মা দিবস স্মরণে : মাকে মনে পড়ে
![](https://hakkatha.com/wp-content/uploads/2024/05/hakkathafav.png)
- প্রকাশের সময় : ০২:৪৪:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০১৯
- / ১১৯৩ বার পঠিত
এবিএম সালেহ উদ্দীন: মা। এক অক্ষরের একটি শব্দ। কিন্তু এর তাৎপর্য ব্যাপক। জগতে মায়ের সাথে আর কেউকে তুলনা করা যায় না। মায়ের সাথে সন্তানের যত স্মৃতি কিংবা সন্তান নিয়ে অমলিন স্মৃতির কোন তুলনা হয়না। সন্তানের আসন্ন যেকোন বিপদের আগাম দ্রষ্টা মা। অতুলনীয় মমত্ববোধ ও ভালোবাসার নির্যাসিত অনুভব ও উপলব্ধিতে মা সন্তানের সমূহ বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারেন। বলা হয়ে থাকে মায়ের চোখে সন্তানের বিপদ সম্পর্কে “পাড়া-পরশীর সবার চেয়ে আগে জানেন মা”। আমাদের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কিংবা জীবনের প্রতি পরতে মায়ের জীবদ্দশার কত স্মৃতি হৃদয়ে বহমান। আমার কিশোর বেলার এমন একটি স্মৃতি এখনও চোখে ভাসে। বাবা হয়ত: ভেবেছিলেন যে বাড়িতে এত কোলাহলের মধ্যে পড়ালেখা করা যায়না। তাই আমাকে প্রথমে গজারিয়া বাজারের একটি ঘরে এবং পরবর্তীতে ভোলায় থাকতে হয়েছে। সেই কারণে বারো বছর বয়স থেকেই আমি আমি বাড়িছাড়া। প্রথমে বাবা বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমায় রেখে যেতেন। কিন্তু একদম মন বসতো না। মায়ের ¯েœহ পরশের আশায় আকুল হয়ে থাকতাম। খুউব কান্না করতাম। প্রায়শ:ই সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি চলে আসতাম। ভোলা শহর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব পঞ্চাশ মাইল। প্রথমে রিক্সা কিংবা পায়ে হেঁটে অত:পর বাস চেপেই ভোলা যাতায়ত করতে হতো। একবার
মা অতুলনীয়। মহান আল্লাহ পাক মাকে সব কিছুর উর্দ্ধে মর্যাদা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বনবী (দ) বলেছেন- “মা হচ্ছেন সমগ্র জাহানের শ্রেষ্ঠ সন্মানীয় নিয়ামত। মাকে কখনও কষ্ট দেয়া যাবে না, অসম্মান করা যাবে না।” তিনি আরো বলেছেন- “পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট ও পাপিষ্ঠ সে ব্যক্তি; যে তার মাকে কষ্ট দেয়, মাকে অসম্মান করে (?) সে অবশ্যই অভিশপ্ত।” সন্তানের প্রতি মায়ের ¯েœহ ও ভালোবাসা অকৃত্রিম। পৃথিবীর কোন কিছুর সঙ্গে মায়ের মায়া-মমতার তুলনা হয় না। অর্থ্যাৎ মহা-মহিম আল্লাহ ও রাসুলে পাকের পরই মায়ের স্থান। হাদিসে আছে- ‘মায়ের পদতলেই সন্তানের বেহেস্ত।’ অতএব মর্যাদাগতভাবে দুনিয়া-জাহানে মায়ের সমকক্ষ আর কেউ নয়। মায়ের তুলনা মা-ই।
বিশ্বচরাচরে মায়ের মর্যাদাকে উচ্চকিত রাখার তাগিদ হচ্ছে মানবধর্মের অন্যতম শিক্ষা। মাকে যেনো অবহেলা না করা হয়। ইসলামে মাতা-পিতার প্রতি অসন্মান ও অবহেলা প্রদর্শন মহা পাপ। এটি ক্ষমাহীন অপরাধ। মাতা-পিতার সন্মান ও মর্যাদা রক্ষার তাগিদে পৃথিবীর সকল ধর্ম এবং মনীষীদের অসংখ্য উক্তি আছে। এ মুহুর্তে রাধারানী দেবীর একটি উক্তি মনে পড়ছেÑ“মা মা-ই। মায়ের সাথে পৃথিবীর আর কিছুর তুলনা চলে না।” এ ব্যাপারে নেপোলিয়ানের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছেনÑ“একটি দেশের পুনরুজ্জীবনের জন্য বিশেষ কিছুরই দরকার হয় না, কেবল মাত্র দরকার হয় কিছু সংখ্যক সু-মাতার।”
পৃথিবীতে সৌভাগ্যবান তিনি, যিনি মায়ের আদর, মায়া-মমতা ও ¯েœহ-পরশে বড় হয়েছেন এবং মাকেই সবকিছুর উর্দ্ধে মর্যাদা দিয়েছেন। আবার এমন অনেক সন্তান আছেন, যারা শিশুকালে মা হারিয়েছেন। মায়ের আদর ও ¯েœহ বঞ্চিত হয়েছেন কিন্তু বড় হয়ে কখনো মাকে ভুলে যান নি। জীবনভর মায়ের মর্যাদাকে বক্ষে ধারণ করে ধন্য হয়েছেন।
মহানবী (দ) জন্মের আগেই পিতৃহারা হয়েছিলেন এবং জন্মের চার বছরের মাথায় প্রাণপ্রিয় মাকে হারিয়েছেন। মাতা-পিতার আদর-¯েœহ বঞ্চিত নিদারুণ দু:খবোধ অন্তরজ্বালা নিয়ে মা-বাবার আবাল্য অস্ফুট স্মৃতিকে বক্ষে ধারণ করেই তিনি মহামহিমের নৈকট্যের পূর্ণ প্রাপ্তির মাধ্যমে জগতের সকল মায়ের প্রতি অপার শ্রদ্ধাবোধ ও সন্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মহানবীর চিরকালের নির্দেশনা হচ্ছে ‘জগতের সকল মায়ের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ-অসিদ্ধ সন্তানই দুর্ভাগা এবং সে অভিশপ্ত।’
মায়ের দু:খ-কষ্ট ও বেদনা মোচনে সর্বাগ্রে সন্তানকেই এগিয়ে আসতে হবে। মাকে অসন্তষ্ট রেখে কিংবা অবহেলা করলে দুনিয়ায় অভিশপ্ত জীবন আর পরকালে ক্ষমাহীন কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এ পৃথিবীর কোন কোন মা সন্তানের নিকট থেকে অবহেলার শিকার হয়েছেন। মা অভিশাপ না দিলেও পাপিষ্ট সন্তানের ভাগ্যে জুটেছে জগতধিকৃত অভিশাপ নিয়ে নিষ্প্রদীপ ধিকৃত জীবনপাতের ঘটনা।
মায়ের খুশি ও সন্তুষ্টির উপর সন্তানকে সদা সচেতন এবং হতে হবে দায়িত্ববান। দুখিনী মায়ের কষ্টবোধকে বিদূরিত করার জন্য সন্তানকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (র)-এর শিশুকালের একটি ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনা। যিনি কুরআন হাফেজ অবস্থায় জন্মেছিলেন। একবার রাতে তাঁর মমতাময়ী মা শুয়েছিলেন এবং আদরের শিশুর কাছে পানি চাইলেন। শিশু আ: কাদের (র) পানি নিয়ে এসে দেখেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাত পোহানোর আগে মা ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার সন্তান পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কম্পিত শরীরসহ দন্ডায়মান! সারা রাত শিশু বাচ্চাটি পানি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন! এ দৃশ্য অবলোকন করে মা তো হতভম্ব। শিশুটির তুলতুলে পা দুটি ফুলে গেছে এবং সারা শরীর কাঁপছে। বাচাধনকে বুকে টেনে মা হাউমাউ কেঁদে উঠলেন। মায়ের ঘুমের বেঘাত হবে, কষ্ট হবে ভেবে মাকে জাগান নি। মহীয়সী মায়ের দোয়ায় তিনি আজ জগদ্বিখ্যাত।
তেমনি মমতাময়ী মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এক মহা দুর্যোপূর্ণ ঝড়-বৃষ্টির ঘোরতর অন্ধকার রাতে একটি বিরাট স্রোতবাহি নদী সাঁতরিয়ে পার হয়ে কঠিন কষ্টের মধ্য দিয়ে মায়ের সান্নিধ্যে পৌঁছে জগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন। মায়ের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে।
সন্তানের জন্য, সন্তানের সুখের লাগি মায়ের ত্যাগ ও কষ্টের কোন তুলনা নেই। সমগ্র জাহানের কোন কিছুর সঙ্গে মায়ের অবদানের তুলনা করা যাবে না। হাদিসে আছেÑ “মাতা-পিতার আনন্দে খোদার আনন্দ এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে খোদা অসন্তুষ্ট।”
অতএব মাকে কখনও অবজ্ঞা করা যাবে না। অসন্মান করা যাবে না। মায়ের অধিকার রক্ষা করেই মহত্ব অর্জন করতে হবে। কারণ পৃথিবীতে মহৎ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে একজন সুমাতার অবদানই সবচেয়ে বেশি। শ্রেষ্ঠ মানুষেরা কখনো তাদের মাকে অমর্যাদা করেন নি।
পৃথিবীতে মা নিয়ে যত গল্প-কবিতা ও গান আছে। মায়ের মর্যাদা রক্ষার তাগিদ আছে। আর কিছুতে তা নেই। সকল ভাষা, সকল ধর্ম আর সকল জাতির মুখে মা নামটি একযোগে যেমন উচ্চারিত হয়। তেমনটি আর কিছুতে হয় না। জগতে একমাত্র মায়েরই কোন প্রতি শব্দ নেই। মা মা-ই। সবাই সকল ভাষায় মাকে মা বলেই ডাকেন। মায়ের চিরত্ব ও মর্যাদার জন্য এমন বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত আর কিছুতে নাই।
সূর্য যেমন অনন্তকাল পৃথিবীতে আলো ছড়ায়; তেমনি মায়ের মমতা ছেয়ে থাকে সমগ্র বিশ্বময়।
মায়ের শুন্যতা কোন কিছুতেই পুরণ হবার নয়। আমরা যারা মা হারা তারা মায়ের মর্ম চিন্তা উপলব্ধি করে ব্যাকুল-বিষন্ন হয়ে উঠি। শয়নে-স্বপনে সর্বদা মাকে খুঁজি। কিন্তু মাকে পাই না। কিন্তু যাদের মা আছেন, তারা তাদের সৌভাগের পরশকে আরো মহিমান্বিত করতে পারেন মায়ের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে। মায়ের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করে, পরম যতেœ মাকে সঙ্গে রেখেই ধন্য হতে পারেন। নিজের জীবনের আলোকমালা দিয়ে সমাজকে করে তুলতে পারেন সমুজ্জ্বল ও আলোকিত।
কখনো কোন অবস্থাতেই যেনো আমরা আমাদের মাকে ভুলে না যাই। মায়ের স্মৃতিছায়া আর মমতা-মায়ায় সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এ মুহুর্তে আঠারো শতকের কবি জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি লাইন মনে পড়ছে- “জাগ জাগ সবে ভারত সন্তান/ মাকে ভুলি কতকাল রহিবে শয়ান।” মায়ের প্রতি যারা অবজ্ঞা করে তাদের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের পঙ্কজিনী বসু নামে এক বালিকা কবি আঠারো শতকে লিখেছিলেন: “নাহি লজ্জা,নাহি ভয়/ মা’য়ে সবে ‘দাসী’ কয়/তবু ঘুমায়ে আছ, তোরা কুলাঙ্গার।” মাত্র ষোল বছর বেঁচেছিলেন তিনি। তেমনি মানবতার মা তেরেসাঁ সমগ্র বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছিলেন মা হারা এতিম সন্তানদের লালন-পালন ভরণ-পোষণ এবং মানুষ করবার দায়িত্ব পালন করে। মায়ের শুন্যতা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সমাজের অনাথ, দুস্থ-অসহয়ায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্য দিয়ে পূণ্যময়তা অর্জন করতে হবে।
এই প্রকৃতিমাতার অভ্যন্তরে আমরা যারা আছি যেনো মাকে ভুলে না যাই। এই সবুজ-শ্যামল প্রান্তর, সুনীল আকাশের ছায়ায়, পৃথিবীর মায়ায় আপন-আলয় থেকে বিচ্ছিন্ন-বিচ্ছেদের আগ পর্যন্ত কখনো যেনো মাকে ভুলে না যাই। প্রতিক্ষণ প্রতি মুহুর্তে মহামহিমের শেখানো দোয়া যেনো করিÑ “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি ছাগিরা।” (হে প্রভু! পরম যতœ-ছায়ায় আমার মাতা-পিতাকে দেখে রেখো- যেমনটি যতœছায়ায়, কোমল মায়ায় তারা দেখেছেন আমায়)।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি লাইন মনে পড়ছে;“আমারে ফিরায়ে লহ অয়ি বসুন্ধরে/কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে বিপুল অঞ্চল-তলে। ওগো মা মৃন্ময়ী/তোমার মৃত্তিকা মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই।”
চিরায়ত বাংলার আরেকটি গান- “সবাই বলো মা, মায়ের দাম কি হয়? পৃথিবীতে মায়ের নেই তুলনা/ মাগো তোমার নেই তুলনা।” কিংবা “মা জননী নাইরে যাহার ত্রিভূবনে তাহার কেহ নাইরে/মায়ের মতো আপন কেহ নাই।”
অতএব আমরা কেউ যেনো অমূল্য রতœ সেই মাকে ভুলে না যাই। মনের শিখায় আলোর দীপ্তিতে সদা-সর্বদা মা যেনো সমুজ্জ্বল থাকেন সর্বময়। বাংলাভাষার আরেকটি বিখ্যাত গানের কলি দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানছি।
“মধুর আমার মাযের হাসি চাঁদের মতো ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।” লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।