স্মরণ : সর্বদা সরব যে কবি
- প্রকাশের সময় : ১২:৫১:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগাস্ট ২০২০
- / ১০৮ বার পঠিত
সৌমিত্র শেখর: কাজী নজরুল ইসলামের একটি চিরচেনা গান : ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি—।’ এই গানে বলা হয়েছে, যে গেছে তাকে ভুলে যাও; দাঁড়ায়ে যে সম্মুখে তাকে গ্রহণ করো, নীরব থেকো না। বাঙালীর সামনে নজরুল সর্বদাই দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর চলে যাওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। তাই বাঙালীর জীবনযাপনের জলসায় তিনি সদা সরব!
আজ বাঙালীর আত্মপরিচয়জ্ঞাপক ¯েøাগানে পরিণত হয়েছে ‘জয় বাংলা’। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করে এই ¯েøাগানটি। ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিগত শতকের ছয়ের দশকে পরিচালিত বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই ¯েøাগান যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। কাজী নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ১৯৪২ সালেই লেখেন ‘বাঙলার জয় হোক’ আর বঙ্গবন্ধু গত ছয়ের দশকে এবং ১৯৭১-এর সাতই মার্চ গগনবিদারী ¯েøাগান তোলেন- ‘জয় বাংলা’। এ যেন চেতনার ক্রমধারাবাহিকতা মাত্র! তবে এ কথাও সত্য, বাঙালীর ‘প্রকৃত নেতা’র অভাব বোধ করেছিলেন নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুই কি নজরুলের সেই স্বপ্নপুরুষ?
নজরুল প্রাজ্ঞ ও দিব্যজ্ঞানীর মতো কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন ১৯৪২ সালেই এবং দিশা দিয়েছেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতা, শুধু ভারতের স্বাধীনতাই নয়, ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাংলার স্বাধীনতাও। যে সময় ভারতের স্বাধীনতার জন্যই সবাই ভাবিত, সে সময় বাংলার মুক্তির কথাও ভেবেছিলেন নজরুল। বিস্ফোরক বাক্য দিয়ে তিনি বলেছেন : “বাঙালী যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালীর বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।” এখানে তিনি তিনটি কথা বললেন :
ক. বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে;
খ. একটি সপ্রতিজ্ঞ বীজমন্ত্র নিতে হবে এবং সেটি ‘বাঙলীর বাঙলা’;
গ. তারা ‘অসাধ্য’ সাধন করতে পারবে।
এর পরই কিন্তু নজরুল পরিষ্কার করে দেন, কী সেই ‘অসাধ্য’। তিনি বলেন, ‘বাঙালী একাই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।’- এই বক্তব্যটি কোনো সাধারণ বাক্য বা অতি-আবেগী ভাষ্য নয়। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলার যে অবদান তার প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি এবং প্রকৃত স্বীকৃতি আজও আসেনি। যদি আসত, তাহলে বাঙালীর আসন উঠে যেত আরো ওপরে। বাংলা থেকে যেমন ব্রিটিশরা তাদের শাসনরথ পরিচালনা আরম্ভ করেছিল, এই বাংলায় তারা প্রতিরোধের মুখেও পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। অগ্নিযুগে হাজার হাজার বাঙালী যুবক-যুবতি ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ বহু নেতার দূরদর্শিতায় ব্রিটিশদের বারবার পড়তে হয়েছে সংকটে। তাই বিপ্লবকেন্দ্র বাংলা থেকে ১৯১১ সালে ব্রিটিশরা ভারতের রাজধানী নিরুপদ্রব দিল্লিতে স্থানান্তর করে।
এসব পর্যালোচনা করেই নজরুল বলেছিলেন, ভারতকে স্বাধীন করার শক্তি বাঙালীর রয়েছে। তবে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না তাদের কর্মকান্ড। তিনি বাঙালীর গুণাবলি পর্যালোচনা করে বলেছেন, বাঙালীর আছে জ্ঞানশক্তি আর প্রেমশক্তি; তবে কর্মশক্তির অভাব বর্তমান। কর্মশক্তির অভাবহেতু বাঙালীর এই দুই শক্তি-জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তি সেভাবে কাজ করে না। এই কর্মবিমুখতার কারণে বাঙালী ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে আছে; আলস্যে নিদ্রাগমন ভালোবাসে; মৃত্যুভয়ে ভীত থাকে। এটিকে নজরুল বলেছেন, তামসিকতা বা অন্ধকারাচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে সেই জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তিকে হারিয়ে ফেলা। এখানে নজরুল দিব্যজ্ঞানীর মতো বাণী উচ্চারণ করেছেন : ‘এই তম, এই তিমির, এই জড়ত্বই অবিদ্যা।’ ‘অবিদ্যা’ কী করে? অবিদ্যা মানুষকে অন্ধকার পথে, ভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়, আর তার মধ্যে যে তীব্রশক্তি উৎপন্নের সম্ভাবনা, সেটিকে বিনাশ করে। মানুষের মধ্যে সাধুগুণকে বিঘœ ঘটায় এই অবিদ্যা। এতে মনুষ্যত্বের মৃত্যুও ঘটে; অমৃতের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই ‘তম’কে- যা কি না মানুষের ‘অবিদ্যা’র উৎপাদক এবং যে অবিদ্যা থেকে এত ক্ষতি ঘটে যায়- নজরুল বলেছেন, সেই ‘তম’কে শাসন করতে পারে ‘রজগুণ’। ‘রজগুণ’ কী? ‘রজঃ’ অর্থ যদিও অহংকার কিন্তু এখানে নজরুল ‘রজগুণ’ অর্থে রাজসিক গুণের কথাই বলেছেন এবং তা হলো অধিকার প্রতিষ্ঠা অর্থে। রজগুণের অধিকারীরা নিজেদের রাজ্যাধিকার বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠা করে চলে। এই রজগুণটি বাঙালীর খুবই প্রয়োজন বলে নজরুল মনে করেছেন। এই ‘রজগুণ’কে তিনি ‘ক্ষাত্রশক্তি’ বলে উল্লেখ করেন। নজরুল বাঙালীর ক্ষাত্রশক্তি জাগরণের কথা বলেছেন বারবার। নজরুল লক্ষ করেছেন, বাঙালীর জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তি আছে। তাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় অনেক কার্যকর, কিন্তু দেহ পাষাণময়। আলস্যের কারণে তারা বিচ্ছিন্ন ও ঘরকুনো। এই পাষাণপ্রতিমাকে সংঘবদ্ধ হয়ে কার্যকরণের কথা বলেছেন নজরুল।
নজরুল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে থাকা ঐশ্বর্য ও সম্ভাবনার কথাও উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর দুঃখ, যে বাঙালী পৃথিবীর অন্যান্য জাতিকে একসময় সমাদর করেছে, সেই বাঙালী জাতি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে দীন জাতিতে। বিদেশি দস্যু ও বণিকরা বাঙালীকে শোষণ করে দিনের পর দিন আর বাঙালী জাতি হীনবল হয়ে ঘরে বসে থাকে- এটি নজরুল মানতে পারছিলেন না। তিনি তাই ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন : ‘বাঙালী সৈনিক হতে পারলো না। ক্ষাত্রশক্তিকে অবহেলা করলো বলে তার এই দুর্গতি তার অভিশপ্তের জীবন।’ বাঙালীর মাঠের ধান পাট রবি ফসল তার সোনা-তামা-লোহা-কয়লা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লুট হয়ে যায়। কাজী নজরুল ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাঙালীর ‘সর্ব ঐশ্বর্য বিদেশি দস্যু বাটপাড়ি করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়’, কিন্তু বাঙালী বসে বসে দেখে। এই পর্যবেক্ষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানেই নজরুল শেষ করেননি। তিনি ক্ষোভ নিয়ে লক্ষ করেছেন, বাঙালীর এই ঐশ্বর্য লুটেরাদের, দস্যুদের বিরুদ্ধে ‘খবরদার’ বলার ক্ষমতা বাঙালীর নেই। অর্থাৎ তিনি চেয়েছেন বাঙালীর এমন নেতৃত্ব, যেখান থেকে এই দস্যু ও অপশক্তিকে প্রতিরোধ করার ডাক আসবে, এসব সংহার করার আহবান ঘোষিত হবে।
নজরুল তো সর্বাংশে কবি; তিনি তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা নন! তার পরও তিনি আহবান জানিয়ে গেছেন: বাঙালীসমাজ, বিশেষ করে তরুণসমাজকে তিনি ডাক দিয়ে গেছেন এই বলে- বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে হবে বাংলাদেশ তাদের; বাংলায় ভিনদেশি ও ভিনজাতি যে শোষণের যন্ত্র নির্মাণ করেছে তা ধ্বংস করতে হবে। সব শেষে তিনি উচ্চারণ করেছেন : ‘বাঙলা বাঙালীর হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালীর জয় হোক।’ এখানেই কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ও বাঙালীর নেতৃত্ব জাগরণের প্রত্যাশা করেন ও জয়ধ্বনি ঘোষণা করেন। এর আগে ‘বাংলা’ ও ‘জয়’-এর এমন চমৎকার সাযুজ্য আর দেখা যায়নি।
কাজী নজরুল ইসলাম এ কথা লেখার ১০ বছর পরে বাঙালী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পন্ন করে এবং এর পর থেকেই মূলত ভাষাভিত্তিক একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম বেগবান হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানকে বীজমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসে বাংলার স্বাধীনতা- প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ফলে বলাই চলে, কাজী নজরুল ইসলামের কল্পপুরুষই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বিদেশি শক্তিকে ‘খবরদার’ বলেছিলেন; তাঁর উচ্চারিত ‘বাঙলার জয় হোক’ বচনই বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’, যে ¯েøাগান হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র। এভাবেই নজরুল সর্বদা সরব হয়ে বাঙালীর জীবন ও স্বপ্নে অবস্থান করেন।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
e-mail: scpcdu@gmail.com