রেশমি রুমাল থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন : আজও সন্তোষে উচ্চকিত মওলানা ভাসানী
- প্রকাশের সময় : ১০:৫২:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৬
- / ১৫৩৮ বার পঠিত
অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারত থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে নামটি আজও অম্লান, তিনি হচ্ছেন- মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি শুধু জনপ্রিয় একজন ইসলামি চিন্তাবিদ বা রাজনীতিকই ছিলেন না, বরং নিপীড়িত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তার নেতৃত্ব ছিল অবিস্মরণীয়। সে কারণে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তানের গোড়াপত্তন ও শেষটায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তার ভূমিকা ছিল দিগন্তপ্রসারী।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এবং নরম্যান থমাস আপহফ ও ওয়ারেন এফ ইলচম্যানের যৌথ সম্পাদিত ‘দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ডেভেলপমেন্ট : থিউর্যাটিক্যাল অ্যান্ড ইমপিরিক্যাল কন্ট্রিবিউশন’ গ্রন্থে এক অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তায় ‘পূর্ব-পাকিস্তান কৃষক সমিতি’ গড়ে তোলার জনক হিসেবে মওলানা ভাসানী চিত্রিত। পাশাপাশি ২০১০ সালে নাভিদা খান সম্পাদিত এবং যুক্তরাজ্য ও ভারতের প্রকাশনা সংস্থা রাউটলেজ থেকে প্রকাশিত ‘বিওন্ড ক্রাইসিস: রি-ইভাল্যুয়েটিং পাকিস্তান (ক্রিটিক্যাল এশিয়ান ষ্টাডিজ)’ গ্রন্থে বামপন্থি রাজনীতির সমতটে ‘ইসলামি সমাজতান্ত্রিক’ হিসেবে তিনি অভিহিত। একইভাবে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে প্রকাশিত ও হুমায়রা ইকতেদার রচিত ‘সেক্যুলারাইজিং ইসলামিস্টস? জামায়াতে ইসলামী অ্যান্ড জামায়াতুদ-দাওয়া ইন আরবান পাকিস্তান’ গ্রন্থে তার অনুরূপ অভিধাটি রয়েছে। এছাড়াও তিনি যে ‘দ্য রেড মওলানা’ বা ‘বিপ্লবী মওলানা’ ছিলেন, তা বিমূর্ত হয়েছে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারী ডেইলি স্টার ও ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় যথাক্রমে ডক্টর লাইলি উদ্দিন রচিত ‘মওলানা ভাসানী: দ্য লেসন অব ফ্রিডম’ ও জিসান খান রচিত ‘টেক মি টু মাই লিডার’ নিবন্ধে।
তবে এই রাজনৈতিক অভিধাগুলোতেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর ইসকান্দার মির্জার শাসনামলে অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিকালীন ১৯৫৪-৫৫ সালে তিনি পাকিস্তানের মেম্বার অব পার্লামেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার রাজনৈতিক উত্থানে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ দারুল উলুমের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৪৭ সালের সিলেট রেফারেন্ডামকালীন আসামের মুসলিমদের একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা, যা পরবর্তীতে আজকের আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। পরে পূর্ব-পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেেেশর স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে দক্ষিনপন্থি, যেমন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীদের পরিত্যাগ করে অগ্রসরমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা সংক্ষেপে ‘ন্যাপ’ গড়ে তোলেন। এছাড়াও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ১৯৫৫-১৯৭৯ সাল স্থায়ী ন্যাটোভুক্ত ও রাশিয়াবিরোধী সামরিক সহযোগী ‘সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সেন্টো’ এবং ‘সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিয়াটো’-তে যোগ দিলে, ভাসানী তার তীব্র বিরোধিতা করেন। অবশ্য তাতে ন্যাপ বিভাজিত হয়ে মস্কো ও পিকিংপন্থি হয় এবং মস্কোপন্থিরা মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে অপর ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গড়েন। এরপর ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধশেষে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের চীনমুখী পররাষ্ট্রনীতির প্রতি সমর্থন জোগালেও পরবর্তীতে ভাসানী ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ফাতেমা জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে সবিশেষ সমর্থন ও নেতৃত্ব দেন। এতে ভাসানী এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যাতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এই ভূখ-ের উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হন। তথাপি ভাসানী ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্দেশিত সাধারণ নির্বাচনে সন্দিহানবশত অংশগ্রহণ না করলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে ১৬২ আসনের ১৬০টি অর্জন করে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
আজ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন যেমন এক সোপানগড়া ইতিহাস, তেমনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর রেশমি রুমাল থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনটিও একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস। সেই অমলীন ইতিহাসের সবটাই জানতে হলে রাজধানী ঢাকার ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী টাঙ্গাইলের সন্তোষে যেতে হবে, যেখানে আমৃত্যূ সংগ্রামী মওলানা ভাসানী ৯৫ বছরের জীবদ্দশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর চিরনিদ্রায় শায়িত। জানা যাবে, কাগমারী পরগনা থেকে সন্তোষ গড়া এবং সেখানকার বন্যাদুর্গত গৃহহীন মানুষের জন্য সুদূর আসাম থেকে কাঠের উপকরণ সামগ্রী ভাসিয়ে আনার কথা। যেখানে গড়ে উঠেছে সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আর প্রবেশমুখে রয়েছে জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, যা বঙ্গবন্ধু নিজে মওলানাকে বুকে জড়িয়ে ১৯৭৫ সালে সরকারীকরণ করেন। তাই বলতে গেলে এক সুবিস্তৃত শিক্ষা পরিম-লে মওলানা ভাসানী রয়েছেন উচ্চকিত। সেখানে ২৮ ছত্রের স্বরচিত একটি কবিতা ‘আর কত কাল’ এক জ্যোত্যির্ময় আবেদনে অনবদ্য, যা তিনি ১৯৪১ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাঠ করেন। উপলব্ধির জন্য তার কয়েকটি ছত্র এমনÑ ‘রৌদ্রে পুড়িয়া বৃষ্টিতে ভিজি কৃষকেরা চষে জমি/ মহাজন আসে সঙ্গে লইয়া নীলামের পরওয়ানা/ চালহীন ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘর আর বুক ভাঙ্গা হাহাকার/ আর কত কাল? জাগো, সবেমিলে করো এর অবসান/ মানুষ তোমরা! শির উঁচু করো, সম্মুখে দেখ চাহি/ দুয়ারে তোমার পয়গাম আসে সাম্যের গান গাহি/ সঙ্গবদ্ধ হও সবে আজ, বুকে আনো হিম্মৎ/ বিজয় ধ্বনিতে ধসিয়া পড়–ক জালিমের ইমারৎ’। (দৈনিক আমাদের অর্থনীতি)
লেখক: টরেন্টো (কানাডা) প্রবাসী, সাংবাদিক।