মুক্তচিন্তা ও সংগ্রামের পথপ্রদর্শক
- প্রকাশের সময় : ০৮:৪২:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২
- / ৩৭ বার পঠিত
যুক্তিবাদিতা ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা কেউ কাউকে দিতে পারে না। এক্ষেত্রে মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী বিধিবিধান কিংবা অনুশাসন মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। তবে সে পথগুলোয় বিরাজিত কিংবা অন্তর্নিহিত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সচ্ছল মুক্তির পথ নিশ্চিত করতে যুক্তি ও মুক্তচিন্তার প্রয়োজন। জ্ঞানী মানুষ কিংবা তাত্ত্বিকরা সে পথ যুক্তি, মুক্তচিন্তা কিংবা বৃহত্তরভাবে গবেষণার (ইজতেহাদ) মাধ্যমে খুঁজে পেয়ে থাকেন। সে পথ কেউ অবরুদ্ধ করতে পারে না। তবে সেক্ষেত্রে চাই মানসিক প্রস্তুতি। সর্বাগ্রে দেখতে হবে আমরা অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা, বিশেষ করে কায়েমি স্বার্থ বা ক্ষমতার লড়াই থেকে বেরিয়ে সর্বাঙ্গীণ মুক্তির পথে হাঁটতে প্রস্তুত কি না। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও বাংলাদেশের জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরেও সময়োচিতভাবে দৃষ্টি দিয়েছিলেন।
এ কারণেই ভাসানী একজন ধার্মিক হয়েও ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে থেকেও বারবার সমাজ বিপ্লবের কথা বলেছেন। সেটি তার যুক্তিবাদিতা ও মুক্তচিন্তার ফসল। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মানুষের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে প্রচলিত বিধিবিধানের বাইরেও পথ অনুসন্ধান করা অপ্রাসঙ্গিক নয়। জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেশবাসীর মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন, যা শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়েছিল গণ-আন্দোলনে সাফল্য।
এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, ব্যক্তিগতভাবে ভাসানী নিজেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আধিষ্ঠিত করার জন্য রাজনীতি করেননি। তার লক্ষ্য ছিল অপশাসন, শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ কৃষক-শ্রমিক কিংবা মেহনতি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্র বিভিন্ন সময় তার গৃহীত বিভিন্ন রাজনীতি ও রণকৌশলের অগ্নিঝরা তাণ্ডবের কারণে কেউ তাকে বলেছেন বিদ্রোহী, আবার কেউ বলেছেন বিপ্লবী অগ্নিপুরুষ। ভাসানীর আজন্ম আপসহীন সংগ্রামের সঙ্গে চিরায়ত ধর্মের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। ধর্ম পালন করেও তিনি ছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রের মাঠে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিতে পেরেছিলেন সমাজ বিপ্লবের। রাজনীতিগতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য যে যে কর্মসূচি কিংবা কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা বাস্তবসম্মত ছিল, তিনি নির্দ্বিধায় দৃপ্ত পদভারে সে পথেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাতে সমালোচক কিংবা নিন্দুকেরা তাকে যত অপবাদই দিক না কেন, তিনি তার পরোয়া করেননি। কারণ রাজনীতিগতভাবে তার ক্ষমতা হরানোর কোনো ভয় ছিল না। এটিও একজন আপসহীন নেতা হিসাবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তার সাফল্যের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। তার সংগ্রামের কারণে তিনি চেয়েছিলেন জনগণের মুক্তি, কোনো ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান কিংবা প্রতিদান নয়। সে মানসিক প্রস্তুতি, দীর্ঘদিনের জেল-জুলুম ও লাগাতার সংগ্রামই একদিন তাকে এনে দিয়েছিল এক ‘মুকুটহীন সম্রাটে’র অভিধা।
ভাসানীর সংগ্রামের ধারা ধর্মীয় অনুশাসনের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিরোধ সৃষ্টি না করলেও ফতোয়াবাজরা তাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করতে তৎপর ছিল। কিন্তু ভাসানীর যুক্তি, মুক্তচিন্তা এবং আপসহীন লড়াইয়ের পরিপার্শ্বিকতায় সেগুলো ধোপে টেকেনি। তার বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল একজন মওলানা হয়েও তিনি কেন ইসলামি জোটের ‘পাকিস্তানি পলিটিক্স’-এর ত্রিসীমানায় নেই। গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী হয়েও বামপন্থি, কমিউনিস্ট কিংবা বিপ্লবীদের সঙ্গে তার কেন সব গোপন আঁতাত।
ভাসানী দর্শনে ও মননে ছিলেন একজন নির্ভেজাল বাঙালি। একজন প্রগতিবাদী, আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, একজন বিপ্লবী। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বাহারউদ্দিন প্রকাশিত ‘আফলাতুনের পৃথিবী-যুক্তি ও মুক্তিচিন্তার বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে তিনি যুক্তি ও মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মীয়, বিশেষ করে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, ধর্মীয় (ইসলাম) কারণে তৎকালীন আরববিশ্বের দার্শনিকদের যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দার্শনিক ইবনে রুশদ তার সময়ে আরববিশ্বে ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি। রুশদ ইসলাম কিংবা কুরআনের আলোকে যুক্তিবাদিতা ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে বেশ সরব হয়েছিলেন। এটি অপ্রয়োজনীয় কিংবা নিষিদ্ধ নয়। সে দর্শনচর্চা অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল বলে তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। বাহারউদ্দিন একপর্যায়ে ইবনে রুশদের উদ্ধৃতি দিয়ে এও বলেছেন, ইবনে রুশদের বিশ্বাস ছিল অ্যারিস্টটলের দর্শন মানুষের কাছে স্রষ্টার সেরা প্রত্যাদেশ। তার বাণীর সঙ্গে ধর্মের কোথাও বিরোধ নেই, বরং ধর্মের সত্যকে পরিপূর্ণ করে বহু চর্চিত গ্রিক দার্শনিক ভাবনা। ধর্ম যেখানে অর্ধসত্যের খবর দেয়, সেখান থেকে মানুষকে পূর্ণ সত্যের দরজায় পৌঁছে দেন দার্শনিক। এখানেই রুশদের চিন্তার পূর্ণতা, বলেছেন বাহারউদ্দিন। মওলানা ভাসানীর দর্শন, বিশেষ করে যুক্তিবাদিতা ও মুক্তচিন্তার পথ, সেভাবেই অগ্রসর হয়েছিল। ভাসানী মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তচিন্তার পথ। সে কারণেই কৃষক-শ্রমিকরাজ কিংবা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেছেন তার অন্তরের গভীর আধ্যাত্মিক প্রত্যাশা-‘রবুবিয়াহ’ প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে ভাসানীর মতে মানুষ, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোনোভাবেই সার্বভৌম হতে পারে না। কারণ উল্লিখিতদের রয়েছে সর্বক্ষেত্রে নিদারুণ সীমাবদ্ধতা। তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখন একমাত্র রবই (আল্লাহ) স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সব ক্ষমতার অধিকারী। আর সেই স্রষ্টাই নিশ্চিত করতে পারেন মানুষের সব ইহলৌকিক ও পারলৌকিক চাহিদা, ক্ষমতা ও অধিকার। অন্য কেউ নয়।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কিংবা বিদ্রোহ ও বিপ্লবের যথাযথ পাঠ ভাসানীর ছিল। পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত অগ্রসর। যমুনার বুকে নৌকায় অবস্থান করে রাতের পর রাত তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সেই নির্জন পরিবেশে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান। ‘রবুবিয়াহ’ প্রতিষ্ঠার ধারণা ভাসানীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গভীর সাধনার এক উল্লেখযোগ্য ফসল। তিনি পার্থিব-অপার্থিব, বাস্তব-অবাস্তব এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকেও গভীর চিন্তাভাবনায় নিয়োজিত ছিলেন। মানুষের পার্থিব বা দৈনন্দিন চাহিদার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চাহিদারও একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ মানুষ জড় পদার্থ নয়। তার একটি স্পর্শকাতর অমূল্য জীবন রয়েছে এবং সে জীবনের রয়েছে একটি মনোজগৎ। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার মানুষের মনোজগতের কোনো চাহিদাকেই মেটাতে পারে না। এগুলো যুক্তিবাদের বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়। চীনের প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক কিংবা শিক্ষক কনফুসিয়াস, যার জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টের প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে, তিনিও এ বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছেন। দিয়ে গেছেন একটি মানবদর্শন কিংবা ধর্ম, যা আজও চীনে অসংখ্য মানুষ অনুসরণ করে, চর্চা করে।
মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন ছিন্নমূল মানুষ। শৈশবেই তিনি পিতা-মাতা, ভাইবোন হারিয়েছিলেন। বেড়ে উঠেছিলেন একজন ভুখা-নাঙ্গা শ্রমজীবী মানুষ হিসাবে। শোষণ, শাসন, বঞ্চনা, সামাজিক বৈষম্য ও অনাচার কাকে বলে, শৈশব থেকেই তিনি সে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। এ কারণেই ব্রিটিশশাসিত ভারতে কিংবা আসামের প্রত্যন্ত প্রান্তরে তিনি লড়াই করেছেন অধিকারহারা মানুষের জন্য। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধেও আপসনহীনভাবে চালিয়ে গেছেন তার লড়াই। তিনি জানতেন, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে প্রথাগত আচরণের মাধ্যমে অধিকার আদায় করা অসম্ভব। তাই তিনি প্রচার করেছিলেন সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা। তিনি জানতেন, প্রথাগত সংগ্রামের মাধ্যমে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্ভব নয়। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাজপথের অব্যাহত লড়াইকে। পাশাপাশি মানুষের মনোজগতের খোরাকের জন্য তিনি দেখিয়েছেন আধ্যাত্মিক কিংবা ধর্মচর্চার পথ। ভাসানী প্রথাগতভাবে শুধু একজন রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন এক যুগোপযোগী শিক্ষকও। এক অলৌকিক বিপ্লবী পুরুষ, যিনি এখনো বিভিন্ন সংকটে আমাদের পাশে দাঁড়ান। পথ দেখান। সূত্র : যুগান্তর
গাজীউল হাসান খান : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক