সীমান্ত হত্যা, ভারতের কোনো রাখঢাক নেই
- প্রকাশের সময় : ০৩:১৭:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ মার্চ ২০২১
- / ১০০ বার পঠিত
শাহাবুদ্দিন খালেদ চৌধুরী: নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহলসহ বেশ কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। বর্তমানে সীমান্তে বাংলাদেশীরা অহরহ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের সশস্ত্র হামলার শিকার হচ্ছেন। তাতে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। গত ৪ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর এক দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির ২৬ মার্চ ঢাকা সফর নিশ্চিত করা। জয়শঙ্কর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে জয়শঙ্করের বক্তব্যগুলো মিডিয়ায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হলেও, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন তা কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যগুলো গ্রহণ করার কোনো বিকল্প আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিল না। সে বৈঠকে জয়শঙ্কর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হয়েছেন বলেও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। জয়শঙ্করের ভাষায়, ‘ঊাবৎু ফবধঃয রং ৎবমৎবঃঃধনষব নঁঃ বি ধষংড় যধাব ঃড় ধংশ ড়ঁৎংবষাবং যিু রং ঃযবৎব ধ ঢ়ৎড়নষবস, ধহফ ঃযব ঢ়ৎড়নষবস রং নবপধঁংব ড়ভ পৎরসব. ঝড় ড়ঁৎ ংযধৎবফ ড়নলবপঃরাব ংযড়ঁষফ নব ধ ঘড় ঈৎরসব, হড় ফবধঃয নড়ৎফবৎ ধহফ ও ধস ংঁৎব রভ বি পধহ মবঃ রঃ ৎরমযঃ, বি পধহ ধফফৎবংং ঃযরং ঢ়ৎড়নষবস বভভবপঃরাবষু.’ অর্থাৎ প্রতিটি মৃত্যু দুঃখজনক, কিন্তু আমাদেরকে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, কেন এ সমস্যা? অপরাধের কারণে এ সমস্যা। কাজেই আমাদের সম্মিলিত উদ্দেশ্য হবে, অপরাধ বন্ধ হবে, মৃত্যুও বন্ধ হবে। আমি সুনিশ্চিত যে, এটি যদি আমরা করতে পারি তা হলে এ সমস্যার সমাধানে আমরা সফল হবো।’
এ দিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনী সভায় আবার ঘোষণা করেছেন, তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশকে দেয়া সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর পানি দেয়ার ব্যাপারে মমতা যতবারই বক্তব্য রেখেছেন ততবারই মনে হয়েছে তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশ ভিক্ষা হিসেবে চাইছে। এরূপ বক্তব্য অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর। গুলি করে কাউকে মেরে হত্যা না বলে মৃত্যু বলা এবং তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে বলার ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা-ই মনে করুন না কেন, দেশের আপামর জনগণ তাতে অবশ্যই চরম অপমানিত বোধ করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, ভারতে প্রত্যেক অপরাধীকে কি গুলি করে মারা হয়? ভারতে কোনো অপরাধীকে গুলি করে মারা ছাড়া কি আর কোনো বিকল্প নেই? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় তো সে রকমই বোঝা যায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে জয়শঙ্কর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি যে অপরাধের জন্য নির্বিচারে গুলি করে মারার কথা বললেন, এটি কি একটি সভ্য এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোভা পায়? কয়েক দিন আগে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করে, যাদের অনেকেরই বৈধ ভিসাও নেই। এ খবরের জন্য বাংলাদেশে কোনো অসন্তোষ সৃষ্টি হতে আমি শুনিনি। সম্ভবত এর কারণ, ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশে আপামর জনগণের কোনো বৈরীভাব নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয়রা বিশেষ করে ভারতীয় সেনারা যেভাবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন তা ভুলে যাওয়ার মতো বাঙালি পাওয়া খুবই দুষ্কর। কিন্তু যখন দেখি বাংলাদেশের পাতি চোরাকারবারিদের দমনের জন্য ভারতের অন্যতম স্বনামধন্য কূটনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বুলেট ছাড়া অন্য কিছু দেখেন না তখন ব্যথিত না হয়ে পারা যায় না।
যখন দেখি ভারতীয় বর্ডারে বিএসএফ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীকে গুলি করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প দেখে না, তখন প্রশ্ন তোলা ছাড়া উপায় থাকে না যে, ভারতে কি প্রত্যেক অপরাধীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়? তাই যদি না হবে বাংলাদেশীদেরও বিএসএফ নির্বিচারে গুলি করতে পারে না। বাংলাদেশী এসব অপরাধীকে গুলি করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ব্যাপারে বক্তব্যগুলো বিভিন্ন অর্থ বহন করে। পরিতাপের বিষয়, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন বলে সংবাদপত্রের খবর দেখলে মনে হয় না। কাজেই ধরে নিতে হবে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগগুলো সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তা হলে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের ফলাফল কী হলো? বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকার করা হলো, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে চোরাকারবারিদের অভয়াশ্রম বানানো হয়েছে কেবল বাংলাদেশী চোরাকারবারিদের উদ্যোগে। যেন ভারতীয় পক্ষের কোনো চোরাকারবারি নেই।
দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ৪৫ জন বাংলাদেশী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। তারা সবাই চোরাচালানের সাথে জড়িত। যেহেতু ২০২০ সালে ধৃত চোরাকারবারিরা সবাই বাংলাদেশী, সেহেতু স্বাভাবিকভাবে সীমান্তে অবৈধ চোরাকারবারের জন্য বাংলাদেশই দায়ী হবে এবং চোরাচালানসংক্রান্ত সব হত্যাকান্ডের জন্য বাংলাদেশ দায়ী হবে। যদিও ভারতীয় বিএসএফ গুলি চালিয়েছে, এ সমস্যার সমাধান ও স্বভাবত বাংলাদেশকেই করতে হবে। কারণ যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, তারা সবাই চোরাকারবারের সাথে জড়িত এবং ভারতের বক্তব্য অনুসারে তারা সবাই বাংলাদেশী। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাও চূড়ান্তভাবে কূটনৈতিক। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বাক্যই ভারতকে হত্যার দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। তিনি বলেছেন, ‘ঝঃড়ঢ় নড়ৎফবৎ পৎরসবং, ঃযব শরষষরহম রিষষ ংঃড়ঢ়’. ‘সীমান্ত অপরাধ বন্ধ করুন, হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে।’ তা হলে ভারতের বক্তব্যের সার হলো, চোরাচালান বন্ধ করতে হত্যা করা যায়। কিন্তু ভারতীয় গরু যখন বাংলাদেশে পাচার করা হয় তখন কি শুধু বাংলাদেশী চোরাকারবারি এ কাজে জড়িত থাকে? সে ক্ষেত্রে ভারতীয় চোরাকারবারি বুলেটের শিকার হয় না কেন? চোরাকারবার রোধে বুলেট ব্যবহারের দৃষ্টান্ত একমাত্র ভারতীয় বিএসএফই স্থাপন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে তা অনুমোদন দিলেন। এত দিন পর্যন্ত বিচারকের জুরির এবং হুকুম তামিলের সব কাজেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী-বিএসএফই সম্পন্ন করেছে। এ বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
প্রতিটি ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডই অনিবার্য করা হয়েছে। কাজেই এ সিদ্ধান্ত উপনীত হতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তথাকথিত চোরাকারবারিদের মৃত্যুদন্ডই অনিবার্য বিধান হিসেবে চালু করা হয়েছে। বিএসএফের বিচার প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্যের পর আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ভারতীয় নতুন দর্শন হলোÑ সীমান্তে চোরাচালান অপরাধের জন্য কোনো তদন্ত ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে মেরে ফেলা আইনত বৈধ।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার যদি মেক্সিকো সীমান্তে একই নীতি প্রয়োগ করত তা হলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতো। কিন্তু এ সীমান্তে গন্ডগোল হওয়ার কথা শোনা গেলেও বর্বরতার কথা তেমন শোনা যায় না। আন্তর্জাতিক আইনে তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনো তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য অংশ পেতে সক্ষম হয়নি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য হলোÑ তারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতার কারণে পানি দিতে পারছে না। ৫০ বছর ধরে বিভিন্ন অজুহাতে তিস্তা চুক্তি করা হচ্ছে না। অজুহাতগুলো কতটুকু সত্য আমাদের জানা থাকার কথা নয়। তবে এর দ্বারা ভারত সরকারের একটি মারাত্মক দুর্বলতার কথা বাইরে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, তা হলোÑ ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের সার্বভৌম শক্তির প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে কি না? (দৈনিক নয়া দিগন্ত)