মওলানা ভাসানীর আদর্শের চেতনায় ভারত-বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ

- প্রকাশের সময় : ১০:২৫:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ মে ২০১৭
- / ৬৯৫ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস স্মরণে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হাদি খান ভাসানীর আদর্শের চেতনায় ভারত-বাংলাদেশের পানি সমস্যার সামাধান সহ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথ ধরেই শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সাথে পানি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। সরকারের এই প্রচেষ্টাকে আরো জোরদার করতে দেশ ও প্রবাসে জনসচেতনতা দরকার। জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রয়োজন বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করা। বক্তারা বলেন, শেখ মুজিব সরকারের পর জিয়াউর রহমান সরকার দেশের পানি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করলেও পরবর্তী সরকারগুলো এব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ না নেয়ায় সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য মহা সংকটে পরিণত হতে চলেছে। বক্তারা ‘বিশ্ব পানি সম্মেলন’-এর মাধ্যমে দেশ দুটির পানি সমস্যার সমাধানের জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, আজ থেকে ৪১ বছর আগের ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ’ অভিমুখে হাজার হাজার মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। দিবসটি স্মরণে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফাউন্ডেশন, নিউইয়র্ক, ইউএসএ এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এদিন (১৬ মে মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ টিপু সুলতান এবং সভা পরিচালনা করেন ফাউন্ডেশনের সিনিয়র সহ সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের। খবর ইউএনএ’র।
‘সময়ের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা লং মার্চ-এর তাৎপর্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি (আইএফসি)-এর চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক ড. মাহবুব হাসান, সন্তোষ ভাসানী কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল আফসার উদ্দিন, এম এ সিদ্দিক পল্লব, আইএফসি’র ভাইস চেয়ারম্যান আজহারুল হক মিলন, অ্যাডভোকেট মনির হোসেন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট কিউ জামান, আব্দুর রাজ্জাক, মানবাধিকার কর্মী কাজী ফৌজিয়া প্রমুখ। সভায় নদীর উপর নিজের লেখা কয়েকটি ছড়া পাঠ করেন ছড়াকার শাহ আলম দুলাল।
সভায় বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্ক’র সাবেক সভাপতি আওলাদ হোসেন খান, বর্তমান সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুর রহীম হাওলাদার, ওয়েব পোর্টাল হককথা.কম ও নিউইয়র্ক ভিত্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ’র সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ, সোসাইটির স্কুল ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আহসান হাবিব, আওয়ামী লীগ নেত্রী শাহানারা রহমান, যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি দরুদ মিয়া রনেল প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে মঈনুদ্দীন নাসের তার স্বাগত বক্তব্যে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের সাথে ভারতের গঙ্গা চুক্তি হয়। পরবতর্তীতে শেখ মুজিব সরকারের সময় গঙ্গা চুক্তি হলেও জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় থেকে পরবর্তীতে এই চুক্তির বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় এই চুক্তির কোন কার্যকররীতা নেই বলে বাংলাদেশ ভারত থেকে ন্যায্য পানি পাচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধির কোন লক্ষণ নেই, যা চুক্তির লংঘন। ফারাক্কার মতো তিস্তাও বাংলাদেশের মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হলেও অনেক দিন ধরে এই কমিশনের সভা হচ্ছে না, অনেক আগে থেকেই নদী কমিশনের কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, গঙ্গার পাড় ঘেষে ভারতে ৭০০ ট্যানারী শিল্প আর ১০০০ টয়লেট গড়ে উঠেছে। যার বর্জ্য গঙ্গাকে দুষিত কওে চলেছে। ফলে গঙ্গা এখন আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, ভারতের ক্ষমতাসীন মোদী সরকার গঙ্গা রক্ষায় ‘গঙ্গা বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছে।
ফারাক্কা আর তিস্তা সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করে এই সমস্যার সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, একটি জাতির মেরুদন্ডকে জাগিয়ে তোলার প্রতীক হিসেকে হুজুর ভাসানীর ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ আমাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। জাতির অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশের পানি সমস্যার কথা বুঝেছিলেন বলেই মৃত্যুর আগেই মওলানা ভাসানী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের পানি সমস্যার ব্যাপারে শেখ হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সহ সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী মরহুম আব্দুর রাজ্জাক-এর কর্মকান্ডের প্রশংসা করে বলেন, পানি সমস্যার সমাধানের জন্য উজানের দেশ হিসেবে ভারত যা করছে তা সঠিক করছে না। তিস্তার পানি আমাদের পেতেই হবে, এই পানি আমাদের অধিকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পানি বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সদস্য। সামনে আমাদের সুযোগ রয়েছে। তাই এখনই সুযোগ জাতিসংঘের মাধ্যমে পানি সমস্যার সমাধান করার। এজন্য তিনি বিশ্ব পানি সম্মেলন আয়োজন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পানি সমস্যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চীন বসে আছে। তিনি বলেন, নদী-পানির আন্দোলন চলছে, চলবেই।
ড. সিদ্দিকুর রহমান ভারত সরকারকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, পানি আমাদের অধিকার, আমাদের যেটুকু পানি দরকার তা দিতে হবে। তিনি পানি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে দল-মতের উর্ধ্বে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জনগণের সরকার। সরকার জনগণের দাবী এগিয়ে নিয়ে যাবে। সরকার দেশের জনগণের সাথে আছে এবং থাকবে।
আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান আর নদী মাতৃক দেশ। পানি-নদী ছাড়া বাংলাদেশ বাঁচবে না। তিনি বলেন, ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরেই ভারতের পানি চুক্তি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরেই শেখ হাসিনা সরকার পানি সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের সময়মত উদ্যোগের ফলে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে আমরা সমুদ্র বিজয় করেছি। তিনি বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে দেশের সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। ইনশা আল্লাহ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই পানি সমস্যারও সমাধান হবে। এজন্য দেশের জনগণকে ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে হবে। তিনি প্রবাস থেকে টীম গঠনের মাধ্যমে পানি সমস্যার ব্যাপারে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন।
ড. মাহবুব হাসান বলেন, পৃথিবীর সকল সভ্যতার গোড়া হচ্ছে নদ-নদী। নদ-নদী না থাকলে দেশ বর্জ্যে পরিণত হবে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাকে আমরাই ধ্বংস করছি। তিনি বলেন, বক্তৃতাবাজী না করে কাজ দিয়েই সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হবে। মওলানা ভাসানী দূরদর্শী নেতা ছিলেন বলেই ফারাক্কা মিছিরের ডাক দিয়েছিলেন। ফারাক্কা আর তিস্তা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সরকারের বৈঠকের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, দেশের নদ-নদী না বাঁচিয়ে বড় বড় অট্টালিকা, ভবন আর ফ্লাইওভার নির্মাণ করে লাভ নেই। এখন দরকার নদী খনন আর আরেকটা ‘ফারাক্কা লং মার্চ’।
প্রিন্সিপ্যাল আফসার উদ্দিন বলেন, মওলানা ভাসানী শুধুই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি আধ্যাত্বিক ব্যক্তিও ছিলেন। আজকের মতো ১৯৭৬ সালে পানি সমস্যা ছিলো না। কিন্তু মওলানা ভাসানী বুঝতে পেিেছলেন বলেই পানির চরম সঙ্কটের আগেই ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ করেছিলেন। ফারাক্কা দিবস স্মরণ করে আমাদেরকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পানি সমস্যার ব্যাপারে জাগরণ তুলতে হবে।
কাজী ফৌজিয়া তার বক্তব্যে মওলানা ভাসানী, ফারাক্কা মিছিল সহ জাতির সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম সহ বিশ্ববাসীকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাপী আগামী দিনের যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। তাই যেকোন মূল্যে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মওলানা ভাসানীর পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি ২০২৬ সালে ‘ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল’-এর ৫০ বছর পূর্তি পালন করার জন্য এখন থেকেই উদ্যোগ নেয়ার জন্য ভাসানী ফাউন্ডেশনের প্রতি আহ্বান জানান।
সভায় অন্যান্য বক্তারা বলেন, ভারত-বাংলাদেশের পানি সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা। মুজিব-জিয়ার সরকারের পর ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে পরবর্তী সরকারগুলোর আর কোন ফলোআপ নেই। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে নিয়ে জাতীয়ভাবে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। ফলে এসব সুযোগে ভারত ফাঁকা মাঠে গোল দিচ্ছে। বক্তারা বলেন, ফারাক্কা আর তিস্তা সমস্যার সমাধান না হলে আগামী ২/১ দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ-এর ভৌগলিক ইতিহাস বদলে যাবে। তাই ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হওয়ার সময়।
সৈয়দ টিপু সুলতান মওলানা ভাসানীকে একজন মহামানব হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রাণ পূরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। ছিলেন অসম্ভব মেধা, প্রজ্ঞা সম্পন্ন মানুষ। তিনি মানুষের জন্য জেল-জুলুমস খেটেছেন, ফারাক্কা মিছিল করেছেন। তার চিন্তা-চেতনাকে লালন-পালন করেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্খলন চলছে বলেই আমরা দেশের পানি সমস্যার ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারছি না। আর জাতীয় ঐক্য ছাড়া পানি সমস্যার সমাধান হবে না।
সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকালীন সময় পানি সমস্যার ব্যাপারে তার উদ্যোগের জন্য তাকে অভিনন্দন জানানো হয়।