স্বৈরাচারের প্রশাসন দিয়ে অন্তর্বর্তী প্রশাসন চলবে না : চাই নবীন ও প্রবীণের বিপ্লবী প্রশাসন
- প্রকাশের সময় : ০১:৫১:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ১০৩ বার পঠিত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ১৫ দিন হয়ে গেল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন সরকার গঠন করেছেন এবং তার উপদেষ্টা পরিষদে এ পর্যন্ত ২০ জন উপদেষ্টা নেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, যেহেতু ছাত্র-জনতার প্রবল গণঅভ্যুত্থানের নায়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ প্রমুখের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন তাই তার কার্যকলাপে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট প্রতিফলিত হবে। ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শর্তহীন সমর্থন দিয়েছে। এত বিপুল জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে আর কেউ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। আর সেই একই কারণে ড. ইউনূসের ওপর বর্তেছে বিশাল গুরু দায়িত্ব। ড. ইউনূসকে এদেশের মানুষ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ হিসেবে চেনে। তিনি নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার রাজনৈতিক বিশ্বাস বা দর্শন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ অতটা ওয়াকেবহাল নয়। অথচ যে পটভূমিতে এবং যাদের সমর্থনে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেখানে তিনি রাজনীতি বিমুখ হতে পারেন না। হলে চলবে না।
এই ধরনের বিশাল গণঅভ্যুত্থান, যেখানে কোটি কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেন, সেটি একটি বিপ্লব হতে পারতো। হয়নি এজন্য যে বিপ্লব করতে হলে জনগণ আর নিরস্ত্র থাকে না, তারা সশস্ত্র হয়ে শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতা থেকে নামায়। আর গণঅভ্যুত্থানে জনগণ থাকে নিরস্ত্র। তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে শাসক গোষ্ঠি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জনগণ নিরস্ত্র হলেও শাসক দল বা শোষক সরকারের প্রধান অভ্যুত্থান দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ করেন। ঠিক এটিই ঘটেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ জাতিসংঘের রিপোর্টই বলছে যে, শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থান দমনের জন্য প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বল প্রয়োগ করেছেন। গত ১৭ আগস্ট জাতিসংঘ যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছে, সেই রিপোর্ট মোতাবেক এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত শাহাদত বরণ করেছেন ৬৫০ ব্যক্তি। এর মধ্যে ৩২ জন শিশু। জনগণের প্রতি বৃষ্টির মতো গুলি ছোঁড়া হয়েছে। এই বল প্রয়োগে সাজোয়া যান, হেলিকপ্টার এবং এ্যাসল্ট রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরেও জনগণ কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তাদের একমাত্র সম্বল ছিল রাস্তা থেকে সংগ্রহ করা ইট পাটকেল। হাসিনা ফ্যাসিবাদের চূড়ায়। আর তার সরকার যেহেতু ছিল একটি দানব সরকার, তাই তার প্রায় সব মন্ত্রী এবং এমপিরাও ছিলেন দানব।
ফরাসি বিপ্লবের চেয়ে বাংলাদেশের আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বিশালতা এবং ব্যাপকতায় অনেক বড় বলে অনেকে এটিকে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলতে চান। ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গ দখলের সময় ২০০ জন বিপ্লবী নিহত হন। কিন্তু বাংলাদেশের আগস্ট বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা। নিরস্ত্র জনগণের মধ্য থেকে এত বিপুল পরিমাণ রক্তপাত বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায় না। এজন্য শুধুমাত্র শেখ হাসিনার দুই হাতই নয়, হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং দলের নেতাদের হাত সহস্রাধিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত।
এত বিপুল রক্তপাতের পর ১৫ দিন পার হয়ে গেল। কিন্তু এ পর্যন্ত পালের গোদাদের কেউই ধরা পড়ল না, এটি চরম বিস্ময়ের কথা। শেখ হাসিনা পার পেয়ে গেলেন। তিনি এখন দিল্লির অদূরে একটি বিশাল সুসজ্জিত অফিসে বসে বাংলাদেশে প্রতি বিপ্লব ঘটানোর জন্য উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন এবং ভারতীয় মিডিয়া সেগুলো প্রচার করে যাচ্ছে। আজকাল ইউটিউবের যুগে সেসব উস্কানিমূলক বক্তব্য বাংলাদেশে বসেও আমরা শুনতে পাচ্ছি।
॥দুই॥
বাংলাদেশে এই রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী হলেন শেখ হাসিনা। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আবুল হাসান মাহমুদ আলী, তাজুল ইসলাম, ফারুক খান, দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, আব্দুস শহীদ, ফরহাদ হোসেন, নাজমুল হাসান পাপন, মহিবুল হাসান চৌধুরী। এছাড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, তারেক আহমেদ সিদ্দিকী, মসিউর রহমান, তৌফিক ইলাহী চৌধুরী এবং গওহর রিজভী প্রমুখ। প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মো. মহিববুর রহমান, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে দুর্বার ছাত্র ও গণ আন্দোলনকে দমন করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে যে, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী মিলে ২৫ জনের মধ্যে শুধুমাত্র আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলক, সালমান এফ রহমান সরকারি ঘোষণা মোতাবেক গ্রেফতার হয়েছেন। দৈনিক মানবজমিনের খবর মোতাবেক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গ্রেফতার হয়েছেন। ২৭ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। অবশিষ্ট ২৩ জনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
তারা কি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন? নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন? ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মেয়র ফজলে নূর তাপস এবং মেয়র আতিকের খবর নাই। এছাড়া অন্তত আড়াই শত সাবেক এমপি রয়েছেন যারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় একেক জন মাফিয়া ডন হিসেবে শে^তসন্ত্রাস কায়েম করেছিলেন। এদের কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? আর যদি গ্রেফতার হয়েই থাকেন তাহলে কাদের কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে? জনগণকে অবশ্যই সেটি জানানো প্রয়োজন।
এতদিন এ ব্যাপারে জনগণ অন্ধকারে ছিলেন। কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্ভবত রাজশাহীতে বলেছিলেন যে কতিপয় রাজনীতিক এবং আমলা সেনাবাহিনীর কাছে জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় চেয়েছিলেন। তিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তবে আইন যদি তাদেরকে চায় তাহলে তিনি তাদেরকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন। তার এই বক্তব্য আরো পরিষ্কার করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ, সংক্ষেপে আইএসপিআর। আইএসপিআরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। এ সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন নাগরিক সেনানিবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এই প্রেক্ষাপটে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ, জীবনরক্ষা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্যমতে, বিভিন্ন সেনানিবাসে যাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তি। ৫ জন বিচারক, ১৯ জন বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা, ৪৮৭ জন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ব্যক্তি ১২ জন। ৫১ জন পরিবার-পরিজন (স্ত্রী ও শিশু)।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ৬১৫ জন নিজ উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এখন পর্যন্ত ৪ জনকে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আশ্রয়প্রাপ্ত তিনজন তাঁদের পরিবারের চার সদস্যসহ মোট সাতজন বর্তমানে সেনানিবাসে অবস্থান করছেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সব তথ্য প্রদান করা হয়েছে।
॥তিন॥
এই সরকারের সামনে যে কাজ তার ব্যাপ্তি, ব্যাপকতা ও গভীরতা বুঝতে হলে একটি মাত্র ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে হয়। সেটি হলো, হারকুলিয়ান টাস্ক। পরিষ্কার কথা হলো এই যে, পতিত স্বৈরাচার দিয়ে সৎ ও সুশাসন কায়েম করা একেবারেই অসম্ভব। শেখ হাসিনা বিগত সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে নিজের মানুষ এবং কট্টর ভারতপন্থী মানুষ বসান নাই। ড. ইউনূস যে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করছেন সেটি বাস্তবায়িত করতে হলে আওয়ামী ও ইন্ডিয়ান এলিমেন্টদের সমাজ ও প্রশাসনের সর্বক্ষেত্র থেকে বিদায় করতে হবে। এখানে আপোস বা মধ্যবর্তী অবস্থানের কোনো সুযোগ নাই। একটি কলামে সব কথা বলা সম্ভব নয়। একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো।
শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করেন ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি। সাবেক বিডিআর এবং বর্তমান বিজিবি ম্যাসাকারে সেনাবহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যা করা হয়। সেই তখন থেকেই জনশ্রুতি রয়েছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের সম্মিলিত নায়ক ভারত এবং শেখ হাসিনাসহ ৫ জন আওয়ামী নেতা। বিডিআর ম্যাসাকারের তদন্তের জন্য জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমের (এখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি বিডিআর ম্যাসাকারের পূর্বাপর ঘটনা তাদের রিপোর্টে বর্ণনা করেছে। আওয়ামী লীগ ও ভারতের সম্পৃক্ততাও নাকি কমিটি পেয়েছিল। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে যে জাহাঙ্গীর আলমের কমিটির ঐ রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক। ঐ রিপোর্টে যাদের দায়ী করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক।
আরো অনেক কথা আছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে কত ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে? কতজনকে গুম করা হয়েছে? কতজনকে খুন করা হয়েছে? আয়নাঘর কি একটি? নাকি একাধিক? শুধুমাত্র মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউল আহসানের ওপর আয়নাঘরের সব দায় চাপালে হবে না। আর কারা ছিল এই আয়নাঘর অপারেশনে? কে বা কারা তার হুকুমদাতা? আরো আছে। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, লক্ষ কোটি টাকার ঋণ খেলাপ, লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি। এগুলোর হিসাব কড়ায় গন্ডায় আদায় করতে হবে।
সরকার যদি এসব কাজে হাত দেয় তাহলে সেসব কাজ করতে তাদের যদি ৫/৬ বছরও লাগে তাও জনগণ তাদেরকে দেবে। জনগণ শুধু চায়, স্বৈরাচারের আস্তাবল থেকে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করা।