ভাসানী-মুজিব সম্পর্ক এবং পথ ও মত
- প্রকাশের সময় : ০৯:১৪:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২
- / ৭৬ বার পঠিত
১৯৭০-এর নির্বাচনে যে স্বাধীনতা আসবে না ভাসানী কিন্তু সেটা সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন। নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি ছিলেন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। সেটা যখন সম্ভব হলো না, নির্বাচন এলো, তাঁর নেতৃত্বে ন্যাপ পূর্ববঙ্গে নির্বাচন বয়কট করল। এটি ছিল বড় মাপের একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যার তাৎপর্য অন্যরা তো বটেই, এমনকি তাঁর আন্তরিক অনুসারীদেরও কেউ কেউ ঠিক বুঝতে পারেননি।
ভাসানী চেয়েছিলেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে অবিভক্ত একটি রায় বেরিয়ে আসুক, যাতে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সেটি ঘটেছে। নির্বাচনের পর ভাসানী মুজিবকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন গণরায়ের সূত্র ধরে আরো সামনে এগিয়ে যেতে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় না গিয়ে বরং পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পাওনাপাতি যা আছে তা মেটানোর দাবি জানাতে।
kalerkanthoতারপর এলো গণহত্যা ও যুদ্ধ। একদা সেই ১৯৪৯ সালে মুজিবের বয়স যখন ২৯, ভাসানীর বয়স ৪৯, গুরু-শিষ্য তখন জেলে বসে যে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা কল্পনা করেছিলেন, বাস্তবে সেটা ভয়াবহ আকারে যখন সত্যি সত্যি এলো তখন তাঁরা দুজন যে একসঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থাকবেন সেটা সম্ভব হলো না। কারণ তত দিনে তাঁরা পৃথক হয়ে গেছেন একে অন্যের কাছ থেকে। বন্দি হয়ে মুজিবকে চলে যেতে হলো পাকিস্তানে আর বন্দি হওয়ার মুখে ভাসানী চলে গেলেন ভারতে। যুদ্ধটা বাংলার দুই নেতার অনুপস্থিতিতেই চলল। যুদ্ধের পরে দুজন যে একসঙ্গে হবেন সেটাও সম্ভব ছিল না। কেননা মুজিব তখন সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, আর ভাসানী তখনো রাজপথে। ভাসানীর স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতাকে মুক্তিতে পরিণত করবেন। পারলেন না; কারণ তখন তিনি অনেকটা একা হয়ে গেছেন। তার পরও চেষ্টা করেছেন; জনসভা, সম্মেলন, বিবৃতি, ফারাক্কা লং মার্চ সবই করলেন, কিন্তু স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হলো না।
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ভাসানীকে শেষ পর্যন্ত অন্তরিন করেছিল। কারণ মুক্তির কাঙ্ক্ষিত সংগ্রামকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন সামনের দিকে। সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যার সেই অতি নির্মম ঘটনা যখন ঘটে ভাসানী তখন সন্তোষে, গৃহবন্দি অবস্থায়। রেডিওতে খবরটি শুনে তাঁর চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রুধারা নেমেছিল বলে জনিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। অশ্রুসিক্ত মওলানা বলেছিলেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। ’
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশের সামগ্রিক স্রোত তখন বইছে একেবারে উল্টো দিকে, তারই মধ্যে ভাসানী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রকাশ্যে মুজিবের গায়েবানা জানাজা ও ফাতেহার আয়োজন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিদেশি সাংবাদিকদের তাঁর নিজের মতো করে তিনি বলেন, ‘আমার মজিবর ভুঁইফোড় রাজনীতিক নয়। […] সে পাশে না থাকলে আমি স্বৈরাচারী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন জাগিয়ে তুলতে পারতাম না। ’
১৫ই আগস্টের দুদিন পরে মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর হুদা ও আরো কয়েকজন সন্তোষে গিয়েছিলেন ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘জালেমশাহিকে খতম’ করেছেন এটা জানাতে। ভাসানী তাঁদের ধমক দিয়েই বলেছিলেন, ‘তোমরা কী জানো যে তোমরা এক গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পক্ষ হয়ে কাজ করেছ?’ মোশতাকের নির্দেশে আগস্টের ১৬ তারিখেই জেনারেল ওসমানী হেলিকপ্টারে করে সন্তোষে গিয়ে ভাসানীকে ঘটনা জানান এবং সমর্থন বিবৃতি দিতে চাপাচাপি করেন। ভাসানী সম্মত হননি। ২১ আগস্ট মোশতাক নিজে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে যান, ভাসানী দেখা করেননি।
১৯৭৫-এর ৮ মার্চ মুজিব গিয়েছিলেন সন্তোষে। উপলক্ষ মোহাম্মদ আলী কলেজের সরকারীকরণ। তখন সেই আবেগঘন ঘটনাটি ঘটে যেটি ফটোগ্রাফাররা ধারণ করেছেন; রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মওলানাকে কদমবুসি করতে যান, মওলানা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। যেন দুই পরমাত্মীয়র পুনর্মিলন। ১২ আগস্ট ভাসানী শেখ মুজিবকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘প্রিয় মুজিব, আমি রাতে এক মিনিটও ঘুমাইতে পারিনি। চক্ষু বুজিলেই দেখিতে পাই, তোমার মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে। তোমার চারদিকে দুর্নীতির পাহাড় গড়িয়া উঠিয়াছে। তাই সাবধান হও, সাবধান হও, সাবধান হও। ’ ‘সাবধান হও’ কথাটি তিনবার ছিল। চিঠিতে ভাসানী মুজিবকে শিগগিরই সন্তোষে এসে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যোগাযোগের সেটাই ছিল অন্তিম প্রচেষ্টা।
এর তিন দিনের মধ্যেই তো সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন, সেই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে মওলানা ভাসানী যাকে অনেক আগেই শত্রু বলে চিহ্নিত করে ফেলেছিলেন, আর যার বিরুদ্ধে তিনি লড়ছিলেন প্রাণপণে।
পাকিস্তান আমলজুড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও তাঁরা দুজনই ছিলেন প্রধান জনব্যক্তিত্ব। উভয়েই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিক, রাজনীতিই ছিল তাঁদের মূল জীবন। ভাসানীর লক্ষ্য ছিল জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; এ কাজটা করা মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী, যদিও সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতার কথা তিনি জানতেন এবং বলতেনও।
মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীপন্থী, যদিও অনিবার্যভাবেই ওই প্রভাব তাঁকে সেই পরিমাণেই ছিন্ন করতে হয়েছিল, যে পরিমাণে তিনি পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করতে চেয়েছেন। স্বাধীন করতে ভাসানীও চেয়েছিলেন। এই পর্যন্ত এই দুই বাঙালি একই পথের যাত্রী। কিন্তু ভাসানী ছিলেন দুর্দান্ত রকমের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ঠিক উল্টো পথের পথিক। সাম্রাজ্যবাদকে শেখ মুজিব যে চিনতেন না এমন নয়, কিন্তু তিনিও তাঁর রাজনৈতিক গুরুর মতো এতটা না হলেও অনেকটাই আমেরিকার দিকেই ঝুঁকে পড়েছিলেন। নিজের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আমেরিকা তার আপন প্রয়োজনেই (মূল বিবেচনা কমিউনিজমকে রোখা) সমর্থন দেবে বলে মুজিব আশা করেছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে যখন জানা গেল যে তিনি যত দূর যেতে চান আমেরিকানরা ততটা যাওয়া পছন্দ করছে না, তখন তিনি রীতিমতো বিপর্যস্ত বোধ করেন। সাম্রাজ্যবাদ সব কিছুই পারে। যুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল এবং যুদ্ধ শেষে মুজিবের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না দেখে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কাজে যুক্ত হয়েছিল। আইয়ুব শাসনের সময়ও আমেরিকানরা সোহরাওয়ার্দীকে ছেড়ে আইয়ুবকেই সমর্থন করেছে।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মুজিবের আরো এক জায়গায় পার্থক্য ছিল। মওলানা নির্বাচনে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন ১৯৪৬-এর পরপরই; ওদিকে মুজিব মনে করতেন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যাবে এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হবে। নির্বাচনের বিপরীতে মওলানার নির্ভরতা ছিল আন্দোলনের ওপর। কৃষক ও শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করতে চেয়েছেন, ট্যাক্স-খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতেন, ঘেরাও ও হাট-হরতালের মতো কর্মপন্থা গ্রহণ করে তিনি আন্দোলনকে শহরে তো বটেই, গ্রামেও নিয়ে যেতে চেয়েছেন। মওলানার নির্ভরশীলতা ছিল সাধারণ মানুষ ও মেহনতিদের ওপর, বিদেশিদের কাছ থেকে সহায়তা তিনি আশা করেননি; মুজিব কিন্তু বিদেশিদের সমর্থন-সহায়তা চেয়েছেন। মুজিব আগরতলায় গেছেন, লন্ডনেও গেছেন, ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানের পরে মওলানা একাধিকবার পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন ন্যাপের আহ্বানে এবং শুধু শাসক বদল নয়, পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই ভাঙার জন্য মেহনতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে।
যুদ্ধের আগে মুজিব তাঁর বিশ্বাসভাজন চিত্তরঞ্জন সুতারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে; বিপরীতে ভাসানীর ইচ্ছা ছিল দেশের ভেতর থেকেই যুদ্ধটা চালাবেন। তিনি যে ভারতে গিয়েছিলেন সেটা নিতান্ত বাধ্য হয়ে এবং যাওয়ার সময় তাঁর এই আশাও হয়তো ছিল যে সেখান থেকে লন্ডনে গিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে জোরদার করবেন। কিন্তু ভারত সরকার যে তাঁকে বাইরে যেতে দেবে না, এটাও নিশ্চিত ছিল এবং তারা তাঁকে যত্নসহকারে আটকেই রেখেছে।
মুজিবের কথা আলাদা, তবে আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনই চেয়েছেন, স্বাধীনতা নয়। যুদ্ধের সময়েই এবং মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেই ঘোরতর সোহরাওয়ার্দীপন্থী খন্দকার মোশতাক আহমদের যোগাযোগ ছিল মার্কিনদের সঙ্গে এবং তাঁর চেষ্টা ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার। একাত্তরের এপ্রিল মাসে সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান ঢাকায় এসেছিলেন দেশের ভেতরে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতা প্রস্তাব নিয়ে। তারও আগে ছয় দফার ঘোষণার সময়ই আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা আওয়ামী লীগের একাংশকে নিয়ে পিডিএমের (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন সমর্থন করলেও ছয় দফা সমর্থন করতে পারেননি।
সোহরাওয়ার্দীপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তিনিও স্বাধীনতা পর্যন্ত যাওয়ার তৎপরতাকে সমর্থন করেননি। ১৯৬৯-এ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করার অল্প পরেই ইয়াহিয়া খান পিন্ডিতে সম্পাদকদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন, তাতে মানিক মিয়া যোগ দেন। ওই সম্মেলনের আয়োজক ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী জানাচ্ছেন যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মানিক মিয়া তাঁকে বলেছিলেন যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান সমস্যা সৃষ্টি করবেন না। […] তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালি নেতা, তবে তিনি অতটা শক্তিশালী নন। তা ছাড়া রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে তাঁর অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়বে। সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা ভঙ্গ হলে লাভবান হবে শুধু ভাসানী ও চরমপন্থীরা। ’ মানিক মিয়ার পরামর্শ ছিল ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে পুনঃস্থাপিত করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার। পাকিস্তানি ওই ব্রিগেডিয়ার আরো জানাচ্ছেন যে ‘ভাসানী ও তাঁর বিপ্লবের ব্যাপারে মানিক মিয়ার ভীতিটা ছিল অসুস্থতার পর্যায়ে। ’ ওই সব কথোপকথনের পরের দিনই মানিক মিয়া পিন্ডির এক হোটেলকক্ষে মারা যান। (তারিখ ৮ মে ১৯৬৯)।
শেখ মুজিবের প্রধান নির্ভরতা ছিল ছাত্রলীগের তরুণদের ওপর। যাদের মূল অংশ স্বাধীনতার দাবি তুলেছে এবং এক পর্যায়ে শুধু স্বাধীনতা নয়, সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এই অংশটি মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। এরা ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের উভয়াংশের উত্থাপিত সিয়াটো-সেন্টো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলসহ কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকারের দাবি মেনে নিয়ে ১১ দফার ভিত্তিতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। গঠন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তবে ছোট হলেও আওয়ামীপন্থী ছাত্রনেতাদের একাংশ যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা লাভের পক্ষে ছিল তাও সত্য। এদের স্লোগান ছিল, ‘তোমার দফা আমার দফা ছয় দফা’। এবং যেটি লক্ষ করার বিষয় সেটি আরো একটি আওয়াজ, ‘বাঁশের লাঠি হাতে ধরো, পাতিবিপ্লবী খতম করো। ’ কিন্তু স্বাধীনতাপন্থীরা ছিল অধিক শক্তিশালী এবং তাদের পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তারা এও বলেছে যে ‘শেখ মুজিবের মন্ত্র, সমাজতন্ত্র’। ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার পক্ষেও তারা মত প্রকাশ করেছে।
কেন্দ্রীয় সত্যটি আবারও উল্লেখ করতে হয়। ভাসানী এবং মুজিব একই শ্রেণি থেকে (পেটি বুর্জোয়া) এসেছেন, কিন্তু ভাসানী সংগ্রাম করেছেন মূলত মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য, আর শেখ মুজিব রয়ে গেছেন নিজের শ্রেণিতেই। দুজনের ভেতর ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক না কেন তাঁদের রাজনীতি চলে গেছে দুটি ভিন্নপথে। আওয়ামী লীগের পেটি বুর্জোয়া অংশের যথার্থ প্রতিনিধি অবশ্য ছিলেন কট্টর সমাজতন্ত্রবিরোধীরা, যাঁদের মুখপত্র ছিল দৈনিক ইত্তেফাক ও তার সম্পাদক। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী নিজে; কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর আনুকূল্যে পত্রিকার মালিকানা চলে গিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী অনুসারীদের হাতে। সোহরাওয়ার্দী ন্যাপের নাম দিয়েছিলেন Nehru-aided Party; ইত্তেফাকও সেই নামই পছন্দ করত।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়