নিউইয়র্ক ১২:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

শ্রদ্ধেয়, আবদুল গাফফার চৌধুরী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:০৬:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১
  • / ১২৬ বার পঠিত

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: চাচাকে নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমি সেইসব কোন বিষয়ে আলোচনা করব না। চাচা হিসাবে আমি আমার দৃষ্টিতে তাঁর মানবিক যে ব্যপারগুলো দেখেছি তার-ই দু-একটি স্মৃতিচারণ এই লেখার উদ্দেশ্য। এখন চাচার বয়স ৮৬ সম্ভবত অতিক্রম করে গেছেন। এতদিন চাচা বেশ সুস্থ ছিলেন ছোট খাটো অসুস্থতার পরেও। বাঙালীদের অ্যাভারেজ বয়সের বিচারে চাচা এতদিন বেশ সুস্থ ছিলেন। এ বছর (২০২১) থেকেই চাচা বেশি অসুস্থ বলা যায়। কথা বলতে কষ্ট হয়। তাঁর দুটো কিডনি এখন কাজ করছে না। আজ বাসায় তো কাল হসপিটালে, সময় কাটছে এইভাবে। চাচাকে শুনলাম এবারেই প্রথম কেমন যেন মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের বিশেষ করে এর রাজনীতির ইতিহাসে আবদুল গাফফার চৌধুরী একটি বিশেষ বিশেষণ এবং অহংকার বটে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে আবদুল গাফফার চৌধুরী বাঙালীদের মনে ততদিন উজ্জল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন। অনেক কারন না থাকলেও একটা বিশেষ কারণ ত আছেই। সেটা হল ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম এবং সালাম বরকত নিহত/শহীদ হবার পর গাফফার চৌধুরী তখন সম্ভবত ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন। একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় এরপর অনেক রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, অনেক ইতিহাস, গল্প সৃষ্টি হয়েছে। কোন বার-ই গাফফার চৌধুরীর এই কবিতার উপর কোন আক্রমণ আসেনি। বরং সেটা গীতিকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের অনবদ্য সুরের মূর্ছনায় অসাধারণ গান হিসেবে আজও প্রতি একুশে ফেব্রæয়ারীতে সবার মুখে গীত হয়।
উল্লেখ্য যে অনেকের মতে, এই গানটিতে প্রথম সুর দিয়েছিলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল লতিফ। একুশের ঐতিহাসিক ঘটনার পর আরো অনেক কবিতা এবং গান রচিত হয়েছে। সেই সবগুলোকে উতরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর উল্লিখিত কবিতাটি গান রূপে বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের অন্তরে গেঁথে আছে, গেঁথে থাকবে। এখানে আব্দুল গাফফার চৌধুরী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন যার কোন বিকল্প নেই। তাই অনেক বিদগ্ধজনের অভিমত আব্দুল গফফার চৌধুরী আর কিছুতে না হলেও এই একটি গানের জন্য অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের মধ্যে।
আব্দুল গাফফর চৌধুরীকে আমি দেখেছি, সব সময় খুব সাধারণ জীবন যাপনে। তাঁর আচার ব্যবহারে। এবং প্রতিপক্ষের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বলতে। হাসিমুখে কথা বলতে। একেবারেই বাঙালী কায়দায় তাঁর চলাফেরা। সাধারণত বাসায় থাকলে একটা লুঙ্গি এবং শার্ট পড়ে বসে মজা করেই কথা বলেন। ইতিহাস সংক্রান্ত স্মৃতিশক্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় তাঁর সমকক্ষ কেউ আছে বলেও মনে হয় না।
অসাধারণ তার স্মৃতি, সেই স্মৃতির সুতো দিয়ে তিনি তৈরি করেন ইতিহাসের অনবদ্য নকশী কাঁথা। তার লেখা তার সমর্থক কিংবা ভিন্নমত পোষণকারী যে কেউ-ই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেন অনেক আগ্রহ নিয়ে।
লেখার শৈল্পিক নিপুণতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক কলাম লেখাতে এর বিকল্প নেই বললেই চলে। আবদুল গাফফার চৌধুরী, অনেকে বলেন তাঁর গুরু বা প্রেরণা ছিলেন আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল হামিদ। আর আবদুল হামিদ সাহেবের গুরু ছিলেন শ্রদ্ধেয় আবুল মনসুর আহমেদ।
দু’একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করি। তখন আমি অনেক ছোট। চাচা থাকতেন আমাদের বাসার কাছেই আজিমপুরের চায়না গলির ওখানে। চাচা প্রায়ই আসতেন দাদুর সাথে দেখা করতে। চাচার তখন পোশাক ছিল অধিকাংশ সময় সাদা পাজামা এবং পাঞ্জাবি আর চোখে চশমা। তখন আমি মাঝেমাঝে কিছু লেখার চেষ্টা করতাম। সম্ভবত একটা নাটক লিখেছিলাম তখন মনে হয়। আর দু একটা অন্য কোন রচনাও হতে পারে। চাচা আসার পর দাদু খুব উৎসাহ নিয়ে চাচাকে আমার লেখাগুলো দেন পড়তে, চাচা বসে মনযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। পড়ার পর আমাকে বললেন, লেখালেখির ব্যাপারে তোমার একটা সহজ এবং স্বাভাবিক স্টাইল আছে দেখলাম। পারলে লেখালেখি করো। হয়তো চাচা সেদিন আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য কথাটা বলেছিলেন কিনা আমি জানিনা। এরপরে যে আমি লিখেছি কিছু তা-না। তবে নিয়মিত ডাইরি লিখতাম।
আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর মানবিক দিক থেকে চাচাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। আমার চাচি দীর্ঘ প্রায় ২৫-৩০ বছর বিছানায় ছিলেন বলা যায়। চাচির অসুস্থতার কারণে চাচা প্রথম রাশিয়াতে এবং পরে লন্ডনে গিয়েই পরিবারের সবাই ওখানেই স্থায়ী হয়ে যান। চাচার লন্ডনের বাড়িতে আমি দুই একবার গেছি।
চাচী তখন হুইল চেয়ারে বসেই সংসারের সব কাজ করতেন। আমাকে ভীষণ আদর করতেন। অনেক কিছু রান্না করে খাইয়েছিলেন একদিন দুপুরে সেই হুইল চেয়ারে বসে। ঐদিন সম্ভবত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা সাহেব চাচার বাসায় ছিলেন, আমার মতই যাত্রাপথে লন্ডনে বিরতির সময়। আমি তখন অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম করাচিতে লন্ডন হয়ে, মুসা সাহেব চাচ্ছিলেন ঢাকাতে একইভাবে লন্ডন হয়ে। লক্ষ্য করছিলাম চাচা মুসা সাহেবের সাথে কতো আন্তরিকভাবে আড্ডা দিচ্ছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। সেই সময়টা সম্ভবত ২০০২ সাল হবে।
জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে একান্তে আলাপরত মাহমুদ রেজা চৌধুরী। ছবি সংগৃহীত

চাচা কিন্তু ইচ্ছা করলেই লন্ডনে না থেকে বাংলাদেশে থাকলে তাঁর বরং পেশাগত দিকে আরো বেশি বিকশিত হবার সুযোগ ছিল। যে কাজটা চাচা লন্ডনে বসে করতেন তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। চাচা দেশে থাকলেও এটা আরও বেশি ভালো করতে পারতেন। সেই সুযোগ চাচার ছিল। চাচির অসুস্থতার কারণেই বিশেষ করে চাচির চিকিৎসার কারণে চাচা লন্ডনেই থেকে যান।
লন্ডনে চাচা অনেক কষ্ট করেছেন। ওনার মতো ব্যক্তিত্ব লন্ডনে এক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, গ্রোসারি স্টোর-এ কাজ করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনদিন কারো কাছে অভিযোগ কিংবা অভিমান করেননি। চাচা আড্ডা প্রিয় মানুষ সব সময়। যে কেউ তাঁর কাছে বসলে কখনো মনেই হবে না সে গুনী আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো একজনের সাথে বসে আলাপ করছেন। খুব দ্রæত মানুষকে চাচা আপন করে নেন এবং নিতে পারেন।
বাংলাদেশে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিত্বকে দেখেছি, তাঁদের সাথে দেখা করাও কষ্টের হয়। এই দিক থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে পরিচিত বা অপরিচিত প্রত্যেকেই সমান আন্তরিক ব্যবহার পেতো, যা এখনও পায়।
মানুষ হিসাবে অন্য মানুষকে বিচার করবার একেকজনের একেক মাপকাঠি থাকে। এটাই স্বাভাবিক। তবে সেই বিভিন্ন মাপকাঠির মধ্যে যে মাপকাঠিটা সবার উপরে থাকা দরকার সেটা একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি তার মানবিক আচার-আচরণের সংস্কৃতিটা কেমন তার উপরেও। আমার মনে হয় না আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে যারা চেনেন বা জানেন তারা কেউ গাফফার চৌধুরীর এই মানবিক দিককে কোন ভাবে অস্বীকার বা খাটো করতে পারবেন।
গাফফার চৌধুরীর সাথে আপনার যেকোনো মতামতের ব্যাপারে দ্বিমত অথবা ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাই বলে গফফার চৌধুরী আপনাকে কোনভাবেই সরাসরি ব্যবহারে এতোটুকু পরিমাণ উপেক্ষা করেননি। রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে চাচার সাথে আমারও মতবিরোধ আছে। কিন্তু সেটা চাচা হিসাবে নয়, বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে। উল্লেখ্য, চাচা কখনোই আমার মতামতের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি, বরং প্রশংসাই করেছেন আমার লেখার সততাকে নিয়ে। আমার প্রথম বই ‘দূরের প্রবাস কাছে স্বদেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে, চাচা তখন নিউইয়র্কে আমাদের বাসায় ছিলেন। এই বইটার উপর তখন চাচা একটি রিভিউ দিয়েছিলেন, যেটা ওই সময়ে স্থানীয় পত্রপত্রিকাতে এবং বাংলাদেশে তখনকার সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ ম্যাগাজিনেও ছাপা হয়েছিল। সেই লেখায় চাচা বলেছিলেন, আমার লেখায় নৈর্ব্যক্তিক একটা ধারা আছে, সেটার ব্যাপারে অনেকের দ্বিমত থাকলেও ওর যুক্তিকে খন্ডন করা কঠিন হবে তাদের। মাহমুদের খুব সহজ ভাষা এবং লেখার সচ্ছল গতি পাঠক-কে আকর্ষণ করবে। অনেকের মুখে শুনেছি, চাচা আমার লেখা নিয়ে বলেছেন, লেখার ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা উপস্থাপনা আছে, যা অনেকের থেকে ভিন্ন এবং বেশ নৈর্ব্যক্তিক মনের। চাচা তখন লিখেছিলেন, ‘মাহমুদ ৯০ দশকের লেখক, ওর লেখালেখিতে কোন নেতা-নেত্রীর প্রতি কোন মোহ নেই, সেই কারণেই অনেক কথা ও স্বাচ্ছন্দেই লিখতে পারে, আমরা যা অনেকেই পারি না’।
চাচা যখনি নিউইয়র্কে আসতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আবার যখন ঢাকাতে থাকতেন, সে সময় আমি থাকলে চাচার সাথে অবশ্যই দেখা করতাম। কিছুক্ষণ চাচার পাশে বসে গল্প করতাম। সেই গল্পে রাজনীতির কথা থাকত সামান্য, বেশিটাই থাকত পরিবারকেন্দ্রিক। উলানিয়া বাড়ি কেন্দ্রিক।
চাচার সাথে এখন কথা হয় খুব কম, লন্ডনে থাকলেও চাচা বেশ ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা চাচাকে অনেক শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁরা লন্ডনে গেলে চাচার সাথে সব সময় দেখা করেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। বিষয়টা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা জানেন বলেই হয়তো চাচাকে এত শ্রদ্ধা করেন।
শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী, তার ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাঙালী ও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বিশেষ এক জায়গা নিয়েই আছেন এবং থাকবেন বলে বিশ্বাস।
মানুষ তো কখনো দেবতা হতে পারে না। দেবতার তুল্য হতে পারে না। দোষে-গুণে একজন মানুষ, মানুষ হন। এটাই মানুষ নামের সংজ্ঞা। আমরা কাউকে দেবতাতুল্য বা দেবতা মানের মানুষ ভেবে বিচার করলে ভুল-ই করবো। হিসাব নিকাশটা হবে একজন মানুষের মানবিক গুণাগুণ নিযয়ে। সব মানুষ একইরকম হতে পারে না। যে কোন মানুষকে তার দোষে-গুণে বিচার করে তার গুণকেই সবার উপরে দেখা উচিত। আমরা সেটা করি কম। এই কারণেও সমাজে আমাদের সহানুভূতিশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিনয় এবং যে কোন ব্যক্তির ‘কম্পার্টমেন্টাল পার্সোনালিটি’ নিয়ে আমরা ভাবিও কম। একজন মানুষ কখন, কখন সারা জীবন তার একটা মাত্র গুণের কারণেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে বা থাকতেও পারেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মধ্যে এরকম অনেক গুণ আছে মানুষ হিসাবে তাঁর, আমি মনে করি সেইসব গুণের জন্য ও আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের অনেকের মাঝে আজও যেমন স্মরণীয় আছেন, অনাগত সময়েও থাকবেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তাঁর ডাকনাম চান্দু মিয়া।
আমরা অনেকেই তাঁকে ‘চান্দু চাচা’ বলেও ডাকি। বিশেষ করে আমি এবং আমার বোন নাজমা। চাচা প্রায়ই নাজমার কথা জিজ্ঞেস করেন, ও কেমন আছে, কোথায় আছে। নাজমাকে চাচা বেশ আদর করেন।
একসময় আমাকে বলেছিলেন নাজমার কিছু সাহায্য লাগলে তাকে যেন বলি। আব্বার প্রতি চাচার অগাধ শ্রদ্ধা দেখেছি। যদিও আব্বা এবং চাচার কিছু জীবন দর্শন বিপরীত ছিল। তবু চাচা আব্বাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। আব্বার মৃত্যুর পর (১৯৯২) ঢাকা যাওয়ার পথে চাচাকে লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে বলেছি, আব্বা মারা গেছেন। ফোনে চাচা কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলেন। পরে কষ্ট করে বললেন, মিয়া ভাই চলে গেলো আমাকে রেখে। আমিবা কতদিন বাঁচি বাবা জানিনা।
আজকে চাচা ভীষণ অসুস্থ, বলতে গেলে বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। কিডনি দুটোই অকার্যকর হয়ে গেলে একটা মানুষ কতটুকু আর ভালো থাকে থাকতে পারেন। এটা আমরা সবাই বুঝি। আপনারা চাচার জন্য দোয়া করবেন। যে চাচার, চার মেয়ে ও এক ছেলে, ওরা সবাই এখন চাচার কাছে আছে। চাচার একমাত্র ছেলে বয়সে আমার একটু ছোট, ওর নাম অনুপম রেজা চৌধুরী। চাচার চার মেয়ে এখন লন্ডনে চাচার পাশেই আছে।
বাংলাদেশের অন্যতম কথা সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক শেষবার লন্ডনে চাচার বাসার পেছনে বসে তারা দুই বন্ধু গল্প করছিলেন। সেই ভিডিও ক্লিপটা আমার কাছে ছিল। লক্ষ্য করেছিলাম সৈয়দ হক, চাচা-কে বলছিলেন, গাফফার তোমার ব্যাপারে আমার একটা অভিযোগ আছে। চাচা বলছিলেন বল। সৈয়দ হক বললেন, তুমি কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেছিলে, খুব ভালো গল্প লিখতে। তোমার উচিত-ই ছিল ওখানেই থাকার। কেন যে রাজনীতি নিয়ে লেখ তুমি, আমি জানিনা। চাচা কোন উত্তর দেননি তবে মুচকি হেসে ছিলেন চাচা। বন্ধুর মতামতের প্রতি এটা ছিল তাঁর শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের প্রকাশ।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। এরকম কবিতা যিনি লেখেন বা লিখতে পারেন কবিতায় তার দক্ষতা কতটা সেটাও সহজেই বোঝা যায়। গেলবার যখন ঢাকাতে ছিলাম তখন এম ই চৌধুরী শামীম, একসময় নিউইয়র্কে ছিল। এখানে উদীচী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামীম। ভিশন পরিমার্জিত এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব শামীম। ঢাকায় ফেরত গিয়েও বেশ সফল হয়েছে শামীম ওর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ও-ই আমাকে দেখালো ওর নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা, ‘স্কলার্স পাবলিশার্স’ এখান থেকে ২০০৯ সালে শামীম চাচার একটি কবিতার বই বের করেছে। স্কলার্স পাবলিশার্স থেকে আমার নিজেরও একটা বই বের হবার কথা আছে। চাচা একসময় শামীমের নিউজার্সীর বাসাতে ছিল অতিথি হয়ে। মনে আছে তখন শামীমের বাসা এবং শামীমের আন্তরিকতা নিয়ে একটা সুন্দর রচনা লিখেছিলেন পত্রিকাতে। যাইহোক, চাচার সেই কবিতার বইটার নাম ‘সময়ের ঘড়ি’। চাচা বইটা উৎসর্গ করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী-কে। সেই উৎসর্গ পাতায় চাচা লিখেছেন-
‘কাব্যের আকাশে যারা ধ্রæবতারা নয়
জীবনের সব ব্যথা অকাতরে সয়
তাদেরও কন্ঠের ধ্বনি তোমার লেখায়
বিদ্যুতের মত যেন বিদ্রæপ রেখায়
চিত্তে চমকায়
দ্রোহের আভায়’।
ঐ বইতেই লেখা চাচার আরেকটা কবিতা। কবিতর নাম-
‘আমাদের মিলিত সংগ্রাম:
মৌলানা ভাসানীর নাম’
‘শহরে, বন্দরে, গ্রামে ঘরে
হৃদয়-নগরে
মুখের ভাষায় শুনি, বুকের সাড়ায় শুনি, চোখের তারায় দেখি নাম
মৌলানা ভাসানীর নাম’…….. অসাধারণ কবিতা।
চাচা সম্পর্কে এতোটুকু লিখলাম। চাচার রাজনীতি দর্শন নিয়ে কিছু লিখলাম না কারণ, সবচেয়ে বড় কথা আব্দুল গফফার চৌধুরী আমার বড় চাচা। যদিও আব্বার ছোট, কিন্তু আমার বড় চাচা। আরেক চাচা ছিলেন মেহেদী চাচা, গাফফার চৌধুরী চাচার ছোট।
উনিও ইন্তেকাল করেছেন অনেক বছর আগে। চান্দু চাচা ও মেহেদি চাচা, দু’জন আমার আপন চাচা
আমার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার। চাচা সম্পর্কে ব্যক্তিগত লেখায় কোথাও যদি ভুল কিছু লিখে থাকি আমাকে ক্ষমা করবেন।
লেখাটা কোনোভাবে যদি চাচা পড়েন, আমার ভুল ভ্রান্তি কিংবা কোন স্থানে কোন বেয়াদবি হলে আমাকে ক্ষমা করবেন চাচা।
শ্রদ্ধান্তে
মাহমুদ, নিউইয়র্ক।
নভেম্বর, ১৭, ২০২১

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

শ্রদ্ধেয়, আবদুল গাফফার চৌধুরী

প্রকাশের সময় : ০২:০৬:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: চাচাকে নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমি সেইসব কোন বিষয়ে আলোচনা করব না। চাচা হিসাবে আমি আমার দৃষ্টিতে তাঁর মানবিক যে ব্যপারগুলো দেখেছি তার-ই দু-একটি স্মৃতিচারণ এই লেখার উদ্দেশ্য। এখন চাচার বয়স ৮৬ সম্ভবত অতিক্রম করে গেছেন। এতদিন চাচা বেশ সুস্থ ছিলেন ছোট খাটো অসুস্থতার পরেও। বাঙালীদের অ্যাভারেজ বয়সের বিচারে চাচা এতদিন বেশ সুস্থ ছিলেন। এ বছর (২০২১) থেকেই চাচা বেশি অসুস্থ বলা যায়। কথা বলতে কষ্ট হয়। তাঁর দুটো কিডনি এখন কাজ করছে না। আজ বাসায় তো কাল হসপিটালে, সময় কাটছে এইভাবে। চাচাকে শুনলাম এবারেই প্রথম কেমন যেন মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের বিশেষ করে এর রাজনীতির ইতিহাসে আবদুল গাফফার চৌধুরী একটি বিশেষ বিশেষণ এবং অহংকার বটে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে আবদুল গাফফার চৌধুরী বাঙালীদের মনে ততদিন উজ্জল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন। অনেক কারন না থাকলেও একটা বিশেষ কারণ ত আছেই। সেটা হল ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম এবং সালাম বরকত নিহত/শহীদ হবার পর গাফফার চৌধুরী তখন সম্ভবত ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন। একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় এরপর অনেক রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, অনেক ইতিহাস, গল্প সৃষ্টি হয়েছে। কোন বার-ই গাফফার চৌধুরীর এই কবিতার উপর কোন আক্রমণ আসেনি। বরং সেটা গীতিকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের অনবদ্য সুরের মূর্ছনায় অসাধারণ গান হিসেবে আজও প্রতি একুশে ফেব্রæয়ারীতে সবার মুখে গীত হয়।
উল্লেখ্য যে অনেকের মতে, এই গানটিতে প্রথম সুর দিয়েছিলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল লতিফ। একুশের ঐতিহাসিক ঘটনার পর আরো অনেক কবিতা এবং গান রচিত হয়েছে। সেই সবগুলোকে উতরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর উল্লিখিত কবিতাটি গান রূপে বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের অন্তরে গেঁথে আছে, গেঁথে থাকবে। এখানে আব্দুল গাফফার চৌধুরী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন যার কোন বিকল্প নেই। তাই অনেক বিদগ্ধজনের অভিমত আব্দুল গফফার চৌধুরী আর কিছুতে না হলেও এই একটি গানের জন্য অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের মধ্যে।
আব্দুল গাফফর চৌধুরীকে আমি দেখেছি, সব সময় খুব সাধারণ জীবন যাপনে। তাঁর আচার ব্যবহারে। এবং প্রতিপক্ষের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বলতে। হাসিমুখে কথা বলতে। একেবারেই বাঙালী কায়দায় তাঁর চলাফেরা। সাধারণত বাসায় থাকলে একটা লুঙ্গি এবং শার্ট পড়ে বসে মজা করেই কথা বলেন। ইতিহাস সংক্রান্ত স্মৃতিশক্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় তাঁর সমকক্ষ কেউ আছে বলেও মনে হয় না।
অসাধারণ তার স্মৃতি, সেই স্মৃতির সুতো দিয়ে তিনি তৈরি করেন ইতিহাসের অনবদ্য নকশী কাঁথা। তার লেখা তার সমর্থক কিংবা ভিন্নমত পোষণকারী যে কেউ-ই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেন অনেক আগ্রহ নিয়ে।
লেখার শৈল্পিক নিপুণতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক কলাম লেখাতে এর বিকল্প নেই বললেই চলে। আবদুল গাফফার চৌধুরী, অনেকে বলেন তাঁর গুরু বা প্রেরণা ছিলেন আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল হামিদ। আর আবদুল হামিদ সাহেবের গুরু ছিলেন শ্রদ্ধেয় আবুল মনসুর আহমেদ।
দু’একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করি। তখন আমি অনেক ছোট। চাচা থাকতেন আমাদের বাসার কাছেই আজিমপুরের চায়না গলির ওখানে। চাচা প্রায়ই আসতেন দাদুর সাথে দেখা করতে। চাচার তখন পোশাক ছিল অধিকাংশ সময় সাদা পাজামা এবং পাঞ্জাবি আর চোখে চশমা। তখন আমি মাঝেমাঝে কিছু লেখার চেষ্টা করতাম। সম্ভবত একটা নাটক লিখেছিলাম তখন মনে হয়। আর দু একটা অন্য কোন রচনাও হতে পারে। চাচা আসার পর দাদু খুব উৎসাহ নিয়ে চাচাকে আমার লেখাগুলো দেন পড়তে, চাচা বসে মনযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। পড়ার পর আমাকে বললেন, লেখালেখির ব্যাপারে তোমার একটা সহজ এবং স্বাভাবিক স্টাইল আছে দেখলাম। পারলে লেখালেখি করো। হয়তো চাচা সেদিন আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য কথাটা বলেছিলেন কিনা আমি জানিনা। এরপরে যে আমি লিখেছি কিছু তা-না। তবে নিয়মিত ডাইরি লিখতাম।
আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর মানবিক দিক থেকে চাচাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। আমার চাচি দীর্ঘ প্রায় ২৫-৩০ বছর বিছানায় ছিলেন বলা যায়। চাচির অসুস্থতার কারণে চাচা প্রথম রাশিয়াতে এবং পরে লন্ডনে গিয়েই পরিবারের সবাই ওখানেই স্থায়ী হয়ে যান। চাচার লন্ডনের বাড়িতে আমি দুই একবার গেছি।
চাচী তখন হুইল চেয়ারে বসেই সংসারের সব কাজ করতেন। আমাকে ভীষণ আদর করতেন। অনেক কিছু রান্না করে খাইয়েছিলেন একদিন দুপুরে সেই হুইল চেয়ারে বসে। ঐদিন সম্ভবত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা সাহেব চাচার বাসায় ছিলেন, আমার মতই যাত্রাপথে লন্ডনে বিরতির সময়। আমি তখন অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম করাচিতে লন্ডন হয়ে, মুসা সাহেব চাচ্ছিলেন ঢাকাতে একইভাবে লন্ডন হয়ে। লক্ষ্য করছিলাম চাচা মুসা সাহেবের সাথে কতো আন্তরিকভাবে আড্ডা দিচ্ছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। সেই সময়টা সম্ভবত ২০০২ সাল হবে।
জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে একান্তে আলাপরত মাহমুদ রেজা চৌধুরী। ছবি সংগৃহীত

চাচা কিন্তু ইচ্ছা করলেই লন্ডনে না থেকে বাংলাদেশে থাকলে তাঁর বরং পেশাগত দিকে আরো বেশি বিকশিত হবার সুযোগ ছিল। যে কাজটা চাচা লন্ডনে বসে করতেন তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। চাচা দেশে থাকলেও এটা আরও বেশি ভালো করতে পারতেন। সেই সুযোগ চাচার ছিল। চাচির অসুস্থতার কারণেই বিশেষ করে চাচির চিকিৎসার কারণে চাচা লন্ডনেই থেকে যান।
লন্ডনে চাচা অনেক কষ্ট করেছেন। ওনার মতো ব্যক্তিত্ব লন্ডনে এক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, গ্রোসারি স্টোর-এ কাজ করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনদিন কারো কাছে অভিযোগ কিংবা অভিমান করেননি। চাচা আড্ডা প্রিয় মানুষ সব সময়। যে কেউ তাঁর কাছে বসলে কখনো মনেই হবে না সে গুনী আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো একজনের সাথে বসে আলাপ করছেন। খুব দ্রæত মানুষকে চাচা আপন করে নেন এবং নিতে পারেন।
বাংলাদেশে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিত্বকে দেখেছি, তাঁদের সাথে দেখা করাও কষ্টের হয়। এই দিক থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে পরিচিত বা অপরিচিত প্রত্যেকেই সমান আন্তরিক ব্যবহার পেতো, যা এখনও পায়।
মানুষ হিসাবে অন্য মানুষকে বিচার করবার একেকজনের একেক মাপকাঠি থাকে। এটাই স্বাভাবিক। তবে সেই বিভিন্ন মাপকাঠির মধ্যে যে মাপকাঠিটা সবার উপরে থাকা দরকার সেটা একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি তার মানবিক আচার-আচরণের সংস্কৃতিটা কেমন তার উপরেও। আমার মনে হয় না আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে যারা চেনেন বা জানেন তারা কেউ গাফফার চৌধুরীর এই মানবিক দিককে কোন ভাবে অস্বীকার বা খাটো করতে পারবেন।
গাফফার চৌধুরীর সাথে আপনার যেকোনো মতামতের ব্যাপারে দ্বিমত অথবা ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাই বলে গফফার চৌধুরী আপনাকে কোনভাবেই সরাসরি ব্যবহারে এতোটুকু পরিমাণ উপেক্ষা করেননি। রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে চাচার সাথে আমারও মতবিরোধ আছে। কিন্তু সেটা চাচা হিসাবে নয়, বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে। উল্লেখ্য, চাচা কখনোই আমার মতামতের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি, বরং প্রশংসাই করেছেন আমার লেখার সততাকে নিয়ে। আমার প্রথম বই ‘দূরের প্রবাস কাছে স্বদেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে, চাচা তখন নিউইয়র্কে আমাদের বাসায় ছিলেন। এই বইটার উপর তখন চাচা একটি রিভিউ দিয়েছিলেন, যেটা ওই সময়ে স্থানীয় পত্রপত্রিকাতে এবং বাংলাদেশে তখনকার সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ ম্যাগাজিনেও ছাপা হয়েছিল। সেই লেখায় চাচা বলেছিলেন, আমার লেখায় নৈর্ব্যক্তিক একটা ধারা আছে, সেটার ব্যাপারে অনেকের দ্বিমত থাকলেও ওর যুক্তিকে খন্ডন করা কঠিন হবে তাদের। মাহমুদের খুব সহজ ভাষা এবং লেখার সচ্ছল গতি পাঠক-কে আকর্ষণ করবে। অনেকের মুখে শুনেছি, চাচা আমার লেখা নিয়ে বলেছেন, লেখার ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা উপস্থাপনা আছে, যা অনেকের থেকে ভিন্ন এবং বেশ নৈর্ব্যক্তিক মনের। চাচা তখন লিখেছিলেন, ‘মাহমুদ ৯০ দশকের লেখক, ওর লেখালেখিতে কোন নেতা-নেত্রীর প্রতি কোন মোহ নেই, সেই কারণেই অনেক কথা ও স্বাচ্ছন্দেই লিখতে পারে, আমরা যা অনেকেই পারি না’।
চাচা যখনি নিউইয়র্কে আসতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আবার যখন ঢাকাতে থাকতেন, সে সময় আমি থাকলে চাচার সাথে অবশ্যই দেখা করতাম। কিছুক্ষণ চাচার পাশে বসে গল্প করতাম। সেই গল্পে রাজনীতির কথা থাকত সামান্য, বেশিটাই থাকত পরিবারকেন্দ্রিক। উলানিয়া বাড়ি কেন্দ্রিক।
চাচার সাথে এখন কথা হয় খুব কম, লন্ডনে থাকলেও চাচা বেশ ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা চাচাকে অনেক শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁরা লন্ডনে গেলে চাচার সাথে সব সময় দেখা করেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। বিষয়টা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা জানেন বলেই হয়তো চাচাকে এত শ্রদ্ধা করেন।
শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী, তার ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাঙালী ও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বিশেষ এক জায়গা নিয়েই আছেন এবং থাকবেন বলে বিশ্বাস।
মানুষ তো কখনো দেবতা হতে পারে না। দেবতার তুল্য হতে পারে না। দোষে-গুণে একজন মানুষ, মানুষ হন। এটাই মানুষ নামের সংজ্ঞা। আমরা কাউকে দেবতাতুল্য বা দেবতা মানের মানুষ ভেবে বিচার করলে ভুল-ই করবো। হিসাব নিকাশটা হবে একজন মানুষের মানবিক গুণাগুণ নিযয়ে। সব মানুষ একইরকম হতে পারে না। যে কোন মানুষকে তার দোষে-গুণে বিচার করে তার গুণকেই সবার উপরে দেখা উচিত। আমরা সেটা করি কম। এই কারণেও সমাজে আমাদের সহানুভূতিশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিনয় এবং যে কোন ব্যক্তির ‘কম্পার্টমেন্টাল পার্সোনালিটি’ নিয়ে আমরা ভাবিও কম। একজন মানুষ কখন, কখন সারা জীবন তার একটা মাত্র গুণের কারণেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে বা থাকতেও পারেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মধ্যে এরকম অনেক গুণ আছে মানুষ হিসাবে তাঁর, আমি মনে করি সেইসব গুণের জন্য ও আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের অনেকের মাঝে আজও যেমন স্মরণীয় আছেন, অনাগত সময়েও থাকবেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তাঁর ডাকনাম চান্দু মিয়া।
আমরা অনেকেই তাঁকে ‘চান্দু চাচা’ বলেও ডাকি। বিশেষ করে আমি এবং আমার বোন নাজমা। চাচা প্রায়ই নাজমার কথা জিজ্ঞেস করেন, ও কেমন আছে, কোথায় আছে। নাজমাকে চাচা বেশ আদর করেন।
একসময় আমাকে বলেছিলেন নাজমার কিছু সাহায্য লাগলে তাকে যেন বলি। আব্বার প্রতি চাচার অগাধ শ্রদ্ধা দেখেছি। যদিও আব্বা এবং চাচার কিছু জীবন দর্শন বিপরীত ছিল। তবু চাচা আব্বাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। আব্বার মৃত্যুর পর (১৯৯২) ঢাকা যাওয়ার পথে চাচাকে লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে বলেছি, আব্বা মারা গেছেন। ফোনে চাচা কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলেন। পরে কষ্ট করে বললেন, মিয়া ভাই চলে গেলো আমাকে রেখে। আমিবা কতদিন বাঁচি বাবা জানিনা।
আজকে চাচা ভীষণ অসুস্থ, বলতে গেলে বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। কিডনি দুটোই অকার্যকর হয়ে গেলে একটা মানুষ কতটুকু আর ভালো থাকে থাকতে পারেন। এটা আমরা সবাই বুঝি। আপনারা চাচার জন্য দোয়া করবেন। যে চাচার, চার মেয়ে ও এক ছেলে, ওরা সবাই এখন চাচার কাছে আছে। চাচার একমাত্র ছেলে বয়সে আমার একটু ছোট, ওর নাম অনুপম রেজা চৌধুরী। চাচার চার মেয়ে এখন লন্ডনে চাচার পাশেই আছে।
বাংলাদেশের অন্যতম কথা সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক শেষবার লন্ডনে চাচার বাসার পেছনে বসে তারা দুই বন্ধু গল্প করছিলেন। সেই ভিডিও ক্লিপটা আমার কাছে ছিল। লক্ষ্য করেছিলাম সৈয়দ হক, চাচা-কে বলছিলেন, গাফফার তোমার ব্যাপারে আমার একটা অভিযোগ আছে। চাচা বলছিলেন বল। সৈয়দ হক বললেন, তুমি কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেছিলে, খুব ভালো গল্প লিখতে। তোমার উচিত-ই ছিল ওখানেই থাকার। কেন যে রাজনীতি নিয়ে লেখ তুমি, আমি জানিনা। চাচা কোন উত্তর দেননি তবে মুচকি হেসে ছিলেন চাচা। বন্ধুর মতামতের প্রতি এটা ছিল তাঁর শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের প্রকাশ।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। এরকম কবিতা যিনি লেখেন বা লিখতে পারেন কবিতায় তার দক্ষতা কতটা সেটাও সহজেই বোঝা যায়। গেলবার যখন ঢাকাতে ছিলাম তখন এম ই চৌধুরী শামীম, একসময় নিউইয়র্কে ছিল। এখানে উদীচী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামীম। ভিশন পরিমার্জিত এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব শামীম। ঢাকায় ফেরত গিয়েও বেশ সফল হয়েছে শামীম ওর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ও-ই আমাকে দেখালো ওর নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা, ‘স্কলার্স পাবলিশার্স’ এখান থেকে ২০০৯ সালে শামীম চাচার একটি কবিতার বই বের করেছে। স্কলার্স পাবলিশার্স থেকে আমার নিজেরও একটা বই বের হবার কথা আছে। চাচা একসময় শামীমের নিউজার্সীর বাসাতে ছিল অতিথি হয়ে। মনে আছে তখন শামীমের বাসা এবং শামীমের আন্তরিকতা নিয়ে একটা সুন্দর রচনা লিখেছিলেন পত্রিকাতে। যাইহোক, চাচার সেই কবিতার বইটার নাম ‘সময়ের ঘড়ি’। চাচা বইটা উৎসর্গ করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী-কে। সেই উৎসর্গ পাতায় চাচা লিখেছেন-
‘কাব্যের আকাশে যারা ধ্রæবতারা নয়
জীবনের সব ব্যথা অকাতরে সয়
তাদেরও কন্ঠের ধ্বনি তোমার লেখায়
বিদ্যুতের মত যেন বিদ্রæপ রেখায়
চিত্তে চমকায়
দ্রোহের আভায়’।
ঐ বইতেই লেখা চাচার আরেকটা কবিতা। কবিতর নাম-
‘আমাদের মিলিত সংগ্রাম:
মৌলানা ভাসানীর নাম’
‘শহরে, বন্দরে, গ্রামে ঘরে
হৃদয়-নগরে
মুখের ভাষায় শুনি, বুকের সাড়ায় শুনি, চোখের তারায় দেখি নাম
মৌলানা ভাসানীর নাম’…….. অসাধারণ কবিতা।
চাচা সম্পর্কে এতোটুকু লিখলাম। চাচার রাজনীতি দর্শন নিয়ে কিছু লিখলাম না কারণ, সবচেয়ে বড় কথা আব্দুল গফফার চৌধুরী আমার বড় চাচা। যদিও আব্বার ছোট, কিন্তু আমার বড় চাচা। আরেক চাচা ছিলেন মেহেদী চাচা, গাফফার চৌধুরী চাচার ছোট।
উনিও ইন্তেকাল করেছেন অনেক বছর আগে। চান্দু চাচা ও মেহেদি চাচা, দু’জন আমার আপন চাচা
আমার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার। চাচা সম্পর্কে ব্যক্তিগত লেখায় কোথাও যদি ভুল কিছু লিখে থাকি আমাকে ক্ষমা করবেন।
লেখাটা কোনোভাবে যদি চাচা পড়েন, আমার ভুল ভ্রান্তি কিংবা কোন স্থানে কোন বেয়াদবি হলে আমাকে ক্ষমা করবেন চাচা।
শ্রদ্ধান্তে
মাহমুদ, নিউইয়র্ক।
নভেম্বর, ১৭, ২০২১