নিউইয়র্ক ১১:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও বর্তমান কারিকুলাম

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:০৪:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৬৬ বার পঠিত

হককথা ডেস্কশিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উন্নত জাতি গঠনের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। শুধু তাই নয়, সভ্যতা বিকাশের শক্তিও এই শিক্ষা—এটা আমরা সবাই জানি। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দেশ বা যে জাতি যত বেশি এগিয়ে, সেই দেশ বা জাতি তত বেশি উন্নত। মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উন্নত জাতি গঠনের আশা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। উন্নত মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা দালানের ভিত মজবুত না হলে যেমন দালানটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার ভিতটা মানসম্পন্ন ও মজবুত না হলে সেই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত্ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে—এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শিক্ষার ওপর আয়োজিত একটি বিশেষ সম্মেলনে বলেছেন, একটি গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের পরিবর্তে এটা দ্রুত বিভাজন তৈরি করছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষার ওপর একটি ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে। দরিদ্র ছাত্রদের প্রযুক্তির অভাব থাকা একটি বিশেষ অসুবিধা এবং যুদ্ধসমূহ স্কুলগুলো শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো ব্যাহত করছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দিলেও সব দেশের প্রতি শিক্ষার ব্যয় বাড়ানোর অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবন্ধকগুলো ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে শিক্ষার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবে নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের উপযোগী নয়।

দেশের শিক্ষার অব্যবস্থা এবং এর উন্নয়ন নিয়ে পত্র পত্রিকায় বহু লেখালেখি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা প্রতিনিয়তই হচ্ছে, কিন্তু এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের বা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কোনো ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশের জনগণকে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, তা মোটেও আমাদের সংবিধানের আলোকে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সংবিধানে বলা হয়েছে, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করার কথা। কিন্তু আমরা সংবিধান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যা সর্বজনীন নয়।

চলতি বছর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা উপকরণের ব্যয় বেশি হওয়ায় দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। শুধু তাই নয়, নতুন কারিকুলামে বাচ্চাদের যা শেখানো হচ্ছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান সরকারের খোদ কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এই শিক্ষা কারিকুলাম মানসম্পন্ন বা উপযুক্ত নয়। অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজ ছাড়াও ‘সম্মিলিত বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ জানালেও তা আমলে না নিয়ে এই কারিকুলাম ইতিমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে বলে জানা যায়। বিগত ১০ মাসের বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, গ্রামের স্কুলগুলোতে এই শিক্ষাক্রম পুরোটাই অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রম বাতিলের জন্য অভিভাবক, ছাত্র, শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলে জোর দাবি উঠেছে। এই শিক্ষাক্রম প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে অন্যান্য শ্রেণিতে চালু করা হবে বলে জানা যায়। নতুন কারিকুলামে স্কুলগুলোতে ভাত, ডিম, শাক ইত্যাদি রান্না শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে। এসব উপকরণ ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। খুবই মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব রান্নাবান্ন তো ঘরেই মায়েরা শেখাতে পারেন। এগুলো শেখার জন্য স্কুলের প্রয়োজন নেই। এর জন্য প্রতিদিন শিক্ষা উপকরণগুলো ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। এই অপ্রোয়জনীয় বাড়তি ব্যয় অভিভাবকেরা কেন বহন করবেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন অভিভাবক বলছেন, আমি কি আমার ছেলেমেয়েকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে হোটেলের বাবুর্চি বানাব? একটা শ্রেণিতে জীবনমুখী একটি বিষয় থাকলেই যথেষ্ট। বিতর্কিত এই কারিকুলাম পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে এটার ওপর যথাযথ জরিপ ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জোর দাবি জানাচ্ছি। যে শিক্ষা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বা করছে, তা কেন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে? এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্মত না হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। ভূরিভূরি জিপিএ ফাইভ পেয়ে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভালো ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছুটছে। মা-বাবাও সন্তানদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছেন, কিন্তু সত্যিকার মানুষ হিসেবে কজন বেরিয়ে আসছে? পরিবেশ, স্বাস্থ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে রান্নবান্না শেখানো হচ্ছে, যার কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমাদের অভিভাবকেরাও একটা ভালো রেজাল্ট, একটা ভালো সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন, সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করছেন কি না, তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ বা গুনাবলি তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা দেখার বা বোঝার মতো সময় বা মাসসিকতা আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নষ্ট রাজনীতির জাঁতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছি। এই অবস্থা বা পরিবেশের মধ্য থেকেও আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে বাবা-মায়ের সুষ্ঠু তদারকিতে সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু তাদের সেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় এবং দেশে মেধাবীদের যথাযথভাবে কাজে না লাগানোর কারণে অনেকে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। এর ফলে দেশ তার মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ ও জ্ঞানী সন্তানদের হারাচ্ছে। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে হবে কর্মমুখী ও জীবনমুখী। কর্মমুখী শিক্ষার ভিত গড়ার জন্য কারিগরি শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা দুটির ওপরই সমান জোর দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সবটাই ব্যাবহারিক শিক্ষামুখী হতে হবে, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষা হতে হবে মানবিক গুণাবলি উদ্রেক করা জীবন ও কর্মমুখী প্রকৃত জ্ঞানার্জনের শিক্ষা। শিক্ষার পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও বাস্তবধর্মী করার জন্য এই খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের সমস্যাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, শিক্ষক, অভিভাবকসহ রাষ্ট্রকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা উন্নত দেশের অনেক কিছুই অনুকরণ করি, কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যস্থাকে অনুসরণ করছি না। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা সন্তানদের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ এবং অন্যতম সেরা শিক্ষাব্যবস্থা। ভবিষ্যত্ প্রজন্ম তথা পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের কল্যাণের কথা চিন্তা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের মানসম্পন্ন বেতনকাঠামো প্রণয়ন এবং প্রকৃত মেধাবী ছেলেমেয়েদের এই পেশায় নিয়োজিত করে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া উন্নত জাতি গঠন তথা টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক

লেখক: অথনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

হককথা/নাছরিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও বর্তমান কারিকুলাম

প্রকাশের সময় : ০৭:০৪:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৩

হককথা ডেস্কশিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উন্নত জাতি গঠনের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। শুধু তাই নয়, সভ্যতা বিকাশের শক্তিও এই শিক্ষা—এটা আমরা সবাই জানি। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দেশ বা যে জাতি যত বেশি এগিয়ে, সেই দেশ বা জাতি তত বেশি উন্নত। মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উন্নত জাতি গঠনের আশা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। উন্নত মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা দালানের ভিত মজবুত না হলে যেমন দালানটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার ভিতটা মানসম্পন্ন ও মজবুত না হলে সেই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত্ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে—এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শিক্ষার ওপর আয়োজিত একটি বিশেষ সম্মেলনে বলেছেন, একটি গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের পরিবর্তে এটা দ্রুত বিভাজন তৈরি করছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষার ওপর একটি ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে। দরিদ্র ছাত্রদের প্রযুক্তির অভাব থাকা একটি বিশেষ অসুবিধা এবং যুদ্ধসমূহ স্কুলগুলো শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো ব্যাহত করছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দিলেও সব দেশের প্রতি শিক্ষার ব্যয় বাড়ানোর অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবন্ধকগুলো ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে শিক্ষার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবে নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের উপযোগী নয়।

দেশের শিক্ষার অব্যবস্থা এবং এর উন্নয়ন নিয়ে পত্র পত্রিকায় বহু লেখালেখি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা প্রতিনিয়তই হচ্ছে, কিন্তু এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের বা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কোনো ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশের জনগণকে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, তা মোটেও আমাদের সংবিধানের আলোকে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সংবিধানে বলা হয়েছে, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করার কথা। কিন্তু আমরা সংবিধান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যা সর্বজনীন নয়।

চলতি বছর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা উপকরণের ব্যয় বেশি হওয়ায় দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। শুধু তাই নয়, নতুন কারিকুলামে বাচ্চাদের যা শেখানো হচ্ছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান সরকারের খোদ কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এই শিক্ষা কারিকুলাম মানসম্পন্ন বা উপযুক্ত নয়। অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজ ছাড়াও ‘সম্মিলিত বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ জানালেও তা আমলে না নিয়ে এই কারিকুলাম ইতিমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে বলে জানা যায়। বিগত ১০ মাসের বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, গ্রামের স্কুলগুলোতে এই শিক্ষাক্রম পুরোটাই অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রম বাতিলের জন্য অভিভাবক, ছাত্র, শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলে জোর দাবি উঠেছে। এই শিক্ষাক্রম প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে অন্যান্য শ্রেণিতে চালু করা হবে বলে জানা যায়। নতুন কারিকুলামে স্কুলগুলোতে ভাত, ডিম, শাক ইত্যাদি রান্না শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে। এসব উপকরণ ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। খুবই মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব রান্নাবান্ন তো ঘরেই মায়েরা শেখাতে পারেন। এগুলো শেখার জন্য স্কুলের প্রয়োজন নেই। এর জন্য প্রতিদিন শিক্ষা উপকরণগুলো ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। এই অপ্রোয়জনীয় বাড়তি ব্যয় অভিভাবকেরা কেন বহন করবেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন অভিভাবক বলছেন, আমি কি আমার ছেলেমেয়েকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে হোটেলের বাবুর্চি বানাব? একটা শ্রেণিতে জীবনমুখী একটি বিষয় থাকলেই যথেষ্ট। বিতর্কিত এই কারিকুলাম পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে এটার ওপর যথাযথ জরিপ ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জোর দাবি জানাচ্ছি। যে শিক্ষা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বা করছে, তা কেন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে? এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্মত না হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। ভূরিভূরি জিপিএ ফাইভ পেয়ে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভালো ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছুটছে। মা-বাবাও সন্তানদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছেন, কিন্তু সত্যিকার মানুষ হিসেবে কজন বেরিয়ে আসছে? পরিবেশ, স্বাস্থ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে রান্নবান্না শেখানো হচ্ছে, যার কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমাদের অভিভাবকেরাও একটা ভালো রেজাল্ট, একটা ভালো সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন, সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করছেন কি না, তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ বা গুনাবলি তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা দেখার বা বোঝার মতো সময় বা মাসসিকতা আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নষ্ট রাজনীতির জাঁতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছি। এই অবস্থা বা পরিবেশের মধ্য থেকেও আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে বাবা-মায়ের সুষ্ঠু তদারকিতে সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু তাদের সেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় এবং দেশে মেধাবীদের যথাযথভাবে কাজে না লাগানোর কারণে অনেকে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। এর ফলে দেশ তার মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ ও জ্ঞানী সন্তানদের হারাচ্ছে। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে হবে কর্মমুখী ও জীবনমুখী। কর্মমুখী শিক্ষার ভিত গড়ার জন্য কারিগরি শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা দুটির ওপরই সমান জোর দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সবটাই ব্যাবহারিক শিক্ষামুখী হতে হবে, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষা হতে হবে মানবিক গুণাবলি উদ্রেক করা জীবন ও কর্মমুখী প্রকৃত জ্ঞানার্জনের শিক্ষা। শিক্ষার পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও বাস্তবধর্মী করার জন্য এই খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের সমস্যাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, শিক্ষক, অভিভাবকসহ রাষ্ট্রকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা উন্নত দেশের অনেক কিছুই অনুকরণ করি, কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যস্থাকে অনুসরণ করছি না। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা সন্তানদের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ এবং অন্যতম সেরা শিক্ষাব্যবস্থা। ভবিষ্যত্ প্রজন্ম তথা পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের কল্যাণের কথা চিন্তা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের মানসম্পন্ন বেতনকাঠামো প্রণয়ন এবং প্রকৃত মেধাবী ছেলেমেয়েদের এই পেশায় নিয়োজিত করে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া উন্নত জাতি গঠন তথা টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক

লেখক: অথনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

হককথা/নাছরিন