নিউইয়র্ক ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৪:৫৫:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০
  • / ৬২ বার পঠিত

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পোশাকে তার ব্যক্তিত্ব এবং শ্রেণী চরিত্র কে বোঝা সহজ হয়। আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের এটাই সাধারণ পোশাক। এই পোশাকে কি বোঝা যায়। বোঝা যায় মানুষটি অত্যন্ত সাদাসিধে স্বভাবের, অল্প চাহিদার। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে এই পোশাকের মানুষটি খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। মিশে যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বা এভাবেও বলা যায় ব্রিটিশ ভারতের অনেক নেতা এবং নেত্রীকে আমরা দেখেছি। নানা পোশাকে, নানা স্বভাবের। পোশাকের সাথে মানুষের স্বভাবের ও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম নেতা গান্ধীর পোশাক ছিল একেবারেই সাধারণ। গান্ধীর চরিত্রের একটা বিশেষ দিকে ছিল তার সেই পোশাক। তার পোশাকের সাথে তার স্বভাব চরিত্রের অমিল ছিল না বলেই, গান্ধীর সেই পোশাক বিশ্ববাসীর কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিলো বলা যায়।
পাক-ভারত উপমহাদেশের আরেক নেতা জিন্নাহ সাহেব। তারও পোশাকের সাথে তার চরিত্রের মিল ছিল বটে। নেহেরুর পোশাকের সাথে নেহেরু’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। নেহেরুর পোশাক ছিল পাজামা, শেরওয়ানি, মাথায় টুপি। নেহেরুর পোশাক খুব সহজেই প্রমাণ করতো ভারতের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চাকাঙ্খী এক ধরনের রাজনৈতিক চরিত্রকেও।
জিন্না সাহেবের পোশাকে আবার আরেকরকম বিষয় আমরা লক্ষ্য করি। সেটাকে একটু গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায় তার পোশাকের সাথে ভারতবর্ষের মানুষের পোশাকের মিল ছলোনা বলা-ই যায়। স্যুটেড-বুটেড জিন্না সাহেবের রাজনীতিটাও ছিল সাধারণ মানুষের শ্রেণীচরিত্র থেকে একটু ভিন্ন, স্বদেশের চাইতে বিদেশ প্রীতি বেশি। ভারতবর্ষে যেন অন্যরকম এক গ্রহ।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী

আজকে যে মহান নেতার কথা সংক্ষেপে কিছু লিখতে চেষ্টা করব তার নাম, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ইংরেজি ১৮৮৫ সালে এই মহান নেতা জন্মগ্রহণ করেন একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। ভাসানী সাহেবের রাজনীতিটাও ছিল বিশ্বের মজলুম বলতে বঞ্চিত মানুষের জন্য। যদি একটু লক্ষ্য করি তার পোশাকের দিকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, আর মাথায় টুপি।
এই পোশাকে কিন্তু বাংলার কোন অথবা ভারতবর্ষের উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষদের দেখিনা। তারপরে সেই মানুষটি যদি একজন বিশেষ মানুষ হন, নেতৃস্থানীয় কেউ হন। সাধারণ ক্ষেত্রে পোষাক ‘বদলে’ যায়। যেমন গিয়েছিল গান্ধীর। আমাদের ইতিহাসের অন্যতম স্বপ্নদর্শী বলবো সেই মাওলানা ভাসানী নিজের কোন জাগতিক স্বার্থে তার পোশাক পরিবর্তন করেননি। বিষয়টা ভেবে দেখার বিষয় আছে কিন্তু।
মলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। অনেক ইতিহাস আছে। মাওলানা ভাসানীর সাথে যারা রাজনীতি করেছেন, তাকে কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন দেশে-বিদেশে। তাই মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার তেমন সুযোগ নেই।
মাওলানা ভাসানী তার সারা জীবনের রাজনীতিতে মজলুম মানুষের জন্য সাহসী কন্ঠ ছিলেন, দিকনির্দেশক ছিলেন। কোন অন্যায়ের সাথে এই মহান নেতা কখনো আপস করেছেন কিনা, সেটা ইতিহাসবিদদের বলবার বিষয়।
মওলানা ভাসানীকে দেখেছি তৎকালীন পাকিস্তানের সামন্তবাদী রাজনীতির বিপক্ষে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে। মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। অনেক ইতিহাসবিদরা বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা মাওলানা ভাসানী সবার আগে দাবি তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে আনার আন্দোলনেও মাওলানা ভাসানীর কোন বিকল্প ছিলনা তখন।
মাওলানা ভাসানী, বাংলাদেশের ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’। কথাটা ইতিহাসবিদরা কখনো খাটো করে দেখবেন না বলেই মনে হয়। মানুষের ভাষায় কথা বলতেন, যে ভাষা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত অসংখ্য মানুষ, বাংলার বঞ্চিত মানুষের। সহজভাবে বুঝতে পারতেন এই মহান নেতার কথা সাধারণ সব মানুষ।
পল্টন ময়দানে একরকম কথা, কিংবা তার বক্তৃতায় একরকম নির্দেশনা। ব্যক্তিগত জীবনে আরেকরকম যাপিত জীবন। তা ছিলনা মাওলানার। টাঙ্গাইলে যে বাড়িতে মাওলানা থাকতেন, (এখন আছে কিনা জানিনা।) সৌভাগ্য হয়েছিল সেই বাড়িটি দেখবার। একেবারে সাধারণ বাড়ি। মাটি ও বেড়ার বাড়ি। একটি কাঠের খাট, মলিন একটি তোষক। এটা ছিল মাওলানার আমরা যাকে বলি বেডরুম।
মাওলানা ভাসানী কে সত্যি স্মরণ করতে হলে, তার জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবসে কিছু আলোচনা, কিছু খিচুড়ি বিলানো, খিচুড়ি খাওয়া। এটা মনে হয় মওলানা ভাসানীকে তার যোগ্য সম্মান দেয়া হয় না। এটা কেবলই কিছু আনুষ্ঠানিকতা। ভাসানী তো কখনও সেই অর্থে ‘আনুষ্ঠানিক’ কোনো ‘ব্যক্তিত্ব’ ছিলেন না। ভাসানী ছিলেন মজলুম মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর স্বপ্নপুরুষ।
আজকের বাংলাদেশ এই মাপের কোনো নেতা নেই আর। যেকোনো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ বলবার কেউ নেই আর।
তবে খামোশ বলবার লোক আছে কিন্ত। তারা খামোশ বলেন যতরকম অনিয়ম, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় সমাজে বাড়ছে। সেসবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে, তাকে খামোশ বলা হয়। প্রয়োজনে মৃত্তিকার সাথে তাকে মিশিয়ে দেয়া হয়। যাতে দ্বিতীয়বার কেউ ‘খামোশ’ না বলতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথাওয়ালা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে। আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটা হল এই মজলুম জননেতার মৃত্যুর পরপরই তার রাজনৈতিক দর্শন, সমর্থক এবং অনুসারীরা অনেক ক্ষেত্রেই রাতারাতি পাল্টে যায়। যারা মাওলানা ভাসানীর খুব কাছের ছিলেন তারাও আর মৌলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ এবং রাজনৈতিক চিন্তাকে ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু কেন পারেননি? প্রশ্নটিই যে কারো মনে আসতেই পারে।
আমরা যদি একটু গভীরে বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়গুলি লক্ষ্য করি তখন আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের ব্যক্তি আধিপত্যবাদ এবং দলীয় আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এই শুরু করার কারণ হলো, দেশের বা সমাজের কোন কোন শ্রেণীর মধ্যে স্বাধীনতার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করা। সেই দেখাটা কি? সেই দেখাটা হল স্বাধীনতা যেন এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। ব্যক্তির ভেতরে যেমন, দলের ভেতরে তেমন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় আমাদের সমাজ চিন্তা এবং সমাজ দর্শনের যেটুকু ইনক্লুসিভ দর্শন কাজ করতো রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে এক্সক্লুসিভ চিন্তার মধ্য দিয়ে।
এটার বড় কারন পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রতি এবং বস্তুকেন্দ্রিক চাওয়া পাওয়ার মধ্যে আমরা স্বাধীনতাকে বা স্বাধীনতার ফল কে ভোগ এবং উপভোগ করতে হঠাৎ করেই এক ধরনের প্রতিযোগিতাতেই লিপ্ত হয়ে পড়ি। এই প্রতিযোগিতাতে রাজনৈতিক দলগুলি সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীকে অগ্রাধিকার দেয়া শুরু করে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে। তখন অজান্তেই রাজনীতিবিদদের সাথে সমাজের অন্যান্য এলিট শ্রেণী বা প্রভাবশালী শ্রেণীর মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে হচ্ছে রুটি হালুয়া ভাগাভাগি করে খাওয়ার মত।  এখানে একটা জিনিস আমাদের বোঝার ব্যাপার আছে যা আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের দাসত্বের এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনিব চরিত্র সমাজে বহুদিন থেকেই সামন্তবাদী সমাজের এক ধরনের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অন্তরালে বেড়ে উঠছিল। রাজনৈতিক গণতন্ত্র সাথে একটু পার্থক্য আছে জনগণের গণতন্ত্রের মধ্যে।
স্বাধীনতার পর পর আমাদের মধ্যে ত্যাগের চাইতে ভোগের স্পৃহা এবং লালসা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয় একটু একটু করে। ১৯৭৫ এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সামাজিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝতে পারব স্বাধীনতার পরপরই আমরা কিভাবে সমাজের নেয় এবং নৈতিকতা বোধ থেকে সরে গিয়েছিলাম কেবলমাত্র শ্রেণি স্বার্থের কারণে। এই শ্রেনীর স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর। কিন্তু মাওলানা ভাসানীর জীবিতকালে-ই মূলত মৌলানার রাজনীতির দর্শন একটু একটু করে বিলীন হওয়া শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে তখন পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির এক ধরনের প্রভাবের কারণে। কে আমাদের শত্রæ, কে আমাদের মিত্র। উভয়ের চেহারা যখন অভিন্ন হওয়া শুরু করল, তখন থেকেই মজলুম মানুষের কণ্ঠস্বর মাওলানা ভাসানীর কণ্ঠস্বর দুর্বল হতে শুরু করল তার শারীরিক এবং বয়সের কারণেও। এই-সব অনেকটা কারণ বলা যেতে পারে যে, মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ভাসানীর রাজনীতি এবং সমাজে মজলুম মানুষদের আর বন্ধু রইল না। বন্ধুর সাথে বন্ধুর পোশাক মিলল না আর। লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি, সরিয়ে রাজনীতির পোশাক বদলে গেল সাফারি সুট, তারপর পুরোদস্তুর স্যুটেড-বুটেড। এসবও বলে দেয় রাজনীতির সামাজিক চরিত্র টুপি, পাঞ্জাবী, লুঙ্গির সাথে সাফারি সুটের পরিবর্তনে রাজনীতিও যে বদলে গিয়েছিল।
মাওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতিতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ মাওলানা জানতেন, প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন পরিবার সম্পদ উৎপাদন করতো নিজেদের ভোগের স্বার্থে। যেমন, একটি কৃষক পরিবার যে ধান উৎপাদন করে সেই পরিবার নিজের ঘরেই সেটা ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করত নিজের খাদ্য সংস্থানের জন্য। ওই চালের বিনিময় কৃষক তার নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র জোগাড় করে নিতো।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হলো বাজার তৈরি করা। বাজারমুখী সংস্কৃতি পুঁজিবাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমাজে এই বাজার মুখি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ছিলেন মাওলানা ভাসানী। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের একটি কেন্দ্র ছিল, উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ। সেই সম্পদ লুট করে নিত পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী এবং আধা পুঁজিবাদী চরিত্রের বণিক শ্রেণি। সেই পাকিস্তানের পুঁজিবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে থাকতেন, বিরুদ্ধে ছিলেন মলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
মওলানা ভাসানী জানতেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত দ্রব্য বা বস্তু সমূহ পণ্যে (commodity) রূপান্তরিত হয়। বাজারে বিক্রয় যোগ্য বস্তুকে আমরা সাধারণত পণ্য বলে থাকি। পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য হলো লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে যাওয়া। এর সাথে আরেকটি বিষয় জড়িত সেটা হল, পুঁজিতন্ত্র উৎপন্ন বস্তুই শুধু পণ্য নয়, মানুষের শ্রম ও ক্ষমতাও পণ্য। এসবও বিক্রি হয় নানাভাবে, মানসিকভাবে শারীরিকভাবে এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে শ্রেণী বৈষম্যের নানা উপায়ে।
মাওলানা ভাসানী জানতেন এবং বুঝতেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিপতি এবং তার ম্যানেজারেরা অথবা শিল্প পরিচালকমন্ডলী উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে আপদমস্তক নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের অর্থ শুধু এই নয় যে, শ্রমিকদের কত মজুরি দেওয়া হবে বা তাদের কাজ কর্মের গতি প্রকৃতি কি হবে তা নির্ধারণ করা। এই নিয়ন্ত্রণ এর অর্থ এটাও যে কী পদ্ধতিতে উৎপাদন হবে বা কোন লাভ জনক পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং সাথে তার বিপণন সংক্রান্ত সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ দখলে রাখা।
পুজি কিংবা অর্থ বিনিয়োগ পরিকল্পনার মালিক পুঁজিপতি। ইতিহাস থেকে আমরা এটাও জানি যে, উনিশ শতকের অবাধ বাণিজ্য যুগ থেকে সরে এসে একচেটিয়া পুঁজি, লগ্নি পুঁজি ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের স্তরের বিকাশ ঘটেছে বিশ শতকের প্রারম্ভে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদের আরো পরিপক্ক রূপ প্রকাশ পায় বহুজাতিক কর্পোরেশন (Multinational Corporation) এর উদ্যোগে গঠিত আধুনিক পুঁজিবাদে।
এই আধুনিক পুঁজিবাদের সামাজিক সংকট, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি যুক্ত ব্যবস্থাপনা, শাসকশ্রেণীর বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করা। এবং সমাজকে নানা ভাবে বিভক্ত করে সমাজে এক ধরনের এলিট তত্ত¡ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর জীবন ছিল বিরতিহীন সংগ্রামের। আজকের বিশ্বের চারিদিকে যদি আমরা একবার দৃষ্টি রাখি দেখতে পাই অর্থনৈতিক পুঁজিবাদের বিকাশ, সামাজিক এলিট তত্ত¡ কিভাবে যে সমাজে মজলুমের ঘনত্ব বানাচ্ছে, সংখ্যা বাড়াচ্ছে। রাষ্ট্রে বৈষম্য বাড়ছে। এসবের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে। তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমন কণ্ঠ, তেমন চরিত্র, আর সেই লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর বেতের টুপির নেতা কই!
সমাধান কোন পথে। সমাধান ইতিহাসের ইতিবাচক ঐতিহ্যকে, ইতিহাসের গৌরবকে, ইতিহাসের সম্মানিত ত্যাগী মানুষদের মনে করে যদি নিজেদের চরিত্র কে একটু পাল্টাতে পারি কোটি, কোটি সাধারণ মানুষদের পক্ষে। তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে যদি একবার বলতে পারি অন্যায়কে ‘খামোশ’।
মাওলানা ভাসানীর জন্ম হোক কিংবা মৃত্যুদিনে তাঁর স্মরণে আমাদের এই চেতনায় নাড়া পড়–ক।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি

প্রকাশের সময় : ০৪:৫৫:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পোশাকে তার ব্যক্তিত্ব এবং শ্রেণী চরিত্র কে বোঝা সহজ হয়। আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের এটাই সাধারণ পোশাক। এই পোশাকে কি বোঝা যায়। বোঝা যায় মানুষটি অত্যন্ত সাদাসিধে স্বভাবের, অল্প চাহিদার। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে এই পোশাকের মানুষটি খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। মিশে যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বা এভাবেও বলা যায় ব্রিটিশ ভারতের অনেক নেতা এবং নেত্রীকে আমরা দেখেছি। নানা পোশাকে, নানা স্বভাবের। পোশাকের সাথে মানুষের স্বভাবের ও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম নেতা গান্ধীর পোশাক ছিল একেবারেই সাধারণ। গান্ধীর চরিত্রের একটা বিশেষ দিকে ছিল তার সেই পোশাক। তার পোশাকের সাথে তার স্বভাব চরিত্রের অমিল ছিল না বলেই, গান্ধীর সেই পোশাক বিশ্ববাসীর কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিলো বলা যায়।
পাক-ভারত উপমহাদেশের আরেক নেতা জিন্নাহ সাহেব। তারও পোশাকের সাথে তার চরিত্রের মিল ছিল বটে। নেহেরুর পোশাকের সাথে নেহেরু’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। নেহেরুর পোশাক ছিল পাজামা, শেরওয়ানি, মাথায় টুপি। নেহেরুর পোশাক খুব সহজেই প্রমাণ করতো ভারতের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চাকাঙ্খী এক ধরনের রাজনৈতিক চরিত্রকেও।
জিন্না সাহেবের পোশাকে আবার আরেকরকম বিষয় আমরা লক্ষ্য করি। সেটাকে একটু গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায় তার পোশাকের সাথে ভারতবর্ষের মানুষের পোশাকের মিল ছলোনা বলা-ই যায়। স্যুটেড-বুটেড জিন্না সাহেবের রাজনীতিটাও ছিল সাধারণ মানুষের শ্রেণীচরিত্র থেকে একটু ভিন্ন, স্বদেশের চাইতে বিদেশ প্রীতি বেশি। ভারতবর্ষে যেন অন্যরকম এক গ্রহ।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী

আজকে যে মহান নেতার কথা সংক্ষেপে কিছু লিখতে চেষ্টা করব তার নাম, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ইংরেজি ১৮৮৫ সালে এই মহান নেতা জন্মগ্রহণ করেন একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। ভাসানী সাহেবের রাজনীতিটাও ছিল বিশ্বের মজলুম বলতে বঞ্চিত মানুষের জন্য। যদি একটু লক্ষ্য করি তার পোশাকের দিকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, আর মাথায় টুপি।
এই পোশাকে কিন্তু বাংলার কোন অথবা ভারতবর্ষের উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষদের দেখিনা। তারপরে সেই মানুষটি যদি একজন বিশেষ মানুষ হন, নেতৃস্থানীয় কেউ হন। সাধারণ ক্ষেত্রে পোষাক ‘বদলে’ যায়। যেমন গিয়েছিল গান্ধীর। আমাদের ইতিহাসের অন্যতম স্বপ্নদর্শী বলবো সেই মাওলানা ভাসানী নিজের কোন জাগতিক স্বার্থে তার পোশাক পরিবর্তন করেননি। বিষয়টা ভেবে দেখার বিষয় আছে কিন্তু।
মলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। অনেক ইতিহাস আছে। মাওলানা ভাসানীর সাথে যারা রাজনীতি করেছেন, তাকে কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন দেশে-বিদেশে। তাই মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার তেমন সুযোগ নেই।
মাওলানা ভাসানী তার সারা জীবনের রাজনীতিতে মজলুম মানুষের জন্য সাহসী কন্ঠ ছিলেন, দিকনির্দেশক ছিলেন। কোন অন্যায়ের সাথে এই মহান নেতা কখনো আপস করেছেন কিনা, সেটা ইতিহাসবিদদের বলবার বিষয়।
মওলানা ভাসানীকে দেখেছি তৎকালীন পাকিস্তানের সামন্তবাদী রাজনীতির বিপক্ষে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে। মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। অনেক ইতিহাসবিদরা বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা মাওলানা ভাসানী সবার আগে দাবি তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে আনার আন্দোলনেও মাওলানা ভাসানীর কোন বিকল্প ছিলনা তখন।
মাওলানা ভাসানী, বাংলাদেশের ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’। কথাটা ইতিহাসবিদরা কখনো খাটো করে দেখবেন না বলেই মনে হয়। মানুষের ভাষায় কথা বলতেন, যে ভাষা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত অসংখ্য মানুষ, বাংলার বঞ্চিত মানুষের। সহজভাবে বুঝতে পারতেন এই মহান নেতার কথা সাধারণ সব মানুষ।
পল্টন ময়দানে একরকম কথা, কিংবা তার বক্তৃতায় একরকম নির্দেশনা। ব্যক্তিগত জীবনে আরেকরকম যাপিত জীবন। তা ছিলনা মাওলানার। টাঙ্গাইলে যে বাড়িতে মাওলানা থাকতেন, (এখন আছে কিনা জানিনা।) সৌভাগ্য হয়েছিল সেই বাড়িটি দেখবার। একেবারে সাধারণ বাড়ি। মাটি ও বেড়ার বাড়ি। একটি কাঠের খাট, মলিন একটি তোষক। এটা ছিল মাওলানার আমরা যাকে বলি বেডরুম।
মাওলানা ভাসানী কে সত্যি স্মরণ করতে হলে, তার জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবসে কিছু আলোচনা, কিছু খিচুড়ি বিলানো, খিচুড়ি খাওয়া। এটা মনে হয় মওলানা ভাসানীকে তার যোগ্য সম্মান দেয়া হয় না। এটা কেবলই কিছু আনুষ্ঠানিকতা। ভাসানী তো কখনও সেই অর্থে ‘আনুষ্ঠানিক’ কোনো ‘ব্যক্তিত্ব’ ছিলেন না। ভাসানী ছিলেন মজলুম মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর স্বপ্নপুরুষ।
আজকের বাংলাদেশ এই মাপের কোনো নেতা নেই আর। যেকোনো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ বলবার কেউ নেই আর।
তবে খামোশ বলবার লোক আছে কিন্ত। তারা খামোশ বলেন যতরকম অনিয়ম, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় সমাজে বাড়ছে। সেসবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে, তাকে খামোশ বলা হয়। প্রয়োজনে মৃত্তিকার সাথে তাকে মিশিয়ে দেয়া হয়। যাতে দ্বিতীয়বার কেউ ‘খামোশ’ না বলতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথাওয়ালা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে। আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটা হল এই মজলুম জননেতার মৃত্যুর পরপরই তার রাজনৈতিক দর্শন, সমর্থক এবং অনুসারীরা অনেক ক্ষেত্রেই রাতারাতি পাল্টে যায়। যারা মাওলানা ভাসানীর খুব কাছের ছিলেন তারাও আর মৌলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ এবং রাজনৈতিক চিন্তাকে ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু কেন পারেননি? প্রশ্নটিই যে কারো মনে আসতেই পারে।
আমরা যদি একটু গভীরে বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়গুলি লক্ষ্য করি তখন আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের ব্যক্তি আধিপত্যবাদ এবং দলীয় আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এই শুরু করার কারণ হলো, দেশের বা সমাজের কোন কোন শ্রেণীর মধ্যে স্বাধীনতার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করা। সেই দেখাটা কি? সেই দেখাটা হল স্বাধীনতা যেন এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। ব্যক্তির ভেতরে যেমন, দলের ভেতরে তেমন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় আমাদের সমাজ চিন্তা এবং সমাজ দর্শনের যেটুকু ইনক্লুসিভ দর্শন কাজ করতো রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে এক্সক্লুসিভ চিন্তার মধ্য দিয়ে।
এটার বড় কারন পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রতি এবং বস্তুকেন্দ্রিক চাওয়া পাওয়ার মধ্যে আমরা স্বাধীনতাকে বা স্বাধীনতার ফল কে ভোগ এবং উপভোগ করতে হঠাৎ করেই এক ধরনের প্রতিযোগিতাতেই লিপ্ত হয়ে পড়ি। এই প্রতিযোগিতাতে রাজনৈতিক দলগুলি সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীকে অগ্রাধিকার দেয়া শুরু করে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে। তখন অজান্তেই রাজনীতিবিদদের সাথে সমাজের অন্যান্য এলিট শ্রেণী বা প্রভাবশালী শ্রেণীর মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে হচ্ছে রুটি হালুয়া ভাগাভাগি করে খাওয়ার মত।  এখানে একটা জিনিস আমাদের বোঝার ব্যাপার আছে যা আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের দাসত্বের এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনিব চরিত্র সমাজে বহুদিন থেকেই সামন্তবাদী সমাজের এক ধরনের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অন্তরালে বেড়ে উঠছিল। রাজনৈতিক গণতন্ত্র সাথে একটু পার্থক্য আছে জনগণের গণতন্ত্রের মধ্যে।
স্বাধীনতার পর পর আমাদের মধ্যে ত্যাগের চাইতে ভোগের স্পৃহা এবং লালসা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয় একটু একটু করে। ১৯৭৫ এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সামাজিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝতে পারব স্বাধীনতার পরপরই আমরা কিভাবে সমাজের নেয় এবং নৈতিকতা বোধ থেকে সরে গিয়েছিলাম কেবলমাত্র শ্রেণি স্বার্থের কারণে। এই শ্রেনীর স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর। কিন্তু মাওলানা ভাসানীর জীবিতকালে-ই মূলত মৌলানার রাজনীতির দর্শন একটু একটু করে বিলীন হওয়া শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে তখন পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির এক ধরনের প্রভাবের কারণে। কে আমাদের শত্রæ, কে আমাদের মিত্র। উভয়ের চেহারা যখন অভিন্ন হওয়া শুরু করল, তখন থেকেই মজলুম মানুষের কণ্ঠস্বর মাওলানা ভাসানীর কণ্ঠস্বর দুর্বল হতে শুরু করল তার শারীরিক এবং বয়সের কারণেও। এই-সব অনেকটা কারণ বলা যেতে পারে যে, মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ভাসানীর রাজনীতি এবং সমাজে মজলুম মানুষদের আর বন্ধু রইল না। বন্ধুর সাথে বন্ধুর পোশাক মিলল না আর। লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি, সরিয়ে রাজনীতির পোশাক বদলে গেল সাফারি সুট, তারপর পুরোদস্তুর স্যুটেড-বুটেড। এসবও বলে দেয় রাজনীতির সামাজিক চরিত্র টুপি, পাঞ্জাবী, লুঙ্গির সাথে সাফারি সুটের পরিবর্তনে রাজনীতিও যে বদলে গিয়েছিল।
মাওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতিতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ মাওলানা জানতেন, প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন পরিবার সম্পদ উৎপাদন করতো নিজেদের ভোগের স্বার্থে। যেমন, একটি কৃষক পরিবার যে ধান উৎপাদন করে সেই পরিবার নিজের ঘরেই সেটা ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করত নিজের খাদ্য সংস্থানের জন্য। ওই চালের বিনিময় কৃষক তার নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র জোগাড় করে নিতো।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হলো বাজার তৈরি করা। বাজারমুখী সংস্কৃতি পুঁজিবাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমাজে এই বাজার মুখি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ছিলেন মাওলানা ভাসানী। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের একটি কেন্দ্র ছিল, উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ। সেই সম্পদ লুট করে নিত পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী এবং আধা পুঁজিবাদী চরিত্রের বণিক শ্রেণি। সেই পাকিস্তানের পুঁজিবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে থাকতেন, বিরুদ্ধে ছিলেন মলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
মওলানা ভাসানী জানতেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত দ্রব্য বা বস্তু সমূহ পণ্যে (commodity) রূপান্তরিত হয়। বাজারে বিক্রয় যোগ্য বস্তুকে আমরা সাধারণত পণ্য বলে থাকি। পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য হলো লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে যাওয়া। এর সাথে আরেকটি বিষয় জড়িত সেটা হল, পুঁজিতন্ত্র উৎপন্ন বস্তুই শুধু পণ্য নয়, মানুষের শ্রম ও ক্ষমতাও পণ্য। এসবও বিক্রি হয় নানাভাবে, মানসিকভাবে শারীরিকভাবে এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে শ্রেণী বৈষম্যের নানা উপায়ে।
মাওলানা ভাসানী জানতেন এবং বুঝতেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিপতি এবং তার ম্যানেজারেরা অথবা শিল্প পরিচালকমন্ডলী উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে আপদমস্তক নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের অর্থ শুধু এই নয় যে, শ্রমিকদের কত মজুরি দেওয়া হবে বা তাদের কাজ কর্মের গতি প্রকৃতি কি হবে তা নির্ধারণ করা। এই নিয়ন্ত্রণ এর অর্থ এটাও যে কী পদ্ধতিতে উৎপাদন হবে বা কোন লাভ জনক পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং সাথে তার বিপণন সংক্রান্ত সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ দখলে রাখা।
পুজি কিংবা অর্থ বিনিয়োগ পরিকল্পনার মালিক পুঁজিপতি। ইতিহাস থেকে আমরা এটাও জানি যে, উনিশ শতকের অবাধ বাণিজ্য যুগ থেকে সরে এসে একচেটিয়া পুঁজি, লগ্নি পুঁজি ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের স্তরের বিকাশ ঘটেছে বিশ শতকের প্রারম্ভে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদের আরো পরিপক্ক রূপ প্রকাশ পায় বহুজাতিক কর্পোরেশন (Multinational Corporation) এর উদ্যোগে গঠিত আধুনিক পুঁজিবাদে।
এই আধুনিক পুঁজিবাদের সামাজিক সংকট, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি যুক্ত ব্যবস্থাপনা, শাসকশ্রেণীর বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করা। এবং সমাজকে নানা ভাবে বিভক্ত করে সমাজে এক ধরনের এলিট তত্ত¡ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর জীবন ছিল বিরতিহীন সংগ্রামের। আজকের বিশ্বের চারিদিকে যদি আমরা একবার দৃষ্টি রাখি দেখতে পাই অর্থনৈতিক পুঁজিবাদের বিকাশ, সামাজিক এলিট তত্ত¡ কিভাবে যে সমাজে মজলুমের ঘনত্ব বানাচ্ছে, সংখ্যা বাড়াচ্ছে। রাষ্ট্রে বৈষম্য বাড়ছে। এসবের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে। তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমন কণ্ঠ, তেমন চরিত্র, আর সেই লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর বেতের টুপির নেতা কই!
সমাধান কোন পথে। সমাধান ইতিহাসের ইতিবাচক ঐতিহ্যকে, ইতিহাসের গৌরবকে, ইতিহাসের সম্মানিত ত্যাগী মানুষদের মনে করে যদি নিজেদের চরিত্র কে একটু পাল্টাতে পারি কোটি, কোটি সাধারণ মানুষদের পক্ষে। তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে যদি একবার বলতে পারি অন্যায়কে ‘খামোশ’।
মাওলানা ভাসানীর জন্ম হোক কিংবা মৃত্যুদিনে তাঁর স্মরণে আমাদের এই চেতনায় নাড়া পড়–ক।