নিউইয়র্ক ০৩:৪০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

শুধুমাত্র ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কি কোনো কাজ হবে? আ. লীগ এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৩৫:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ১০২ বার পঠিত
মোবায়েদুর রহমান: এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। গত ২২ সেপ্টেম্বর আমেরিকা বাংলাদেশের বেশ কয়েক ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কাদের কাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সেসম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কত জনের ওপর করা হয়েছে তাও বলা হয়নি। ভিসা আরোপের যে মূল নীতিমালা রয়েছে সেখানে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য ইত্যাদি ক্যাটেগরি দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন যে এই ভিসা নীতির আওতা অনেক বড় এবং বিস্তৃত। বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠান— যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করবেন তাদেরও ওপরই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এখানে যে কোনো ব্যক্তির ইংরেজি করা হয়েছে Any person. এবং ম্যাথিউ মিলার এবং দেশ ও বিদেশের সাংবাদিকরা এই ‘এ্যানি পার্সনের’ ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন। কাদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তাদের নাম জানতে চাইলে ম্যাথিউ মিলার বলেন যে এই নাম প্রকাশ করার ওপরে মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসম্পর্কে ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গোপনীয়তা ও প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থেই নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
কিন্তু বাংলাদেশে এই নাম প্রকাশ করা নিয়ে তুমুল জল্পনা কল্পনা চলছে। ফেসবুক এবং ইউটিউব এসব জল্পনা কল্পনায় সয়লাব। কারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে তাদের সংখ্যা ৫৭ থেকে শুরু করে ৪৫২ পর্যন্ত পৌঁচেছে। আমাদের কানেও এই বিরাট সংখ্যার কিছু কিছু নাম ধাম এসেছে। কিন্তু আমরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার খাতিরে ঐ সব নাম এখানে উল্লেখ করছি না। কিন্তু দুই জন ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এদের মধ্যে একজন হলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আমরা কিন্তু বলছি না যে জনাব মানিক ভিসা রেস্ট্রিকশনের আওতায় এসেছেন। কিন্তু জনাব মানিক নিজেই একটি কথা বলে বিষয়টি উষ্কে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুনতে পাচ্ছি, আমার ওপরও নাকি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যদি হয়ে থাকে তাহলে কেন হয়েছে সেটা আমি জানি না। তবে আমি এই নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করি না। লন্ডনে আমার বাড়ি আছে। প্রয়োজন হলে আমি লন্ডন গিয়ে থাকবো।
তিনি নিজেই আরেকটি তথ্য ফাঁস করেন। বলেন যে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি পবিত্র হজ¦ব্রত পালনের জন্য মক্কা মোয়াজ্জেমায় গিয়েছিলেন। সেখানে হজে¦র আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নাকি তার হজে¦র আনুষ্ঠানিকতা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেননি। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি লন্ডন আগমন করেন। এখনও নাকি তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। স্বাভাবিকভাবেই তখন জল্পনা কল্পনা শুরু হয় যে তাহলে কি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকের ওপরও ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে?
আরেক ব্যক্তি হলেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ চৌধুরী। তার শেষ কর্ম দিবসে তাকে প্রথা অনুযায়ী বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার নামও শুনছি। তবে আমি কোনো দিন আমেরিকা যাইনি। এবং ভবিষ্যতেও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই। স্বাভাবিকভাবেই বোদ্ধা মানুষদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে যে তারা গায়ে পড়ে এসব কথা বলতে গেলেন কেন? তারা তাদের এসব কথাকে তুলনা করছেন ঐ প্রবাদ বাক্যটির সাথে। সেটি হলো, ‘মাচার তলে কে?’ উত্তর, ‘আমি কলা খাই না’।
এই দুইজন নিজেদের কথা বলেছেন। সাথে প্রাক্তন বিচারপতি মানিকের বয়ানে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। এই তিনটি নাম ছাড়াও আমাদের কাছে গুজবের পাখায় ভর করে আরও অনেক নাম এসেছে। সৎ সাংবাদিকতার স্বার্থে আমরা ঐ সব নাম লেখা থেকে বিরত থাকলাম।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা তো জারি করা হয়েছে। নাম ধাম জানা যাচ্ছে না। গুজবে বাজার ভরপুর। তবে আজ হোক কাল হোক, এসব ব্যক্তির নাম জানা যাবেই। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে যাদের ওপর ভিসা রেস্ট্রিকশন করা হয়েছে তাদের একটি তালিকা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে না থাকায়, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে দেওয়া হয়েছে। শাহরিয়ার আলম বলেছেন যে তালিকাটি ছোট। কত ছোট তা তিনি বলেননি। এখন যাদের ওপর ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে তারা কিভাবে বিষয়টি জানবেন? একটি সূত্র বলছে যে এই দায়িত্ব সরকারের। তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানিয়ে দেবেন। অপর একটি সূত্র বলছে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঐ তালিকা পাঠানো ছাড়াও মার্কিন সরকার আলাদা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে চিঠি দেবেন। এই দুই সূত্রের খবরের মধ্যে যার খবরটিই সঠিক হোক না কেন, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তারা অবশ্যই ইতোমধ্যে ঘটনা জেনে গেছেন।
এ তো গেল ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির কথা। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে? বিরোধী দলের ভেতরে উল্লাস সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ বঙ্গের এক জেলায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন যে আওয়ামী শিবিরে নাকি কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। কান্নাকাটি শুরু হয়েছে কিনা সেটি আমরা জানি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছে তার মধ্যে স্পষ্টভাবে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এ কথা কেউ মানুন আর না মানুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার মাটিতে বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের মাটিতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে ভিসা নীতিকে তিনি পরোয়া করেন না। আমেরিকায় যে যেতেই হবে তার তো কোনো মানে নাই। তবে এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি তার পুত্র সম্পর্কে যে উক্তিটি করেছেন অন্যেরা তার নতুন ডাল পালা গজিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়কে নাকি ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, যদি ওরা জয়কে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে, তো দিক। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলে মেয়েদেরকে লেখা পড়া শিখিয়েছি। ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। জয় আমেরিকাতে বিয়ে করেছে। তার সন্তান আছে। তার বাড়ি আছে। তার সম্পদও আছে। ওরা যদি এরপরেও জয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চায় তো দিক। তাতে কারো কিছু আসে যায় না।
এই ধরণের বক্তব্য তো হলো ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া। ভিসা রেস্ট্রিকশনের রাজনৈতিক ফলআউট কি? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আসুন, সে বিষয়ে কিছু কথা বলা যাক।
এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভয়েস অব আমেরিকাকে’ একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। ইন্টারভিউটি হয়েছে সম্ভবত ২৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের মানুষ সেটি সামাজিক মাধ্যমে জানতে পারলো ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া জানার আগেই আওয়ামী লীগের বর্তমান দুই নম্বর ব্যক্তি জেনারেল সেক্রেটারি ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা আমেরিকার ভিসা রেস্ট্রিকশনকে কেয়ার করি না। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশে সংবিধান মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবেই। কারও শক্তি নাই বর্তমান সংবিধান মোতাবেক যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করার। তিনি আরো আগ বাড়িয়ে বলেছেন যে সুদান, গ্যাবন এবং ভেনিজুয়েলার ওপর ভিসা স্যাংশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ ওগুলো মানেনি। তাদের যে কাজ তারা করে গেছে। ভিসা রেস্ট্রিকশন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা এমন সব কথা বলেছেন যা সহিংস, নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক রীতি নীতির পরিপন্থী। তিনি তার সেই পুরাতন ডায়ালগ আবার স্টার্ট করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কথা ধার করে বলেছেন, ‘খেলা হবে’। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হলো, ‘শেখ হাসিনার জন্মদিনের আলোচনায় ওবায়দুল কাদের/ক্যাপ্টেন আমেরিকায়, তিনি এলে জোরদার খেলা হবে/আমরা কিভাবে চলবো, আমরাই ঠিক করবো’। ক্যাপ্টেন বলতে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কথাই বলছেন।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা সম্পর্কে মির্জা ফখরুল ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ফখরুল সাহেব, ৪৮ ঘন্টা তো গেলো। আপনাদের আন্দোলনে কোনো পাবলিক নাই। আপনাদেরকে কোনো ছাড় নাই। হুমকি দিয়ে লাভ নাই। বৃহৎ শক্তির হুমকিই শেখ হাসিনা পরোয়া করেন না। আর আপনারা?’ গানের বাণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কি আশায় বাধি খেলা ঘর? এই খেলা ঘর ভেঙ্গে সবই হবে বেদনার বালু চর।’ থাকবেন শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা।
বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এরপর সভা সমিতি মিছিল করার জন্য আর কোনো পারমিশন তারা নেবেন না। এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, অনুমতি নেবেন না? জনগণ যখন ধাওয়া দেবে তখন কর্ণফুলি গিয়ে পড়বেন। আমরা মাঠ ছাড়বো না।
এতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মার্কিন বিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে তারা কানাডা বিরোধী ভূমিকাও নিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম শিরোনামে যে সাংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম, ‘কানাডা খুনীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া টুডে’ নামক পত্রিকায় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে তিনি কানাডার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করেন।
এই ধরণের অনেক কথাই বলা হয়েছে। আজকে শেষ করার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। শুধুমাত্র ভিসা স্যাংশন দিয়ে কি নির্বাচনকে পরিশুদ্ধ করা যাবে? বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এর আগে ২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা তিনটি দেশের ওপর ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছিল। দেশ তিনটি হলো নাইজেরিয়া, উগান্ডা এবং সোমালিয়া। বিবিসির বিশ্লেষণ মোতাবেক নাইজেরিয়া এবং উগান্ডায় ভিসা নীতি কাজ করেনি। অর্থাৎ তারা মানেনি। সোমালিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেজন্য সেখানে কিছু কাজ হয়েছে। এই পটভূমিতে সরকার যেখানে মার্কিন বিরোধী ভূমিকায় অনঢ় সেখানে কি ভিসা নীতি কোনো কাজ করবে? আপাত দৃষ্টিতে তা তো মনে হয় না।
ভিসা নীতি বা বিদেশী শক্তি নয়, কাজ করবে প্রবল গণঅভ্যুত্থান। সেই গণঅভ্যুত্থানের আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বলেছে, ৫ অক্টোবরের পর তারা আরও কঠোর কর্মসূচী দেবে। আগামীকাল বুধবার সেই ৫ই অক্টোবর। দেখা যাক, বিএনপি কেমন এবং কোন্ ধরণের কঠোর কর্মসূচী দেয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

শুধুমাত্র ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কি কোনো কাজ হবে? আ. লীগ এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না

প্রকাশের সময় : ০৬:৩৫:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মোবায়েদুর রহমান: এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। গত ২২ সেপ্টেম্বর আমেরিকা বাংলাদেশের বেশ কয়েক ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কাদের কাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সেসম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কত জনের ওপর করা হয়েছে তাও বলা হয়নি। ভিসা আরোপের যে মূল নীতিমালা রয়েছে সেখানে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য ইত্যাদি ক্যাটেগরি দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন যে এই ভিসা নীতির আওতা অনেক বড় এবং বিস্তৃত। বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠান— যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করবেন তাদেরও ওপরই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এখানে যে কোনো ব্যক্তির ইংরেজি করা হয়েছে Any person. এবং ম্যাথিউ মিলার এবং দেশ ও বিদেশের সাংবাদিকরা এই ‘এ্যানি পার্সনের’ ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন। কাদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তাদের নাম জানতে চাইলে ম্যাথিউ মিলার বলেন যে এই নাম প্রকাশ করার ওপরে মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসম্পর্কে ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গোপনীয়তা ও প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থেই নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
কিন্তু বাংলাদেশে এই নাম প্রকাশ করা নিয়ে তুমুল জল্পনা কল্পনা চলছে। ফেসবুক এবং ইউটিউব এসব জল্পনা কল্পনায় সয়লাব। কারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে তাদের সংখ্যা ৫৭ থেকে শুরু করে ৪৫২ পর্যন্ত পৌঁচেছে। আমাদের কানেও এই বিরাট সংখ্যার কিছু কিছু নাম ধাম এসেছে। কিন্তু আমরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার খাতিরে ঐ সব নাম এখানে উল্লেখ করছি না। কিন্তু দুই জন ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এদের মধ্যে একজন হলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আমরা কিন্তু বলছি না যে জনাব মানিক ভিসা রেস্ট্রিকশনের আওতায় এসেছেন। কিন্তু জনাব মানিক নিজেই একটি কথা বলে বিষয়টি উষ্কে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুনতে পাচ্ছি, আমার ওপরও নাকি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যদি হয়ে থাকে তাহলে কেন হয়েছে সেটা আমি জানি না। তবে আমি এই নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করি না। লন্ডনে আমার বাড়ি আছে। প্রয়োজন হলে আমি লন্ডন গিয়ে থাকবো।
তিনি নিজেই আরেকটি তথ্য ফাঁস করেন। বলেন যে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি পবিত্র হজ¦ব্রত পালনের জন্য মক্কা মোয়াজ্জেমায় গিয়েছিলেন। সেখানে হজে¦র আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নাকি তার হজে¦র আনুষ্ঠানিকতা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেননি। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি লন্ডন আগমন করেন। এখনও নাকি তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। স্বাভাবিকভাবেই তখন জল্পনা কল্পনা শুরু হয় যে তাহলে কি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকের ওপরও ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে?
আরেক ব্যক্তি হলেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ চৌধুরী। তার শেষ কর্ম দিবসে তাকে প্রথা অনুযায়ী বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার নামও শুনছি। তবে আমি কোনো দিন আমেরিকা যাইনি। এবং ভবিষ্যতেও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই। স্বাভাবিকভাবেই বোদ্ধা মানুষদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে যে তারা গায়ে পড়ে এসব কথা বলতে গেলেন কেন? তারা তাদের এসব কথাকে তুলনা করছেন ঐ প্রবাদ বাক্যটির সাথে। সেটি হলো, ‘মাচার তলে কে?’ উত্তর, ‘আমি কলা খাই না’।
এই দুইজন নিজেদের কথা বলেছেন। সাথে প্রাক্তন বিচারপতি মানিকের বয়ানে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। এই তিনটি নাম ছাড়াও আমাদের কাছে গুজবের পাখায় ভর করে আরও অনেক নাম এসেছে। সৎ সাংবাদিকতার স্বার্থে আমরা ঐ সব নাম লেখা থেকে বিরত থাকলাম।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা তো জারি করা হয়েছে। নাম ধাম জানা যাচ্ছে না। গুজবে বাজার ভরপুর। তবে আজ হোক কাল হোক, এসব ব্যক্তির নাম জানা যাবেই। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে যাদের ওপর ভিসা রেস্ট্রিকশন করা হয়েছে তাদের একটি তালিকা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে না থাকায়, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে দেওয়া হয়েছে। শাহরিয়ার আলম বলেছেন যে তালিকাটি ছোট। কত ছোট তা তিনি বলেননি। এখন যাদের ওপর ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে তারা কিভাবে বিষয়টি জানবেন? একটি সূত্র বলছে যে এই দায়িত্ব সরকারের। তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানিয়ে দেবেন। অপর একটি সূত্র বলছে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঐ তালিকা পাঠানো ছাড়াও মার্কিন সরকার আলাদা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে চিঠি দেবেন। এই দুই সূত্রের খবরের মধ্যে যার খবরটিই সঠিক হোক না কেন, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তারা অবশ্যই ইতোমধ্যে ঘটনা জেনে গেছেন।
এ তো গেল ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির কথা। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে? বিরোধী দলের ভেতরে উল্লাস সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ বঙ্গের এক জেলায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন যে আওয়ামী শিবিরে নাকি কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। কান্নাকাটি শুরু হয়েছে কিনা সেটি আমরা জানি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছে তার মধ্যে স্পষ্টভাবে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এ কথা কেউ মানুন আর না মানুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার মাটিতে বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের মাটিতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে ভিসা নীতিকে তিনি পরোয়া করেন না। আমেরিকায় যে যেতেই হবে তার তো কোনো মানে নাই। তবে এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি তার পুত্র সম্পর্কে যে উক্তিটি করেছেন অন্যেরা তার নতুন ডাল পালা গজিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়কে নাকি ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, যদি ওরা জয়কে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে, তো দিক। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলে মেয়েদেরকে লেখা পড়া শিখিয়েছি। ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। জয় আমেরিকাতে বিয়ে করেছে। তার সন্তান আছে। তার বাড়ি আছে। তার সম্পদও আছে। ওরা যদি এরপরেও জয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চায় তো দিক। তাতে কারো কিছু আসে যায় না।
এই ধরণের বক্তব্য তো হলো ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া। ভিসা রেস্ট্রিকশনের রাজনৈতিক ফলআউট কি? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আসুন, সে বিষয়ে কিছু কথা বলা যাক।
এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভয়েস অব আমেরিকাকে’ একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। ইন্টারভিউটি হয়েছে সম্ভবত ২৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের মানুষ সেটি সামাজিক মাধ্যমে জানতে পারলো ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া জানার আগেই আওয়ামী লীগের বর্তমান দুই নম্বর ব্যক্তি জেনারেল সেক্রেটারি ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা আমেরিকার ভিসা রেস্ট্রিকশনকে কেয়ার করি না। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশে সংবিধান মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবেই। কারও শক্তি নাই বর্তমান সংবিধান মোতাবেক যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করার। তিনি আরো আগ বাড়িয়ে বলেছেন যে সুদান, গ্যাবন এবং ভেনিজুয়েলার ওপর ভিসা স্যাংশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ ওগুলো মানেনি। তাদের যে কাজ তারা করে গেছে। ভিসা রেস্ট্রিকশন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা এমন সব কথা বলেছেন যা সহিংস, নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক রীতি নীতির পরিপন্থী। তিনি তার সেই পুরাতন ডায়ালগ আবার স্টার্ট করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কথা ধার করে বলেছেন, ‘খেলা হবে’। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হলো, ‘শেখ হাসিনার জন্মদিনের আলোচনায় ওবায়দুল কাদের/ক্যাপ্টেন আমেরিকায়, তিনি এলে জোরদার খেলা হবে/আমরা কিভাবে চলবো, আমরাই ঠিক করবো’। ক্যাপ্টেন বলতে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কথাই বলছেন।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা সম্পর্কে মির্জা ফখরুল ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ফখরুল সাহেব, ৪৮ ঘন্টা তো গেলো। আপনাদের আন্দোলনে কোনো পাবলিক নাই। আপনাদেরকে কোনো ছাড় নাই। হুমকি দিয়ে লাভ নাই। বৃহৎ শক্তির হুমকিই শেখ হাসিনা পরোয়া করেন না। আর আপনারা?’ গানের বাণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কি আশায় বাধি খেলা ঘর? এই খেলা ঘর ভেঙ্গে সবই হবে বেদনার বালু চর।’ থাকবেন শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা।
বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এরপর সভা সমিতি মিছিল করার জন্য আর কোনো পারমিশন তারা নেবেন না। এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, অনুমতি নেবেন না? জনগণ যখন ধাওয়া দেবে তখন কর্ণফুলি গিয়ে পড়বেন। আমরা মাঠ ছাড়বো না।
এতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মার্কিন বিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে তারা কানাডা বিরোধী ভূমিকাও নিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম শিরোনামে যে সাংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম, ‘কানাডা খুনীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া টুডে’ নামক পত্রিকায় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে তিনি কানাডার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করেন।
এই ধরণের অনেক কথাই বলা হয়েছে। আজকে শেষ করার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। শুধুমাত্র ভিসা স্যাংশন দিয়ে কি নির্বাচনকে পরিশুদ্ধ করা যাবে? বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এর আগে ২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা তিনটি দেশের ওপর ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছিল। দেশ তিনটি হলো নাইজেরিয়া, উগান্ডা এবং সোমালিয়া। বিবিসির বিশ্লেষণ মোতাবেক নাইজেরিয়া এবং উগান্ডায় ভিসা নীতি কাজ করেনি। অর্থাৎ তারা মানেনি। সোমালিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেজন্য সেখানে কিছু কাজ হয়েছে। এই পটভূমিতে সরকার যেখানে মার্কিন বিরোধী ভূমিকায় অনঢ় সেখানে কি ভিসা নীতি কোনো কাজ করবে? আপাত দৃষ্টিতে তা তো মনে হয় না।
ভিসা নীতি বা বিদেশী শক্তি নয়, কাজ করবে প্রবল গণঅভ্যুত্থান। সেই গণঅভ্যুত্থানের আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বলেছে, ৫ অক্টোবরের পর তারা আরও কঠোর কর্মসূচী দেবে। আগামীকাল বুধবার সেই ৫ই অক্টোবর। দেখা যাক, বিএনপি কেমন এবং কোন্ ধরণের কঠোর কর্মসূচী দেয়।