নিউইয়র্ক ০৭:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিচয় বহন করবে গাজীউল হাসান খান 

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ জুন ২০২৩
  • / ৬০ বার পঠিত

গাজীউল হাসান খান  : বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তির দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এখন চলছে এক উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। এবং সে পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডেমোক্রেটিকদলীয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেটি হবে দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচন। কিন্তু তাঁর নিজ দেশ পরিচালনা এবং বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধ জো বাইডেনের ভূমিকা এরই মধ্যে বেশ কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে পরাশক্তিগতভাবে চীনের ওপরে ধরে রাখা এবং সে লক্ষ্যে অর্থনীতি ও সামরিক দিক থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্বব্যাপী এক চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে এক চীন নীতির বিরোধিতা এবং অন্যদিকে উসকানিমূলকভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সমগ্র বিশ্বকে এক চরম মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি করেছেন। সে পরিস্থিতি থেকে তাঁর নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রও বাদ পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।

কারণ অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ও দৃশ্যমান মন্দার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি, বাণিজ্য ঘাটতি ও দৃশ্যমান বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই দায়ী করছেন। অনেকের ধারণা, বাইডেন দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অত্যাসন্ন হয়ে উঠতে পারে। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণা ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বকে এক অপরিণামদর্শী অস্থিরতা ও সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও পরিত্রাণ পাবে না।

তাতে পরাশক্তিগত দিক থেকে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখা তো দূরের কথা, এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় কিংবা ডলারের একাধিপত্য ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ জো বাইডেন ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন একটি সহনশীল ও ভারসাম্য বজায় রাখার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে এরই মধ্যে অনেকটাই বিপর্যস্ত বা নস্যাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিচয় বহন করবেএ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরে বেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং ক্ষেত্র বিশেষে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তাতে বাড়ছে প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা রিপাবলিকানদলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা।

বেআইনিভাবে তাঁর নিজ বাসস্থানে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক গোপন নথিপত্রের কপি রাখা এবং সেগুলো নিয়ে ফেডারেল অনুসন্ধানকারীদের বারবার মিথ্যা কথা ও তাদের কাজে বাধা প্রদানের দায়ে মায়ামির ফেডারেল কোর্টে ৩৭টি অপরাধমূলক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। আজ ১৩ জুন থেকে সেসব অভিযোগের শুনানি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তাতে সব সত্যকে অগ্রাহ্য করার মতো স্পর্ধাসম্পন্ন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে বলে কানাঘুষা চলছে। এর মধ্যেও সব অভিযোগ মাথায় নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যে রাজনৈতিক সমাবেশ ডেকেছেন। ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ৩৭টি অপরাধমূলক অভিযোগ উত্থাপনের পরও তার বিরোধিতা করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ক্যাভিন ম্যাকার্থি এবং ফ্লোরিডার গভর্নর ও ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ রন ডি সান্তিস।

এতে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী রিপাবলিকানদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফেডারেল কর্তৃপক্ষ যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে তার বিরোধিতা করে নিন্দা জানিয়েছে রিপাবলিকানদলীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল। তারা ফেডারেল কর্তৃপক্ষ উত্থাপিত অপরাধমূলক অভিযোগকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আইনের শাসনের বরখেলাপ বলে মন্তব্য করেছে। এ অবস্থায় নীরব রয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকানদলীয় অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ মাইক পেন্স। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক এই ভাইস প্রেসিডেন্ট তাঁর (ট্রাম্প) বিরুদ্ধে অনেক কিছুই জানেন, যা অন্যরা জানে না। সুতরাং এ বিষয়টি আগামী দিনে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠতে পারে। ফেডারেল আইনের কারণে শেষ পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে পারেন মাইক পেন্স।

ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধমূলক অনেক অভিযোগকেই তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবেন বলে আবাস পাওয়া গেলেও তাঁর (বাইডেনের) জনপ্রিয়তা তেমনভাবে বাড়ছে না। বাড়ছে প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা সাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী বলে চিহ্নিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এ অবস্থা এক সংকটজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়াও রিপাবলিকান দল থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, নিউ জার্সি রাজ্যের সাবেক গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এবং ফ্লোরিডার বর্তমান গভর্নর রন ডি সান্তিসসহ রিপাবলিকানদলীয় আরো কয়েকজন।

এ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান দলকে কোন অবস্থানে নিয়ে যাবে তা এখনো পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন এক মেরুকরণ শুরু হলেও বর্তমান ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কারণে তা শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ দীর্ঘদিন ধরে এক জটিল সমস্যার জন্ম দিয়েছে এবং তা আরো শক্তিশালী করেছে জো বাইডেনসহ ডেমোক্রেটিকদলীয় নেতাদের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উগ্রজাতীয়তাবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ না গড়ে তুলে বরং সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী কায়দায় অগ্রসর হয়েছেন পরাশক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে। তাতে বিশ্বব্যাপী বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার ভাব।

একজন গণতন্ত্রী এবং প্রাজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে জো বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর নিজ দেশ এবং বিশ্বব্যাপী একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক অগ্রসরমাণতার দিগদর্শন চালু করতে। জো বাইডেন উসকানি দিয়েছেন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ চালু করতে এবং তার পাশাপাশি চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে। কিন্তু জো বাইডেনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অকার্যকর হবে বলে অনেকে মনে করেন।

তার কারণ সৌদি আরব, আমিরাত, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশই ক্রমে ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন সামরিক জোট ও বহুকেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয়। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উৎপাদন আরো কমানো হচ্ছে এবং বাড়ানো হচ্ছে মূল্য। ফলে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পোৎপাদনশীল দেশে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জাপান, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমেই নেমে আসছে অর্থনৈতিক মন্দার গ্রাস।

এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য এমনকি প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করেছেন। সেসব কারণে বর্তমানে ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরেও অনেকেই চাচ্ছেন না জো বাইডেন দ্বিতীয় টার্মের জন্য নির্বাচন করুক। একটি সহনশীল ও স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা ধরে রাখা এবং তাকে সামনের দিকে আরো অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে চাচ্ছেন একটি নতুন ধারার রাজনীতি ও বাস্তববাদী তরুণ নেতৃত্ব।

জো বাইডেনের মতো জরাগ্রস্ত ও সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিকদের প্রস্থানের পক্ষে এখন ক্রমেই সমর্থন বাড়ছে। নতুবা তাদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সব কিছু অগ্রাহ্য করার মতো স্পর্ধাসম্পন্ন রাজনীতিকদের আরো জন্ম হতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে। তাতে শুধু সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিই নয়, প্রসার লাভ করবে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রজাতীয়তাবাদ। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী হারাবে তার পরাশক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তি।

এসব দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে ভুল নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়বে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন মূল্যবোধগত যত কিছু আছে তা ক্রমেই হারাতে থাকবে। গণতান্ত্রিক দিক থেকে মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্র নেহাতই একটি সাবেক সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী দেশ হিসেবে নিজের পরিচয়টুকু বহন করতে বাধ্য হবে। লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

সুমি/হককথা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিচয় বহন করবে গাজীউল হাসান খান 

প্রকাশের সময় : ১১:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ জুন ২০২৩

গাজীউল হাসান খান  : বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তির দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এখন চলছে এক উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। এবং সে পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডেমোক্রেটিকদলীয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেটি হবে দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচন। কিন্তু তাঁর নিজ দেশ পরিচালনা এবং বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধ জো বাইডেনের ভূমিকা এরই মধ্যে বেশ কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে পরাশক্তিগতভাবে চীনের ওপরে ধরে রাখা এবং সে লক্ষ্যে অর্থনীতি ও সামরিক দিক থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্বব্যাপী এক চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে এক চীন নীতির বিরোধিতা এবং অন্যদিকে উসকানিমূলকভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সমগ্র বিশ্বকে এক চরম মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি করেছেন। সে পরিস্থিতি থেকে তাঁর নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রও বাদ পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।

কারণ অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ও দৃশ্যমান মন্দার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি, বাণিজ্য ঘাটতি ও দৃশ্যমান বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই দায়ী করছেন। অনেকের ধারণা, বাইডেন দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অত্যাসন্ন হয়ে উঠতে পারে। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণা ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বকে এক অপরিণামদর্শী অস্থিরতা ও সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও পরিত্রাণ পাবে না।

তাতে পরাশক্তিগত দিক থেকে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখা তো দূরের কথা, এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় কিংবা ডলারের একাধিপত্য ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ জো বাইডেন ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন একটি সহনশীল ও ভারসাম্য বজায় রাখার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে এরই মধ্যে অনেকটাই বিপর্যস্ত বা নস্যাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিচয় বহন করবেএ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরে বেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং ক্ষেত্র বিশেষে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তাতে বাড়ছে প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা রিপাবলিকানদলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা।

বেআইনিভাবে তাঁর নিজ বাসস্থানে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক গোপন নথিপত্রের কপি রাখা এবং সেগুলো নিয়ে ফেডারেল অনুসন্ধানকারীদের বারবার মিথ্যা কথা ও তাদের কাজে বাধা প্রদানের দায়ে মায়ামির ফেডারেল কোর্টে ৩৭টি অপরাধমূলক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। আজ ১৩ জুন থেকে সেসব অভিযোগের শুনানি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তাতে সব সত্যকে অগ্রাহ্য করার মতো স্পর্ধাসম্পন্ন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে বলে কানাঘুষা চলছে। এর মধ্যেও সব অভিযোগ মাথায় নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যে রাজনৈতিক সমাবেশ ডেকেছেন। ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ৩৭টি অপরাধমূলক অভিযোগ উত্থাপনের পরও তার বিরোধিতা করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ক্যাভিন ম্যাকার্থি এবং ফ্লোরিডার গভর্নর ও ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ রন ডি সান্তিস।

এতে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী রিপাবলিকানদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফেডারেল কর্তৃপক্ষ যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে তার বিরোধিতা করে নিন্দা জানিয়েছে রিপাবলিকানদলীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল। তারা ফেডারেল কর্তৃপক্ষ উত্থাপিত অপরাধমূলক অভিযোগকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আইনের শাসনের বরখেলাপ বলে মন্তব্য করেছে। এ অবস্থায় নীরব রয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকানদলীয় অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ মাইক পেন্স। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক এই ভাইস প্রেসিডেন্ট তাঁর (ট্রাম্প) বিরুদ্ধে অনেক কিছুই জানেন, যা অন্যরা জানে না। সুতরাং এ বিষয়টি আগামী দিনে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠতে পারে। ফেডারেল আইনের কারণে শেষ পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে পারেন মাইক পেন্স।

ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধমূলক অনেক অভিযোগকেই তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবেন বলে আবাস পাওয়া গেলেও তাঁর (বাইডেনের) জনপ্রিয়তা তেমনভাবে বাড়ছে না। বাড়ছে প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা সাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী বলে চিহ্নিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এ অবস্থা এক সংকটজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়াও রিপাবলিকান দল থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, নিউ জার্সি রাজ্যের সাবেক গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এবং ফ্লোরিডার বর্তমান গভর্নর রন ডি সান্তিসসহ রিপাবলিকানদলীয় আরো কয়েকজন।

এ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান দলকে কোন অবস্থানে নিয়ে যাবে তা এখনো পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন এক মেরুকরণ শুরু হলেও বর্তমান ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কারণে তা শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ দীর্ঘদিন ধরে এক জটিল সমস্যার জন্ম দিয়েছে এবং তা আরো শক্তিশালী করেছে জো বাইডেনসহ ডেমোক্রেটিকদলীয় নেতাদের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উগ্রজাতীয়তাবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ না গড়ে তুলে বরং সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী কায়দায় অগ্রসর হয়েছেন পরাশক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে। তাতে বিশ্বব্যাপী বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার ভাব।

একজন গণতন্ত্রী এবং প্রাজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে জো বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর নিজ দেশ এবং বিশ্বব্যাপী একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক অগ্রসরমাণতার দিগদর্শন চালু করতে। জো বাইডেন উসকানি দিয়েছেন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ চালু করতে এবং তার পাশাপাশি চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে। কিন্তু জো বাইডেনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অকার্যকর হবে বলে অনেকে মনে করেন।

তার কারণ সৌদি আরব, আমিরাত, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশই ক্রমে ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন সামরিক জোট ও বহুকেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয়। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উৎপাদন আরো কমানো হচ্ছে এবং বাড়ানো হচ্ছে মূল্য। ফলে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পোৎপাদনশীল দেশে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জাপান, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমেই নেমে আসছে অর্থনৈতিক মন্দার গ্রাস।

এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য এমনকি প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করেছেন। সেসব কারণে বর্তমানে ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরেও অনেকেই চাচ্ছেন না জো বাইডেন দ্বিতীয় টার্মের জন্য নির্বাচন করুক। একটি সহনশীল ও স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা ধরে রাখা এবং তাকে সামনের দিকে আরো অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে চাচ্ছেন একটি নতুন ধারার রাজনীতি ও বাস্তববাদী তরুণ নেতৃত্ব।

জো বাইডেনের মতো জরাগ্রস্ত ও সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিকদের প্রস্থানের পক্ষে এখন ক্রমেই সমর্থন বাড়ছে। নতুবা তাদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সব কিছু অগ্রাহ্য করার মতো স্পর্ধাসম্পন্ন রাজনীতিকদের আরো জন্ম হতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে। তাতে শুধু সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিই নয়, প্রসার লাভ করবে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রজাতীয়তাবাদ। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী হারাবে তার পরাশক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তি।

এসব দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে ভুল নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়বে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন মূল্যবোধগত যত কিছু আছে তা ক্রমেই হারাতে থাকবে। গণতান্ত্রিক দিক থেকে মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্র নেহাতই একটি সাবেক সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী দেশ হিসেবে নিজের পরিচয়টুকু বহন করতে বাধ্য হবে। লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

সুমি/হককথা