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই’।
বাংলাদেশ সোসাইটির নয়া কর্ণধার আরো বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সোসাইটির দায়িত্ব গ্রহণ করবো ৪ জানুয়ারি। এরপর সোসাইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করবো। তারপর অন্যান্যদেরও আহ্বান জানাবো ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রবাসীদের উন্নয়নে কাজ করতে। যেমনিভাবে আমরা জালালাবাদ এসোসিয়েশনকে বৃহত্তর সিলেটবাসীর প্রাণের সংগঠনে রুপান্তরিত করেছি। তবে, আমাদের প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আনতে হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্টদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবে। সবার সহযোগিতা পেলেই আমরা সফলতা অর্জন করবো। তবে, তার আগে নিজের ঘরকে ঠিক করতে হবে’।
জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বদরুন্নাহার খান মিতা তুলে ধরেন তাঁর অনুভূতির কথা। ‘আমাদের জালালাবাদ কোন ভাঙ্গন নেই। সিলেট অনেক বড় একটি অঞ্চল। তাই সংগঠনও হচ্ছে সিলেটবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে। এখানে কোন কোন্দল নেই। আমরা বিভিন্ন দিবসগুলো জালালাবাদ এসোসিয়েশনের ব্যানারেই করে থাকি। আমাদের সবার মধ্যে রয়েছে সু-সম্পর্ক’।
আলোচনায় উঠে আসে সিলেট সদর থানা সমিতির উত্থান এবং বিভাজন প্রসঙ্গ। কথা হয় ‘সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক’র প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা ও বর্তমান সভাপতি শাহাব উদ্দিন এর সাথে। তিনি বলেন, ‘দেখুন আমাদের দ্বিধাবিভক্তির জন্য আমরাই দায়ী। ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন’র। কিন্তু মতের অমিল এবং উচ্চভিলাসী মনোভাবে খুব সম্ভবত ২০০৫-০৭ সালে গঠন হয়  ‘সিলেট সদর থানা সমিতি’র’।
তিনি আরো জানান, ‘বস্তুত এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় আমরা প্রবাসী কমিউনিটিকে বিভ্রান্তিকর জাতিতে পরিণত করছি। আমাদের নেতৃত্বের কোন্দলও রয়েছে। এছাড়াও মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে গণতান্ত্রিক মতামত নিজের অবস্থানের বিপক্ষে গেলে তা মেনে নিতে রাজি নই। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। নেতৃত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার খায়েসে একটা থেকে আরেকটা সংগঠনের সৃষ্টি। আমি বিশ্বাস এই হীন মানসিকতার পরিবর্তন না হয় ততদিন আসলে এসব দ্বিধাবিভক্তির বন্ধ হবে না’।
সিলেট বিভাগের অন্যতম একটি জেলার নাম মৌলভী বাজার। এলাকাটিতে প্রবাসীদের অর্থনৈতিক প্রভাব বেশ সচল বলা যায়। কিন্তু একটি মাত্র জেলাকে ঘিরে গড়ে উঠা কয়েকটি সংগঠন নিয়ে বিপাকে সাধারণ সিলেটবাসী। অত্র এলাকার প্রবাসী বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানান যায়, উত্তর আমেরিকাতে বৃহত্তর সিলেট বাসীর প্রথম সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় আশির দশকে। ‘মৌলভীবাজার জেলা সমিতি’ নামের ঐ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল মালেক সিপিএ। কিন্তু কয়েক বছর না যেতে  নব্বই দশেকের শুরুতেই তা ভেঙ্গে একই নামে গড়ে উঠে আরেক সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন গজনফর আলী চৌধুরী।
এমনটি তুলে ধরেন, মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক এর সাবেক সভাপতি মিনহাজ আহমেদ সাম্মু। তিনি বলেন, ‘আশির দশকে আমাদের সিলেটের অঞ্চল ভিত্তিক এখানে (নিউইয়র্কে) তেমন কোন সংগঠন ছিলো না। মৌলভীবাজার জেলা সমিতির মাধ্যমে সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত ক্ষমতার লড়াই এবং মতের অমিলেই এসব সংগঠন গড়ার অন্যতম কারণ। যদিও একটা সময়ে এসে ‘মৌলভী বাজার জেলা সমিতি’ অকার্যর হয়ে যায়। এর আগে (তখনকার সময়ে) আমরা জুনিয়র কয়েকজন স্পোর্টস মনা মিলে ১৯৯৫ সালের দিকে গঠন করি ‘মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থা’। যার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলাম আমি মিনহাজ আহমেদ সাম্মু। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র (মৌলভীবাজারের) প্রবাসীদের নিয়ে মধ্যবর্তী পন্থায় আমরা ঐ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। অনেক সামাজিক কর্মকান্ড’সহ বিভিন্ন খেলাধুলার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি আমরা। সফলতাও অর্জন করি। কয়েকদিন না যেতেই তা ভেঙ্গে একই নামে গড়ে উঠে আরেকটি সংগঠন। যা শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে কার্যত নিস্ক্রিয় রয়েছে এসব সংগঠন’।
মৌলভী বাজার জেলা সমিতির চলমান দুটি সংগঠনের মধ্যে ঐক্যের ব্যাপারে মিনহাজ আহমেদ সাম্মু বলেন, ‘মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা’র প্রতিষ্ঠা লাভ করে ২০০০ সালের দিকে। যার  আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ শওকত আলী। প্রথম মিটিং এ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করি আমি। কিন্তু শুরুতেই কিছু কমিটি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালিন ৩১ সদস্য কমিটি, মিটিং ছাড়াই একশ ছাড়িয়ে যায়। সংগঠনের গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠায় আমি’সহ বেশ কয়েকজন ঐ সমিতির কর্মকান্ডে যোগ দেইনি। পরবর্তীতে আমাদের নেয়ার চেষ্টা করওে সফল হয়নি। প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক’। আমরা দুটো সংগঠনই সামজিক কর্মকান্ডমূলক কাজ করে যাচ্ছি। আমরা পাশাপাশি কাজ করছি। কোন বিরোধ নেই আমাদের মাঝে। যে যার ইচ্ছের মতই উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডে তাদের জোরালো ভূমিকা রাখছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে সবাইকে একই ছাদের নিয়ে আসতে কয়েকজন মাঠে নেমেছেন। কয়েকদিন পরপর একটা ঐক্যের ডাক আসে। এবছরের মাঝামাঝি ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কয়েকজন তৎপর হয়। প্রস্তাব আসে ‘ঐক্য কমিটি’ গড়ার। উভয় পক্ষ কিছু প্রতিনিধির নামের তালিকা দেন। কিন্তু সেখানেও গড়মিল দেখা যায়। প্রস্তাবিত নামের তালিকা পরিবর্তন হয়ে যায়। এর ফলে উদ্যোগটা ভেস্তে যায়। সেখানেও ঘটে দ্বিধাবিভক্তি। ঐক্যের পক্ষে একটি অংশ আর বিপক্ষে আরেকটি অংশ। যারা ঐক্যের ব্যাপারে আগ্রহী তারা একটা কমিটির পক্ষে চলে যায়; আর যারা বঞ্চিত কিংবা অনাগ্রহী তারা বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ২০১৫ সালে ১১ জানুয়ারি জালালাবাদ এসোসিয়েশনে ঐক্য কমিটি গঠনে একটি সভা করার ঘোষণা দেয় পক্ষের নেতারা। মূলত ঐক্য আমি’সহ সবাই চাই। এটা একটা  জটিল সমিকরণ। কিন্তু যতদিন না ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে; ততদিন তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করছি’।
এ বিষয়ে কথা হয় মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সভাপতি সৈয়দ জুবায়ের আলীর সাথে। তিনি জানান, ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম নিউ ইয়র্কে মৌলভীবাজার ডিষ্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম সভাপতি ছিলেন আ. মুসাব্বির এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী নিয়ে মত বিরোধ ঘটায় এই সংগঠন বিভক্ত হয়ে ‘মোলভীবাজার জেলা সমিতি’ নামে আর একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আজমল খান এবং সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন মিনহাজ আহমদ শামু। কিন্তু বিভক্তভাবে দুই সংগঠনের কাজ চললেও ২০১৪ সালে ইউ ইয়র্ক প্রবাসী মোলভীবাজারের মুরুব্বীগণ দু’টি সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেন। উভয় সংগঠন থেকে ৭জন করে সদস্য নিয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান আহ্বায়ক ও এমরান হোসেন মেম্বার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। আহ্বায়ক কমিটির উদ্যোগে আগামী ১১ জানুয়ারী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হবে।
একই নামে আরেকটি গড়ে উঠা সংগঠনের মধ্যে কার্যত নিস্ক্রিয় হয়ে আছে (১) মৌলভী বাজার জেলা সমিতি-১। (২) মৌলভী বাজার জেলা সমিতি-২। (৩) মৌলভীবাজর জেলা ক্রীড়া সংস্থা-১। (৪) মৌলভীবাজর জেলা ক্রীড়া সংস্থা-২।
সিলেটের অতি পরিচিত আরেক জেলার নাম হচ্ছে সুনামগঞ্জ। সময়ের পথ পরিক্রমায় অঞ্চল ভিত্তিক সমিতি গঠন প্রক্রিয়ায় এ জেলার বাসিন্দারাও মতানৈক্যের মাঝে পার করছেন তাদের প্রবাস জীবন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের দিকে গড়ে তোলেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী। মূলত সেখান থেকেই বেরিয়ে জন্ম নেয় আরো দু’টি সংগঠন। যার মধ্যে ‘সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ’ এবং ‘সুনামগঞ্জ কল্যাণ সমিতি অন্যতম’। কথা বলেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতাকালিন সদস্য, সাবেক সভাপতি আফতাব আলী। তিনি জানান, ‘আসলে প্রবাসেও আমরা দ্বিধাবিভক্তির জাতিতে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পদ-পদবীর লোভ এবং মতের অমিল। আমাদের শুরুটা হয় ভালো কিছু দিয়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস শেষটা মন্দের। আমরা পুরো কমিউনিটির মাঝে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ত্যাগী মনোভাবের অভাব রয়েছে আমাদের। ঐক্য আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু সেটা মুখে বললেও বাস্তবে তার উল্টোটা বিশ্বাস করি আমরা। নিজের স্বার্থ ঠিক রেখে ঐক্য সম্ভব নয়। ত্যাগী মনোভাবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলেই আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। মুল কথা হচ্ছে ঐক্যের জন্য ভুলতে হবে মতানৈক্য’।
প্রবাসী সংগঠনের ধারাবাহিক ভাঙ্গন সৃষ্টির কারণ নিয়ে মতামত তুলে ধরেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন রুবেল। তিনি জানান, ‘এত কিছুর জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের নিজেদের মধ্যে ইগো সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ। সেই সাথে রয়েছে পদের লড়াই। দেশে যদি কোন বিভেদ থাকে সেটার প্রভাব। আামাদের এসব কৃতকর্মের ফলে ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে কমিউনিটির কাছে। যেখানে খোদ নিজেরাই দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েছি; সেখানে কমিউনিটির উন্নয়নে কী ভুমিকা রাখবো আমরা? আর এসব বাজে অবস্থানের প্রতিদান দিচ্ছেন নতুন প্রজন্ম। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো কোন উদাহরণ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।  আমাদের এসব কর্মকান্ডের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কমিউনিটি’সহ বাংলাদেশী-আমেরিকানদের মাঝেও’। উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের জেলার নামে প্রতিষ্ঠিত (১) সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি। (২) সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ। (৩) সুনাগঞ্জ কল্যাণ সমিতি। এসব সংগঠনের কার্যক্রম চললেও মতবিরোধের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেণ সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা।
সিলেটের অন্যতম আরেকটি জেলা হচ্ছে হবিগঞ্জ। সেখানেও রয়েছে একাধিক সংগঠন। রয়েছে উপজেলা নবীগঞ্জের নামক সংগঠনও। বাংলা পত্রিকার সাথে কথা হয় ‘হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক’র বর্তমান সভাপতি সৈয়দ নজমুল হাসান কুবাদ’র। তিনি জানান, ‘আসলে আমরা ১৯৯৮ সালে গঠন করি আমাদের হবিগঞ্জের এই সমিতি। মূলত আমাদের একটা মহিলা কলেজকে কেন্দ্র করে গঠন হয় সংগঠনটি। সেই কলেজের উন্নয়নের কাজে প্রবাসীদের অর্থ অনুদানের লক্ষ্যেই নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। তখনকার সময়ে কলেজের ইমারত নির্মাণে অর্থ সহায়তা দিয়েছি। হবিগঞ্জের ডায়াবেটিস হসপিটালেও আমরা আর্থিক অনুদান দিয়েছি। এছাড়াও আমাদের জেলার গরীব অসহায়দের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক অনুদারে লক্ষ্যে ‘ওয়ান-কোয়াটার এ ডে চেইঞ্জ এ লাইফ’ শ্লোগান নিয়ে আমরা সফলতা অর্জন করি। এসব হচ্ছে আমাদের ইতিবাচক। আর নেতিবাচকের কথা কী বলবো? যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। সভা-সমিতিতে আমাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে ঠিকই; কিন্তু মতের অমিলে একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়া এই নীতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। তারপরও আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। সংগঠনের নব-নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট নাসিরুদ্দিন সাহেবকে আগামী ১১ জানুয়ারি ২০১৫ তে দায়িত্ব হস্তান্তর করবো। উল্লেখ্য, বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ অঞ্চলের এরকম বেশ কয়েকটি সংগঠন লয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে (১) হবিগঞ্জ জেলা সমিতি। (২) হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক। (৩) হবিগঞ্জ সদর সমিতি। (৪) বৃন্দাবণ কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন। (৫) নবিগঞ্জ কল্যাণ সমিতি অন্যতম।
বৃহত্তর সিলেট প্রবাসীদের স্বার্থে গড়ে উঠা এসব সংগঠনের নেতারা একেক রকম মন্তব্য দিলেও সাধারণ সিলেটবাসী মনে করছেন, ‘এসব সংগঠনের কারণেই প্রবাসেও আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে পারিনি। নিউ ইয়র্কে কিংবা উত্তর আমেরিকাতে সিলেটের এত সংগঠনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। বাংলাদেশেও আমাদের সিলেটিদের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লন্ডনে তা আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। কিন্তু আমেরিকাতে আমাদের অবস্থান খুবই নাজুক। আর এ জন্য দায়ী আমাদের মতবিরোধ এবং অসংখ্য সমিতির উত্থান। আমরা সিলেটবাসীর একটি সংগঠন হলে সবাই এলাকার উন্নয়নে জোরালো ভুমিখা রাখতে সক্ষম হতাম। আমাদের রয়েছে মাত্র চারটি জেলা এবং গুটি কয়েক উপজেলা। বৃহত্তর সিলেটের একটি সমিতি গঠন হয়ে জেলা এবং উপজেলা কেন্দ্রীক শাখা সংগঠন হতে পারতো। যা একই নামের হলে আমরা হতাম ঐক্যবদ্ধ জাতিগোষ্ঠি। আমাদের অর্থনৈতিক সহায়তা কাজে লাগাতে পারতাম এলাকার উন্নয়নে। সবার মাঝে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হতো। বিশেষ দিনে একটি অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারাকে জানান দিতে পারতাম ‘আমরা হগল সিলোটি’। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি’।
thএক নজরে সিলেটের ইতিহাস
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এর পূর্ব থেকেই (অর্থাৎ পাকিস্তান আমল) সাবেক সিলেট জেলা ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত। সময়ের প্রয়োজনে পরবর্তী কালের সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কার্যক্রমের সূত্রে ১৯৯৫ সালের ১লা আগস্ট চারটি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের ষষ্ঠ বিভাগে রুপান্তর লাভ করে সিলেট বিভাগ। গঠিত এই বিভাগের মোট আয়াতন ১২,৫৯৫.৯৫ বর্গ কিলোমিটার। সিলেট বিভাগের পূর্বে ভারতের আসাম, উত্তরে মেঘালয় রাজ্য (খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া পাহাড়), দক্ষিণে ত্রিপুরা রাজ্য, আর পশ্চিমে বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগ। সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে এই অঞ্চলের প্রাচীন সীমানার কিছু নিদর্শন ফুটে উঠে। তৎকালীন শ্রীহট্টমন্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগের  চেয়ে আয়াতনে অনেক বড় ছিল। এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখন্ডল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অনেকাংশ শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাই প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল অর্থাৎ শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত। যোগিনী তন্ত্রে শ্রীহট্টের সীমার বিবরণ এরকম: পূর্ব্বে স্বর্ণ নদীশ্চৈব, দক্ষিণে চন্দ্রশেখর লোহিত, পশ্চিমে ভাগে উত্তরেচ নীলাচল এবং এতন্মধ্যে মহাদেব শ্রীহট্ট নামো নামতা।
প্রাচীন গ্রন্থাদিতে এ অঞ্চলের (সিলেট বিভাগ) বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শিবের স্ত্রী সতি দেবির কাটা হস্ত (হাত) এই অঞ্চলে পড়েছিল। যার ফলে ‘শ্রী হস্ত’ হতে শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম “সিরিওট” বলে উল্লেখ আছে। এছাড়াও, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এলিয়েনের বিবরণে “সিরটে”, এবং পেরিপ্লাস অব দ্যা এরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থে এ অঞ্চলের নাম “সিরটে” এবং “সিসটে” এই দুইভাবে লিখিত হয়েছে। অতঃপর ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে যখন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে এ অঞ্চলের নাম “শিলিচতল” উল্লেখ করেছেন। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ার খিলজি দ্বারা বঙ্গবিজয়য়ের মধ্য দিয়ে এদেশে মুসলিম সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটলে মুসলিম শাসকগণ তাঁদের দলিলপত্রে “শ্রীহট্ট” নামের পরিবর্তে “সিলাহেট”, “সিলহেট” ইত্যাদি নাম লিখেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ মিলে। আর এভাবেই শ্রীহট্ট থেকে রূপান্তর হতে হতে একসময় সিলেট নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন।
সিলেটের ইতিহাস কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে; যেমন প্রাচীন অধিবাসী বিবরণ, ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন রাজ্য সমুহ, আর্য যুগ, মোসলমান শাসিত আমল, মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি, মুক্তি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ। সিলেট বলতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশের সিলেট বিভাগ বোজানো হয় যদিও ঐতিহাসিক সিলেট অঞ্চলের কিছু অংশ ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের আসাম রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। (বাংলা পত্রিকা)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

বৃহত্তর সিলেট ভিত্তিক সংগঠনে আধিপত্য ও মর্যাদার লড়াই

প্রকাশের সময় : ০৩:১৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৫

নিউইয়র্ক: বলা হয়ে থাকে উত্তর আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের সবচে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের। অর্থনৈতিক শক্তি এবং ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে সিলেট হচ্ছে সবচে ক্ষমতাধর কমিউনিটি। তেমন একটা দলীয় কোন্দল না থাকলেও রয়েছে আধিপত্য ও মর্যাদার লড়াই। আর এই আধিপত্যের লড়াইকে ঘিরেই একে একে গড়ে উঠছে অঞ্চল কেন্দ্রীক বিভিন্ন সংগঠন। প্রবাসে বৃহত্তর সিলেটবাসীর এসব সংগঠন বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে সভা সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট। যাতে রয়েছে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল, যা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট সদর’সহ এই চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। চারটি জেলার একটি বিভাগের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারি সিলেট প্রবাসীরা গড়ে তুলেছেন অসংখ্য আঞ্চলিক সংগঠন। বলা হয়ে থাকে উত্তর আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘আমব্রেলা খ্যাত’ সংগঠন ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’ হলেও সদস্য সংখ্যার দিক থেকে কখনও ছাড়িয়ে যায় জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা। যা বৃহত্তর সিলেটবাসীর  ‘আমব্রেলা খ্যাত’ সংগঠন হিসেবে পরিচিত। মূলত এই সংগঠনটির ব্যানারেই কিংবা সম্মিলিত উদ্যোগে মহান একুশে ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’সহ নানা জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয়ে থাকে। এত কিছুর পরও প্রশ্ন উঠছে একই নামে কিংবা অঞ্চল ভিত্তিক এতগুলো সংগঠনের গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। বাংলা পত্রিকার সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে আসে সিলেট প্রবাসী নানা জনের নানা মত। অনেকে অভিযোগ করেন, ‘শুধুমাত্র ক্ষমতার মোহ আর কমিউনিটির পত্রিকায় শিরোনামে তৃপ্ত হতেই এসব সংগঠনের উত্থান’। কেউ বা বলছেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা এসব সংগঠনগুলোর ভালো কাজের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন কোন্দলেও। ক্ষমতার দম্ভ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য, পদ-পদবী এবং অঞ্চল ভেদে একটি ভেঙ্গে গড়ছে আরেকটি সংগঠন। যার প্রভাব পড়ছে এখানকার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নতুন প্রজন্মের মধ্যে। একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়ার এসব নেতিবাচক মনোভাবে বাংলাদেশী প্রবাসীরা এখানকার মূলধারার কাছে পরিণত হচ্ছে হাসির পাত্রে। যদি একই ছাদের নীচে পুরো সিলেটবাসী থাকতো তাহলে মুলধারায় আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো সুদৃঢ় হতে পারতো। আমরা পরিশ্রমী ও সাহসি জাতি। জাতি হিসেবে আমাদের এইতুটু আত্মসম্মানবোধ নেই বলেই আজকে একটি গড়ে আরেকটি সংগঠনের উৎপত্তি’।
জালালাবাদ এসোসিয়েশন ছাড়াও সিলেট সদর ও মহানগরের নামে রয়েছে একাধিক সংগঠন। এছাড়াও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আছে অসংখ্য সমিতির অবস্থান। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে শুরু হওয়া এসব সংগঠনের বিভাজনের সৃষ্টিতে মূখ্য ভুমিকা হচ্ছে কর্তৃত্বের লড়াই। এক নজরে দেখা নেয়া যাক বৃহত্তর সিলেট বিভাগের কিছু সংখ্যক থানা কিংবা উপজেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সংগঠনের তালিকা। (১) জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা, (২) সিলেট ডিস্ট্রিক্ট সোসাইটি, (৩) সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইন্ক। (৪) সিলেট সদর থানা সমিতি, (৫) সিলেট মহানগর উন্নয়ন পরিষদ, (৬) হবিগঞ্জ জেলা সমিতি, (৭) হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক, (৮) হবিগঞ্জ সদর সমিতি, (৯) বৃন্দাবন কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন, (১০) নবিগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (১১) মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, (১২) মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক, (১৩) মৌলভীবাজার জেলা সমিতি (নিস্ক্রিয়), (১৪) মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থা (নিস্ক্রিয়), (১৫) সুনামগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (১৬) সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ, (১৭) ফেঞ্চুগঞ্জ সমিতি, (১৮) বালাগঞ্জ ওসমানী নগর প্রবাসী কল্যাণ সমিতি ইউএসএ, (১৯) বড়লেখা জুড়ি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি, (২০) কুলাউড়া বাংলাদেশী এসোসিয়েশন অব ইউএসএ, (২১) বিশ্বনাথ প্রবাসী কল্যাণ সমিতি, (২২) জকিগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইন্্ক, (২৩) বিয়ানীবাজার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, (২৪) বিয়ানীবাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ ইন্ক, (২৫) রাজনগর উন্নয়ন পরিষদ, (২৬) সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি, (২৭) ফেঞ্চুগঞ্জ কল্যাণ সমিতি, (২৮) বিশ্বনাথ কল্যাণ সমিতি, (২৯) গোলাপগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইন্্ক।  কয়েকজন বন্ধু কিংবা পরিবার কেন্দ্রীক গড়ে উঠা নামে বেনামে এরকম আরো অসংখ্য সমিতি রয়েছে উত্তর আমেরিকার’সহ নিউ জার্সি ও নিউইয়র্কে।
বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠা এসব সংগঠন বিষয়ে কথা হয় সিলেটবাসীর সর্ববৃহৎ সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ সোসাইটির নব-নির্বাচিত সভাপতি আজমল হোসেন কুনু’র সাথে। তিনি বলেন, ‘দেখুন আপনার যে প্রশ্ন করেছেন তা ঠিক অনেক ক্ষেত্রে। তবে, বৃহত্তর সিলেটের ঐক্য এখনো রয়েছে। কিছু কিছু ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ হচ্ছে মতের অমিল। ক্ষমতার মোহ যে নেই সেটাও বলা যাবে না। কারণ বিষয়গুলো আপেক্ষিক। একেক জন একেক ভাবে চিন্তা করে থাকেন। আর বিভাজনের সবচে বড় কারণ হেচ্ছ নেতৃত্ব সঙ্কট। উত্তরণের উপায়ও রয়েছে আমাদের। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। প্রবাসে আমাদের গ্রহণযোগ্য বৃদ্ধিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই’।
বাংলাদেশ সোসাইটির নয়া কর্ণধার আরো বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সোসাইটির দায়িত্ব গ্রহণ করবো ৪ জানুয়ারি। এরপর সোসাইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করবো। তারপর অন্যান্যদেরও আহ্বান জানাবো ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রবাসীদের উন্নয়নে কাজ করতে। যেমনিভাবে আমরা জালালাবাদ এসোসিয়েশনকে বৃহত্তর সিলেটবাসীর প্রাণের সংগঠনে রুপান্তরিত করেছি। তবে, আমাদের প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আনতে হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্টদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবে। সবার সহযোগিতা পেলেই আমরা সফলতা অর্জন করবো। তবে, তার আগে নিজের ঘরকে ঠিক করতে হবে’।
জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বদরুন্নাহার খান মিতা তুলে ধরেন তাঁর অনুভূতির কথা। ‘আমাদের জালালাবাদ কোন ভাঙ্গন নেই। সিলেট অনেক বড় একটি অঞ্চল। তাই সংগঠনও হচ্ছে সিলেটবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে। এখানে কোন কোন্দল নেই। আমরা বিভিন্ন দিবসগুলো জালালাবাদ এসোসিয়েশনের ব্যানারেই করে থাকি। আমাদের সবার মধ্যে রয়েছে সু-সম্পর্ক’।
আলোচনায় উঠে আসে সিলেট সদর থানা সমিতির উত্থান এবং বিভাজন প্রসঙ্গ। কথা হয় ‘সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক’র প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা ও বর্তমান সভাপতি শাহাব উদ্দিন এর সাথে। তিনি বলেন, ‘দেখুন আমাদের দ্বিধাবিভক্তির জন্য আমরাই দায়ী। ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন’র। কিন্তু মতের অমিল এবং উচ্চভিলাসী মনোভাবে খুব সম্ভবত ২০০৫-০৭ সালে গঠন হয়  ‘সিলেট সদর থানা সমিতি’র’।
তিনি আরো জানান, ‘বস্তুত এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় আমরা প্রবাসী কমিউনিটিকে বিভ্রান্তিকর জাতিতে পরিণত করছি। আমাদের নেতৃত্বের কোন্দলও রয়েছে। এছাড়াও মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে গণতান্ত্রিক মতামত নিজের অবস্থানের বিপক্ষে গেলে তা মেনে নিতে রাজি নই। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। নেতৃত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার খায়েসে একটা থেকে আরেকটা সংগঠনের সৃষ্টি। আমি বিশ্বাস এই হীন মানসিকতার পরিবর্তন না হয় ততদিন আসলে এসব দ্বিধাবিভক্তির বন্ধ হবে না’।
সিলেট বিভাগের অন্যতম একটি জেলার নাম মৌলভী বাজার। এলাকাটিতে প্রবাসীদের অর্থনৈতিক প্রভাব বেশ সচল বলা যায়। কিন্তু একটি মাত্র জেলাকে ঘিরে গড়ে উঠা কয়েকটি সংগঠন নিয়ে বিপাকে সাধারণ সিলেটবাসী। অত্র এলাকার প্রবাসী বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানান যায়, উত্তর আমেরিকাতে বৃহত্তর সিলেট বাসীর প্রথম সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় আশির দশকে। ‘মৌলভীবাজার জেলা সমিতি’ নামের ঐ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল মালেক সিপিএ। কিন্তু কয়েক বছর না যেতে  নব্বই দশেকের শুরুতেই তা ভেঙ্গে একই নামে গড়ে উঠে আরেক সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন গজনফর আলী চৌধুরী।
এমনটি তুলে ধরেন, মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক এর সাবেক সভাপতি মিনহাজ আহমেদ সাম্মু। তিনি বলেন, ‘আশির দশকে আমাদের সিলেটের অঞ্চল ভিত্তিক এখানে (নিউইয়র্কে) তেমন কোন সংগঠন ছিলো না। মৌলভীবাজার জেলা সমিতির মাধ্যমে সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত ক্ষমতার লড়াই এবং মতের অমিলেই এসব সংগঠন গড়ার অন্যতম কারণ। যদিও একটা সময়ে এসে ‘মৌলভী বাজার জেলা সমিতি’ অকার্যর হয়ে যায়। এর আগে (তখনকার সময়ে) আমরা জুনিয়র কয়েকজন স্পোর্টস মনা মিলে ১৯৯৫ সালের দিকে গঠন করি ‘মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থা’। যার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলাম আমি মিনহাজ আহমেদ সাম্মু। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র (মৌলভীবাজারের) প্রবাসীদের নিয়ে মধ্যবর্তী পন্থায় আমরা ঐ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। অনেক সামাজিক কর্মকান্ড’সহ বিভিন্ন খেলাধুলার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি আমরা। সফলতাও অর্জন করি। কয়েকদিন না যেতেই তা ভেঙ্গে একই নামে গড়ে উঠে আরেকটি সংগঠন। যা শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে কার্যত নিস্ক্রিয় রয়েছে এসব সংগঠন’।
মৌলভী বাজার জেলা সমিতির চলমান দুটি সংগঠনের মধ্যে ঐক্যের ব্যাপারে মিনহাজ আহমেদ সাম্মু বলেন, ‘মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা’র প্রতিষ্ঠা লাভ করে ২০০০ সালের দিকে। যার  আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ শওকত আলী। প্রথম মিটিং এ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করি আমি। কিন্তু শুরুতেই কিছু কমিটি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালিন ৩১ সদস্য কমিটি, মিটিং ছাড়াই একশ ছাড়িয়ে যায়। সংগঠনের গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠায় আমি’সহ বেশ কয়েকজন ঐ সমিতির কর্মকান্ডে যোগ দেইনি। পরবর্তীতে আমাদের নেয়ার চেষ্টা করওে সফল হয়নি। প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘মৌলভীবাজার জেলা সমিতি ইউএসএ ইন্ক’। আমরা দুটো সংগঠনই সামজিক কর্মকান্ডমূলক কাজ করে যাচ্ছি। আমরা পাশাপাশি কাজ করছি। কোন বিরোধ নেই আমাদের মাঝে। যে যার ইচ্ছের মতই উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডে তাদের জোরালো ভূমিকা রাখছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে সবাইকে একই ছাদের নিয়ে আসতে কয়েকজন মাঠে নেমেছেন। কয়েকদিন পরপর একটা ঐক্যের ডাক আসে। এবছরের মাঝামাঝি ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কয়েকজন তৎপর হয়। প্রস্তাব আসে ‘ঐক্য কমিটি’ গড়ার। উভয় পক্ষ কিছু প্রতিনিধির নামের তালিকা দেন। কিন্তু সেখানেও গড়মিল দেখা যায়। প্রস্তাবিত নামের তালিকা পরিবর্তন হয়ে যায়। এর ফলে উদ্যোগটা ভেস্তে যায়। সেখানেও ঘটে দ্বিধাবিভক্তি। ঐক্যের পক্ষে একটি অংশ আর বিপক্ষে আরেকটি অংশ। যারা ঐক্যের ব্যাপারে আগ্রহী তারা একটা কমিটির পক্ষে চলে যায়; আর যারা বঞ্চিত কিংবা অনাগ্রহী তারা বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ২০১৫ সালে ১১ জানুয়ারি জালালাবাদ এসোসিয়েশনে ঐক্য কমিটি গঠনে একটি সভা করার ঘোষণা দেয় পক্ষের নেতারা। মূলত ঐক্য আমি’সহ সবাই চাই। এটা একটা  জটিল সমিকরণ। কিন্তু যতদিন না ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে; ততদিন তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করছি’।
এ বিষয়ে কথা হয় মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সভাপতি সৈয়দ জুবায়ের আলীর সাথে। তিনি জানান, ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম নিউ ইয়র্কে মৌলভীবাজার ডিষ্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম সভাপতি ছিলেন আ. মুসাব্বির এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী নিয়ে মত বিরোধ ঘটায় এই সংগঠন বিভক্ত হয়ে ‘মোলভীবাজার জেলা সমিতি’ নামে আর একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আজমল খান এবং সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন মিনহাজ আহমদ শামু। কিন্তু বিভক্তভাবে দুই সংগঠনের কাজ চললেও ২০১৪ সালে ইউ ইয়র্ক প্রবাসী মোলভীবাজারের মুরুব্বীগণ দু’টি সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেন। উভয় সংগঠন থেকে ৭জন করে সদস্য নিয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান আহ্বায়ক ও এমরান হোসেন মেম্বার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। আহ্বায়ক কমিটির উদ্যোগে আগামী ১১ জানুয়ারী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হবে।
একই নামে আরেকটি গড়ে উঠা সংগঠনের মধ্যে কার্যত নিস্ক্রিয় হয়ে আছে (১) মৌলভী বাজার জেলা সমিতি-১। (২) মৌলভী বাজার জেলা সমিতি-২। (৩) মৌলভীবাজর জেলা ক্রীড়া সংস্থা-১। (৪) মৌলভীবাজর জেলা ক্রীড়া সংস্থা-২।
সিলেটের অতি পরিচিত আরেক জেলার নাম হচ্ছে সুনামগঞ্জ। সময়ের পথ পরিক্রমায় অঞ্চল ভিত্তিক সমিতি গঠন প্রক্রিয়ায় এ জেলার বাসিন্দারাও মতানৈক্যের মাঝে পার করছেন তাদের প্রবাস জীবন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের দিকে গড়ে তোলেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী। মূলত সেখান থেকেই বেরিয়ে জন্ম নেয় আরো দু’টি সংগঠন। যার মধ্যে ‘সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ’ এবং ‘সুনামগঞ্জ কল্যাণ সমিতি অন্যতম’। কথা বলেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতাকালিন সদস্য, সাবেক সভাপতি আফতাব আলী। তিনি জানান, ‘আসলে প্রবাসেও আমরা দ্বিধাবিভক্তির জাতিতে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পদ-পদবীর লোভ এবং মতের অমিল। আমাদের শুরুটা হয় ভালো কিছু দিয়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস শেষটা মন্দের। আমরা পুরো কমিউনিটির মাঝে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ত্যাগী মনোভাবের অভাব রয়েছে আমাদের। ঐক্য আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু সেটা মুখে বললেও বাস্তবে তার উল্টোটা বিশ্বাস করি আমরা। নিজের স্বার্থ ঠিক রেখে ঐক্য সম্ভব নয়। ত্যাগী মনোভাবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলেই আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। মুল কথা হচ্ছে ঐক্যের জন্য ভুলতে হবে মতানৈক্য’।
প্রবাসী সংগঠনের ধারাবাহিক ভাঙ্গন সৃষ্টির কারণ নিয়ে মতামত তুলে ধরেন ‘সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন রুবেল। তিনি জানান, ‘এত কিছুর জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের নিজেদের মধ্যে ইগো সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ। সেই সাথে রয়েছে পদের লড়াই। দেশে যদি কোন বিভেদ থাকে সেটার প্রভাব। আামাদের এসব কৃতকর্মের ফলে ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে কমিউনিটির কাছে। যেখানে খোদ নিজেরাই দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েছি; সেখানে কমিউনিটির উন্নয়নে কী ভুমিকা রাখবো আমরা? আর এসব বাজে অবস্থানের প্রতিদান দিচ্ছেন নতুন প্রজন্ম। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো কোন উদাহরণ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।  আমাদের এসব কর্মকান্ডের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কমিউনিটি’সহ বাংলাদেশী-আমেরিকানদের মাঝেও’। উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের জেলার নামে প্রতিষ্ঠিত (১) সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি। (২) সুনামগঞ্জ সোসাইটি অব ইউএসএ। (৩) সুনাগঞ্জ কল্যাণ সমিতি। এসব সংগঠনের কার্যক্রম চললেও মতবিরোধের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেণ সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা।
সিলেটের অন্যতম আরেকটি জেলা হচ্ছে হবিগঞ্জ। সেখানেও রয়েছে একাধিক সংগঠন। রয়েছে উপজেলা নবীগঞ্জের নামক সংগঠনও। বাংলা পত্রিকার সাথে কথা হয় ‘হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক’র বর্তমান সভাপতি সৈয়দ নজমুল হাসান কুবাদ’র। তিনি জানান, ‘আসলে আমরা ১৯৯৮ সালে গঠন করি আমাদের হবিগঞ্জের এই সমিতি। মূলত আমাদের একটা মহিলা কলেজকে কেন্দ্র করে গঠন হয় সংগঠনটি। সেই কলেজের উন্নয়নের কাজে প্রবাসীদের অর্থ অনুদানের লক্ষ্যেই নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। তখনকার সময়ে কলেজের ইমারত নির্মাণে অর্থ সহায়তা দিয়েছি। হবিগঞ্জের ডায়াবেটিস হসপিটালেও আমরা আর্থিক অনুদান দিয়েছি। এছাড়াও আমাদের জেলার গরীব অসহায়দের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক অনুদারে লক্ষ্যে ‘ওয়ান-কোয়াটার এ ডে চেইঞ্জ এ লাইফ’ শ্লোগান নিয়ে আমরা সফলতা অর্জন করি। এসব হচ্ছে আমাদের ইতিবাচক। আর নেতিবাচকের কথা কী বলবো? যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। সভা-সমিতিতে আমাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে ঠিকই; কিন্তু মতের অমিলে একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়া এই নীতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। তারপরও আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। সংগঠনের নব-নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট নাসিরুদ্দিন সাহেবকে আগামী ১১ জানুয়ারি ২০১৫ তে দায়িত্ব হস্তান্তর করবো। উল্লেখ্য, বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ অঞ্চলের এরকম বেশ কয়েকটি সংগঠন লয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে (১) হবিগঞ্জ জেলা সমিতি। (২) হবিগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতি ইউএসএ ইন্্ক। (৩) হবিগঞ্জ সদর সমিতি। (৪) বৃন্দাবণ কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন। (৫) নবিগঞ্জ কল্যাণ সমিতি অন্যতম।
বৃহত্তর সিলেট প্রবাসীদের স্বার্থে গড়ে উঠা এসব সংগঠনের নেতারা একেক রকম মন্তব্য দিলেও সাধারণ সিলেটবাসী মনে করছেন, ‘এসব সংগঠনের কারণেই প্রবাসেও আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে পারিনি। নিউ ইয়র্কে কিংবা উত্তর আমেরিকাতে সিলেটের এত সংগঠনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। বাংলাদেশেও আমাদের সিলেটিদের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লন্ডনে তা আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। কিন্তু আমেরিকাতে আমাদের অবস্থান খুবই নাজুক। আর এ জন্য দায়ী আমাদের মতবিরোধ এবং অসংখ্য সমিতির উত্থান। আমরা সিলেটবাসীর একটি সংগঠন হলে সবাই এলাকার উন্নয়নে জোরালো ভুমিখা রাখতে সক্ষম হতাম। আমাদের রয়েছে মাত্র চারটি জেলা এবং গুটি কয়েক উপজেলা। বৃহত্তর সিলেটের একটি সমিতি গঠন হয়ে জেলা এবং উপজেলা কেন্দ্রীক শাখা সংগঠন হতে পারতো। যা একই নামের হলে আমরা হতাম ঐক্যবদ্ধ জাতিগোষ্ঠি। আমাদের অর্থনৈতিক সহায়তা কাজে লাগাতে পারতাম এলাকার উন্নয়নে। সবার মাঝে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হতো। বিশেষ দিনে একটি অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারাকে জানান দিতে পারতাম ‘আমরা হগল সিলোটি’। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি’।
thএক নজরে সিলেটের ইতিহাস
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এর পূর্ব থেকেই (অর্থাৎ পাকিস্তান আমল) সাবেক সিলেট জেলা ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত। সময়ের প্রয়োজনে পরবর্তী কালের সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কার্যক্রমের সূত্রে ১৯৯৫ সালের ১লা আগস্ট চারটি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের ষষ্ঠ বিভাগে রুপান্তর লাভ করে সিলেট বিভাগ। গঠিত এই বিভাগের মোট আয়াতন ১২,৫৯৫.৯৫ বর্গ কিলোমিটার। সিলেট বিভাগের পূর্বে ভারতের আসাম, উত্তরে মেঘালয় রাজ্য (খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া পাহাড়), দক্ষিণে ত্রিপুরা রাজ্য, আর পশ্চিমে বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগ। সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে এই অঞ্চলের প্রাচীন সীমানার কিছু নিদর্শন ফুটে উঠে। তৎকালীন শ্রীহট্টমন্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগের  চেয়ে আয়াতনে অনেক বড় ছিল। এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখন্ডল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অনেকাংশ শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাই প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল অর্থাৎ শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত। যোগিনী তন্ত্রে শ্রীহট্টের সীমার বিবরণ এরকম: পূর্ব্বে স্বর্ণ নদীশ্চৈব, দক্ষিণে চন্দ্রশেখর লোহিত, পশ্চিমে ভাগে উত্তরেচ নীলাচল এবং এতন্মধ্যে মহাদেব শ্রীহট্ট নামো নামতা।
প্রাচীন গ্রন্থাদিতে এ অঞ্চলের (সিলেট বিভাগ) বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শিবের স্ত্রী সতি দেবির কাটা হস্ত (হাত) এই অঞ্চলে পড়েছিল। যার ফলে ‘শ্রী হস্ত’ হতে শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম “সিরিওট” বলে উল্লেখ আছে। এছাড়াও, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এলিয়েনের বিবরণে “সিরটে”, এবং পেরিপ্লাস অব দ্যা এরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থে এ অঞ্চলের নাম “সিরটে” এবং “সিসটে” এই দুইভাবে লিখিত হয়েছে। অতঃপর ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে যখন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে এ অঞ্চলের নাম “শিলিচতল” উল্লেখ করেছেন। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ার খিলজি দ্বারা বঙ্গবিজয়য়ের মধ্য দিয়ে এদেশে মুসলিম সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটলে মুসলিম শাসকগণ তাঁদের দলিলপত্রে “শ্রীহট্ট” নামের পরিবর্তে “সিলাহেট”, “সিলহেট” ইত্যাদি নাম লিখেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ মিলে। আর এভাবেই শ্রীহট্ট থেকে রূপান্তর হতে হতে একসময় সিলেট নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন।
সিলেটের ইতিহাস কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে; যেমন প্রাচীন অধিবাসী বিবরণ, ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন রাজ্য সমুহ, আর্য যুগ, মোসলমান শাসিত আমল, মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি, মুক্তি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ। সিলেট বলতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশের সিলেট বিভাগ বোজানো হয় যদিও ঐতিহাসিক সিলেট অঞ্চলের কিছু অংশ ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের আসাম রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। (বাংলা পত্রিকা)