মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ নেবে না
- প্রকাশের সময় : ০৪:২৬:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ মার্চ ২০১৫
- / ৮৭১ বার পঠিত
মনিজা রহমান: বিশ্ব নারী দিবস ছাড়া আর কোন দিবসের তারিখ আমার মনে থাকে না। কি করব ? আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ তো! পুরুষ পাঠকরা হয়ত ভেবে বসতে পারেন, নারী বলেই এমন একচক্ষু নীতি। আদতে কিন্তু তা নয়। ৮ মার্চ নারী দিবসের পরের দিন অর্থাৎ ৯ মার্চ আমার জন্মদিন। নিজের জন্মদিন পৃথিবীতে কে না মনে রাখে? ৮ মার্চ আরো একটা বিশেষ কারণে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এদিন আমার প্রিয় নায়ক আমির খানের জন্মদিন !
বহুবার ভেবেছি যে, বিধাতা আর একদিন আগে আমাকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখালে কি আর এমন ক্ষতি হত! মনে মনে এই ভেবে তৃপ্ত হতাম ৮ মার্চকে ঘিরে বিশ্বময় এত আয়োজন-অনুষ্ঠান, সেখানে কোথায় আমারও যেন অংশগ্রহণ আছে। কিংবা হতে পারে প্রিয় অভিনেতার সঙ্গে একই দিনে জন্মদিন উদযাপন !
প্রশ্ন উঠতে পারে, নারী বলে একটা নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে নিজেকে আটকে রাখার কারণ কি? কিন্তু যাকে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় হিসাব করে, সংসার-সন্তানের জন্য সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সব কাজ করে যেতে হয়, ৫০০ শব্দের একটা লেখা লিখতে গিয়ে দশবার নানা প্রয়োজনে উঠে যেতে হয়, তার জন্য নারী দিবসের বিশেষ তাৎপর্য আছে বৈকি ! আমাদের মতো যাদের কূল রাখি, নাকি শ্যাম রাখি অবস্থা তাদের পুরো জীবনটাই কেমন যেন গোলমেলে। কোন সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না।
মার্চ মাসটা এ বছর আমার জন্য আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর এই মাসের শুরুতে সাজানো ছকের থিতু হওয়া জীবন ছেড়ে নিউইয়র্কে এসেছিলাম। কিভাবে কোথা থেকে একটা বছর চলে গেল!
নাজিম হেকমতের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘আমি বাংলাদেশ ছেড়ে আসার পরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। পৃথিবীকে যদি বলো, সে বলবে- এ আর এমন কি! ক্ষণকাল মাত্র। কিন্তু আমার জীবনের একটি বছর !’
আমার জীবনের সবচেয়ে সংগ্রামময় একটি বছর। স্কুলে পড়ার সময় পরীক্ষার আগের দিন রাতে আমি ছাড়া পৃথিবীর সবাইকে খুব সুখী মানুষ মনে হতো। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে রাস্তার মানুষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আর ভাবতাম, আহারে ওদের তো রাত জেগে, প্রচন্ড টেনশন নিয়ে পড়তে হয় না ! খালি মনে হতো, আমার চেয়ে কষ্টে আর কে আছে?
নিউইয়র্কে আসার পরেও ক্ষণে ক্ষণে মাথার মধ্যে এই ভাবনাটা উঁকি দিত, আমার চেয়ে দু:খে আর কে আছে ! বেড়ানোর জন্য কিংবা কাজের প্রয়োজনে ভিনদেশে যাওয়া এক ব্যপার আর টিকে থাকার জন্য ভিন্ন আবহাওয়া-ভিন্ন সংস্কৃতিতে উদ্বাস্তু জীবন যাপন আরেক ব্যাপার।
এ বছরের শুরু থেকে এই মনোভাবে কিছুটা চিড় ধরল। যখন জানলাম বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা গত দুই মাস ধরে ছুটির দিনে স্কুলে যাচ্ছে। লাখ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থী জীবন হাতে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাচ্ছে। ঢাকায় থাকতে আমার ছোট ছেলে মগবাজার মধুবাগে এক বিশেষ ধরনের স্কুলে পড়তো। মনে আছে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের আগে, কতখানি শংকা আর আতংকে নীল হয়ে আমি ওকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। একবার তো রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরিত হওয়ায়, সেঞ্চুরি অর্কিডে চশমার দোকানের পিছনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম। এখন নতুন শহরে আমি কিছু করতে পারি না পারি, আমার দুই সন্তান তো তুষারপাত হোক আর ব্লিজার্ড হোক, নিয়মিত, নিরাপদে স্কুলে যেতে পারছে।
ফেব্রুয়ারীতে বইমেলা শুরু হবার পরে মনটা আবার আনচান করতে লাগলো। বহু বছরের লালিত অভ্যাস তো। কিন্তু সেই আকাঙ্খায় শেষ পেরেক ঠুকে দিল অভিজিৎ রায়ের সকরুণ চলে যাওয়া। দীর্ঘশ্বাসের শেষ বাষ্পটুকু মিলিয়ে গেল বাতাসে। ইচ্ছে হলো এখনই সাবওয়ে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে ম্যানহাটানে চলে যাই। গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে গিয়ে জাতিসংঘ কার্যালয়ের সুউচ্চ ভবনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠি। এসব নারী দিবস, মানবাধিকার দিবস, মাতৃভাষা দিবস তারাই তো নির্ধারণ করে, তাই না ? তাতে কি সভ্যতা এগিয়েছে এতটুকু ?
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকাতে কেবলই আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর।
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না !’
কারো হয়ত মনে খটকা লাগতে পারে, যার স্মরণশক্তি খারাপ, তার কিভাবে এতখানি কবিতা হুবহু মুখস্ত থাকে। আসলে একটা সময় ছিল, যখন একবার পড়লেই আমার সব মনে থাকতো। ক্লাস সিক্সে থাকতে জীবনে প্রথম ওয়েস্টার্ন বই পড়েছিলাম। শওকত হোসেনের লেখা ‘দখল’। বইয়ের নায়কের নাম ছিল ন্যাট রাফ। ওর দুই কাউবয় বন্ধুর নাম ছিল ম্যাথু গান আর জো হুইটনি। নায়ক-খল নায়কের এ্যাকশন, রোমান্স, উত্তেজনা সবকিছুর রোমাঞ্চকর স্বাদ এখনও যেন মস্তিস্কের কোষে কোষে লেগে আছে। অথচ এখন দেখুন গতকাল পড়া বইয়ের নায়কের নাম শুধু নয়, বইয়ের নামও ভুলে যাই।
আবার আবুল হাসানে আসি। আজ থেকে সম্ভবত পঁচিশ বছর আগে দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় কবির কবিতার ওপর বিশ্লেষণধর্মী একটা লেখা পড়েছিলাম। তখন ওই বয়সে পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতাম শুক্রবারের সাহিত্য পাতার জন্য। সাহিত্য সাময়িকীর কোন লেখা ভালো লাগলে একাধিকবারও পড়েছি। যেমন এই লেখাটা। আজও জীবনের প্রতিটি ব্যর্থতায় মনে করি আবুল হাসানের অসাধারণ দুই লাইন-
‘ওরা ভরে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ
আমি লাস্টবেঞ্চি আমি কিছুই পারবো না’
দূরে এসে এভাবে স্মৃতি-কল্পনার জাবর কাটাই। এ যেন আয়নায় নিজের ছবির সামনে দাঁড়ানো। শুধু প্রিয় বঙ্গভূমির দিকে তাকালেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। পেট্রোল বোমায় পোড়া লাশ, গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, অভিজিৎ রায় নামে এক মুক্তমনার বলিদান। কিন্তু উচ্চকণ্ঠে কিছু বলতে গেলে বাধে। মনে হয় আমার যেন সেই অধিকার নেই। আসলে যার একটা মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিশু থাকে, তার স্বাধীনতা সবদিক থেকে খর্ব হতে থাকে। প্রিয় কবির আবৃত্তি অনুষ্ঠানে গিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে যাকে সিঁড়িতে বসে শুনতে হয় উচ্চারিত শব্দমালা। এভাবে ক্রমে আড়াল হতে হতে হয়ত একদিন হারিয়েই যেত হয় তাকে।
দেড় যুগের বেশী সময় চাকরি করার পরে জীবনে প্রথমবারের মতো উপার্জনবিহীন থাকা কিংবা একটি বিশেষ শিশুর মা হয়ে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে জীবনটা পার করে দেয়া যেত। তাতে লাভ কিছুই হত না। শরীরের হাড়ে হাড়ে ক্লেদ আর গ্লানি সঞ্চিত হতে দেয়া ছাড়া। চারদিক তুষারপাতে সাদা হয়ে যাওয়া শহরে ভাবতে বসি।
‘তবু পাতা-তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে ল’য়ে
বনের শাখার মতো-শাখার পাখীর মতো হ’য়ে
হিমের হাওয়ার রাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে
বিদীর্ণ শাখার শব্দে-অসুস্থ ডানার কোলাহলে
ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে
আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে
আমার এ-জীবন, জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমার দিন চলে, আমার রাত্রি তবু চলে
তার ছিড়েঁ গেছে, তবু তাহারে বীণার মতো করে
বাজাই, যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধরে!’
আমার জীবন থেকে এভাবে চলে গেছে মাঠ, গ্যালারি, স্টেডিয়াম, প্রেসবক্সশিরা-উপশিরায় একদিন ছিল যারা। তবু আমি স্বপ্নে-জাগরণে সেখানেই বাস করি। অনেক নেতিবাচক খবরের ভিড়ে শুধু চোখ রাখতে চাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টাইগারদের সাফল্য গাথায় (কেউ হয়ত ভাবতে পারেন ক্রীড়া সাংবাদিক বলেই এমন পক্ষপাত) কিংবা খুঁটিয়ে পড়ি আর আশায় উদ্দীপ্ত হই কখনও সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন কিংবা ফুটবলার সাবিনা খাতুনের দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে অর্জনের মহিমায় (পুরুষরা বলতে পারেন নারী বলেই শুধু এই দুজনের কথা বলা হল)।
না পুরুষ পাঠক, একজন দুইজন ব্যতিক্রমের জন্য পুরুষ জাতির প্রতি বিষোদগারে আকীর্ণ হৃদয় আমার নয়। নাদিয়ার সাফল্যের খবর আমি জেনেছিলাম তাঁর এক পুরুষ সহকর্মীর দেয়া স্ট্যাটাস থেকে। আর সাবিনার মতো স্কুল কলেজে দৌড়ে-লাফে প্রথম হওয়া কত মেয়ে ঘোর সংসারী হয়ে জীবন থেকে হারিয়ে যায়, যদি না সে আকবর আলী মতো কোন কোচের চোখে না পড়ে!
প্রতিভা তো অনেকেরই থাকে। কিন্তু বিকশিত পারতে পারে কজন? যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, অর্থ দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, সুযোগ দিয়ে নারীকে নিজেকে চেনাতে সাহায্য করেছেন, সে পুরুষ হোক আর নারী হোক.. বিন¤্র প্রণতি আমার সবার জন্য।