মানবাধিকার, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ
- প্রকাশের সময় : ০২:০৭:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩
- / ৮১ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদন-২০২২ মানবাধিকার তর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত করে। যেহেতু বাংলাদেশ বিষয়ে প্রতিবেদনটি বেশ বড়, আমি কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করব। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বৃহত্তম মুসলিম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর (জামায়াত) নেতারা আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের দ্বারা হয়রানির শিকার এবং তাদের বাক ও সমাবেশের সাংবিধানিক স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সবাই জানে, দলটির গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের নীতিগুলির পরিপন্থি হওয়ায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। এই সংক্রান্ত একটি মামলা এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। ২০১৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর বিধান অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে। যে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে; যুদ্ধাপরাধ ও চরমপন্থায় জড়িত ছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, লিঙ্গ সমতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, সেই দলটি কেন যুক্তরাষ্ট্র, যারা নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ত্রাণকর্তা বলে দাবি করে; তাদের চিন্তার কারণ?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং সরকার বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্মনিবন্ধন বা নাগরিকত্ব দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়নি এবং তাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের কনভেনশন রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব রিফিউজি বা ১৯৬৭ প্রটোকলের পক্ষ নয়। ফলস্বরূপ, সরকার এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলাফেরার স্বাধীনতা, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করা বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়। বাংলাদেশ মানবিকতার খাতিরে এই নিঃস্ব রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়েছে এবং সরকার আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে মিয়ানমার তথা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রশ্ন আসতেই পারে, এই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্মা আইন প্রণয়ন ছাড়া আর কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
আরোও পড়ুন । পর্দার আড়ালে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের সন্দেহভাজনরা যদি আইনি প্রক্রিয়া এড়াতে দেশ ছেড়ে চলে যায় এবং পরে আর ফিরে না আসে, তাহলে ন্যায়বিচার কীভাবে নিশ্চিত হবে? অপরাধীদের প্রত্যাবাসনে অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর একজন খুনিকে বাংলাদেশ সরকারের শত অনুরোধ সত্ত্বেও ফেরত পাঠানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফ্রিডম হাউসের বার্ষিক প্রতিবেদন উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি মজ্জাগত হয়ে গেছে। অথচ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে ছিল। ধীরে ধীরে তা ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৭ সালে ১৭তম স্থানে উঠে আসে। টিআইবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্নীতির সূচকে একই রকম। এটা উল্লেখ করা আবশ্যক, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে এবং অনেক অর্থনীতিবিদও মনে করেন, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দুর্নীতি হতে পারে। বহু উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়, সরকারও এ বিষয়ে সজাগ।
যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের– বিশেষত যেখানে তার সব কথায় সায় না দেওয়ার সরকার আছে; মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অহরহ উদ্বেগ প্রকাশ করে। অথচ ন্যাম ইউএস ডাটাবেজ অনুসারে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬০ লাখ লোক নিখোঁজ হয় এবং ৪ হাজার ৪০০ অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যায়। দেশটির অন্তত ৩৬টি রাজ্য শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করে ৮০টিরও বেশি খসড়া আইন প্রবর্তন করেছে; ৪৯টি রাজ্যে ভোটের অধিকার সীমাবদ্ধ করে এমন বিধানসহ ৪২০টিরও বেশি বিল প্রণয়ন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যালট কারচুপি এবং মৃত ব্যক্তিদের দ্বারা ভোট দেওয়ার অভিযোগ উপস্থাপিত হয়েছিল। বিশ্বের অনেক প্রান্তে ৯/১১-এর সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গৃহীত যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে চিহ্নিত হয়। কখনও কখনও যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যক্তি এবং সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আবার দেশটি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সরকারের সঙ্গে জোট গঠন করে নিজেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে।
যুক্তরাষ্ট্র অতি উৎসাহের সঙ্গে ইরানিদের উন্নত জীবনের জন্য প্রতিবাদ করার ইন্ধন দেয়, কিন্তু ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের একই কাজ করার ক্ষেত্রে দেশটি নীরব। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন মন্তব্য করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার প্রতিবেদন রাজনৈতিক মিথ্যা ও পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্যকে ইঙ্গিত করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে মানবাধিকার বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবেও কাজ করতে পারে। উপরন্তু পরাশক্তিগুলোর দ্বৈত মনোভাব মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের অনেক ক্ষেত্রে উজ্জীবিত করে। অনেক সময় মানবাধিকার ও শান্তির নামে পরাশক্তিগুলো বিশ্বে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নকশা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তাই সমাজ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, চরমপন্থা, সন্ত্রাস, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং নির্দিষ্ট দেশের স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশ তার সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বহুল প্রশংসিত। দেশটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে; লিঙ্গ ব্যবধান ও দারিদ্র্য কমিয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যা মানবাধিকার রক্ষায় দেশটির অঙ্গীকার তুলে ধরে। বাংলাদেশ বোঝে, মানবাধিকার বিলাসিতা নয় এবং এর ভিত্তি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন ও শান্তি অর্জন অসম্ভব। বাংলাদেশ কোনো পরাশক্তিকে খুশি করার জন্য নয়, বরং তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, মানব উন্নয়ন এবং টেকসই আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে মানবাধিকার রক্ষা এবং মূল্যবোধের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই মানবাধিকারের উন্নয়নে কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে যে কোনো দেশের গঠনমূলক সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। একই সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চারিত যে কোনো পক্ষপাতমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদ হওয়াও জরুরি। সূত্র : সমকাল
ড. ফারজানা মাহমুদ : আইনজীবী ও গবেষক