একটি মিডিয়ার রিপোর্টে আবৃত্তি শিল্পীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ
- প্রকাশের সময় : ১২:১০:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ মে ২০১৮
- / ৯৫২ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কের অনুষ্ঠিত ‘নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব-২০১৮’ এর অনুষ্ঠান এবং এই উৎসবে প্রবাসের কবীদের কবিতা পাঠ না করা নিয়ে শুক্রবার প্রকাশিত স্থানীয় একটি বাংলা সাপ্তাহিক-এর রিপোর্ট ঘিরে প্রবাসের আবৃত্তি শিল্পীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটির নিন্দা জানিয়ে নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব-২০১৮’র উপদেষ্টা ও ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটি’র চেয়ারম্যান, আবৃত্তি শিল্পী মিথুন আহমদ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন।
গত ২৩ মে বুধবার প্রদত্ত দীর্ঘ বিবৃতিতে নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব-২০১৮’র উপদেষ্টা ও ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটি’র চেয়ারম্যান, আবৃত্তি শিল্পী মিথুন আহমদ বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব নিয়ে নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আবৃত্তি উৎসবের কোনো ইতিবাচক খবর ছিল না। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভাষায় নেতিবাচকভাবে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। এবং অসংখ্য মনগড়া ও অসত্য তথ্য প্রদান করেছে। ফেসবুকে একজন কবি স্বীকার করেছেন তিনি এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন। তার মূল অভিযোগ প্রবাসের অনুষ্ঠিত এই আবৃত্তি উৎসবে প্রবাসী কবিদের কবিতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়: গত ১৩ মে রোববার নিউইয়র্কে হয়ে গেল প্রথমবারের মত আবৃত্তি উৎসব। একটি আয়োজন করতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ প্রাণশক্তি, শ্রম আর মেধার প্রয়োজন হয় তা কেবল আয়োজকরাই জানেন। এরকম একটি বিস্তৃত নান্দনিক উৎসবের জন্য যোগারযন্ত্র, প্রচার, যোগাযোগ, সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, মহড়া, অনুশীলন আর সর্বপরি আয়োজনটি ঘিরে খুঁটিনাটি প্রকাশনা, মূদ্রণ, সাজসজ্জা, মিলনায়তন, আলোক ও মঞ্চ পরিকল্পনা, সাউন্ড, আমন্ত্রিত অতিথি অভ্যর্থনা, শিল্পী সমন্বয় এই মহাযজ্ঞকে গড়ে তুলতে অতুলনীয় শ্রম দিতে হয়েছে আয়োজকদের সার্বক্ষণিক একটি কর্মী দলকে। যে উৎসবটি এক নজরে হয়ে গেল শুধুমাত্র একটি দিনকে কেন্দ্র করে, সেই মিলনকে সম্মিলিত করতে এই একটি ক্ষেত্রকে প্রস্তুতের জন্য কাজ করে যেতে হয়েছে বিগত দশ বছর ধরে। আবৃত্তি উৎসব হবে এরকম চিন্তার স্বপ্ন নিয়ে তার পেছনে আরো তিনটি বছর পরিকল্পনা আর পরিকল্পনার ভাবনা নিয়ে, অপেক্ষা করতে হয়েছে আবৃত্তি শিল্পীদের। আবৃত্তি শিল্পীরা নিজেরাই নিজেদের আবৃত্তি শুনবার জন্য একটি মঞ্চ প্রস্তুত করতে আরো বেশি সাহসী হয়ে ওঠেছে দিনকে দিন। এরকম একটি সফল উৎসবের একজন উপদেষ্টা এবং উৎসব পরিচালনা পর্ষদ ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটি’র চেয়ারম্যান হিসেবে এর সকল আয়োজনের সাথে সরাসরি সম্পৃক থাকার কারণে এই বিদ্বেষ প্রসূত অতি নোংরা ও নিম্ন রুচিসম্পন্ন অসত্য বনোয়াট ভিত্তিহহীন সংবাদটি আমাকে এতোই মর্মাহত করেছে যে, বিবেক প্রসূত যে কোন মানুষের জন্যই তা একটি বাড়তি চাপ। একটি আবৃত্তি উৎসবের রিপোর্টিং এ ‘মুরিদ’ ‘কুক্ষিগত’ এইসকল নেতিবাচক অশ্লীল শব্দ ইঙ্গিত করে মানহানিকর ও আপত্তিকর অভিযোগের পূর্বে বাঞ্চনীয় বিচক্ষণতার দাবী রাখে। এ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বস্তুনিষ্ঠতার অন্তরায়।
একটি আদর্শিক চেতনার অবস্থান থেকে একটি উৎসবের সম্মিলন করতে যে দীর্ঘ পথের ত্যাগ ও অনুশীলিত-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখতে হয় তা নিশ্চই প্রবাসের প্রগতিশীলধারার সাংবাদিক ও সম্পাদক মাত্র সবারই জানা।
বিবৃতিতে বলা হয়: প্রবাসে বসবাস করেছেন বা এখনো করছেন এমন লেখক ছড়াকার কবিদের মধ্যে প্রয়াত শহীদ কাদরী থেকে শুরু করে তসলিমা নাসরিন এবং মনজুর কাদের পর্যন্ত কবি ছড়াকারদের কবিতা এই উৎসবে আবৃত্তিকাররা আবৃত্তি করেছেন। মাত্র চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি কবিতার মধ্যে বাংলাভাষার সকল উল্লেখযোগ্য কবির কবিতা বাস্তবিক কারণেই পড়া সম্ভব হয়নি। আবৃত্তিযোগ্য কবিতার বিবেচনায় আবৃত্তিকাররা সবসময়ই তাদের নিজ নির্বাচন থেকেই বিষয়স্তু ও কবিকে বেছে নেন। এটা একজন শিল্পীর নিজস্ব স্বাধীনতা।
বাংলা সাহিত্যের যে কোন একজন জীবিত কবি তার নিজের জীবদ্দশায় নিজেকে একজন অনিবার্য কবি বলে দাবী করতেই পারেন এবং তা আবৃত্তিযোগ্য ও শিল্পগত বিচারে বা ভালোবাসার বিবেচনায় বিবেচিত হলে আবৃত্তিকাররা নিশ্চয়ই একদিন না একদিন তার কবিতাকে অনিবার্যভাবেই আবৃত্তি করবেন। সেজন্য বিশেষ কোন আইন কিংবা লেখককের বিশেষ কোন কৌশলকে বেছে নেবার প্রয়োজন পড়েনা তাদের নিজ নিজ কবিতাকে বলপ্রয়োগ করে আবৃত্তি করানোর জন্য। বলপ্রয়োগহীন নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নে কবিতার শক্তিই কেবল কবিতাকে মহৎ উৎকর্ষে পৌঁছায়।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়: প্রশ্ন যদি হয়ে থাকে প্রবাসে বসবাসরত বা এখনো বসবাস করেছেন এমন কারো কবিতা কিংবা কোন স্থানিক কবি ও লেখকের রচনা এই উৎসবে আবৃত্তি করা হয়েছে কি? তার সরাসরি উত্তর হ্যাঁ পড়া হয়েছে, এবং তাদের কাউকেই নিজ থেকে কোন ধরনের অনুরোধ করতে হয়নি। নিউইয়র্কে অবস্থানরত শক্তিমান কবিদের সাথে আবৃত্তিকারদের অনেকদিনের গভীর সখ্যতা এবং নিউইয়র্কের আবৃত্তিকারদের কণ্ঠে তাদের একাধিক কবিতা আবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তাদের কাউকেই নিজেদের কবিতাকে আবৃত্তিকারদের ওপর চাপিয়ে দেবার কোনরূপ অনুরোধ, প্রভাব কিংবা অনুনয়-বিনিনয় করে কোনরকম যোগাযোগ করবার অভিযোগও শোনা যায়নি। আবৃত্তি শিল্পীরা কখনোই কোন কবিকে ‘আঞ্চলিক কবি’ বলে মনে করে না। নিউইয়র্কে বসবাসরত কবিদের ‘স্থানীয় কবি’ সম্বোধন করে সংকীর্ণতা দেখিয়ে ‘প্রবাসী কবি’ বলে কখনোই অমর্যাদা ও ধৃষ্টতা প্রকাশ করেনা আবৃত্তি শিল্পীরা। একজন নিষ্ঠাবান ও মেধাবী শিল্পী সাহিত্যিক কবি লেখক সে যদি কাজটি নিরন্তরভাবে করে যায়, তিনি তখন মুল¯্রােতেরই একজন খ্যাতিমান ও শক্তিশালী কবি লেখক শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হন। জ্যোতি প্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু সে কারণেই কখনোই প্রবাসী বা স্থানীয় লেখক নন। যারা নিজেদেরকে শুধুই ‘স্থানীয় প্রবাসী কবি-লেখক’ ভাবেন, তখন ভাবতে এতটুকুও কষ্ট হয়না যে তাদের রুচির দুর্ভিক্ষ এবং কাঙালপনার মূল শূণ্যতার জায়গাটি আসলে কোথায়? এখন প্রশ্ন হলো এই রিপোর্টে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা তাদের নিজেদেরকে আঞ্চলিক বা স্থানীয় পরিচয় দিয়ে কোটা ভিত্তিক লেখক-কবি মনে করেন কিনা? আর তা যদি হয়, তবে তাদের জন্য এই মনে করাটা, অসম্মান বৈ মর্যাদাকর নয়। শিল্প-চর্চায় ‘কোটা ভিত্তিক রক্ষণশীলতা’ লেখক-কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতি অশ্রদ্ধারই নামান্তর মাত্র।
‘নিউইয়র্ক আবৃত্তি উৎসব ২০১৮’ এবং আবৃত্তি উৎসব পরিচালনা পর্ষদ ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটি’ স্পষ্টভাবে এমন অসত্য তথ্যেপূর্ণ নোংরা ভাষার ‘হলুদ সাংবাদিকতা’কে নিন্দনীয় উদাহরণ এবং কেবল শুধু একটি আশুভ দৃষ্টান্তই বলে মনে করে মাত্র। এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও টেলিফোন যোগাযোগে পত্রিকাটির সম্মানিত সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা করা হলে তিনি এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তাঁর পত্রিকায় সর্বোচ্চ দুঃখ প্রকাশের আশ্বাস দেন। আমরা আরও আশা করতে চাই যে, আবৃত্তি উৎসব পর্ষদের সাথে আনুষ্ঠানিক এক সৌজন্য বৈঠকের জন্যও কর্তৃপক্ষ অচিরেই উদ্যোগী হবেন।
বিবৃতিতে বলা হয়: উৎসবের বেশ কিছুদিন আগ থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজনের বিভিন্ন মন্তব্য- তার ভাষায় ‘প্রবাসী কবিদের কবিতা’ আবৃত্তিকারদের দিয়ে আবৃত্তি করানোর প্রস্তাব-প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে নানা ভর্ৎসনা তিরস্কার অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এসকল রূঢ় মন্তব্যসমূহকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে অশালীন অশ্রব্য ও নিম্নরুচি সম্পন্ন জবাব ও পাল্টা জবাবের অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিরও সৃস্টি হয়, যা সত্যিই প্রাকৃত কবি-লেখক ও শিল্পী আবৃত্তিকারদের জন্য ছিলো অস্বস্তিকর ও চরম অবমাননাকর। এক পর্যায়ে ‘প্রবাসী কবিদের কবিতা’ না পড়লে শুক্রবারের পত্রিকায় ছেপে দেয়ার ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে ফেসবুক ষোষণা দেয়া হয়। ভব্যতা জ্ঞানের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে সর্বোচ্চ শোভন সীমাকেও অতিক্রম করা এই হুমকি আবৃত্তিকারদের খুবই মর্মপীড়া দিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও উৎসবে অংশগ্রহণকারী চল্লিশজনের অনেককেই ব্যক্তিগত অনুরোধ জানিয়ে এবং প্রকারান্তরে ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেও বিশেষ কোন ‘প্রবাসী কবিদের’ কবিতা পড়তে আবৃত্তিশিল্পীরা ব্যর্থ হয়েছেন। কবি হিসেবে এটা একজন কবির জন্য কতটুকু সম্মানজনক আর নিউইয়র্কে বসবাসরত অন্যান্য কবিদের জন্য কতটুকুই মর্যাদাপূর্ণ সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তারা খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। কবিরা যদি নিজেরাই নিজেদেরকে ‘লোকাল কবি’, ‘স্থানীয় কবি’, ‘আঞ্চলিক কবি’ সম্বোধনে নিজেদের পরিচয়কে ব্র্যাকেটবন্দি করে কোটাভিত্তিক দাবী আদায়ের প্রশ্নে আন্দোলনে যেতে চান, সেটা আবশ্যই তারা করতেই পারেন। সর্বোপরি একজন কবি তাদের একটি কবিতাকে এই উৎসবে আবৃত্তি করানোর বিভিন্ন প্রস্তাব ও কৌশল ব্যবহার করার পরও এই উৎসবে আবৃত্তিকাররা নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়েই তাদের কবিতাকে নির্বাচন করেছেন। হাজার বছরের বাঙলা কবিতার মধ্য থেকে কিংবা সারা বিশ্বব্যাপী প্রবাসে অবস্থানরত কবিদের মধ্য থেকে খুব স্বাভাবিক কারণেই কোনো বিশেষ কবির কবিতা শক্তিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন আবৃত্তিকাররা। একজন কবির কবিতার নিজস্ব স্বরকে নির্বাচনের জন্য একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় প্রভাবক হিসেবে কবিতার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির ভাষা প্রকরণের সম্বোহনটি অনুভব করে আবৃত্তিকারা। আবৃত্তিকারদের জন্য কবিতার সেই ইনার পোয়েটিক্যাল অবর্জারভেশন ও পারফরমেন্স অবজেক্টটাই মূখ্য, আবৃত্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে এটাই বিবেচিত হয় সর্বাগ্রে, আধুনিক কালের বিজ্ঞ কবিজনেরা নিজ জ্ঞানে স্পষ্টতই জানেন সেকথা। এই ব্যাখ্যার পর আবৃত্তি শিল্পীরা কখন কেন কোথায় কোন কবির কবিতা পড়তে – কি কারণে ব্যর্থ হন, সেটা নিশ্চিই আর বলবার অবকাশও রাখেনা। আর কোনো কবির কোনো কাব্যপ্রতিভার ঔজ্জ্বল্যের চিহ্ন আবিষ্কারে যদি কোনো আবৃত্তিকার অপারগ হন, তাহলে- জনে জনে তাদের প্রত্যকের কাছেই উত্তর খুঁজেতে পারেন নিজেকে বঞ্চিত ভেবেছেন এমন যে কোন কবি। কিন্তু একজন কবি কি একটিবারও ভেবে দেখবেননা- এই নিদারুণ অসহায়ত্ব আর অকারণ নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভেবে এরকম একটি নিলাজ বাসনার কথা মুখে তোলা কতটুকু সমীচীন। কেউ নিশ্চই নিজের অহেতুক কাব্যদৈনতার কথা এভাবে প্রকাশ করেনা। এ উপলব্ধি থাকলে কেউ অনৈতিকতার আশ্রয়ে কদর্য ভাষায় প্রশ্ন করার নামে অসত্যাচারে মেতে উঠেনা কেউ। এবং অমানবিক কুৎসিত ও নিম্নতর রুচীর গালমন্দকে সচিত্রও করে না হয়তো। পাঠক মাত্ররই এই সকল কর্মকান্ডকে নিন্দনীয় ছাড়া অন্য আর কিছু বিকল্প ভাববার অবকাশ আছে কি?
বিবৃতিতে মিথুন আহমেদ বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত হয়েছি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান জাতীয় দৈনিকের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংস্করণটিতে একজনের ফেসবুক মন্তব্য ও তার অশোভন আচরণ কমেন্টসমূহকে পত্রিকাটির ‘নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদন’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে আমার বরাত দিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই পত্রিকার কোনো সংবাদদাতা আমার সঙ্গে উৎসব নিয়ে কোনো কথাই বলেননি।
আমি আহত ও বিস্মিত হয়েছি জেনে, এই জাতীয় দৈনিকটির প্রধান সম্পাদক ও নির্বাহী প্রধান আমার অতি প্রিয় একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব, যিনি গত সাড়ে তিন দশক ধরে পেশাদারিত্বের সুনাম নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে সব সময় সুস্পষ্ট করতে সচেষ্ট। এই মুহুর্তে এবং উৎসব চলাকালীন সময়ে তিনি নিউইয়র্কেই অবস্থান করছেন। আধুনিক সাংবাদিকতা ও এই উৎসবের চেতনা এবং সংস্কৃতি চর্চচার রাজনৈতিক বিশ্বাসের দীর্ঘদিনের সুহৃদ তিনি। সেই আশির দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনেকেই গত প্রায় চার দশক খুব কাছাকাছি থেকে ঘনিষ্ঠতায় নিবিড় বন্ধুত্বে আজো যুক্ত হয়ে আছেন তাঁর সাথে। উৎসব পর্ষদ ও আয়োজকদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের সাথেই তাঁর রয়েছে গত সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পেশাগত সম্পর্কের গভীর সম্পৃক্ততা। একটি ব্যক্তি ঘৃনার নিম্নমানবিকতার কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি-ঈর্ষার ফেসবুক বক্তব্যগুলো নিয়ে সংবাদ মাধ্যম নিজস্ব সংবাদদাতা নামে শিরোনাম করাটা কতটুকু নৈতিক তা আর কেউ না হলেও, তিনি অবগত হলে ততোধিক কষ্টই উপলব্ধি করবেন। এ কথা শুধু বিনয় নিয়েই প্রকাশ করতে চাই যে, আবৃত্তি উৎসব নিয়ে সাংষ্কৃতিক আগ্রাসন ও অভিবাসনের মত গুরুতর অভিযোগ এবং অসত্যভাষণের সংবাদটি মূদ্রণের পূর্বে নিশ্চয়ই আরো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সত্যতা যাচাইয়ের অবকাশ ছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়: উৎসব শুরুর বেশ কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই প্রবাসের অন্যসকল সাংস্কৃতিক কর্মী-কবি-ছড়াকার-লেখকেরা আবৃত্তি উৎসব নিয়ে তাদের উৎসাহ প্রকাশ করে পাশে থেকেছেন। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে চায়ের আড্ডায় কিংবা অন্যত্র কোনো অনুষ্ঠানের বিরতির ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু তাদের কেউই এই উৎসবে তাদেরকে বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্তির কোন অব্যক্ত বাসনার কথা কখনোই প্রকাশ করেননি।
প্রবাস জীবনে গত দুই যুগ ধরে সকল প্রগতিকামী চিন্তা-আন্দোলন-সংগ্রামে যাকে দেখেছি উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা রাখতে এবং যার প্রায় অনেক অবস্থানকেই আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। যার কবিতা আমি আগ্রহভরে নিজ উদ্যোগে কিনে সংগ্রহ করে পাঠ করি এবং আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া সময় পেলে কখনো কখনো তাকে জানানোও সম্ভব হয়। গত চব্বিশ বছরে হয়তো আমাদের বারো বারও মুখোমুখি দেখা হয়নি, কিংবা চব্বিশবারও ফোনে কথা হয়নি, কিন্তু আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি এতোই শ্রদ্ধাশীল চিন্তায় ও চেতনায় যে, সকল সময়ই আদর্শিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তা ঐক্যমত্য প্রকাশ পেয়েছে।
উৎসবের তিন সপ্তাহ আগে তিনি আমাকে ফোনে জানতে চান ‘আবৃত্তি উৎসবে প্রবাসী কবিদের কবিতা আবৃত্তি করা হবে কিনা?’ আমি একই কথা বারবার তাকে জানিয়ে এসেছি, অথচ তিনি আমার নাম উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার বক্তব্যকে আংশিকভাবে প্রকাশ করছেন একাধিকার। আমি বলেছিলাম যে, ‘প্রবাসী বলে কোন বিশেষ বিশেষ কবির আলাদা তালিকা করে আবৃত্তি শিল্পীদের ওপর কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রবাসে বসবাসরত কবিদের ক্ষেত্রে আমাদের কোন বারণ নেই। আমরা বরঞ্চ উৎসাহী। তবে সবচেয়ে সহজ হবে আপনারা যদি আপনাদের কোন পছন্দের আবৃত্তি শিল্পীকে আপনাদের কবিতা পড়তে অনুরোধ করেন। আমাকে জানানোর জন্য ধন্যবাদ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমিও দেখবো কি করা যায়।’
বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমি এই একই কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার উল্লেখ করেছি। আর এই এতকিছুর পরও প্রবাস জীবনে গত দুই যুগ ধরে সকল প্রগতিকামী চিন্তা-আন্দোলন-সংগ্রামে যাকে দেখেছি উৎসাহব্যঞ্জক ভুমিকা রাখতে এবং যার প্রায় অনেক অবস্থানকেই আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, জেনে বিস্মিত হয়েছি- তিনি কি করে এত সহজেই এমন নিষ্ঠুর অবিবেচক হতে পারলেন!
কোন কবির কবিতাকে আবৃত্তি করাতে না পারাকে কেন্দ্র করে একজন তার সকল আক্ষেপ, বিষোদগার, অভিমান ও ভয়াভহ বাক্যবাণ করে সমালোচিত হয়েছেন এবং সবাইকে তাই একটি কথাই বলতে হচ্ছে, ‘একজন কবি তার কবিতা না পড়াতে পারার কারণে তার কছে সকল কিছুই খারাপ, অসফল, ত্রুটিপূর্ণ, কদর্য ও নোংরা ভাষায় গালমন্দ অপবাদ দিয়ে বক্তব্য দিয়ে তিনি তার কবি সত্ত্বাকেই অপমান করছেন। এরকম একটি ভয়াবহ জেদ থেকে তিনি মাতৃ মৃত্যু শিওরে বসেও অক্লান্তভাবে আবৃত্তি শিল্পীদের কদর্য ভাষায় অপমান করে যাচ্ছেন।’
আমার ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তার মত আদর্শিক দর্শনে বিশ্বস্ত, চেতনায় দীপ্ত মানুষটি কী করে এতটা নিষ্ঠুর ও অবিবেচক হতে পারে? আমি আশা করবো বিবেকের বিশুদ্ধ যায়গা থেকে তিনি একদিন ঠিকই তা উপলব্ধি করতে পারবেন, তিনি আজ যা করছেন তা থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শপন্থীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরকম ধ্বংসাত্মক মনোভাব আর ভালো কাজকে আক্রমণ করার প্রবণতা নিজের প্রতি চরম অবহেলা আর অসম্মানকেই ডেকে আনে।
অভিযোগ যদি এইই থাকে এবং এর উত্তরের আশাবাদী হওয়া যায় এভাবে যে, নিউইয়র্কে অবস্থানরত ‘প্রবাসী কবিদের’ কবিতা তাদের নিজ কাব্য প্রতিভার গুণেই, ভালোবেসেই একদিন নিশ্চয়ই আবৃত্তি শিল্পীরা আবৃত্তি করবেন। কার না জানা আছে ভালোবাসা আর প্রতিভা জোর করে প্রতিষ্ঠা করা যায়না। প্রতিভাবান কবি যারা বসবাস করছেন এই শহরে, তাদের কোনো কবিতা কোনো অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হলে এখন থেকে কি একথা একবারের জন্যও শ্রোতা-দর্শকদের মনে প্রশ্ন জাগবেনা যে, তাদের কবিতাগুলো পাঠের জন্য বিশেষ কোন চাপ, প্রভাব, ভীতি দেখানো হয়েছে কিনা? তাতে করে তো ক্ষতি হবে প্রতিভাবান কবিদেরই, তদের কাব্য প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেবে। আর দিনে দিনে তারা কেবলই স্থানীয় ও আঞ্চলিকতায় পরিণত হতে থাকবেন। আর এই সুযোগে অমেধাবী অপ্রতিভাবান প্রাক শিক্ষিতরাই মেধাবী কবিদের কাতারে আসতে চাইবে। সেটা নিশ্চই কবিতা আর শক্তিমান মৌলিক কবিদের জন্য সুখকর সংবাদ নয়!
বিবৃতিতে তিনি বলেন, একজন কবির কাজ হলো আরো বেশি ভালো কবিতা লিখে পাঠকের মন জয় করা। স্বার্থান্বেষণ, পরনিন্দা, অতিমাত্রায় প্রচারমুখীনতা কবি খ্যাতিকেই কেবল ম্লান করে। ব্যর্থতার দায়কে প্রতিশোধপরায়নতা, অভিমান, হিংসা আর ক্রোধ দিয়ে ঢাকা যায় না। আর তারই বশবর্তী হয়ে কাব্যের আয়োজনকে অসত্যভাষণে হেয় করা অন্তত কবিকে মানায় না।
‘এক পৃথিবী লিখবে বলে- এমন এক কবির জন্য আমরা থাকি এই শহরে’। কবিতার জয় হোক। কবিকে প্রণতি। কবিদের মঙ্গল শুভাশিস।
‘বিবেকের বন্ধ দরজায়, শব্দের হাতুড়িকে আজ হানো
বোধের বিশ্বাসে, ভাবনাকে মজবুত করে
ভাবো, আরো বেশী করে ভাবো’।