নিউইয়র্ক ০৩:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:২০:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • / ১৫৯ বার পঠিত

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সম্প্রদায় বলতে নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীক বুঝি। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। এই সবকিছু সব সম্প্রদায়ের সামাজিক চিন্তার অন্তর্গত। আর ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে যে কোন সম্প্রদায়ের নেতিবাচক কোনো চিন্তা, কোন বৈষম্য এবং অবিচারকে বেশি বোঝায়। ইংরেজিতে এর একটিকে বলে ‘কমিউনিটি’, অপরটি ‘কমিউনাল’। দুটো শব্দ শুনতে প্রায় একই রকম মনে হলেও এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হতেই পারে। তবে তার দায়ভার যতটা না কোন সম্প্রদায়ের তার চেয়ে বেশি রাজনীতির। সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টা রাজনীতি থেকে বা রাজনীতির শ্রেণীর স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসে এর বহু দৃষ্টান্ত আছে।
১৯৫২ সালের আটই ফাল্গুন (২১ ফেব্রæয়ারী) দিনটা বাঙালী সম্প্রদায় এবং সংস্কৃতি পাঠে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক দিন বা দিবস বলা যায় একে। এই দিনের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল বাঙালী সম্প্রদায়ের একটি রাজনৈতিক মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সঞ্চারিত। এই রাজনীতির সাথে বাঙালীর জন্ম-জন্মান্তরের একটি ইতিবাচক সংস্কৃতির যোগসুত্রতা অবশ্য-ই আছে। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির যৌক্তিকতা ছিল, তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর একটি ন্যায্য দাবী কে কেন্দ্র করেও। দাবিটা ছিল, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মাতৃভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্ন নিয়ে। এই দাবিটা ছিল সেই সময়ে আমাদের রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির ন্যায্য অধিকারের একটি দাবি। পরবর্তীতে মেঘনা, যমুনা ও সিন্ধু নদীর নানান গতিপথের সঙ্কীর্ণতায় এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ন্যায্য দাবিটাকে প্রকারান্তরে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক চিন্তা বা মতবাদ বলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণী মনে করে। তারা ‘সম্প্রদায়ের’ চিন্তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে সমাজের অভ্যন্তরে একে অন্যের প্রতি আস্থাহীনতার কৃষ্টি হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কেন করে। সেটা আরেক প্রসঙ্গ। অন্য কোন সময় সেই আলোচনা হবে।
একটা কথা আমরা প্রায় ভুলে যাই যে, সম্প্রদায় নয়, সাম্প্রদায়িকতা সম্প্রদায়ের ভেতরে এক ধরনের ক্যান্সার কিংবা কোন কঠিন রোগের মতো-ই সংক্রামিত হয় খুব দ্রæত। এটাও একটা সামাজিক দূরারোগ।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং তার বিজয় ছিল সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রভুত্বকে না মানবার। প্রভু না মানার সংস্কৃতি। দুই হাজার একুশ সালে এসেও দেখছি আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে আমরা যে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভু সংস্কৃতিকে ধিক্কার দিয়েছিলাম, দুঃখজনক হলেও এটা এখন সত্য যে, সেই ‘প্রভু সংস্কৃতি’ এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান আছে। যেখানেই এই প্রভু সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিরাজ করবে সেখানে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ পাখা মেলে উড়বে-ই।
১৯৫২ সালের আমাদের যে বিজয় ছিল সম্প্রদায়ের ইতিবাচক কল্যাণের অর্থে, কাল- ক্রমে সেই বিজয় আজকে নানা জায়গায় নানাভাবে নানান সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বন্দি হয়ে যাচ্ছেও বলা যায়। এটা আমাদের ৫২’র বিজয়ের পরাজয়। পুরনো দিনের মতোই এখনো আমরা অনেকে প্রশ্ন তুলি ভাষা ও ধর্মকে আলাদা করে। দুটোকে আলাদা করতে চেষ্টা করি। তাই কেউ, কেউ প্রশ্ন করেন বাঙালীরা মুসলমান কিনা। অথবা মুসলমানদের ভাষা বাংলা কিনা। অনেকে আবার এটাও বলি যে, বাঙালী মুসলমান। বাঙালী মুসলমান বলতে একটা সম্প্রদায়, আরেকটা ধর্ম। দুটো মনে হয় ভিন্ন কিছু। একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন করবার এক ধরনের অপচেষ্টা। প্রকৃত অর্থে ভাষার সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই। এই বিরোধ চিন্তটা ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘কমিউনাল’ চিন্তার অংশ।
এটা অস্বীকার করা খুব কঠিন যে, বাঙালী জাতির মধ্যে সম্প্রদায় চিন্তা যতটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে সেই অর্থে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ সমাজকে বিভক্ত করে বেশি। বাঙালী জাতি দুটি প্রধান ধর্মে বিভক্ত। একটি হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ অপরটি ইসলাম অনুসারী। উভয়ের মাতৃভাষা এক। সংস্কৃতিও অনেকটা অভিন্ন। বাধা, সংঘাত বা দ্ব›দ্ব কোথায়? সেটা বাঙালীর ধর্ম বিশ্বাস কেন্দ্রিক না যতটা তার চাইতে বেশি বাঙালীর ধর্ম চিন্তার অজ্ঞানতা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অথবা অতিরিক্ত অবজ্ঞা বা অবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। অথবা বিশেষ কোন মহলের বিশেষ কোন নেতিবাচক চিন্তা এটা। এই চিন্তা গোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মূলত মানুষের সহজাত ধর্ম ‘বিশ্বাসকে’ ব্যবহার করে নিজেদের রাজনীতি এবং অর্থনীতির শ্রেণী স্বার্থকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। এটা আমরা ভুলে যাই যে কোন সম্প্রদায়ের ভেতরে নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসকে অবহেলা অথবা অসম্মান করা সম্প্রদায়ের ইতিবাচক কল্যাণ কে নির্দেশ করে না বরং সেটা অনুপ্রাণিত এবং উৎসাহিত করে সম্প্রদায় কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতার অপ-শক্তিকে। এই কথাতে এটা অনেকটাই প্রমাণ হয় যে, সম্প্রদায়ের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার উৎসটা রাজনৈতিক।
বাঙালী জাতির একটি বড় দুর্বলতা, আমাদের দৃষ্টি এবং চিন্তার সংকীর্ণতার একটি দিক। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত। সবার মধ্যে এই সংকীর্ণতা বেশ কাজ করে বলে মনে হয়। বাঙালী জাতির নানান অহংকারের একটি সবাই কমবেশি মনে করি, ‘আমরাই’ সব জানি। কেউ, কেউ অন্য কাউকে জানার ব্যাপারে ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখাতেও কুন্ঠা বোধ করি। এটাও আরেক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা।
আমাদের অনেকের মধ্যে ‘প্রগতিশীলতা’ অর্থ সবার আগে নিজেদের ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা। অথবা নিজের ধর্মকে অসম্মান করা। এই পথে চললে সহজেই নিজেকে ‘প্রগতিশীল’ বলে বাঙালী সমাজেও প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। বাঙালী সমাজে যে কোন ধর্মের প্রতি কোন প্রকার বিশ্বাস বা আনুগত্য। এটাকে এক ধরনের অপ্রগতিশীল চিন্তা অথবা ‘কমিউনাল’ বলেও বলা হয়। এটা আমাদের মানসিকতার সংকীর্ণতা। যুগের প্রবাহ কিনা তা অবশ্য জানিনা।
সাম্প্রদায়িকতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একের উপর অন্য দল বা শ্রেণীর আধিপত্য সৃষ্টি করার অসুস্থ মনস্তাত্তি¡ক অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা বা প্রবণতা। এটা রাজনীতি এবং অর্থনীতি উভয়ের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য।
সাম্প্রদায়িকতা কেবল ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই হয় তা-ও না। রাজনীতি এবং অর্থনীতিতেও হয়। তাই যে কোন সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কেবল ধর্মকে চিহ্নিত করাটা যুক্তিসঙ্গত না। কিন্তু লক্ষ্য করি, অন্য কোন ক্ষেত্রে কোন আধিপত্যবাদকে সাম্প্রদায়িক বলি না যতটা ধর্মকেন্দ্রিক হলে সেটাকেই সাম্প্রদায়িক বলি। এটাও আমাদের চিন্তার সংকীর্ণতা।
পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনেক সময় সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতা তার জাতীয়তাবাদ চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে বলেও বলা হয়। ১৯৯৪ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সমাজ গবেষক ভারতের জয়া চ্যাটার্জির একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’।
এই বইটা পড়ে জানতে পারি, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিতীয়বার ভাগ হয়। দ্বিতীয়বার বাংলা ভাগ নিশ্চিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত হয় যার লক্ষ্য ছিল, ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করা। তখন থেকেই শুরু আদর্শ ও রাজনৈতিক আচরণের দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন জটিল রূপের মিশ্রণ এবং উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরকার ঐক্য কে নষ্ট করে দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণী স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটানো।
ভারতের আরেক সমাজ গবেষক এবং লেখক শ্রী অ¤øান দত্ত তার একটি রচনা, ‘বাংলাদেশ দেখে এলাম’ এই রচনাতে লেখক এক জায়গায় লেখেন: ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রাদুর্ভাব আমি দেখিনি। সাম্প্রদায়িক বৃদ্ধি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে মুক্ত সাধারণ মানুষের মন। হিন্দুদের ভেতর ভয় সংশয় যথেষ্ট আছে। কিন্তু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতায় সে জন্য দায়ী এমন আমার মনে হয়নি। অপরিচিতা এক হিন্দু মহিলা আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন, কিছুদিন আগে তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা ভাবছেন। পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু ডাকাতি হয়, আমরা সেজন্য দেশত্যাগ করবার কথা ভাবি না। বাংলাদেশেরও অস্থির অবস্থায় এসব ঘটনা বিরল নয়, হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলেই তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। এটা দুঃখজনক, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানকে বিচার করা যাবে না অল্প কিছু অপরাধের আচরণ দিয়ে’। (গ্রন্থ : সমাজ, সংস্কৃতি, স্মৃতি- অ¤øান দত্ত, প্রকাশক, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৪২)
উল্লেখিত কথাটা অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একটি দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। আজকের বাংলাদেশে আমরা এই দৃষ্টান্তগুলো আমাদের দৃষ্টি ও মেধায় ধরে রাখতে পারছিনা। এটা হিন্দু কিংবা মুসলমান বাঙালীর সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা নয়। এই ব্যর্থতা রাজনীতির এবং অর্থনীতির। এখানে কারোর নিজেদের ‘ধর্ম’ কারণ নয়। ধর্মকে কারণ তৈরি করা হয়। এটাতে সাধারণ মানুষকে খুব দ্রæত সমাজের শাসক এবং শোষকদের ‘পদতলে’ কিংবা নিজেদের ‘বগলতলায়’ আনা সম্ভব। এই শাসক এবং শোষকদের আরেক ভিন্ন শ্রেণি স্বার্থে সমাজের কিছু আধা শিক্ষিত আর কিছু উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণির কেউ, কেউ কোন না কোনভাবে একে সমর্থন যোগান। তা-ও শ্রেণী বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে।
আমরা মানি যে, সমসাময়িক ধারা বিশেষ করে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের অন্যতম একটি প্রধান উৎস। ৫২’ উত্তর আমাদের বাঙালী সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অর্থে সামাজিক, নৃতত্ত¡, ভাষাতত্ত¡, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানাবিধ মেলবন্ধনের মিশ্র নানান রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক মেরুকরণে এবং এক ধূসর চিন্তার কারণে বাঙালী সম্প্রদায়ের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার অংকুর ধীরে, ধীরে বড় হযয়ে এখন সেটা প্রায় বটগাছের আকার ধারণ করেছে বলা যায়। এটা দুঃখজনক।
লেখিকা জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ বইটি পড়লে আরো জানতে পারি যে, বাংলার ক্ষেত্রে অনেকে এই ধারণাকে একটি সাধারণ সত্য বলে গ্রহণ করেন যে, বাংলার মুসলমানেরা সহজাতভাবে সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের উচ্চশ্রেণীর নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাদের সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে সহজে সংগঠিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জী আরো বলেন যে, বাংলায় শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সমান্তরাল অবস্থার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অনেক ঐতিহাসিকরা যারা বলেন, বাংলার নানা রকম সামাজিক বিরোধ, সেটা শহর কিংবা পল্লী এলাকা যেখানেই হোক না কেন, অতি দ্রæত সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা পরিগ্রহ করে বা করতে পারে।
তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যে, সাম্প্রদায়িকতার এই প্রক্রিয়ার শেকড় মুসলিম সমাজের মধ্যে নিহত আছে বলে ধরে নেয়া হলেও, মুসলমান কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণকে সেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যায় না যতটা দেখা যায় বাঙালী রাজনৈতিক শ্রেণী গোষ্ঠীর এই ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করবার অপচেষ্টাকে। সমানভাবে এটাও সত্য হিন্দু বাঙালীদের মধ্যেও এরকম অসহিষ্ণুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার চিন্তার ইতিহাসটাও সীমিত না। এই দুয়ের কারণ দুই সম্প্রদায়ের নিজ, নিজ ধর্মীয় কারণ না যতটা, তার চাইতেও বড় রাজনৈতিক হিংসা, প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার শ্রেণী বিভাজনের বৈষম্য। উৎপাদন সম্পর্কের বৈষম্য। অর্থনীতির অসম প্রতিযোগিতা। এই সবকিছু আমাদের রাজনীতি এবং অর্থনীতির অবকাঠামোতে বিরাজমান আছে বলেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতা এক ধরনের অক্সিজেন পায়।
এ থেকেও প্রমাণ হয় বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা মূলত এই সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীর অবকাঠামো এবং স্বার্থের পক্ষে একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যার অথবা যাদের প্রধান একটি লক্ষ্য, সমাজে বৈষম্যকে বজায় রাখা এবং ব্যক্তি বা দলীয় আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করা। কখনো সেটা অগ্রাধিকার পায় তথাকথিত দেশের কল্যাণের নামে, কখনো ধর্মের নামে, কখনো বা গণতন্ত্রের নামে।
এটা কিন্তু আজকে ভারতেও দেখছি। আজকের ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ করে আজকের ভারতের শাসক শ্রেণীর যে রাজনীতি সেখানেও ভারতের বৃহত্তর জাতি ‘সম্প্রদায়ের’ ভূমিকা কে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে গড়ে তোলার চেষ্টা কিন্তু অব্যাহত আছে।
আজকের যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদের গভীরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এর পেছনেও আছে ‘সাম্প্রদায়িকতার’ মনোভাব, যা নেই সেটা, সম্প্রদায়ের ‘ইনক্লুসিভ’ কোন চিন্তাশীল সংস্কৃতির চর্চা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িকতা এখন ধীরে, ধীরে তার উগ্র মূর্তি ধারণ করছে। সেই উগ্রবাদীতার অন্য অর্থে সাম্প্রদায়িকতার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটে ৬ জানুয়ারী ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে। এই সাম্প্রদায়িকতার কারণও কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি।
মধ্যপ্রাচ্যেও একই রকম কৃষ্টির চর্চা-ই চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তি দীর্ঘদিন থেকে আছে, সেখানে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বড় হলেও তাদের ভেতরে যে শ্রেণী স্বার্থের রাজনীতি কাজ করছে এর পেছনেও কোন ইনক্লুসিভ চিন্তা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সার্বিক কল্যাণের কোন চিন্তা নেই। যা আছে সেটাও হলো রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার। সৌদি আরবের রাজতন্ত্র এই সাম্প্রদায়িকতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত।
আমরা যদি আমাদের চিন্তার সংস্কৃতিতে ‘সম্প্রদায়’-কে প্রাধান্য না দিয়ে যদি ‘সাম্প্রদায়িকতাকে’ ‘আধুনিকতা’ বলে মনে করি সেখানে আমাদের অকল্যাণ ছাড়া বড় কোনো কল্যাণ হবার সম্ভাবনা থাকবে না। সেকারণে সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতা। এই দুটো বিষয় যে সম্পূর্ণ আলাদা এটা আমাদের চিন্তা করা জরুরি এখন আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি স্তরে। এই দুইটির কোনটাকে আমরা গুরুত্ব দিব, অগ্রাধিকার দিব- আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বৃহত্তর কল্যাণের প্রয়োজনে, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবার সময় এখন। এক্ষেত্রে আমাদের ৫২’র রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীকার আন্দোলন একটি উৎসাহ হতে পারে।
৫২’ সালে আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং কল্যাণের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত। কোন ধরনের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দ্বারা পরিচালিত নয়। বাংলা আমার মাতৃভাষা। তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার যৌক্তিক আন্দোলন এবং দাবিটাও ছিল আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক একটি নেয় এবং আদর্শিক লড়াই।
একবিংশ সালের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা নিজেদের সম্প্রদায়ের কি এবং কোন, কোন ইনক্লুসিভ চিন্তাকে আমাদের সার্বিক কল্যাণে অগ্রাধিকারে রাখবো। এটা আমাদের সবার প্রধান চিন্তা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি, এই বিষয়ে আমাদেও চিন্তাকে অগ্রসর করবার চাইতে বেশি কাজ করছে নিজেদের ভেতর এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষমতা এবং ব্যক্তি বা দলের আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিা করবার সামন্ততান্ত্রিক চেষ্টা। এই ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করা ছিলো বায়ান্ন সালে আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করবার লড়াইয়ের অন্যতম একটি লক্ষ্য। এর পেছনে অন্য আর কোন ‘সাম্প্রদায়িক’ চিন্তা ছিলো না।
আজকের বাংলাদেশে আমাদের সাম্প্রদায়িকতার কোন চিন্তা ভাবনাকে যেন নিজের অজান্তেও প্রশ্রয় না দিই। এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কল্যাণের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। আধুনিকতা বলি বা প্রগতিশীলতা বলি, উভয় চিন্তাতেই সম্প্রদায় কথাটা যতটা ইতিবাচক ও যৌক্তিক এবং সভ্যতার ন্যায় বোধকে জাগ্রত করে সাম্প্রদায়িকতা সেভাবে করেনা এবং করবেও না। সেটা যে ধরণের সাম্প্রদায়িকতাই হোক না কেন।
‘সম্প্রদায়ের’ কল্যান মানে না, ‘সম্প্রদায়ি’ হওয়া। আর সাম্প্রদায়িকতার কারণে কেবল নিজের ‘ধর্ম’ বিশ্বাস বা চিন্তাকে শ্রেণীগত স্বার্থে অগ্রাধিকার দিয়ে বিপরীত কোন ধর্মকে উপেক্ষা করা, অবজ্ঞা করা অন্যায় এবং অপরাধমূলক কাজ। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সাম্প্রদায়িকতা কেবল ধর্মকেন্দ্রিক হতে পারেনা। সাম্প্রদায়িকতার মূল শক্তি কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরাজনীতি।
পৃথিবীর বুকে আমরা অবশ্যই একটি সম্প্রদায়। বাঙালী সম্প্রদায়। আমাদের বাঙালীদের ধর্ম ভিন্ন হতেই পারে। সেটা সাম্প্রদায়িকতা নয়। কিন্তু সেই ধর্মের বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা অথবা বিবেচনাকে নিয়ে যখন আমরা কুবিতর্ক এবং রাজনীতি করা শুরু করি তখন সেটা ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে যেতেও পারে। আধুনিক বাংলাদেশে এটা কাম্য নয়।
বায়ান্নর ৮-ই ফাগুন, আমাদের জাতীয় অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ফসল। আমাদের আগামী বাংলাদেশের সু বিকাশে এবং সু বিনির্মাণে এই দর্শন বা দেখাটাকে আমাদের সামনে অগ্রসর হবার অন্যতম সহায়ক করে নিতে হবে। দুই হাজার একুশের বাংলাদেশে এবং আগামী বাংলাদেশ এটা যেন আমাদের সকল বাঙালীদের চেতনায় নাড়া দিতে পারে।
সবশেষে স্মরণ করছি, লেখক আহমেদ ছফার একটি প্রবন্ধে উল্লেখিত বাংলার অজানা এক লোক কবির অমর একটি কবিতার কয়েকটি লাইন। যা আমাদের ‘সম্প্রদায়’ চিন্তা থেকে ‘সাম্প্রদায়িকতাকে’ দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
‘মানুষের মান দাও
মানুষের গান গাও
মানুষ সবার সেরা
মানুষ ঈশ্বর ঘেরা
এ সংসারে’
লেখক: সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা

প্রকাশের সময় : ১১:২০:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২১

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সম্প্রদায় বলতে নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীক বুঝি। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। এই সবকিছু সব সম্প্রদায়ের সামাজিক চিন্তার অন্তর্গত। আর ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে যে কোন সম্প্রদায়ের নেতিবাচক কোনো চিন্তা, কোন বৈষম্য এবং অবিচারকে বেশি বোঝায়। ইংরেজিতে এর একটিকে বলে ‘কমিউনিটি’, অপরটি ‘কমিউনাল’। দুটো শব্দ শুনতে প্রায় একই রকম মনে হলেও এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হতেই পারে। তবে তার দায়ভার যতটা না কোন সম্প্রদায়ের তার চেয়ে বেশি রাজনীতির। সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টা রাজনীতি থেকে বা রাজনীতির শ্রেণীর স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসে এর বহু দৃষ্টান্ত আছে।
১৯৫২ সালের আটই ফাল্গুন (২১ ফেব্রæয়ারী) দিনটা বাঙালী সম্প্রদায় এবং সংস্কৃতি পাঠে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক দিন বা দিবস বলা যায় একে। এই দিনের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল বাঙালী সম্প্রদায়ের একটি রাজনৈতিক মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সঞ্চারিত। এই রাজনীতির সাথে বাঙালীর জন্ম-জন্মান্তরের একটি ইতিবাচক সংস্কৃতির যোগসুত্রতা অবশ্য-ই আছে। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির যৌক্তিকতা ছিল, তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর একটি ন্যায্য দাবী কে কেন্দ্র করেও। দাবিটা ছিল, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মাতৃভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্ন নিয়ে। এই দাবিটা ছিল সেই সময়ে আমাদের রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির ন্যায্য অধিকারের একটি দাবি। পরবর্তীতে মেঘনা, যমুনা ও সিন্ধু নদীর নানান গতিপথের সঙ্কীর্ণতায় এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ন্যায্য দাবিটাকে প্রকারান্তরে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক চিন্তা বা মতবাদ বলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণী মনে করে। তারা ‘সম্প্রদায়ের’ চিন্তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে সমাজের অভ্যন্তরে একে অন্যের প্রতি আস্থাহীনতার কৃষ্টি হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কেন করে। সেটা আরেক প্রসঙ্গ। অন্য কোন সময় সেই আলোচনা হবে।
একটা কথা আমরা প্রায় ভুলে যাই যে, সম্প্রদায় নয়, সাম্প্রদায়িকতা সম্প্রদায়ের ভেতরে এক ধরনের ক্যান্সার কিংবা কোন কঠিন রোগের মতো-ই সংক্রামিত হয় খুব দ্রæত। এটাও একটা সামাজিক দূরারোগ।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং তার বিজয় ছিল সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রভুত্বকে না মানবার। প্রভু না মানার সংস্কৃতি। দুই হাজার একুশ সালে এসেও দেখছি আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে আমরা যে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভু সংস্কৃতিকে ধিক্কার দিয়েছিলাম, দুঃখজনক হলেও এটা এখন সত্য যে, সেই ‘প্রভু সংস্কৃতি’ এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান আছে। যেখানেই এই প্রভু সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিরাজ করবে সেখানে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ পাখা মেলে উড়বে-ই।
১৯৫২ সালের আমাদের যে বিজয় ছিল সম্প্রদায়ের ইতিবাচক কল্যাণের অর্থে, কাল- ক্রমে সেই বিজয় আজকে নানা জায়গায় নানাভাবে নানান সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বন্দি হয়ে যাচ্ছেও বলা যায়। এটা আমাদের ৫২’র বিজয়ের পরাজয়। পুরনো দিনের মতোই এখনো আমরা অনেকে প্রশ্ন তুলি ভাষা ও ধর্মকে আলাদা করে। দুটোকে আলাদা করতে চেষ্টা করি। তাই কেউ, কেউ প্রশ্ন করেন বাঙালীরা মুসলমান কিনা। অথবা মুসলমানদের ভাষা বাংলা কিনা। অনেকে আবার এটাও বলি যে, বাঙালী মুসলমান। বাঙালী মুসলমান বলতে একটা সম্প্রদায়, আরেকটা ধর্ম। দুটো মনে হয় ভিন্ন কিছু। একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন করবার এক ধরনের অপচেষ্টা। প্রকৃত অর্থে ভাষার সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই। এই বিরোধ চিন্তটা ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘কমিউনাল’ চিন্তার অংশ।
এটা অস্বীকার করা খুব কঠিন যে, বাঙালী জাতির মধ্যে সম্প্রদায় চিন্তা যতটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে সেই অর্থে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ সমাজকে বিভক্ত করে বেশি। বাঙালী জাতি দুটি প্রধান ধর্মে বিভক্ত। একটি হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ অপরটি ইসলাম অনুসারী। উভয়ের মাতৃভাষা এক। সংস্কৃতিও অনেকটা অভিন্ন। বাধা, সংঘাত বা দ্ব›দ্ব কোথায়? সেটা বাঙালীর ধর্ম বিশ্বাস কেন্দ্রিক না যতটা তার চাইতে বেশি বাঙালীর ধর্ম চিন্তার অজ্ঞানতা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অথবা অতিরিক্ত অবজ্ঞা বা অবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। অথবা বিশেষ কোন মহলের বিশেষ কোন নেতিবাচক চিন্তা এটা। এই চিন্তা গোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মূলত মানুষের সহজাত ধর্ম ‘বিশ্বাসকে’ ব্যবহার করে নিজেদের রাজনীতি এবং অর্থনীতির শ্রেণী স্বার্থকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। এটা আমরা ভুলে যাই যে কোন সম্প্রদায়ের ভেতরে নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসকে অবহেলা অথবা অসম্মান করা সম্প্রদায়ের ইতিবাচক কল্যাণ কে নির্দেশ করে না বরং সেটা অনুপ্রাণিত এবং উৎসাহিত করে সম্প্রদায় কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতার অপ-শক্তিকে। এই কথাতে এটা অনেকটাই প্রমাণ হয় যে, সম্প্রদায়ের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার উৎসটা রাজনৈতিক।
বাঙালী জাতির একটি বড় দুর্বলতা, আমাদের দৃষ্টি এবং চিন্তার সংকীর্ণতার একটি দিক। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত। সবার মধ্যে এই সংকীর্ণতা বেশ কাজ করে বলে মনে হয়। বাঙালী জাতির নানান অহংকারের একটি সবাই কমবেশি মনে করি, ‘আমরাই’ সব জানি। কেউ, কেউ অন্য কাউকে জানার ব্যাপারে ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখাতেও কুন্ঠা বোধ করি। এটাও আরেক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা।
আমাদের অনেকের মধ্যে ‘প্রগতিশীলতা’ অর্থ সবার আগে নিজেদের ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা। অথবা নিজের ধর্মকে অসম্মান করা। এই পথে চললে সহজেই নিজেকে ‘প্রগতিশীল’ বলে বাঙালী সমাজেও প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। বাঙালী সমাজে যে কোন ধর্মের প্রতি কোন প্রকার বিশ্বাস বা আনুগত্য। এটাকে এক ধরনের অপ্রগতিশীল চিন্তা অথবা ‘কমিউনাল’ বলেও বলা হয়। এটা আমাদের মানসিকতার সংকীর্ণতা। যুগের প্রবাহ কিনা তা অবশ্য জানিনা।
সাম্প্রদায়িকতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একের উপর অন্য দল বা শ্রেণীর আধিপত্য সৃষ্টি করার অসুস্থ মনস্তাত্তি¡ক অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা বা প্রবণতা। এটা রাজনীতি এবং অর্থনীতি উভয়ের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য।
সাম্প্রদায়িকতা কেবল ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই হয় তা-ও না। রাজনীতি এবং অর্থনীতিতেও হয়। তাই যে কোন সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কেবল ধর্মকে চিহ্নিত করাটা যুক্তিসঙ্গত না। কিন্তু লক্ষ্য করি, অন্য কোন ক্ষেত্রে কোন আধিপত্যবাদকে সাম্প্রদায়িক বলি না যতটা ধর্মকেন্দ্রিক হলে সেটাকেই সাম্প্রদায়িক বলি। এটাও আমাদের চিন্তার সংকীর্ণতা।
পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনেক সময় সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতা তার জাতীয়তাবাদ চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে বলেও বলা হয়। ১৯৯৪ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সমাজ গবেষক ভারতের জয়া চ্যাটার্জির একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’।
এই বইটা পড়ে জানতে পারি, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিতীয়বার ভাগ হয়। দ্বিতীয়বার বাংলা ভাগ নিশ্চিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত হয় যার লক্ষ্য ছিল, ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করা। তখন থেকেই শুরু আদর্শ ও রাজনৈতিক আচরণের দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন জটিল রূপের মিশ্রণ এবং উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরকার ঐক্য কে নষ্ট করে দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণী স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটানো।
ভারতের আরেক সমাজ গবেষক এবং লেখক শ্রী অ¤øান দত্ত তার একটি রচনা, ‘বাংলাদেশ দেখে এলাম’ এই রচনাতে লেখক এক জায়গায় লেখেন: ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রাদুর্ভাব আমি দেখিনি। সাম্প্রদায়িক বৃদ্ধি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে মুক্ত সাধারণ মানুষের মন। হিন্দুদের ভেতর ভয় সংশয় যথেষ্ট আছে। কিন্তু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতায় সে জন্য দায়ী এমন আমার মনে হয়নি। অপরিচিতা এক হিন্দু মহিলা আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন, কিছুদিন আগে তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা ভাবছেন। পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু ডাকাতি হয়, আমরা সেজন্য দেশত্যাগ করবার কথা ভাবি না। বাংলাদেশেরও অস্থির অবস্থায় এসব ঘটনা বিরল নয়, হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলেই তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। এটা দুঃখজনক, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানকে বিচার করা যাবে না অল্প কিছু অপরাধের আচরণ দিয়ে’। (গ্রন্থ : সমাজ, সংস্কৃতি, স্মৃতি- অ¤øান দত্ত, প্রকাশক, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৪২)
উল্লেখিত কথাটা অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একটি দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। আজকের বাংলাদেশে আমরা এই দৃষ্টান্তগুলো আমাদের দৃষ্টি ও মেধায় ধরে রাখতে পারছিনা। এটা হিন্দু কিংবা মুসলমান বাঙালীর সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা নয়। এই ব্যর্থতা রাজনীতির এবং অর্থনীতির। এখানে কারোর নিজেদের ‘ধর্ম’ কারণ নয়। ধর্মকে কারণ তৈরি করা হয়। এটাতে সাধারণ মানুষকে খুব দ্রæত সমাজের শাসক এবং শোষকদের ‘পদতলে’ কিংবা নিজেদের ‘বগলতলায়’ আনা সম্ভব। এই শাসক এবং শোষকদের আরেক ভিন্ন শ্রেণি স্বার্থে সমাজের কিছু আধা শিক্ষিত আর কিছু উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণির কেউ, কেউ কোন না কোনভাবে একে সমর্থন যোগান। তা-ও শ্রেণী বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে।
আমরা মানি যে, সমসাময়িক ধারা বিশেষ করে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের অন্যতম একটি প্রধান উৎস। ৫২’ উত্তর আমাদের বাঙালী সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অর্থে সামাজিক, নৃতত্ত¡, ভাষাতত্ত¡, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানাবিধ মেলবন্ধনের মিশ্র নানান রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক মেরুকরণে এবং এক ধূসর চিন্তার কারণে বাঙালী সম্প্রদায়ের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার অংকুর ধীরে, ধীরে বড় হযয়ে এখন সেটা প্রায় বটগাছের আকার ধারণ করেছে বলা যায়। এটা দুঃখজনক।
লেখিকা জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ বইটি পড়লে আরো জানতে পারি যে, বাংলার ক্ষেত্রে অনেকে এই ধারণাকে একটি সাধারণ সত্য বলে গ্রহণ করেন যে, বাংলার মুসলমানেরা সহজাতভাবে সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের উচ্চশ্রেণীর নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাদের সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে সহজে সংগঠিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জী আরো বলেন যে, বাংলায় শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সমান্তরাল অবস্থার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অনেক ঐতিহাসিকরা যারা বলেন, বাংলার নানা রকম সামাজিক বিরোধ, সেটা শহর কিংবা পল্লী এলাকা যেখানেই হোক না কেন, অতি দ্রæত সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা পরিগ্রহ করে বা করতে পারে।
তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যে, সাম্প্রদায়িকতার এই প্রক্রিয়ার শেকড় মুসলিম সমাজের মধ্যে নিহত আছে বলে ধরে নেয়া হলেও, মুসলমান কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণকে সেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যায় না যতটা দেখা যায় বাঙালী রাজনৈতিক শ্রেণী গোষ্ঠীর এই ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করবার অপচেষ্টাকে। সমানভাবে এটাও সত্য হিন্দু বাঙালীদের মধ্যেও এরকম অসহিষ্ণুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার চিন্তার ইতিহাসটাও সীমিত না। এই দুয়ের কারণ দুই সম্প্রদায়ের নিজ, নিজ ধর্মীয় কারণ না যতটা, তার চাইতেও বড় রাজনৈতিক হিংসা, প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার শ্রেণী বিভাজনের বৈষম্য। উৎপাদন সম্পর্কের বৈষম্য। অর্থনীতির অসম প্রতিযোগিতা। এই সবকিছু আমাদের রাজনীতি এবং অর্থনীতির অবকাঠামোতে বিরাজমান আছে বলেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতা এক ধরনের অক্সিজেন পায়।
এ থেকেও প্রমাণ হয় বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা মূলত এই সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীর অবকাঠামো এবং স্বার্থের পক্ষে একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যার অথবা যাদের প্রধান একটি লক্ষ্য, সমাজে বৈষম্যকে বজায় রাখা এবং ব্যক্তি বা দলীয় আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করা। কখনো সেটা অগ্রাধিকার পায় তথাকথিত দেশের কল্যাণের নামে, কখনো ধর্মের নামে, কখনো বা গণতন্ত্রের নামে।
এটা কিন্তু আজকে ভারতেও দেখছি। আজকের ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ করে আজকের ভারতের শাসক শ্রেণীর যে রাজনীতি সেখানেও ভারতের বৃহত্তর জাতি ‘সম্প্রদায়ের’ ভূমিকা কে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে গড়ে তোলার চেষ্টা কিন্তু অব্যাহত আছে।
আজকের যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদের গভীরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এর পেছনেও আছে ‘সাম্প্রদায়িকতার’ মনোভাব, যা নেই সেটা, সম্প্রদায়ের ‘ইনক্লুসিভ’ কোন চিন্তাশীল সংস্কৃতির চর্চা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িকতা এখন ধীরে, ধীরে তার উগ্র মূর্তি ধারণ করছে। সেই উগ্রবাদীতার অন্য অর্থে সাম্প্রদায়িকতার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটে ৬ জানুয়ারী ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে। এই সাম্প্রদায়িকতার কারণও কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি।
মধ্যপ্রাচ্যেও একই রকম কৃষ্টির চর্চা-ই চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তি দীর্ঘদিন থেকে আছে, সেখানে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বড় হলেও তাদের ভেতরে যে শ্রেণী স্বার্থের রাজনীতি কাজ করছে এর পেছনেও কোন ইনক্লুসিভ চিন্তা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সার্বিক কল্যাণের কোন চিন্তা নেই। যা আছে সেটাও হলো রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার। সৌদি আরবের রাজতন্ত্র এই সাম্প্রদায়িকতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত।
আমরা যদি আমাদের চিন্তার সংস্কৃতিতে ‘সম্প্রদায়’-কে প্রাধান্য না দিয়ে যদি ‘সাম্প্রদায়িকতাকে’ ‘আধুনিকতা’ বলে মনে করি সেখানে আমাদের অকল্যাণ ছাড়া বড় কোনো কল্যাণ হবার সম্ভাবনা থাকবে না। সেকারণে সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতা। এই দুটো বিষয় যে সম্পূর্ণ আলাদা এটা আমাদের চিন্তা করা জরুরি এখন আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি স্তরে। এই দুইটির কোনটাকে আমরা গুরুত্ব দিব, অগ্রাধিকার দিব- আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বৃহত্তর কল্যাণের প্রয়োজনে, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবার সময় এখন। এক্ষেত্রে আমাদের ৫২’র রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীকার আন্দোলন একটি উৎসাহ হতে পারে।
৫২’ সালে আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং কল্যাণের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত। কোন ধরনের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দ্বারা পরিচালিত নয়। বাংলা আমার মাতৃভাষা। তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার যৌক্তিক আন্দোলন এবং দাবিটাও ছিল আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক একটি নেয় এবং আদর্শিক লড়াই।
একবিংশ সালের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা নিজেদের সম্প্রদায়ের কি এবং কোন, কোন ইনক্লুসিভ চিন্তাকে আমাদের সার্বিক কল্যাণে অগ্রাধিকারে রাখবো। এটা আমাদের সবার প্রধান চিন্তা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি, এই বিষয়ে আমাদেও চিন্তাকে অগ্রসর করবার চাইতে বেশি কাজ করছে নিজেদের ভেতর এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষমতা এবং ব্যক্তি বা দলের আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিা করবার সামন্ততান্ত্রিক চেষ্টা। এই ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করা ছিলো বায়ান্ন সালে আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করবার লড়াইয়ের অন্যতম একটি লক্ষ্য। এর পেছনে অন্য আর কোন ‘সাম্প্রদায়িক’ চিন্তা ছিলো না।
আজকের বাংলাদেশে আমাদের সাম্প্রদায়িকতার কোন চিন্তা ভাবনাকে যেন নিজের অজান্তেও প্রশ্রয় না দিই। এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কল্যাণের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। আধুনিকতা বলি বা প্রগতিশীলতা বলি, উভয় চিন্তাতেই সম্প্রদায় কথাটা যতটা ইতিবাচক ও যৌক্তিক এবং সভ্যতার ন্যায় বোধকে জাগ্রত করে সাম্প্রদায়িকতা সেভাবে করেনা এবং করবেও না। সেটা যে ধরণের সাম্প্রদায়িকতাই হোক না কেন।
‘সম্প্রদায়ের’ কল্যান মানে না, ‘সম্প্রদায়ি’ হওয়া। আর সাম্প্রদায়িকতার কারণে কেবল নিজের ‘ধর্ম’ বিশ্বাস বা চিন্তাকে শ্রেণীগত স্বার্থে অগ্রাধিকার দিয়ে বিপরীত কোন ধর্মকে উপেক্ষা করা, অবজ্ঞা করা অন্যায় এবং অপরাধমূলক কাজ। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সাম্প্রদায়িকতা কেবল ধর্মকেন্দ্রিক হতে পারেনা। সাম্প্রদায়িকতার মূল শক্তি কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরাজনীতি।
পৃথিবীর বুকে আমরা অবশ্যই একটি সম্প্রদায়। বাঙালী সম্প্রদায়। আমাদের বাঙালীদের ধর্ম ভিন্ন হতেই পারে। সেটা সাম্প্রদায়িকতা নয়। কিন্তু সেই ধর্মের বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা অথবা বিবেচনাকে নিয়ে যখন আমরা কুবিতর্ক এবং রাজনীতি করা শুরু করি তখন সেটা ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে যেতেও পারে। আধুনিক বাংলাদেশে এটা কাম্য নয়।
বায়ান্নর ৮-ই ফাগুন, আমাদের জাতীয় অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ফসল। আমাদের আগামী বাংলাদেশের সু বিকাশে এবং সু বিনির্মাণে এই দর্শন বা দেখাটাকে আমাদের সামনে অগ্রসর হবার অন্যতম সহায়ক করে নিতে হবে। দুই হাজার একুশের বাংলাদেশে এবং আগামী বাংলাদেশ এটা যেন আমাদের সকল বাঙালীদের চেতনায় নাড়া দিতে পারে।
সবশেষে স্মরণ করছি, লেখক আহমেদ ছফার একটি প্রবন্ধে উল্লেখিত বাংলার অজানা এক লোক কবির অমর একটি কবিতার কয়েকটি লাইন। যা আমাদের ‘সম্প্রদায়’ চিন্তা থেকে ‘সাম্প্রদায়িকতাকে’ দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
‘মানুষের মান দাও
মানুষের গান গাও
মানুষ সবার সেরা
মানুষ ঈশ্বর ঘেরা
এ সংসারে’
লেখক: সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষক।