নিউইয়র্ক ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা : ‘ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধে মওলানা ভাসানীর মতো নেতা প্রয়োজন’

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:০২:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৭
  • / ৯৯৯ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্কে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘হুজুর ভাসানী’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনেক বড় মাপের নেতা। তিনি নিজে নিজে নেতা হননি। জনগণই তাকে নেতা বানিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর বাংলাদেশেরই নেতা ছিলেন না, ছিলেন আফ্রো-এশিয়ার সকল মানুষের নেতা। ছিলেন অবিংসবাদিত নেতা, ইতিহাসের মহান নেতা। ছিলেন নেতাদের নেতা। বক্তারা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ‘বন্ধু প্রতীম ভারত’ যেভাবে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন চালাচ্ছে তা প্রতিরোধে মওলানা ভাসানীর মতো নেতা প্রয়োজন। আর এই আগ্রাসন চলতে থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কিনা তাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফাউন্ডেশন নিউইয়র্ক, ইউএসএ আয়োজিত সম্মেলনের আয়োজন করে। সিটির জ্যাকসন হাইটস্থ পিএস-৬৯ মিলনায়তনে গত ১৯ নভেম্বর রোববার অপরাহ্নে আয়োজিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ টিপু সুলতান। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মওলানা ভাসানীর উপর এম. ফিল এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডিধারী ড. লেইলি উদ্দিন (লন্ডন)। সম্মেলনে কী নোট স্পীকার ছিলেন মওলানা ভাসানীর উপর পিএইচডিধারী কানাডার ডাউসন কলেজের অধ্যাপক ড. আবিদ বাহার। এছাড়াও প্যানেল স্পিকার ছিলেন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. গুলশান আরা, ড. মাহফুজুর রহমান ও ড. দেলোয়ার হোসেন। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর উপর ডকুমেন্টরি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। উল্লেখ্য, এবারের সম্মেলন ছিলো ভাসানী ফাউন্ডেশনের চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। খবর ইউএনএ’র।

ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী ইমামের উপস্থাপনায় সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান ও ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু, ভাসানী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক দেওয়ান সামসুল আরেফীন, ফাউন্ডেশনের সহ সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের, সাপ্তাহিক ঠিকানা’র প্রেসিডেন্ট ও সিওও সাঈদ-উর রব, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, বাংলাদেশ সোসাইটির’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন খান,অ্যাটর্নী শান্তলী হক, ইউএনডিপি-তে কর্মরত কাজী আফজালুর রহমান, বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রনালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব রশিদ খান, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য কে এম এস এ কায়সার, ডা. সাইদুর রহমান, ডা. হাসান সারওয়ার, ডা. এম ডি আক্তার হোসেইন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট কাজী বেলাল।
এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাষ্টিবোর্ড সদস্য কাজী আজহারুল হক মিলন ও অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সোসাইটর সহ সভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী, সাংবাদিক ইমরান আনসারী, অ্যাডভোকেট মুনির হোসেন, মানবাধিক সংগঠন ড্রাম-এর অর্গানাইজিং পরিচালক কাজী ফৌজিয়া, সাবেক ছাত্রনেতা কাজী মোস্তফা ফরিদ প্রমুখ।

সম্মেলনের শুরুতে মওলানা ভাসানীর বিদেহী আতœার শান্তি কামনা করে বিশেষ দোয়া করা হয়। দোয়া পরিচারণা করেন কাজী আজহারুল হক মিলন। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর উপর লিখিত কবিতা আবৃত্তি করেন লুবনা কাইজার ও কাজী ফৌজিয়া। সম্মেলনে ড. লেইলি উদ্দিন ও ড. আবিদ বাহারকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এছাড়া ‘ভাসানী’ বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। এটি সম্পাদনা করেন সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মওলানা ভাসানী প্রকৃত অর্থে চিনতে আর জানতে হলে তাঁর উপর পড়াশুনা করা দরকার। তাকে নিয়ে আরো গবেষণা দরকার। আর সেই কাজটি না করে অনেকেই তাঁর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করছেন। কেউ কেউ ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। যা দু:খজনক। বক্তারা বলেন, দেশ ও প্রবাসের সকলের কাছে মাওলানা ভাসানীকে তুলে ধরার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছেও তাঁকে তুলে ধরতে হবে।

ড. লেইলি উদ্দিন মওলানা ভাসানীর উপর তার গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেন, আমি মওলানা ভাসানীর উপর ৯ বছর ধরে গবেষণা করেছি। এজন্য আমি একাধিকবার লন্ডন থেকে বাংলাদেশের ঢাকা ও টাঙ্গাইল এবং ভারতের আসাম সহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছে। মওলানাকে জানার চেষ্টা করেছি, তাকে নিয়ে, তার কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছি। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমি মওলানা ভাসানীকে জানতে চেয়েছি। তিনি বিশাল মনের মানুষ ছিলেন। তাকে আমি নতুন প্রজন্মের মাঝে পাইনি, কিন্তু মানুষের ঘরে ঘরে পেয়েছি। মওলানা ভাসানী শুধু রাজনীতি করেননি, তিনি ইমামতি করেছেন, দোয়া করেছেন, কবিতা লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, সংসারও করেছেন। মওলানার একটি কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। সেই কবিতার জন্য তিনি আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি মওলানার ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন ও ফারাক্কা লং মার্চ-এর কথা তুলে ধরে বলেন, মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশেও মানুষের অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি আর গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি কখনো ক্ষমতার রাজনীতি নয়, সবসময় জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছেন।
তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনেক বড় মাপের নেতা। তিনি নিজে নিজে নেতা হননি। জনগণই তাকে নেতা বানিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি সাধারণ জীবন-যাপন করলেও নেতা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর আদর্শ বাস্তায়ন হলে বাংলাদেশ সহ বিশ্বে এতো অশান্তি হতো না। ড. লেইল তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি জাতীয় নেতাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন।

ড. আবিদ বাহার বলেন, মওলানা ভাসানী এতো শক্তিশালী নেতা ছিলেন যে তাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা পর্যন্ত ভয় পেতো। মওলানার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। মওলানা বলেছিলেন- ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। তাঁর হুমকীর কারনেই সামরিক জান্তারা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি কখনো ক্ষমতার রাজনীতি করতেন না। সারাজীবন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ আর পরিবেশ বাঁচাতে ফারাক্কা লং মার্চ করেছেন। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অথচ আজ ভারতে বিমাতা সূলভ আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। অথচ দেশের জনগণ চান আর নাই চান ক্ষমতাসীনরা উল্টো ভারতকে তোয়াজ করে ক্ষমতায় থাকতেই ব্যস্ত। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ভারতকে খুশি করতে যদি ভারতীয় পতাকা দিয়ে শাড়ী বানিয়ে পড়তে হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়? অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশের পাশের ছোট দেশ কিউবা তাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর আতœমর্যাদা রক্ষা করে আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে চলছে।
ড. আবিদ বাহার বলেন, বাংলাদেশে আজ কি হচ্ছে? রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন মায়ানমানের বিরুদ্ধে সরকার কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না? অথচ জিয়া সরকারের সময় মায়ানমার ভয়ে চুপসে থাকতো। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমানই নন, তাদের মধ্যে হিন্দুও আছে। মায়ানমার পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, আজ মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতেন, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতেন।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, মওলানা ভাসানীর কাছে আমরা সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞ। কেননা, তিনি সিলেটকে বাংলাদেশের সাথে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন।
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সকল মানুষের পথ প্রদর্শক। নেতাদের নেতা। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। ইতিহাসের পাতায় তাঁকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে।
দেওয়ান সামসুল আরেফীন বলেন, মওলানা ভাসানী আরো গভীরভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। তাঁকে নিয়ে আরো গবেষণা দরকার। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে।
মঈনুদ্দীন নাসের বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন আস্থা আর নির্ভরতার নেতা। আজকের বাংলাদেশে ভাসানীর মতো নেতা দরকার। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতিকরা নষ্ট হয়ে গেছে, সেনাবাহিনীর শক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আজ বাংলাদেশকে মাথা উচু করে দাঁড়তে দেয়া হচ্ছে না। অথচ মওলানা ভাসানী সব সময় মাথা উচু করে রাজনীতি করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলেই তার সময় মিয়ানমারকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের দেয়া মানচিত্র পুনর্বহালের দাবী তুলে বলেন, সেই মানচিত্রে আরাকান ও ইয়োমা আমাদের ছিলো।
সাঈদ-উর রব বলেন, মওলানা ভাসানী অসাধারণ মানুষ হয়েও সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন। তিনি বলেন, আজো আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি, গণতন্ত্র পাইনি, আইনের শাসন পাইনি, অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। এজন্য আমরাই দায়ী। কারণ আমরা অযোগ্যদের নেতা বানিয়েছি। নিজেদের বিবেক, স্বাধীনতা বন্ধক রেখেছি। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
ডা. ওয়াজেদ এ খান বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। অথচ তার মূল্যায়ন নেই। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৃটিশ, ভারত, পাকিস্তান এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও কারাবরণ করেছেন। মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখতেন তা আজো বাস্তবায়িত হয়নি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা : ‘ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধে মওলানা ভাসানীর মতো নেতা প্রয়োজন’

প্রকাশের সময় : ০৮:০২:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

নিউইয়র্ক: স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্কে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘হুজুর ভাসানী’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনেক বড় মাপের নেতা। তিনি নিজে নিজে নেতা হননি। জনগণই তাকে নেতা বানিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর বাংলাদেশেরই নেতা ছিলেন না, ছিলেন আফ্রো-এশিয়ার সকল মানুষের নেতা। ছিলেন অবিংসবাদিত নেতা, ইতিহাসের মহান নেতা। ছিলেন নেতাদের নেতা। বক্তারা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ‘বন্ধু প্রতীম ভারত’ যেভাবে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন চালাচ্ছে তা প্রতিরোধে মওলানা ভাসানীর মতো নেতা প্রয়োজন। আর এই আগ্রাসন চলতে থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কিনা তাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফাউন্ডেশন নিউইয়র্ক, ইউএসএ আয়োজিত সম্মেলনের আয়োজন করে। সিটির জ্যাকসন হাইটস্থ পিএস-৬৯ মিলনায়তনে গত ১৯ নভেম্বর রোববার অপরাহ্নে আয়োজিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ টিপু সুলতান। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মওলানা ভাসানীর উপর এম. ফিল এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডিধারী ড. লেইলি উদ্দিন (লন্ডন)। সম্মেলনে কী নোট স্পীকার ছিলেন মওলানা ভাসানীর উপর পিএইচডিধারী কানাডার ডাউসন কলেজের অধ্যাপক ড. আবিদ বাহার। এছাড়াও প্যানেল স্পিকার ছিলেন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. গুলশান আরা, ড. মাহফুজুর রহমান ও ড. দেলোয়ার হোসেন। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর উপর ডকুমেন্টরি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। উল্লেখ্য, এবারের সম্মেলন ছিলো ভাসানী ফাউন্ডেশনের চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। খবর ইউএনএ’র।

ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী ইমামের উপস্থাপনায় সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান ও ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু, ভাসানী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক দেওয়ান সামসুল আরেফীন, ফাউন্ডেশনের সহ সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের, সাপ্তাহিক ঠিকানা’র প্রেসিডেন্ট ও সিওও সাঈদ-উর রব, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, বাংলাদেশ সোসাইটির’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন খান,অ্যাটর্নী শান্তলী হক, ইউএনডিপি-তে কর্মরত কাজী আফজালুর রহমান, বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রনালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব রশিদ খান, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য কে এম এস এ কায়সার, ডা. সাইদুর রহমান, ডা. হাসান সারওয়ার, ডা. এম ডি আক্তার হোসেইন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট কাজী বেলাল।
এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাষ্টিবোর্ড সদস্য কাজী আজহারুল হক মিলন ও অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সোসাইটর সহ সভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী, সাংবাদিক ইমরান আনসারী, অ্যাডভোকেট মুনির হোসেন, মানবাধিক সংগঠন ড্রাম-এর অর্গানাইজিং পরিচালক কাজী ফৌজিয়া, সাবেক ছাত্রনেতা কাজী মোস্তফা ফরিদ প্রমুখ।

সম্মেলনের শুরুতে মওলানা ভাসানীর বিদেহী আতœার শান্তি কামনা করে বিশেষ দোয়া করা হয়। দোয়া পরিচারণা করেন কাজী আজহারুল হক মিলন। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর উপর লিখিত কবিতা আবৃত্তি করেন লুবনা কাইজার ও কাজী ফৌজিয়া। সম্মেলনে ড. লেইলি উদ্দিন ও ড. আবিদ বাহারকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এছাড়া ‘ভাসানী’ বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। এটি সম্পাদনা করেন সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মওলানা ভাসানী প্রকৃত অর্থে চিনতে আর জানতে হলে তাঁর উপর পড়াশুনা করা দরকার। তাকে নিয়ে আরো গবেষণা দরকার। আর সেই কাজটি না করে অনেকেই তাঁর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করছেন। কেউ কেউ ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। যা দু:খজনক। বক্তারা বলেন, দেশ ও প্রবাসের সকলের কাছে মাওলানা ভাসানীকে তুলে ধরার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছেও তাঁকে তুলে ধরতে হবে।

ড. লেইলি উদ্দিন মওলানা ভাসানীর উপর তার গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেন, আমি মওলানা ভাসানীর উপর ৯ বছর ধরে গবেষণা করেছি। এজন্য আমি একাধিকবার লন্ডন থেকে বাংলাদেশের ঢাকা ও টাঙ্গাইল এবং ভারতের আসাম সহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছে। মওলানাকে জানার চেষ্টা করেছি, তাকে নিয়ে, তার কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছি। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমি মওলানা ভাসানীকে জানতে চেয়েছি। তিনি বিশাল মনের মানুষ ছিলেন। তাকে আমি নতুন প্রজন্মের মাঝে পাইনি, কিন্তু মানুষের ঘরে ঘরে পেয়েছি। মওলানা ভাসানী শুধু রাজনীতি করেননি, তিনি ইমামতি করেছেন, দোয়া করেছেন, কবিতা লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, সংসারও করেছেন। মওলানার একটি কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। সেই কবিতার জন্য তিনি আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি মওলানার ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন ও ফারাক্কা লং মার্চ-এর কথা তুলে ধরে বলেন, মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশেও মানুষের অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি আর গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি কখনো ক্ষমতার রাজনীতি নয়, সবসময় জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছেন।
তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনেক বড় মাপের নেতা। তিনি নিজে নিজে নেতা হননি। জনগণই তাকে নেতা বানিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি সাধারণ জীবন-যাপন করলেও নেতা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর আদর্শ বাস্তায়ন হলে বাংলাদেশ সহ বিশ্বে এতো অশান্তি হতো না। ড. লেইল তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি জাতীয় নেতাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন।

ড. আবিদ বাহার বলেন, মওলানা ভাসানী এতো শক্তিশালী নেতা ছিলেন যে তাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা পর্যন্ত ভয় পেতো। মওলানার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। মওলানা বলেছিলেন- ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। তাঁর হুমকীর কারনেই সামরিক জান্তারা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি কখনো ক্ষমতার রাজনীতি করতেন না। সারাজীবন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ আর পরিবেশ বাঁচাতে ফারাক্কা লং মার্চ করেছেন। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অথচ আজ ভারতে বিমাতা সূলভ আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। অথচ দেশের জনগণ চান আর নাই চান ক্ষমতাসীনরা উল্টো ভারতকে তোয়াজ করে ক্ষমতায় থাকতেই ব্যস্ত। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ভারতকে খুশি করতে যদি ভারতীয় পতাকা দিয়ে শাড়ী বানিয়ে পড়তে হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়? অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশের পাশের ছোট দেশ কিউবা তাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর আতœমর্যাদা রক্ষা করে আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে চলছে।
ড. আবিদ বাহার বলেন, বাংলাদেশে আজ কি হচ্ছে? রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন মায়ানমানের বিরুদ্ধে সরকার কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না? অথচ জিয়া সরকারের সময় মায়ানমার ভয়ে চুপসে থাকতো। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমানই নন, তাদের মধ্যে হিন্দুও আছে। মায়ানমার পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, আজ মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতেন, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতেন।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, মওলানা ভাসানীর কাছে আমরা সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞ। কেননা, তিনি সিলেটকে বাংলাদেশের সাথে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন।
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সকল মানুষের পথ প্রদর্শক। নেতাদের নেতা। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। ইতিহাসের পাতায় তাঁকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে।
দেওয়ান সামসুল আরেফীন বলেন, মওলানা ভাসানী আরো গভীরভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। তাঁকে নিয়ে আরো গবেষণা দরকার। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে।
মঈনুদ্দীন নাসের বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন আস্থা আর নির্ভরতার নেতা। আজকের বাংলাদেশে ভাসানীর মতো নেতা দরকার। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতিকরা নষ্ট হয়ে গেছে, সেনাবাহিনীর শক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আজ বাংলাদেশকে মাথা উচু করে দাঁড়তে দেয়া হচ্ছে না। অথচ মওলানা ভাসানী সব সময় মাথা উচু করে রাজনীতি করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলেই তার সময় মিয়ানমারকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের দেয়া মানচিত্র পুনর্বহালের দাবী তুলে বলেন, সেই মানচিত্রে আরাকান ও ইয়োমা আমাদের ছিলো।
সাঈদ-উর রব বলেন, মওলানা ভাসানী অসাধারণ মানুষ হয়েও সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন। তিনি বলেন, আজো আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি, গণতন্ত্র পাইনি, আইনের শাসন পাইনি, অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। এজন্য আমরাই দায়ী। কারণ আমরা অযোগ্যদের নেতা বানিয়েছি। নিজেদের বিবেক, স্বাধীনতা বন্ধক রেখেছি। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
ডা. ওয়াজেদ এ খান বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। অথচ তার মূল্যায়ন নেই। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৃটিশ, ভারত, পাকিস্তান এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও কারাবরণ করেছেন। মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখতেন তা আজো বাস্তবায়িত হয়নি।