নিউইয়র্ক ০৫:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মতামত : ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা ও চিনের স¤প্রসারণবাদী নীতি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:১৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জুলাই ২০২০
  • / ৪৪ বার পঠিত

প্রদীপ মালাকার: সারা পৃথিবীর সকল দেশ ও জাতি যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনা রুখতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এবং করোনা তান্ডবে আক্রান্ত দেশগুলির অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও ধর্ম সব কিছুই যখন লন্ড-ভন্ড তখন হঠাৎ করেই এপ্রিল মাসের শেষ দিকে চীনের সেনা দল ভারতের লাদাখ রাজ্যে গালাওয়ান উপত্যকায় অনুপ্রবেশ করে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। চীনা সেনার অনুপ্রবেশের খবরে ভারত ও সেখানে দ্রæত সেনা পাঠায়। চীনের সেনাবাহিনী ভারতীয় ভূখন্ডের ৬০-৭০ কিলোমিটার ভেতরে ডুকে পড়ে বলে বিভিন্ন আন্তজারতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চীন-ভারতের মধ্যে লাদাখের কারাকুরাম পাস থেকে অরুণাচল রাজ্যের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যা বেশির ভাগ অঞ্চলই চিহ্নিত নয়। তবে উভয় দেশই ব্রিটিশের করা ম্যাকমোহন লাইন বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলকে উভয় দেশ-ই তাদের সীমান্ত হিসেবে মেনে আসছে।
গত দু-তিন সপ্তাহের ভেতর চীনা সেনাবাহিনী এই এলএসি অন্তর চার জায়গায় অতিক্রম করে অবস্থান নেয়। সেই জায়গাগুলো হলো লাদাখের প্যাংগং সো বা প্যাংগং লেক, গালওয়ান নদী ও ডেম চক আর সিকিমের নাকুলা। আর বিতর্কিত স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষই সীমান্তে বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্ত উত্তেজনা নিরসনে এবং লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে নিজ নিজ বাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে ৬ জুন উভয় পক্ষের কোর কমান্ডার পর্যায়ের আলোচনায় সিধান্ত হয়। তারপরেও ১৫ জুন ভারত-চীন সেনাদের মধ্যে সংঘষ হয় এবং ভারতের ২০ সেনা সহ উভয় পক্ষেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। অবশেষে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোবাল ও চিনের স্টেট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াংয়ির দীর্ঘ আলোচনায় উভয় পক্ষ বিতর্কিত অঞ্চলকে বাফার ঘোষণা করে এবং তার থেকে উভয় পক্ষের বাহিনী দুই কিলোমিটার যার যার অংশে সরে যেতে সম্মত হয়। ক্রমান্বয়ে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারত সীমান্তে লাল ফৌজের হানার পিছনে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া রাস্তা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভারত মহাসাগরে আমেরিকার নেতৃত্বে ভারতের কোয়াডের সদস্য হওয়া। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিক মহল মনে করেন চীনের সীমান্ত আগ্রাসন বা আধিপত্যই দায়ী। চীন-ভারতের সীমান্ত সমস্যা দীর্ঘ দিনের এবং একাধিক সীমান্তে। ২০১৭ সালে চীন ভুটানের ডোকলাম নামক স্থানের উপর দিয়ে রাস্তা বানাতে উদ্যোগী হলে ভারত তাতে বাধা দেয়। কারণ ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এবং ভারতের জলপাইগুড়ি করিডোর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরে। উপরন্ত, তিন দিকে ভারত ভূখন্ড বেষ্টিত ক্ষুদ্র ভুটানের পররাষ্ট্র বিষয়ক দেখভাল ভারতের উপর ন্যাস্থ। দীর্ঘ ৭৮ দিন চীন-ভারতের সেনাবাহিনী মুখামুখি যুদ্ধংদেহী রূপে অবস্থানের পর সমঝোতার ভিত্তিতে উভয় দেশের বাহিনী যার যার অবস্থানে ফিরে যায়। শুধু ভারত নয়, রাশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, লাওস সহ আরও ২০টি দেশের বিভিন্ন অংশকে নিজেদের বলে দাবী করে চীন, কোথাও সমুদ্র, কোথাও নদী, কোথাও বা জমি। চল্লিশের দশকে প্রতিবেশী পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে শিন জিয়াং প্রদেশ বানিয়েছিল চীন। ১৯৫০ সালে দখল করেছিল তিব্বত।
চীন আন্তজারতিক আইন (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অফ দ্য লজ অফ দ্য সি) না মেনে দক্ষিণ চীন সাগরের একাধিক ছোট বড় দ্বীপ দখল করে। জাতিপুঞ্জের সামদ্রিক আইনে উপকুল থেকে দুইশত মাইল ভিতরে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের সমুদ্রে অধিকার থাকবে। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে সীমান্ত উপকূলবর্তী দেশ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড, ব্রণেই এ সকল দুর্বল ও ক্ষুদ্র দেশের সামদ্রিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে সামরিক ঘাটি বানিয়ে পুরো চীন সাগর নিজেদের বলে দাবি করে চীন। এমনকি, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের একাধিপত্য কায়েমের চেষ্টা বানচাল করতে আমেরিকাও সক্রিয়। ১৯৫০ সালে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট চিয়াংকাই শেক (রিপাবলিক অফ চায়না) ও কুয়োমিনতাং দলের নেতা থাকাকালীন চিন সরকার প্রকাশিত এক ম্যাপে দক্ষিণ চীন সাগরে ছোট ছোট ১১টি রেখা দিয়ে ঘেরা একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। চীনের বক্তব্য ছিল, এই রেখা দিয়ে ঘেরা অংশটা তাদের। এই ইলেভেন ড্যাশ লাইন-এর মধ্যের ডুবো পাহাড়ের মাথা, প্রবাল প্রাচীর আর দ্বীপগুলোর একসঙ্গে নাম দেওয়া হয় ‘ম্যাপ অফ সাউথ চায়না সি আইল্যান্ডস’। এর মধ্যে ছিল প্যারাসেল আইল্যান্ডস, স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডস, ম্যাক ক্লেস ফিলদ, ব্যাঙ্ক এবং স্কার বড়োশোল।
দু’ বছর পরে চীনে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কমিউনিস্ট সরকার পূর্বতন সরকারের একই ম্যাপ অনুসরণ করতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে চিন “গালফ অফ টং কিন”-কে ভিয়েতনামের হাতে দেওয়ার ফলে দু’টি বিন্দু বাদ পড়ে হয় “নাইন ড্যাশ লাইন”। ১৯৭৪ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি ঝটিকা অভিযান চালিয়ে প্যারাসেল আইল্যান্ডস থেকে হটিয়ে দেয় ভিয়েতনাম বাহিনীকে। কয়েক বছর পরেই স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডসের একধিক দ্বীপ দখল করে। ২০০৯ সালে চীন রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে ম্যাপটি পেশ করে নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। ১৯৫৪ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরুর দুই দেশের মধ্যে করা “পঞ্চ শিলা” নীতিকে মান্যতা দেয়। পঞ্চ শিলার নিতিগুলো ছিল:
১. প্রতিটি স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পারস্পারিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা।
৩. দ্বন্ধ-সংঘাত পরিত্যাগ বা অনাক্রমণ নীতি গ্রহণ করা।
৪. পারস্পারিক সাম্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
৫. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু চীন ১৯৬২ সালে পঞ্চ শিলা নীতি ও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে ভারত-তিব্বতের নেতা দালাইলামা ও তার অনুসারীদের আশ্রয় ও সহযোগিতার অজুহাত তুলে লাদাখ ও অরুণাচলে আক্রমণ করে। সেই থেকে চীন লাদাখের আকসাই চীন ও অরুণাচল প্রদেশের উপর দাবী করে আসছে। চীন তার প্রতিবেশীদের প্রতি স¤প্রসারণ নীতি বাস্তবায়ন করতে যখন যেখানে যা দরকার তাই করেছে। কখনও সামরিক কৌশল, কখনও চাণক্য কৌশল, কখনও বাণিজ্য বা আর্থিক ঋণ সুবিধা দিয়ে কিংবা ভু-রাজনীতির সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশীকে বাগে আনার চেষ্টা করেছে। চীন এবার মনে করেছিল ভারতকে একটি সামরিক ধাক্কা দিলেই হাতে-নাতে পূর্বের মত ফল পেয়ে যাবে। যেমন সামরিক ধাক্কা দিয়ে মধ্য এশিয়ার তিনটি দেশ- কাজাখস্থান, কিরগিজস্থান ও তাজিকিস্থান- সেরকম কিন্তু ভারত নয়। জবরদস্তির সঙ্গে প্রণোদনার মিশেল দিয়ে চীন ওই দেশগুলোর কাছ থেকে নিজের অনুকুলে সীমান্ত মীমাংসা হাসিল করেছিল। দাবি করব বিস্তর কিন্তু একেবারে কম নিয়ে আপস করছি, এ রকম ভাব দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে মোহগ্রস্ত করার চাতুরী এটা। চীন আসলে কানাকড়িও ছাড় দেয়নি অথচ বাহিরে ভাব দেখিয়েছে- শান্তির স্বার্থে ক্ষতি মেনে নিলাম। রাশিয়ার সাথে কু-হুয়াং অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে দুই পরাক্রমশালী দশের দ্ব›দ্ব। ১৯২৯ এবং ১৯৫৯ সালে দু’দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত ও হয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যার আজও অধরা।
উপরন্ত, ভারত-চীন সংঘাতের মধ্যে নূতন করে রাশিয়ার একটি শহর নিজেদের বলে দাবী জানায় চীন। চীন দীর্ঘ দিন যাবত জাতীয়তাবাদী তাইওয়ান রাষ্ট্রটির পুরো অংশটাই নিজেদের বলে দাবী করে আসছে। মাঝে মধ্যেই রাষ্ট্রটি দখলের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সাময়িকী “ইন্ডিয়া টুডের” ৩ জুলাই ২০২০ সংখ্যায় “চায়নার লাদাখ গেমপ্লেন” শীর্ষক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, সামরিক কব্জির জোরে আকসাই চীন এলাকাটি গ্রাস করে নিতে চাইছে চীন। এ অবস্থায় সীমান্ত সমস্যার বিষয়টির সুরাহায় ভারতকে সাবধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইন্ডিয়া টুডে আরও লিখছে- চীনের ঔদার্য্যরে অভিনয়ে মোহগ্রস্থ হয়ে ১৯৯০ দশকে ভূখন্ডগত অনেক ছাড় দিয়ে ফেলেছে মধ্য এশিয়া।
সর্বশেষ ২০১১ সালে তাজিকিস্থানের সঙ্গে সীমান্ত রক্ষা করে চীন। প্রথমে ২৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি চীন তাজিকিস্থানের কাছ থেকে পায় বলে দাবি করে। কিন্তু সার্কেল পর্বত এলাকায় ১ হাজার ১৫৮ বর্গ কিলোমিটার ভূমি দিতে রাজি হয় তাজিকরা। চীন বলে, ঠিক আছে। ক্ষতি মেনে নিলাম। তাজিকরা আনন্দে গদগদ হয় জিতেছি, জিতেছি বলে। অথচ চিন এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়নি। তাজিকরা তো চীনাদের কোনও জমিই দখল করে রাখেনি। যা সে পেল, সবটাই তার লাভ। চীনের মোহনীয় কৌশলের শিকার হয়েছিল মঙ্গোলিয়া। রাশিয়া ও চিনের মধ্যবর্তী “বাফার” দেশটিতে বেজিং তার অংশ বলে মনে করে। চীনের নৃতাত্তি¡ক চাতুরী এখন চলছে কাজাখস্থান ও রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে ।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে চীন যে তামাশা করে, তা ওই সময় আমোদজনক ছিল। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বালতিস্থান/লাদাখ অঞ্চলের দখলীকৃত জমির ৫ হাজার ১৮০ বর্গ কিলোমিটার (২ হাজার ৫০ বর্গ মাইল) চীনকে ছেড়ে দেয়। বিনিময়ে পাকিস্তানকে চিন দিয়েছিল খনিজ সম্পদ পূর্ণ অপারং উপত্যকা এবং দরবান্দ-দড়োয়াজা এলাকার ৭৫০ বর্গ মাইল জমি। তবু পাকিস্তানের নেতারা বলেন, তারা চীনকে কোন ছাড় দেয়নি। শুধু তাই নয়, ওই নেতারা ৭৫০ বর্গ মাইল জমি পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়ার ঔদার্য্যরে জন্য প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিবন্ধে বলা হয় পাকিস্তানের ওই ভুমি প্রত্যপর্ণের পরিণামে প্রথমবারের মতো কুনলুন পর্বতমালা থেকে শুরু করে কারাকুরাম পর্যন্ত চীনের সীমান্ত বিস্তার ঘটে এবং এরই কারণে এশিয়ায় চীনা সীমান্ত কৌশল নিন্দা অর্জন করতে থাকে। এমন কি জন্ম ও কাশ্মীরের জমি তড়িঘড়ি চীনকে দিয়ে দেওয়ার কারনে পাকিস্তান ও এখন আফসোস করে। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, বেইজিংযের সমস্যা হচ্ছে, তার সীমান্ত চাতুরীর ব্যাপারটি ভারতের উপর খাটাতে পারছেনা। ২০০৫ সালের খসড়া চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে তাৎপর্যময় ছাড় হাতিয়ে নিতে না পেরে চীন আশ্রয় নিয়েছে সহিংস সামরিক কৌশলের।
২০১৩ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি দেপসাং এর ১৯ কিলোমিটার ভিতরে অনুপ্রবেশ করে। সীমান্ত প্রশ্নে সুবিধা দ্রæত আদায় করে নেওয়ার মতলবেই এটা করা। স¤প্রীতি লাদাখে চীন যা করলো তারও লক্ষ হচ্ছে আকসাই চীন এলাকার স্থিতাবস্থা বিনষ্ট করে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর সীমান্ত স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করিয়ে নেওয়া। এটা হয়ে গেলে চীনকে কিছুই হারাতে হবে না। চীন ধরে নিয়েছিল, ভারত মেনে নেবে যে, আকসাই চীন যেমন আছে তেমনিই থাকবে চিরকাল। চীনের বিরাট গলদ এটাই। চীনের কামনা পূরণ করতে গিয়ে আকসাই চীন অঞ্চলে ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখন্ডের ওপর দাবী ভারত কি ছেড়ে দিবে?
চীন দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্ক ভুক্ত দেশগুলির ওপরও দৃষ্টি পড়ে। হিমালয়ের কোলে তিন দিকে ভারত বেষ্টিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র নেপাল। নেপাল ও ভারতের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহু পুরানো। নেপালের বেশীরভাগ ব্যবসা বাণিজ্য ভারত ভূখন্ড দিয়েই পরিচালিত হতো। চীন সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই চিনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এ শরিক হয়ে নেপালের উত্তর সীমান্ত থেকে চীনের সাংহাই বন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে। নেপালের সহিত এই সখ্যতার সুযোগ নিয়ে নেপালের উত্তর ও মধ্য সীমান্তের অন্তত ১২টি জায়গায় চীন সে দেশের জমি জবর দখল করে রাস্থা বানানোর পাশাপাশি ছোট বাঁধ বানিয়ে নদীর গতি পথ ঘুরিয়েছে। ভারত-চিন সংঘাতে, চীন ভু-রাজনীতির সুযোগ নিয়ে, ভারতকে চাপে ফেলতে উল্টো তাদের অনুগত সরকারকে দিয়ে দাবি করা হয় ভারতের কালাপানি, লিপুলেখ ও লিস্পিয়াধুরা-কে তাদের অঞ্চল। তড়িঘড়ি করে নতুন মানচিত্র তউরি করে তা সংসদে পাস করিয়ে নেয়। এর ফলে ভারত নেপাল সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
চীন দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা ডিঙ্গিয়ে ভারত মহাসাগরে আদিপত্য বিস্তারে চেষ্টা বহু দিনের স্বপ্ন। এর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপে ঘাটি গড়ার আশ্রয় খুঁজছিল। সুযোগ এসেও যায়, চীন শ্রীলংকাকে ঋণের ফাঁদে ফেলে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের হানবানটোটা বন্দর এবং বন্দর সংলগ্ন ১৫০০০ একর জমি চিনের সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলংকা সরকার। এই লিজ দেবার পেছনে রয়েছে চীনের আগ্রাসী উচ্চাকাঙখা আর শ্রীলংকা সরকারের ভেতরের দুর্নীতির আখ্যান, যার ফল হিসেবে চীন পেয়ে গেছে ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরের নিরবছিন্ন নিয়ন্ত্রণ। অপর দিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাদার বন্দরটি ৬২ বিলিয়ন ডলারে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের আওতায় চিনের সহায়তায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হয়। এখানেও পাকিস্তান দেনার দায়ে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। ফলে গাদার ও হাবানটোটা দুই জায়গায় সামরিক ঘাঁটি বানাতে আর চীনের আর বাধা রহিল না। অপর দিকে ভারত মহাসাগরের দিয়াগু গারসিয়ায় এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব থেকেই আমেরিকা ও ভারতের নৌঘাঁটি রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পোরও সময়ই চিনের সাথে বাণিজ্য লড়াই লেগে আছে। আমেরিকা চায়না ভারত মহাসাগরে চিনের স¤প্রসারণ বা আদিপত্য। তাই ভারত মহাসাগরে চীনকে রুখতে আমেরিকার নেতৃত্বে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এক জোট হয়ে নৌ সামরিক শক্তি সমাবেশ করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন চীনের স¤প্রসারণ বা আদিপত্যকে কেন্দ্র করে আবারও কি চীন-আমেরিকার মধ্যে শীতল যুব্দের অশনি সংকেত অত্যাসন্ন?
নিউইয়র্ক, ইউএসএ

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

মতামত : ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা ও চিনের স¤প্রসারণবাদী নীতি

প্রকাশের সময় : ১২:১৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জুলাই ২০২০

প্রদীপ মালাকার: সারা পৃথিবীর সকল দেশ ও জাতি যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনা রুখতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এবং করোনা তান্ডবে আক্রান্ত দেশগুলির অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও ধর্ম সব কিছুই যখন লন্ড-ভন্ড তখন হঠাৎ করেই এপ্রিল মাসের শেষ দিকে চীনের সেনা দল ভারতের লাদাখ রাজ্যে গালাওয়ান উপত্যকায় অনুপ্রবেশ করে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। চীনা সেনার অনুপ্রবেশের খবরে ভারত ও সেখানে দ্রæত সেনা পাঠায়। চীনের সেনাবাহিনী ভারতীয় ভূখন্ডের ৬০-৭০ কিলোমিটার ভেতরে ডুকে পড়ে বলে বিভিন্ন আন্তজারতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চীন-ভারতের মধ্যে লাদাখের কারাকুরাম পাস থেকে অরুণাচল রাজ্যের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যা বেশির ভাগ অঞ্চলই চিহ্নিত নয়। তবে উভয় দেশই ব্রিটিশের করা ম্যাকমোহন লাইন বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলকে উভয় দেশ-ই তাদের সীমান্ত হিসেবে মেনে আসছে।
গত দু-তিন সপ্তাহের ভেতর চীনা সেনাবাহিনী এই এলএসি অন্তর চার জায়গায় অতিক্রম করে অবস্থান নেয়। সেই জায়গাগুলো হলো লাদাখের প্যাংগং সো বা প্যাংগং লেক, গালওয়ান নদী ও ডেম চক আর সিকিমের নাকুলা। আর বিতর্কিত স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষই সীমান্তে বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্ত উত্তেজনা নিরসনে এবং লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে নিজ নিজ বাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে ৬ জুন উভয় পক্ষের কোর কমান্ডার পর্যায়ের আলোচনায় সিধান্ত হয়। তারপরেও ১৫ জুন ভারত-চীন সেনাদের মধ্যে সংঘষ হয় এবং ভারতের ২০ সেনা সহ উভয় পক্ষেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। অবশেষে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোবাল ও চিনের স্টেট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াংয়ির দীর্ঘ আলোচনায় উভয় পক্ষ বিতর্কিত অঞ্চলকে বাফার ঘোষণা করে এবং তার থেকে উভয় পক্ষের বাহিনী দুই কিলোমিটার যার যার অংশে সরে যেতে সম্মত হয়। ক্রমান্বয়ে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারত সীমান্তে লাল ফৌজের হানার পিছনে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া রাস্তা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভারত মহাসাগরে আমেরিকার নেতৃত্বে ভারতের কোয়াডের সদস্য হওয়া। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিক মহল মনে করেন চীনের সীমান্ত আগ্রাসন বা আধিপত্যই দায়ী। চীন-ভারতের সীমান্ত সমস্যা দীর্ঘ দিনের এবং একাধিক সীমান্তে। ২০১৭ সালে চীন ভুটানের ডোকলাম নামক স্থানের উপর দিয়ে রাস্তা বানাতে উদ্যোগী হলে ভারত তাতে বাধা দেয়। কারণ ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এবং ভারতের জলপাইগুড়ি করিডোর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরে। উপরন্ত, তিন দিকে ভারত ভূখন্ড বেষ্টিত ক্ষুদ্র ভুটানের পররাষ্ট্র বিষয়ক দেখভাল ভারতের উপর ন্যাস্থ। দীর্ঘ ৭৮ দিন চীন-ভারতের সেনাবাহিনী মুখামুখি যুদ্ধংদেহী রূপে অবস্থানের পর সমঝোতার ভিত্তিতে উভয় দেশের বাহিনী যার যার অবস্থানে ফিরে যায়। শুধু ভারত নয়, রাশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, লাওস সহ আরও ২০টি দেশের বিভিন্ন অংশকে নিজেদের বলে দাবী করে চীন, কোথাও সমুদ্র, কোথাও নদী, কোথাও বা জমি। চল্লিশের দশকে প্রতিবেশী পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে শিন জিয়াং প্রদেশ বানিয়েছিল চীন। ১৯৫০ সালে দখল করেছিল তিব্বত।
চীন আন্তজারতিক আইন (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অফ দ্য লজ অফ দ্য সি) না মেনে দক্ষিণ চীন সাগরের একাধিক ছোট বড় দ্বীপ দখল করে। জাতিপুঞ্জের সামদ্রিক আইনে উপকুল থেকে দুইশত মাইল ভিতরে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের সমুদ্রে অধিকার থাকবে। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে সীমান্ত উপকূলবর্তী দেশ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড, ব্রণেই এ সকল দুর্বল ও ক্ষুদ্র দেশের সামদ্রিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে সামরিক ঘাটি বানিয়ে পুরো চীন সাগর নিজেদের বলে দাবি করে চীন। এমনকি, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের একাধিপত্য কায়েমের চেষ্টা বানচাল করতে আমেরিকাও সক্রিয়। ১৯৫০ সালে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট চিয়াংকাই শেক (রিপাবলিক অফ চায়না) ও কুয়োমিনতাং দলের নেতা থাকাকালীন চিন সরকার প্রকাশিত এক ম্যাপে দক্ষিণ চীন সাগরে ছোট ছোট ১১টি রেখা দিয়ে ঘেরা একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। চীনের বক্তব্য ছিল, এই রেখা দিয়ে ঘেরা অংশটা তাদের। এই ইলেভেন ড্যাশ লাইন-এর মধ্যের ডুবো পাহাড়ের মাথা, প্রবাল প্রাচীর আর দ্বীপগুলোর একসঙ্গে নাম দেওয়া হয় ‘ম্যাপ অফ সাউথ চায়না সি আইল্যান্ডস’। এর মধ্যে ছিল প্যারাসেল আইল্যান্ডস, স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডস, ম্যাক ক্লেস ফিলদ, ব্যাঙ্ক এবং স্কার বড়োশোল।
দু’ বছর পরে চীনে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কমিউনিস্ট সরকার পূর্বতন সরকারের একই ম্যাপ অনুসরণ করতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে চিন “গালফ অফ টং কিন”-কে ভিয়েতনামের হাতে দেওয়ার ফলে দু’টি বিন্দু বাদ পড়ে হয় “নাইন ড্যাশ লাইন”। ১৯৭৪ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি ঝটিকা অভিযান চালিয়ে প্যারাসেল আইল্যান্ডস থেকে হটিয়ে দেয় ভিয়েতনাম বাহিনীকে। কয়েক বছর পরেই স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডসের একধিক দ্বীপ দখল করে। ২০০৯ সালে চীন রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে ম্যাপটি পেশ করে নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। ১৯৫৪ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরুর দুই দেশের মধ্যে করা “পঞ্চ শিলা” নীতিকে মান্যতা দেয়। পঞ্চ শিলার নিতিগুলো ছিল:
১. প্রতিটি স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পারস্পারিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা।
৩. দ্বন্ধ-সংঘাত পরিত্যাগ বা অনাক্রমণ নীতি গ্রহণ করা।
৪. পারস্পারিক সাম্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
৫. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু চীন ১৯৬২ সালে পঞ্চ শিলা নীতি ও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে ভারত-তিব্বতের নেতা দালাইলামা ও তার অনুসারীদের আশ্রয় ও সহযোগিতার অজুহাত তুলে লাদাখ ও অরুণাচলে আক্রমণ করে। সেই থেকে চীন লাদাখের আকসাই চীন ও অরুণাচল প্রদেশের উপর দাবী করে আসছে। চীন তার প্রতিবেশীদের প্রতি স¤প্রসারণ নীতি বাস্তবায়ন করতে যখন যেখানে যা দরকার তাই করেছে। কখনও সামরিক কৌশল, কখনও চাণক্য কৌশল, কখনও বাণিজ্য বা আর্থিক ঋণ সুবিধা দিয়ে কিংবা ভু-রাজনীতির সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশীকে বাগে আনার চেষ্টা করেছে। চীন এবার মনে করেছিল ভারতকে একটি সামরিক ধাক্কা দিলেই হাতে-নাতে পূর্বের মত ফল পেয়ে যাবে। যেমন সামরিক ধাক্কা দিয়ে মধ্য এশিয়ার তিনটি দেশ- কাজাখস্থান, কিরগিজস্থান ও তাজিকিস্থান- সেরকম কিন্তু ভারত নয়। জবরদস্তির সঙ্গে প্রণোদনার মিশেল দিয়ে চীন ওই দেশগুলোর কাছ থেকে নিজের অনুকুলে সীমান্ত মীমাংসা হাসিল করেছিল। দাবি করব বিস্তর কিন্তু একেবারে কম নিয়ে আপস করছি, এ রকম ভাব দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে মোহগ্রস্ত করার চাতুরী এটা। চীন আসলে কানাকড়িও ছাড় দেয়নি অথচ বাহিরে ভাব দেখিয়েছে- শান্তির স্বার্থে ক্ষতি মেনে নিলাম। রাশিয়ার সাথে কু-হুয়াং অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে দুই পরাক্রমশালী দশের দ্ব›দ্ব। ১৯২৯ এবং ১৯৫৯ সালে দু’দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত ও হয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যার আজও অধরা।
উপরন্ত, ভারত-চীন সংঘাতের মধ্যে নূতন করে রাশিয়ার একটি শহর নিজেদের বলে দাবী জানায় চীন। চীন দীর্ঘ দিন যাবত জাতীয়তাবাদী তাইওয়ান রাষ্ট্রটির পুরো অংশটাই নিজেদের বলে দাবী করে আসছে। মাঝে মধ্যেই রাষ্ট্রটি দখলের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সাময়িকী “ইন্ডিয়া টুডের” ৩ জুলাই ২০২০ সংখ্যায় “চায়নার লাদাখ গেমপ্লেন” শীর্ষক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, সামরিক কব্জির জোরে আকসাই চীন এলাকাটি গ্রাস করে নিতে চাইছে চীন। এ অবস্থায় সীমান্ত সমস্যার বিষয়টির সুরাহায় ভারতকে সাবধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইন্ডিয়া টুডে আরও লিখছে- চীনের ঔদার্য্যরে অভিনয়ে মোহগ্রস্থ হয়ে ১৯৯০ দশকে ভূখন্ডগত অনেক ছাড় দিয়ে ফেলেছে মধ্য এশিয়া।
সর্বশেষ ২০১১ সালে তাজিকিস্থানের সঙ্গে সীমান্ত রক্ষা করে চীন। প্রথমে ২৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি চীন তাজিকিস্থানের কাছ থেকে পায় বলে দাবি করে। কিন্তু সার্কেল পর্বত এলাকায় ১ হাজার ১৫৮ বর্গ কিলোমিটার ভূমি দিতে রাজি হয় তাজিকরা। চীন বলে, ঠিক আছে। ক্ষতি মেনে নিলাম। তাজিকরা আনন্দে গদগদ হয় জিতেছি, জিতেছি বলে। অথচ চিন এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়নি। তাজিকরা তো চীনাদের কোনও জমিই দখল করে রাখেনি। যা সে পেল, সবটাই তার লাভ। চীনের মোহনীয় কৌশলের শিকার হয়েছিল মঙ্গোলিয়া। রাশিয়া ও চিনের মধ্যবর্তী “বাফার” দেশটিতে বেজিং তার অংশ বলে মনে করে। চীনের নৃতাত্তি¡ক চাতুরী এখন চলছে কাজাখস্থান ও রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে ।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে চীন যে তামাশা করে, তা ওই সময় আমোদজনক ছিল। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বালতিস্থান/লাদাখ অঞ্চলের দখলীকৃত জমির ৫ হাজার ১৮০ বর্গ কিলোমিটার (২ হাজার ৫০ বর্গ মাইল) চীনকে ছেড়ে দেয়। বিনিময়ে পাকিস্তানকে চিন দিয়েছিল খনিজ সম্পদ পূর্ণ অপারং উপত্যকা এবং দরবান্দ-দড়োয়াজা এলাকার ৭৫০ বর্গ মাইল জমি। তবু পাকিস্তানের নেতারা বলেন, তারা চীনকে কোন ছাড় দেয়নি। শুধু তাই নয়, ওই নেতারা ৭৫০ বর্গ মাইল জমি পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়ার ঔদার্য্যরে জন্য প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিবন্ধে বলা হয় পাকিস্তানের ওই ভুমি প্রত্যপর্ণের পরিণামে প্রথমবারের মতো কুনলুন পর্বতমালা থেকে শুরু করে কারাকুরাম পর্যন্ত চীনের সীমান্ত বিস্তার ঘটে এবং এরই কারণে এশিয়ায় চীনা সীমান্ত কৌশল নিন্দা অর্জন করতে থাকে। এমন কি জন্ম ও কাশ্মীরের জমি তড়িঘড়ি চীনকে দিয়ে দেওয়ার কারনে পাকিস্তান ও এখন আফসোস করে। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, বেইজিংযের সমস্যা হচ্ছে, তার সীমান্ত চাতুরীর ব্যাপারটি ভারতের উপর খাটাতে পারছেনা। ২০০৫ সালের খসড়া চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে তাৎপর্যময় ছাড় হাতিয়ে নিতে না পেরে চীন আশ্রয় নিয়েছে সহিংস সামরিক কৌশলের।
২০১৩ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি দেপসাং এর ১৯ কিলোমিটার ভিতরে অনুপ্রবেশ করে। সীমান্ত প্রশ্নে সুবিধা দ্রæত আদায় করে নেওয়ার মতলবেই এটা করা। স¤প্রীতি লাদাখে চীন যা করলো তারও লক্ষ হচ্ছে আকসাই চীন এলাকার স্থিতাবস্থা বিনষ্ট করে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর সীমান্ত স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করিয়ে নেওয়া। এটা হয়ে গেলে চীনকে কিছুই হারাতে হবে না। চীন ধরে নিয়েছিল, ভারত মেনে নেবে যে, আকসাই চীন যেমন আছে তেমনিই থাকবে চিরকাল। চীনের বিরাট গলদ এটাই। চীনের কামনা পূরণ করতে গিয়ে আকসাই চীন অঞ্চলে ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখন্ডের ওপর দাবী ভারত কি ছেড়ে দিবে?
চীন দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্ক ভুক্ত দেশগুলির ওপরও দৃষ্টি পড়ে। হিমালয়ের কোলে তিন দিকে ভারত বেষ্টিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র নেপাল। নেপাল ও ভারতের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহু পুরানো। নেপালের বেশীরভাগ ব্যবসা বাণিজ্য ভারত ভূখন্ড দিয়েই পরিচালিত হতো। চীন সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই চিনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এ শরিক হয়ে নেপালের উত্তর সীমান্ত থেকে চীনের সাংহাই বন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে। নেপালের সহিত এই সখ্যতার সুযোগ নিয়ে নেপালের উত্তর ও মধ্য সীমান্তের অন্তত ১২টি জায়গায় চীন সে দেশের জমি জবর দখল করে রাস্থা বানানোর পাশাপাশি ছোট বাঁধ বানিয়ে নদীর গতি পথ ঘুরিয়েছে। ভারত-চিন সংঘাতে, চীন ভু-রাজনীতির সুযোগ নিয়ে, ভারতকে চাপে ফেলতে উল্টো তাদের অনুগত সরকারকে দিয়ে দাবি করা হয় ভারতের কালাপানি, লিপুলেখ ও লিস্পিয়াধুরা-কে তাদের অঞ্চল। তড়িঘড়ি করে নতুন মানচিত্র তউরি করে তা সংসদে পাস করিয়ে নেয়। এর ফলে ভারত নেপাল সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
চীন দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা ডিঙ্গিয়ে ভারত মহাসাগরে আদিপত্য বিস্তারে চেষ্টা বহু দিনের স্বপ্ন। এর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপে ঘাটি গড়ার আশ্রয় খুঁজছিল। সুযোগ এসেও যায়, চীন শ্রীলংকাকে ঋণের ফাঁদে ফেলে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের হানবানটোটা বন্দর এবং বন্দর সংলগ্ন ১৫০০০ একর জমি চিনের সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলংকা সরকার। এই লিজ দেবার পেছনে রয়েছে চীনের আগ্রাসী উচ্চাকাঙখা আর শ্রীলংকা সরকারের ভেতরের দুর্নীতির আখ্যান, যার ফল হিসেবে চীন পেয়ে গেছে ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরের নিরবছিন্ন নিয়ন্ত্রণ। অপর দিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাদার বন্দরটি ৬২ বিলিয়ন ডলারে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের আওতায় চিনের সহায়তায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হয়। এখানেও পাকিস্তান দেনার দায়ে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। ফলে গাদার ও হাবানটোটা দুই জায়গায় সামরিক ঘাঁটি বানাতে আর চীনের আর বাধা রহিল না। অপর দিকে ভারত মহাসাগরের দিয়াগু গারসিয়ায় এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব থেকেই আমেরিকা ও ভারতের নৌঘাঁটি রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পোরও সময়ই চিনের সাথে বাণিজ্য লড়াই লেগে আছে। আমেরিকা চায়না ভারত মহাসাগরে চিনের স¤প্রসারণ বা আদিপত্য। তাই ভারত মহাসাগরে চীনকে রুখতে আমেরিকার নেতৃত্বে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এক জোট হয়ে নৌ সামরিক শক্তি সমাবেশ করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন চীনের স¤প্রসারণ বা আদিপত্যকে কেন্দ্র করে আবারও কি চীন-আমেরিকার মধ্যে শীতল যুব্দের অশনি সংকেত অত্যাসন্ন?
নিউইয়র্ক, ইউএসএ