বেওয়ারিশ
![](https://hakkatha.com/wp-content/uploads/2024/05/hakkathafav.png)
- প্রকাশের সময় : ০৩:২২:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ মে ২০২০
- / ২৯৬ বার পঠিত
সাঈদুল হক নিপু: নিউইয়র্কে আমার বন্ধুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। একেবারে শূন্য বলতে পারলাম না যার জন্য, সে আর কেউ নয় বন্ধুবর শামসুজ্জামান খান। বন্ধুরা তাকে (শামসুজ্জামান) তোমরা অনেকেই শামস নামে চেন তাই এ পর্যাযয়ে তার ঠিকূজী-কূলজী নিয়ে টানাটানি না করাই শ্রেয় মনে করছি। কিছুদিন আগে আমাদের ব্রাহ্মনবাড়িয়ার একটি সংগঠনের (আবেশ) জন্য শামসের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম, তারই তাগাদা দিতে গিয়ে দেখি শামস আকাশ-পাতাল ব্যস্ত কথা বলার ফুরসতটুকু নেই। খালি পালাই পালাই করছে। রীতিমত চেঁচামেচি করে কথাবলার সময় আদায় করতে হলো। যা জানলাম এখন মনে হচ্ছে তা না জানলেই ভাল করতাম।
পাঠক মাত্রেই সবাই জনেন যে আটলান্টিকের এপারে আমেরিকা নামক সোনার হরিণ, টানেনা এমন বাঙালীর সংখ্যা হাতেগোনা। কেউ টুরিস্ট ভিসায়, কেউবা চাকুরী ভিসায়, কেউ আবার ইমিগ্রেশন ভিসায় আমেরিকায়। সবচেয়ে কঠিন ভিসা হলো ‘মেক্সিকো ভিসা’ যাতে কিনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হয়ে এসে মেক্সিকোর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে হয় স্বপ্নপুরীতে। এ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য হতভাগা যাত্রাপথেই মারা পরে বিভিন্ন অত্যাচার, রোগবালাই আর অনাহারে। যারা এতসব ঝকমারি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, তাদের শুরু হয় জেল-জরিমানা সহ, অবৈধ হবার বিভিন্ন পর্যায়ের অবর্ণনীয় যাতনায়।
তেমনি এক ভিসায় আমাদের আজকের অক্ষাংশের মূল চরিত্র খান মোহাম্মদ আমিনুজ্জামান সাহেব, সোনার হরিণের সন্ধানে প্রথমে দেশ ছাড়লেন সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে ১৯৯০ সালে। আসার সমযয় সে তার আট মাস বয়সের একমাত্র শিশু সন্তানকে স্ত্রীর কোলে রেখে আসেন, যাদেরকে আর কোনদিনই তার দেখা হয়ে উঠেনি। কী মর্মান্তিক এই প্রবাস জীবনে তার নেই বৈধতার কোন প্রমাণপত্র। শুরু হয় সম্পূর্ণ অপরিচিত বৈরী পরিবেশে নিয়তির সাথে নিষ্ঠুর সংগ্রাম, শুধু টিকে থাকার জন্য! সৌদি আরবের মরুভূমিতে আগুনের লেলিহান শিখার মত আবাহাওয়ার সাথে জীবনযুদ্ধ। সে কি নিদারুণ কষ্টের ৫টি বছর, প্রতি পদক্ষেপে দগ্ধ হয়ে হাতের শেষ কড়িটুকু খুইয়ে আবশেষে ১৯৯৫ সালে এসে পৌঁছান নিউইয়র্ক শহরে। যথারিতী আবারো শুরু হয় অবৈধ হবার যাতনা আসতে না আসতেই।
পাঠক এখানে আমেরিকাতে অবৈধ থাকার যে কষ্ট তা একটু না বললে ভদ্রলোকের প্রতি অবিচার করা হবে। এ দেশে একেতো কাগজ (বৈধ) ওয়ালা অভিবাসীরাই রিফুজি ষ্টেটাস অন্তর্গত, সেখানে অবৈধদের যে কি করুণ অবস্থা সেটা আন্দাজ করতে নিশ্চয়ই কষ্ট হবার কথা নয়। সবচেয়ে অবর্নণীয় ও ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যখন ৫০ বা ততোধিক বছরের শিক্ষিত, নামী-দামী কোম্পানিতে কাজ করা, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া, অফিসার গোত্রের লোকগুলো আত্মহত্যার সামিল এরূপ জঘন্য ও মানবেতর অবৈধ জীবন বেছে নেয়, কেউবা স্বেচ্ছায়, কেউবা পারিবারিক চাঁপের কারণে।
অবৈধ হওয়াতে আপনাকে কেউ বাসা ভাড়া দেবে না, বাধ্য হয়েই আপনাকে থাকতে হবে অন্যের বাসায় সাবলেট, যেখানে খাবার-দাবার সহ আপনার প্রাইভেসির বারটা বেজে যেতে বাধ্য। আর যদি আপনি ব্যাচেলরদের মেসে উঠেন তবে দেখবেন বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের হরেক রকমের মেজাজী লোক যাদের প্রায় প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, প্রচুর টাকা খরচ করে বিভিন্ন পন্থায় স্বপ্নের দেশে পৌছেছেন। দেশের সহায়-সম্বল বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। একটাই লক্ষ্য শুধু কিভাবে পয়সা বাঁচানো যায়। দেশে টাকা পাঠাতে হবে পরিবারে জন্য। এ লক্ষ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে একেক রুমে ৪-৫ জনের বসবাস, না আছে খাবার দাবারের মান, না আছে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সর্বোপরি রয়েছে হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রম, ডলার রোজগারের আশায়। সব মিলিয়ে সে এক মানবেতর জীবন, নিজেদের রান্না নিজেরাই ভাগাভাগি করে করতে হয়, কেউ কেউ রান্নার ভয়ে দীর্ঘদিন নিম্নমানের হোটেলে বা ফাস্ট ফুডের দোকানে খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন- এমন উদাহরণও রয়েছে প্রচুর।
আবার অবৈধদের কাজের ক্ষেত্রেও বড় নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করতে হয়, কারণ নিয়োগ কর্তারা দৈনিক ১২-১৪ ঘন্টা কাজ করিয়ে মাত্র ৪০-৪৫ ডলার মজুরী দিতেও কার্পণ্য করেন, কেননা তারা অবৈধ হওয়াতে আইনগতভাবে কাজ পাবার যোগ্য নন। এ সুযোগে একজনকে দিয়ে একাধিক লোকের কাজ করিয়ে নেন। শুষে নেন তার রক্ত মাংস সহ সম্পুর্ণ জীবনী শক্তি।
অবৈধ হওয়াতে পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে ডিপোর্টেশনের ভয় থাকে। তাই যতই অত্যাচার, জুলুম চলুক, মুখ বন্ধ। মজার বিষয় হচ্ছে- যে খাটছে এবং যে খাটাচ্ছে উভয়েই বাংলাদেশী। একজন নির্লজ্জের মত অপরের অসহায়তার সুযোগে নিজের ফায়দা হাসিলের জন্য খাটাচ্ছে, আর অপরজন অবৈধ হবার মাশুল দিতে খেটে মরছে।
অনেকেই আবার এটর্নী (এডভোকেট/উকিল) নিযুক্ত করেন স্থায়ীভাবে বসবাসের সনদ গ্রীনকার্ড পাবার আশায়। আশা বড় মারাত্মক জিনিস, একে তো স্বল্প আয়, তার উপর উকিলের বিশাল খরচ যোগান, কারো কারে জীবন চলে যায় এ প্রক্রিয়ায়। তাও যদি পেশার প্রতি সৎ এমন উকিল হয়। আমাদের বাঙালী কমিউনিটিতে এমনও উকিল রয়েছেন যিনি আমারই এক ভাই রফিকের কাছ থেকে ২০ বছরে প্রায় লক্ষাধিক ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন বৈধতার কাগজ পাইয়ে দেবেন বলে, কিন্তু পারেন নি, সেই কাগজ একজন ইহুদী উকিল স্বল্প খরচে বের কওে দেন পরবর্তীতে।
আমাদের আজকের নায়ক আমিন সাহেব (সংক্ষেপ) তার স্বল্প আয়ের সিংহভাগই উকিলকে দিয়ে সর্বদাই প্রায় দেউলিয়ার পর্যায়ে ছিলেন। কোন কোন সময় এর বাড়ী, ওর বাড়ীতে থেকেছেন দৈন্যতার কারণে। সময়ের আবর্তে ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধ ২৫টি বছর যোগ হয়েছে তার জীবনের সাথে। এখন তিনি ৭৫, প্রতিনিয়ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, অনিয়ম আর অবহেলা, স্ত্রী-সন্তানের বিয়োগ ব্যথা, সুদীর্ঘ কাল মাতৃভুমির প্রতি গভীর অনুরাগ সব মিলিয়ে জীবনের প্রায় শেষ বিন্দুর কেন্দ্রে ছিল তার অবস্থান।
এমনি যখন অবস্থা, এলো করোনার প্রকোপ। আমিন সাহেব এমনিতেই করোনা ভাইরাসের জন্য সহজ শিকার ছিলেন তার শারীরিক অবস্থার কারনে, ভাইরাসের প্রকোপ বুঝে উঠার আগেই হলেন মলেব্যাধি করোনায় আক্রান্ত। ভাইরাসের ছোবলে জর্জরিত আত্মীয় পরিজনহীন একাকী একজন মানুষ, না আছে ঔষধ-পথ্য, না আছে সেব-শুশ্রæষা বা মনোবল বাড়ানোর জন্য কোন নিকট আত্মীয়। করোনার প্রকোপে আকাশ-পাতাল জ্বর, কাশি, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট সহ সীমাহীন দুর্বলতা। এমনি শ্বাস কষ্ট যে শুয়ে থাকা অসম্ভব। বসে কাটাতে হয় সমস্ত রাত। এক গøাস পানি তুলে খাবার সামর্থ নেই। কাশির দমকে আর শ্বাসকষ্টের করণে মুখে কোন কথাই আসে না। কউকে ফোন করে বলবে বা ৯১১ কল দেবে এমন অবস্থা নেই। এক কথায় মূমুর্ষ অবস্থা।
পাঠক, একটিবার ভাবুন। সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মুখলূকাত আজ কত অসহায় ও একাকী। হসপিটাল থেকে কবর পর্যন্ত সম্পূর্ণ একাকী “ঙহব ডধু ঔড়ঁৎহবু” আগে-পিছে কেউ নেই ভালবাসা বা সান্তনা দেবার মত। এপর্যায়ে যখন চরম বেহাল অবস্থা তিনি নিজেই ৯১১-এ কল দেন। ওপাড়ে অপারেটর শুধু বুঝলেন যে অবস্থা চুড়ান্ত খারাপ তাই এসে নিয়ে যায় বেলভিউ হসপিটালে। কয়েকদিন চলল যমে-মানুষে টানা টানি, বেলভিউ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে, অবশেষে গত ২৪ এপ্রিল, ২০২০ সন্ধায়, সকল চাওযয়া-পাওয়ার গøানিময় জীবনের ইতি টেনে ঢলে পরেন করোনার কোলে। পেছনে রেখ যান অতৃপ্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস আর কপর্দক শূন্যতা।
পাঠক, আপনারা সবাই হয়ত জানেন যে নিউইয়র্ক শহরে একটি লাশ সমাহিত করতে ন্যূনতম চার হাজার ডলারের মত খরচ পড়ে। মৃত আমিন সাহেব তার সেভিংস শূণ্যের কোঠায় রেখে মরে গিয়ে বেঁচেছেন, কিন্ত হাসপাতালের খাতায় “ঊসবৎমবহপু ঈড়হঃধপঃ” হিসেবে যার নাম লিখেছেন তিনি আমিন সাহেবের বোনদের বৈবাহিক সূত্রে টাঙ্গাইলের আত্মীয়। যদিও তিনি জন্মসূত্রে মানিকগঞ্জের অধিবাসী, তার মেলামেশা বেশিছিল টাঙ্গাইলের লোকদের সাথে। আমার বন্ধু শামসের বাড়িও টাঙ্গাইলে, তাই লাশ দাফনের খরচ যোগানোর দায়িত্ব এসে পরে টাঙ্গাইলবাসীর উপর।
একদিকে লকডাউন, করোনার ভয়ে কেউ ঘর থেকে বেরুচ্ছে না। লাশ পরে আছে বেলভিউ হসপিটালের মর্গে বেওয়ারিশ হয়ে। এমনি লেজেগোবড়ে যখন অবস্থা তখনই আমি ফোন করি শামসকে। জানলাম সে প্রস্তুতি নিচ্ছে “তড়ড়স” এর মাধ্যমে মানিকগঞ্জ সমিতি ও টাঙ্গাইল সমিতি সহ হোমড়া চোমড়াদের সাথে আলোচনায় বসার। কিভাবে এত টাকা যোগার হবে লাশ দাফনের খরচ বাবদ। অবশেষে দুই সমিতি আর কতিপয় সহৃদয় ব্যাক্তির সহযোগিতায়, বাংলাদেশ সোসাইটির দনকৃত নিউজার্সীস্থ কবরের জায়াগায় দাফন করা হলো ২৫ এপ্রিল, ২০২০। সেই সাথে সমাপ্ত হলো একটি অবৈধ অভিবাসী জীবনের করুণ অধ্যায়ের।
পাঠক, লেখাটি অনেক প্রলম্বিত হলো। ক্ষমাকরবেন। পরিশেষে কিছু প্রশ্ন? কেন শিক্ষিত মানুষেরা এরকম জীবন ধারণ করতে চলে আসেন আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে? যে পরিশ্রম এখানে অবৈধ থেকে করেন, তার আংশিক যদি সে তার দেশের কর্মক্ষেত্রে করতেন, তবে কি তিনি দেশে ভাল থাকতে পারতেন না, প্রবাসী হবার চেয়ে? কেন মরিচীকার পেছনে ছোটেন? তা কি পরিবারের চাহিদায়, না সমাজে “জাতে” উঠার জন্য? নাকি পাশের বাড়ীর অমুক আমেরিকায, আমি কেন নই? করাণ যা-ই হোক পাঠক দয়া করে কেউ যেন খান মোহাম্মদ আমিনুজ্জামান সাহেবের পদাংক অনুসরণ করবেন না। তার আত্মীয় পরিজনের কেউ কি চেয়েছেন তার এই করুন মৃত্যু? এর জন্য দায়ী কে? সমাজ, সংসার না আমাদের ঘুণে ধরা মানসিকতা।
পাঠক, আমার আকুল আবেদন নিজের আজীবনের বাসস্থান ছেড়ে অজানা, অন্ধকারে ঝাপ দেবার আগে অন্তত দশবার ভাবুন। এ বিশ্ব আর আগের মত নেই, কোথাও অবৈধদের স্থান নেই। যে আপনাকে এ ব্যাপারে ফুসলাবে, ভাববেন না সে আপনার বন্ধু, একটু চেষ্টা করলে দেখবেন দেশেই অনেক ভাল থাকবেন। অন্তত আত্মীয় পরিজন থাকতেও “বেওয়ারিশ” লাশে পরিণত হবেন না। আমার এ অনুরোধ যদি একজনকেও অবৈধভাবে অভিবাসী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে তবেই আমার এ লেখা স্বার্থক মনে করব।
নিউইয়র্ক।