নিউইয়র্ক ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বাইডেনের ন্যাটো-যুদ্ধের খরচ দেবে কে?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৩২:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগাস্ট ২০২১
  • / ৪৮ বার পঠিত

গৌতম দাস: জো বাইডেন ক্ষমতার শপথ নেয়ার চার মাসের মাথায় চীনের বিরুদ্ধে জি-৭ জোট আর ন্যাটোকে দিয়ে আসলে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ চীন বলেছে, কয়েকটি ছোট দেশের জোট দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করার দিন শেষ। তবে বাইডেনের ওই সব কথাবার্তা অপ্রস্তুত থেকে বলা। কারণ ঠিক কোথায় কিভাবে তিনি পৌঁছাতে চান, তাতে আমেরিকার লাভ কী? অথবা বলা যায় সেটি সম্ভব কি না, আমেরিকার সেই মুরোদ এখনো আছে কি না, হোমওয়ার্ক যথেষ্ট করেছেন কি না, এসব প্রশ্নের জবাব বাইডেনের সাথে আছে, তা তার পদক্ষেপের মধ্যে ছাপ বা প্রমাণ নেই।
ন্যাটোর হুমকি দিয়েছেন তিনি? অথচ তার কী মনে নেই, কেন ওবামা ইরানের সাথে আপস করেছিলেন? ইরানের জন্ম থেকে আরোপিত নানা অবরোধ ওবামা তুলে নিয়েছিলেন, P5+1 এর পারমাণবিক চুক্তি করেছিলেন- কেন? কারণ ইরাকে আইএসের তৎপরতা ও দখলদারি শুরু হলেও তাতে আমেরিকার খরচ বইবার মুরোদ ছিল না যে, আবার ইরাকে সৈন্য পাঠায়। আর এ কাজটিই ইরানী সেনাবাহিনী করে দেবে বলে তিনি আপস করেছিলেন। কাজেই…।
চীন-আমেরিকার বিরোধকে হালকা ভাষায় বললে এটি বাণিজ্য বিরোধ বা বড় জোর বাণিজ্যযুদ্ধ বলা শুরু হয়েছিল, যা চলে আসছে কেবল ট্রাম্প আমল থেকে এ পর্যন্ত। কারণ ওবামা আমল পর্যন্ত এটি বিরোধ বা বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও দেখা দিতে দেয়া হয়নি। তবে ওবামা দুবারই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীন সফরে গেছেন আর চীন তাকে একগাদা বাণিজ্য সুবিধা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আর তা দিয়েই সেটি আর কখনো বিরোধ বা কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও হাজির হয়নি। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম বছরেও (২০১৭) তিনি এমনই ভাবে সফরে গিয়ে আরো বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে এসেছিলেন যেটা পরের বছর (২০১৮) থেকে আর ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ টার্মটা ব্যবহার না করে পারেনি। তা হলে এটি কি ব্যক্তি ট্রাম্পের জাতিবাদী ভাব নিয়ে আগানোর সমস্যা, নাকি এটি অনিবার্য ছিল? জবাব হলো, এটি অবশ্যই অনিবার্য ছিল। তবে ট্রাম্পের জাতিবাদ এটিকে সহজ করবে মনে করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছেন।
আসলে এটি যে অনিবার্য তা নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেন। এটি হলো আমরা যখন রিফুজি হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজছি সেই একাত্তরের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার প্রথম গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন। ফলে মাওয়ের চীন সফরে যাওয়া প্রথম কোনো আামেরিকান প্রেসিডেন্ট হলেন নিক্সন। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারীতে চীন সফরে যান। আর সেই থেকে সেকালের বিনিয়োগ-খরায় থাকা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হামলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমেরিকার বিনিয়োগপাড়া ওয়ালস্ট্রিট ছিল সবচেয়ে খুশি।
কিন্তু সে দিনও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই জানতেন এই সুখ সাময়িক। কারণ এতে একদিন চীনই বড় হয়ে এই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু সেসব ভুলে বিনিয়োগ গ্রাহক চীনের বিশাল বাজার তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকাকে বিশাল লাভালাভ রিলিফ দেবে, পাওয়া যাবে- এটিই ছিল মুখ্য বিবেচনা। ক্যাপিটালিজমের আদি এবং অনিবার্য স্ববিরোধ হলো, সে নিজেই ক্রমেই বাজার সঙ্কুচিত করবেই। তাতে আবার একসময় নতুন বাজার পাওয়ার সঙ্কটে পুরনো মালিকরা দিশেহারা হবেন আর নতুন উত্থিত মালিক তাকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। তাই বলছি, সেই ১৯৭২ সাল থেকেই সবাই জানত এ দিন আসবেই। এমনকি এখনকার ওয়ালস্ট্রিটের লিডার (গোল্ডম্যান স্যাক্সে) যারা তারা ইতোমধ্যেই আমেরিকান রাষ্ট্র ছেড়ে চীনা রাষ্ট্রের ভক্ত-পরামর্শক হয়ে গেছেন।
বাইডেন এবারের জি-৭ মানে ধনী সাত দেশের এক ক্লাবের বৈঠকে যোগ দিতে আয়োজনস্থল ব্রিটেনের কর্নওয়ালে গিয়েছিলেন। সত্যিকারভাবে জি-৭ হলো গেøাবাল নেতা আমেরিকার একক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার এক সভা যাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ গেøাবাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক স্বরে পশ্চিমাদেশগুলো যেন কথা বলে বাকি রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারে। জি-৭ এর জন্ম হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তবে এভাবে জি-৭ নামে বসা একেবারেই ইনফরমাল। মানে হলো যেমন, বিশ্বব্যাংকের উপরে কোনো ফরমাল মাতব্বরি প্রতিষ্ঠান জি-৭ নয়।
এভাবে সত্তরের দশক থেকে জি-৭ এর শীর্ষ বৈঠক ব্যবস্থা চলে এলেও এবারই প্রথম চীনকে পশ্চিমা দেশ তাদের যেন এনিমি করে দেখেই কিছু কথা বলা হয়েছে; এমনকি গত ২০১৮ সালের সম্মেলনেও কারো নাম উল্লেখ করেনি।
জি-৭ ফ্যাক্টসশিট
এবারের জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ থেকে এক ফ্যাক্টসশিট বুলেটিন বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাইডেন চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ প্রসঙ্গে এখানে জি-৭ বৈঠকে নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীনের নাম নিয়েই কথাটা তিনি বলেছেন। আবার দ্বিতীয়ত তিনি ঠিক শত্রæ দেশ বলেননি; বলেছেন যার সাথে তার ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ আছে, এভাবে বলেছেন। অর্থাৎ এবার স্বীকার করে নিলেন চীনের সাথে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে কথা এবারই প্রথম বলা হলো কেন?
আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকে চীন তো আমেরিকার কাছে খুবই আদরের দেশ ছিল। কারণ চীন ছিল সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বড় ঋণ খাতক দেশ। আর সেই সাথে আমেরিকার হাইটেক পণ্যের আমদানি দেশ। কিন্তু চীনই ২০১০ সালের পর থেকে হয়ে যায় সরাসরি আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধের দেশ, প্রতিযোগী যেখান থেকে আজ গেøাবাল অর্থনীতির নেতৃত্ব আগামীতে আমেরিকা থেকে কেড়ে নেয়ার দেশ। তাই এই প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে বাইডেন স্বীকার করেছেন যে, চীন আমেরিকার সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে আছে। ফলে সরাসরি না হলেও নাম উল্লেখ করে স্বীকার করে নিলেন চীনের কাছে আমেরিকা নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে, তাই ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’।
এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকা প্রতিযোগিতা করার যোগ্য কী? কতটা? জবাব হলো, না যোগ্য নয়। কারণ আমেরিকা চীনের কাছে হেরে যাবে। ঠিক যেমন এককালে ব্রিটেনও আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল। কারণ বিষয়গুলো অবজেকটিভ ফেনোমেনা বা ঘটনা। ক্যাপিটালিজমের কপালই এমন!
যেসব গরিব ব্রিটেনবাসীকে এককালে আমেরিকায় কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে- পরে ১৭৭৬ সালে ওই গরিব ও চাষাবাদ করে খাওয়া লোকেরা কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সশস্ত্রভাবে উৎখাত করে নিজেদের আমেরিকাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। এরও পরে ১৮৮২ সালের পর থেকে আমেরিকা ক্যাপিটাল একুমুলেশনের বা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের দিক থেকে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটি থেকে পরে ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা হয়ে যায়। ঠিক যেন একইভাবে এখনকার পূর্বাভাস হলো, ২০২৮ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতায় এসে এখন বাইডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটি অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার দিকে যাত্রা। সেটি হলো, আমেরিকা আবার দুনিয়াকে শাসন করেই যাবে। সে জন্যই গত নির্বাচনের সময় থেকে জিতার পরও এখন তার ¯েøাগান হলো ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। না এটি আমেরিকার (নেতাগিরিতে) ফেরত আসা নয়, বরং বাইডেন মানে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, মাত্র। আমেরিকা নয়। সোজাসাপ্টা বললে তিনি মিথ্যা আশ্বাসের ¯েøাগান দিচ্ছেন।
তা হলে তিনি সঠিক কী করতে পারতেন? বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা চীনকে নেতা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে নিজের অবস্থান যতটা সম্ভব ভালো ও উঁচুতে ধরে রাখার চেষ্টা করে যেতেন অর্থাৎ পরিস্থিতিকে অন্তত খামোখা যুদ্ধ-সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া নয়। কারণ পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার মানে হবে, স্বাভাবিক অবস্থায় যদি আমেরিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার সুযোগ থাকে তবে সেটাকেই নষ্ট বা নড়বড়ে করে ফেলা হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু কেন আমরা যুদ্ধের কথা তুলছি? বাইডেন কেবল চীনের সাথে স্ট্রাটেজিক প্রতিযোগিতার কথা বলেছেন, যুদ্ধের কথা তো বলেননি!
হ্যাঁ, এটুকু আপাত-সত্য হলেও বাইডেন আরেক কিছু বড় আকাম করেছেন। যেমন একই নিঃশ্বাসে তিনি প্রায় নেই হয়ে ন্যাটোর (সেক্রেটারির) সাথে মিটিং করেছেন; জি-৭ এর সভা শেষের এক দিন পরে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের উসকানিমূলক কথা বা হুমকি দিয়েছেন। এমনিতেই এটি ছিল বাইডেনের ‘এক ঢিলে অনেক পাখি মারা’র সফর। কারণ তিনি ব্রাসেলসে গিয়ে ইইউ-আমেরিকার শীর্ষ বৈঠকও করে নিয়েছেন আগের দিন। এ দিকে জি-৭, ন্যাটো বা ইইউর সাথে বৈঠক মানে হলো, মূল টপ সাত-দশ নেতার সাথে তিন ফোরামেই বসা মিটিং। একই লোক অথচ ফোরামগুলো ভিন্ন।
ফলে জি-৭ এর বৈঠকে সব কিছুতে আলোচনার ইস্যু হলো চীন। আবার বাইডেন ন্যাটোতে এলে ন্যাটোর দেয়া বিবৃতি লিখছে যে, ‘চীনের উচ্চাকাঙ্খা ও চাপানো আচরণ তাদের অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তাকে সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ করছে বিশেষত তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম আইনের প্রতি অনুগত থাকার বিরুদ্ধে।’ এ ছাড়া ন্যাটোর আরো অভিযোগ হলো, চীন-রাশিয়া মিলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ঢিবি বানাচ্ছে। অর্থাৎ সার কথায় বাইডেন চীনের সাথে আমেরিকার বিরোধকে মিলিটারিলি লড়ার দিকে ঠেলে দিতে চান এই পরিষ্কার ইঙ্গিত এখানে আছে। আর ন্যাটো এই প্রথম যে অজুহাতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোট গড়া হয়েছিল তা এখন বাইডেনের উপস্থিতির সভা থেকে ন্যাটোরও অজুহাত হয়ে গেল।
ঘটনা হলো, আপনি যদি কারো বাসার প্রধান প্রবেশমুখ কোন অজুহাতে বাধা খাড়া করতে যান তবে ভুয়া আইনি বা বেআইনি যে যুক্তিতেই হোক ওই বাড়িওয়ালা আপনাকে উৎখাত করবেই। চীনের কেবল উত্তর-পূর্ব দিকটাই সমুদ্রের দিকে খোলা। বাকি সাড়ে তিন দিকে এটি ল্যান্ডলকড। এখন আমেরিকার সিনেটের পেশ করা লিখিত পরিকল্পনায় মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল। আর চীনে সমুদ্রপথের প্রবেশমুখের চার দিকে প্রায় ১০টি দেশের সাথে সামুদ্রিক সীমানা আছে। আর বলাই বাহুল্য তা আন-ডিমার্কেটেড। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব বিরোধ মীমাংসার সালিস করে দেয়। তবে এটি আমাদের রাষ্ট্রের আদালত বা জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা নয়। এটি আসলে আরবিট্রেশন অর্থাৎ যেটাকে আমরা গ্রামের সালিসি বা আপসে মীমাংসা বৈঠক বলি, এটি তাই। যেমন এখানে দুই পক্ষেরই বিচারক নিয়োগ দেয়ার সুযোগও থাকে। এই আনক্লসের সালিস আদালতে কেবল চীন-ফিলিপাইনের সমুদ্র সীমানাবিরোধের কেসটাই উঠেছিল। তাতে এই জাপানী বিচারকের ব্যাপারে, তাকে বদল করে অন্য বিচারক দেয়ার আবেদন করেছিল চীন, যা মানা হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ চীন সেই থেকে বিচার কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর এতে ব্যাপারটা আর আপস সালিসি না হয়ে (অর্থাৎ বিচারক বদলে না দিয়ে) রাষ্ট্রের আদালতের ভূমিকাই যেন হয়েছিল। আর সেই রায় দেয়া হয়েছিল ফিলিপাইনের পক্ষে। স্বভাবতই চীন সেই রায় মানেনি। আর সেই থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোটের প্রপাগান্ডা শুরু হয় যে, আন্তর্জাতিক আইন না-মানা দেশ হলো চীন। অথচ শুরু থেকেই এটি ছিল গায়ে পড়ে চীনের প্রবেশপথে বাধা তৈরির জন্য আমেরিকার কৌশল যে কথা ওই সিনেট রিপোর্টে লেখা আছে।
এ দিকে ওই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের একমাত্র উত্তর-পূর্ব সমুদ্র প্রবেশপথেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের সব জ্বালানি আসে। তাই এই পথ ও এর বিকল্প পোর্টও চীন খুঁজবে, সেটিই স্বাভাবিক। সে কারণে পাকিস্তান, বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত), মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো চীনের নিজের স্বার্থেই জরুরি। অথচ এসব বন্দর বানাতে গেলে এবার ভারতকে দিয়ে আমেরিকা কান্নার রোল উঠাবে যে, আমাকে চীন চার দিকে ‘মুক্তামালা’র মতো ঘিরে ফেলল! মানে চোর উল্টো পুলিশ ডাকে! এমনকি থাইল্যান্ডের ভূখন্ড কেটে সুয়েজ খালের মতো আরেকটা মালাক্কা বাইপাস তৈরির আলাপ চলছে চীনের থাইল্যান্ডের সাথে।
আমেরিকা ভূখন্ড এশিয়াতে নয়। তা হলে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াডে আমেরিকার এই নেতাগিরি কেন? আমেরিকা বলবে আমার বন্ধুরা এখানে আছে তাদের রক্ষা করতে। এই অজুহাতও না হয় মেনে নেয়া যাক।
প্রেসিডেন্ট ওবামা হলেন সেই লোক যিনি এশিয়া পিভোট (PIVOT) পলিসি চালু করতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কী ছিল সেটি?
উপরে যেটা বলেছিলাম চীনের প্রবেশপথের দুই দিকেসহ চার দিকে প্রায় ১০টি দেশ আছে (যাদের বেশির ভাগই আবার আসিয়ান জোটের সদস্য) এবং যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা মীমাংসিত নয়। আমেরিকার সব প্রশাসনের খুবই মন-কামনা যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে এরা সবাই চীনের সাথে সামরিক বিরোধে জড়াক। আর তাতে আমেরিকা তাদের সবাইকে নিজের কোলে বা কোনো জোটে তুলে নিয়ে এবার তাদের পক্ষ হয়ে চীনের সাথে বিরোধে আমেরিকা সামরিক নেতা হিসেবে হাজির হোক। এটিই ছিল আমেরিকার কথিত স্বপ্ন বা আমেরিকার পিভোট বা ভরকেন্দ্র-ভূমিকা; চীনের বিরুদ্ধে এক আলগা মাতবর আমেরিকা।
আলগা বললাম কেন? বললাম এ জন্য যে, বাস্তবে অমন ১০ দেশের কেউ আমেরিকার প্ররোচনায় পা দেয়নি। তাদের অবস্থান বুদ্ধিমানের। সেটি হলো, তারা মনে করে, চীনের সাথে সমুদ্রসীমা অমীমাংসিত বলে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু সে জন্য আমেরিকার সামরিক জোটে যাওয়া বিপজ্জনক। তারা মনে করে, চীন বিরোধিতার স্বার্থে আমেরিকার কোলে উঠে বসার মানে হয় না। আর সমুদ্রবিরোধে চীনের সাথে আপসে না গেলে তো তাদের দাবি লোপাট হবে না।
আবার ওই ১০ দেশের সবার বাণিজ্য স্বার্থের দিক থেকে চীন তাদের কাম্য। কারণ চীন অবকাঠামো-ঋণ দেয়ার উত্থিত দেশ। এ ছাড়া চীনে রফতানির বাজার পাওয়াও সম্ভব। কাজেই এই স্বার্থকে মেরে ফেলাও তো বোকামি। এ কারণে ওই সব দেশের (এমনকি চীনের বিরুদ্ধে জেতা ফিলিপাইনও) কেউ আমেরিকার কোলে ওঠেনি। উল্টো চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়া যার সাথে চীনের ঠিক সমুদ্রসীমা বিতর্ক নেই, তবে জেলেদের মাছ ধরার রাইট নিয়ে বিরোধ আছে, সেও এই টিকা পাওয়ার কালে চীনা টিকার টেস্টে অংশগ্রহণ ও টিকা কেনার সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর প্রকাশ্যে বলছে, দুটো আলাদা ইস্যু, আমরা আমাদের মাছ ধরার রাইট ছাড়িনি।
এক কথায় বললে এটি ওবামার পিভোট শুধু পাত্তা না পাওয়া নয়, এশিয়াতেই আমেরিকার পা ফেলার জায়গাও কেউ দিতে, যুদ্ধে জড়াতে কেউ রাজি না হওয়া।
এখন ওবামার আমেরিকার এত বড় ব্যর্থতার পরও বাইডেন একই ফর্মুলা নিয়ে আবার এসেছেন কেন? যারা কেউ পিভোটে যোগ দেয়নি তারা কেন আবার ইন্দো-প্যাসিফিক না কোভিডে যোগ দেবে বলে বাইডেনের আশাবাদ? তা হলে কিসের ভরসায় তিনি জি-৭ বা ন্যাটোকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে ও ঢোল বাজাতে এলেন?
চীনের সাথে আমেরিকার গেøাবাল নেতৃত্ব নেয়া বা দেয়া নিয়ে বিরোধ আছে, যাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটিকে ফয়সালার জন্য বাইডেন যুদ্ধের দিকে এটিকে ঠেলে দেবেন আর এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যেতে পোলারাইজড হতে যাবে কেন? ইতোমধ্যেই এটি পরীক্ষিত যে তারা কেউ যাবে না এবং পিভোট প্রকল্প আজ মৃত!
তা হলে এবার ইউরোপ অনেক সাড়া দিচ্ছে মনে হচ্ছে; সেটি কেন? খুব সম্ভবত এটি এক ‘সাদা’-বাদী শঙ্কা ও তা থেকে একাত্মবোধ। বাইডেন এ ভয়টাই ইউরোপে বিক্রি করেছেন। কথাটাকে প্রতীকীভাবে অনেক সময় বলা হয়, এশিয়া বা চীন গেøাবাল নেতৃত্বে শক্ত হয়ে বসে যাওয়ার মানে কী? মানে হলো, আমরা দেখব, গুলিস্তানের কামানের পাশ দিয়ে সাদা পশ্চিমা তরুণরা ক্লান্ত হলে ফাইল হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকার কুইন্সে বা পশ্চিমের কোনো শহরের বাঙালী পাড়ায় আমরা ভিড় করি- কখনো চাকরি কখনো স্কলারশিপের লোভে! এ ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করে তাদের তিনি নিজের পেছনে জড়ো করেছেন যে, দেখি না চীনের নেতা হয়ে যাওয়াকে ১০ বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারি কি না!
বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)
বাইডেন জি-৭ বৈঠকে শুধু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি তুলেছেন তাই নয়, সাথে আরেক চালচুলাহীন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছেন। সেটি বিনা তুলনায় বললে কেউ কিছু বুঝবে না। বলতে হবে এটি চীনের বেল্ট-রোডের বিকল্প এক বাইডেন জোটের কর্মসূচি। এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)’। প্রথম তিনটি শব্দ ইংরেজি বি দিয়ে বলে B3 আর পরে ওয়ার্ল্ডের ড। এ কারণে সংক্ষিপ্ত B3W। এক কথায় বললে বেল্ট-রোড জাতীয় বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ার খাতের ঋণ, তবে যার পরিমাণ বিশাল। B3W এর কি সেই মুরোদ আছে?
আমেরিকার এই দিন শেষের বেলায়? এখানে আমেরিকান বিনিয়োগ বলতে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মাধ্যমে তাদের জন্মকালে যা চাঁদা দিয়েছিল। একালে ইউএসএইডের মতো সরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণের অর্থ কমে আসা দেখলেই তো বোঝা যায় কিভাবে আমেরিকান সক্ষমতা কমে এসেছে, কী হাল হয়েছে! এর ওপর বাইডেন আশাবাদ রেখেছেন ব্যবসায়ীদের তারা মটিভেট করে এখানে আনবেন! এসব কল্পকাহিনী তুলে রেখে বাইডেনের পরামর্শকদের উচিত বিশ্বব্যাংকের জন্য ফান্ড তুলতে ওর জন্মের সময় কী কষ্ট করতে হয়েছিল তা স্মরণ করা।
আর চীন কিভাবে করেছে? চীন একালে বিপুল সারপ্লাস একুমুলেশনের দেশ। সেই সরকারি ফান্ডটাই পরে কোথায় লাগানো যায় সেই বুদ্ধি করতেই প্রসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মাথায় কেউ বুদ্ধি দিয়েছিল বলে ২০১৩ সাল থেকে বেল্ট-রোডের জন্ম। এখন B3W হলো অনিশ্চিত আর ফকিরি চাঁদা তোলা এক ফান্ডমাত্র- সে কী করে চীনা সরকারি বিপুল সারপ্লাসের সাথে প্রতিযোগিতা করবে? আমেরিকার হাতে বিপুল সারপ্লাস সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে, সেই আমেরিকা কবেই মরে গেছে। সেই বুড়া বাঘকে এখন নয়া চাবুক দিয়ে চাবকালেই কি সে বাঘ তরুণ হয়ে চীনের সমতুল্য বা প্রতিদ্ব›দ্বী হতে পারবে? না সম্ভব? এগুলো কি স্বপ্ন কল্পনার গল্প দিয়ে পূরণ হওয়ার মতো কাজ?
আবার মনে করিয়ে দেই। বেল্ট-রোডের বেলায় প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল এটি নাকি ঋণগ্রস্ত করে দিয়ে সে দেশের সম্পদের মালিকানা চীনের নিয়ে নেয়ার ব্যবসা। তা হলে এখন বাইডেন B3W করতে চাচ্ছেন কেন? একই ঋণব্যবসা করতে? এর জবাব কী দেবেন বাইডেন?
এ দিকে আফ্রিকায় চীনা এমন বিনিয়োগ নিয়ে যারা প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল তাদের আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এক নয়া সার্ভে রিপোর্টে আফ্রিকায় চীনা সাকসেস নিয়ে গবেষণা রিপোর্ট বের হয়েছে।
শেষ কথা হলো, বিনিয়োগ আর গল্প আসলে এক কথা নয়। ‘ট্যাকার মুরোদ’ থাকা লাগে চাচা!

যুদ্ধের খরচ জরুরি, হিউম্যান রাইটও
কলোনি যুগের আমেরিকা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের জোরে বড় অর্থনীতি হিসেবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেই তাকে দুনিয়ার ‘গেøাবাল অর্থনীতিতে নেতা’ বলে সবাই মেনে নিয়েছিল। এককালে আমেরিকা নেতা হয়নি। তাকে প্রায় ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্য। মূল কারণ দুনিয়া তখন কলোনি দখলের রামরাজত্বে ডুবেছিল, যার অবসান দরকার ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) দুনিয়ার কলোনি দখলদার শক্তিগুলা যারা দুনিয়ার ওপর একচ্ছত্র খবরদারি চালিয়ে বেড়াত তারা যুদ্ধের মাঝপথে সবাই দেউলিয়া হয়ে গেছিল। ফলে নেতা হিটলার (সাথে মুসোলিনির ইতালি আর মার্শাল তেজো জাপানসহ অন্যরা) এক দিকে আর অন্য দিকে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিরা এভাবে এক পোলারাইজেশন ঘটতে পেরেছিল বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বের অংশ জয়লাভ করেছিল।
এই যুদ্ধের আসল ফ্যাক্টর যে যুদ্ধের পোলারাইজেশন এবং তা এমন কেন হয়েছিল ও কিসের ভিত্তিতে; তা আমাদেরকে তখন পরিষ্কার জানতে দেয়া হয়নি। তবে দুটো শক্তি ঘটনা যেভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল আমরা খাপছাড়াভাবে তাই জানতাম।
এরই একটা হলো, ইউরোপ যেন ব্রিটিশদের মতো ভালো মানুষদের নেতৃত্বে মানে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নেতৃত্বে খারাপ মানুষ হিটলার আর তার বন্ধুদের পরাজিত করেছিল। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প। এ ছাড়া ওদিকে আরেক ব্যাখ্যা চালু ছিল কমিউনিস্টদের। এটিও আরেক ভালভালাইয়া; মানে চার দিকে সব খালি ভালো আর ভালো। ভালো মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনের হাতে জর্মানীর হিটলারের পরাজয়, এটিই নাকি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল গল্প। কিন্তু আমরা খুবই সরি, এ দুটোর একটিও বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, পোলারাইজেশন ও মুখ্য ফ্যাক্টর ছিল না। কেন?
আমরা চার্চিলকে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বুঝতে গেছিলাম আর সেটি এ জন্য যে তারাই তো আমাদেরকে ইউরোপ চিনিয়েছিল। তারাই আমাদের প্রভু ছিল। ইউরোপের ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র ইংরেজি আমাদের এলিটরা বুঝত আর তারা কেবল ব্রিটিশ মিডিয়া পড়ে সেগুলো অনুবাদ করত। এভাবে গেøাবাল কাহিনীর যতটুকু নাগালে আসত তা দিয়েই কেবল আমরা বিশ্বযুদ্ধ যতটুকু যা বুঝতাম। তাই আমেরিকা বলে কোনো দেশ আছে কি না ঠিকমতো বুঝতাম না; অর্থাৎ চার্চিলের চোখ দিয়েই আমরা বিশ্বযুদ্ধ বুঝেছিলাম।
অথচ হার্ডকোর সত্য এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের মতো কলোনি হয়ে থাকা দেশগুলো আর ইউরোপের কারো না কারো কলোনি শাসন হয়ে থাকবে কি না- এটিই ফয়সালা করে দিয়েছিল। কঠিন সত্যটা ছিল, চার্চিল আমাদের ত্রাতা বা মুক্তিদাতা ছিলেন না। কলোনি থেকে আমাদের আসল মুক্তিদাতা হয়েছিল আমেরিকা। যদিও তা আমেরিকার নিজ স্বার্থেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দুনিয়ার সব কলোনি দখলদার চার্চিলসহ সব কুতুবকে দাসখত দিতে বাধ্য করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে শেষ হলে পরে তাদের সবাইকে দুনিয়া থেকে কলোনি ব্যবস্থা উঠিয়ে ফেলতেই হবে; যাতে দুনিয়া কলোনিমুক্ত প্রায় শ দুয়েক স্বাধীন রাষ্ট্রের এক দুনিয়া হয়। মূল কথাটা হলো, আমাদের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে চার্চিলও আসলে আমাদের ভিলেন ছিল। কিন্তু হিটলারের মারের মুখে নিজের যুদ্ধের খরচ চালানোর মুরোদ ছিল না বলে আমেরিকান শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অতএব যুদ্ধ শেষে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ১৯৬৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে অসংখ্য দেশের কলোনিমুক্তি ঘটে গিয়েছিল।
অখন্ড ভারতের দিক থেকে দেখলে বিশ্বযুদ্ধের এটিই ছিল আসল ইতিহাস, আমাদের কলোনিমুক্তির ইতিহাস। গেøাবাল ইতিহাসের দিক থেকে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসল ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে আর তাই স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশেষে প্রথম গেøাবাল অর্থনীতির নেতা হয়েছিল আমেরিকা।
এই আমেরিকান নেতৃত্ব মানে কী? এর মানে আর আবছা রেখে লাভ নেই, যা স্টালিন বা চার্চিল আমাদেরকে সেকালে জানতে দেয়নি তা হলো, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে খরচের বড় অংশটি একাই বহন করেছিল আমেরিকা। মানে ইউরোপ এমনি এমনি আমেরিকান নেতাগিরি মেনে নেয়নি।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরেক যে ব্যাখ্যা- আমাদের রাজনীতি ভালো বোঝে এমন ভাবধারা কমিউনিস্টদের মুখ থেকে জানি, সেটিও আসলে সোভিয়েত ভাষ্য। আর সেখানেও যুদ্ধের বড় খরচদাতা ওই একই আমেরিকা হলেও কমিউনিস্টদের ইতিহাস ভাষ্যে সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়ে এসেছে।
তবে ফ্যাক্টস হলো, আমেরিকাও দাসখত বা ‘সহযোগিতা’ চুক্তিতে স্তালিন বা চার্চিলকে অপমানজনকভাবে শামিল হতে বাধ্য করেননি। এসব চুক্তিতে অপরপক্ষ হিসেবে প্রথম ও একক স্বাক্ষরদাতা ছিলেন চার্চিল আর সেটির নাম আটলান্টিক চুক্তি, ১৬ আগস্ট ১৯৪১। আর পরে সেই ড্রাফটটাই কিন্তু এবার চার রাষ্ট্র ব্রিটেন, আমেরিকা চীন ও সোভিয়েত মিলে আবার স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। তবে এবার ওই চুক্তির নাম দেয়া হয়েছিল ‘জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণায়’ স্বাক্ষর এই নামের আড়ালে। সাথে একই দিনে আরো ২৬ দেশ ওই একই ডকুমেন্টে প্রতি স্বাক্ষর করেছিল। এটিই আমেরিকার নেতৃত্বে হিটলারবিরোধী জোটের দলিল। কিন্তু তবু কোথাও কলোনি ছেড়ে দিতে চলে যেতে হবে এই ভাষা বা শব্দ কোথাও নেই। তবে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে যেকোনো ভূখন্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক হবে যে ওই ভূখন্ডের শাসন কিভাবে চলবে; অর্থাৎ কলোনি করা নিষিদ্ধ হলেও এ ভাষায় তা বলা হয়নি।
এ প্রসঙ্গকথা এবার গুছিয়ে বলে শেষ করা যাক। তা হলে আমেরিকা কিভাবে গেøাবাল নেতা হয়েছিল সেটি আমাদের মতো দেশের এলিট বা কুতুবরা কেউ জানত বা টের পেয়েছিল তা মনে হয় না। এর কাহিনী বা ঘটনার দিক এটিই। আর এটিই এখন আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ গত ১১-১৬ জুন জুড়ে বাইডেন জি-৭ আর ন্যাটোর মিটিংয়ে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি বা হুমকি তুলেছিলেন। অথচ আসল কথাটা এই যুদ্ধের খরচ কে দেবে সেটিই বলেননি। অথচ আমরা উপরে দেখলাম যুদ্ধের খরচই আসল। এটিই সেকালে ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র বহন করতে সক্ষম ছিল রুজভেল্টের আমেরিকা। তাই ইউরোপ হিটলারের হাতে দখল ও বিলীন হওয়ার বদলে আমেরিকান নেতৃত্বকেই বেটার বিকল্প বোধ করেছিল। আর আমেরিকার স্বার্থ শুধু গেøাবাল নেতা হওয়া ছিল তা নয়, তার হাতে জমা থাকা বিপুল সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত সম্পদ তখন বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল, কারণ দুনিয়া তখন কলোনিমুক্ত স্বাধীন। ফলে এরা সবাই তখন আমেরিকার ঋণের সরাসরি অথবা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে খাতক। আমেরিকা এসব স্বাধীনমুক্ত দেশকে ঋণের খাতক হিসেবে পেয়েছিল।
কাজেই একালে বাইডেনের ভাবি যুদ্ধের খরচের সংস্থান না করে চীনকে যুদ্ধের হুমকি দেখানো এগুলোকে কী বলা যায়? এর মানে কি আমেরিকা-চীনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ নামে যে বিরোধ প্রকাশ্যে বাজারে হাজির আছে, তা বাইডেন এখন যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান করতে চাইছেন? হ্যাঁ তাই। সে জন্যই এটিকে ছেলেমানুষি চিন্তা বলছি। কারণ এক তো খরচের ব্যাপার আছে; সেটি ছাড়াও চীনের সাথে আমেরিকান বিরোধ মূলত হাতে থাকা উদ্বৃত্ত সম্পদ না থাকা থেকে উদ্ভূত বিরোধ- এমন বিরোধকে বাইডেন যুদ্ধে গিয়ে সেটিকে নিজের পক্ষে জিতে আনবেন কী করে?
ধরা যাক, যুদ্ধ একটি হলো আর আমেরিকা তাতে জিতেও গেল। কিন্তু তার পরে এতে কি আমেরিকার হাতে যথেষ্ট ‘সঞ্চিত উদ্বৃত্ত সম্পদ’ না থাকার সঙ্কট, সেটি এখন আছেও তা কেটে যাবে? বিপুল সম্পদটা আসবে কোথা থেকে? কিভাবে?
আসলে তখনো দুনিয়ায় সম্ভাব্য একমাত্র উদ্বৃত্ত সম্পদের উৎস দেশ হয়ে থাকবে এ চীনই। আর সেই চীনের কাছে হাত পেতে আমেরিকা তার জনগণকে খাওয়াবে, দুনিয়া রুল করবে- এমন কল্পনা এবসার্ড বলারও সুযোগ দেখি না। এ জন্য বলেছি, সম্পদ থাকা না থাকার সঙ্কট যুদ্ধে জিতেও কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তা হলে অথর্ব ন্যাটোকে সামনে আনা কেন?
বাইডেন ন্যাটোকে সামনে রেখে হুমকিটা দিয়েছেন। ন্যাটোকে দিয়ে তিনি আর্টিকেল পাঁচ চালু করার সামরিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার হাসির কথা হলো, চীন-রাশিয়া নাকি পারমাণবিক অস্ত্রে তাদের সমান হয়ে যাচ্ছে। এতে আমেরিকা হুমকি দেখছে। আচ্ছা খোদ পারমাণবিক অস্ত্রই যেখানে সবার জন্যই হুমকি, সেটি যার হাতেই থাকুক; সেখানে ওরা আমার সমান হয়ে যাচ্ছে কেন? এটি কী নাকিকান্নাময় যুদ্ধের অজুহাত তোলা নয়!
কিন্তু আসল কথাটা হলো, সেই ওবামা আমল থেকে, চাক হেগেল যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (২০১৩-১৫), তখন থেকেই ন্যাটো যে একটি খরচের ডিব্বা, আর সেই খরচের বেশির ভাগ (প্রায় ৯৫ শতাংশ) কেন আমেরিকা একা বইবে- এসব প্রশ্ন আর অজুহাত তুলে কি চাক হেগেল সেকালেই ইউরোপকে অপমান করেনি? ট্রাম্পও তো একই প্রশ্ন তুলেছিলেন। আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, একালে ন্যাটো একটি অপ্রয়োজনীয় সংগঠন। আফগানিস্তানের পর ন্যাটোর আর দুনিয়ায় কোনো ভূমিকা নেই- ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এমন সব ঘোষণা দেয়নি কি? এমনকি তিনি ইউরোপে (জার্মানীতে) ও জাপানে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনো আমেরিকান সৈন্যের সামরিক ব্যারাক মেনটেন করে যাওয়ার খরচ এবার থেকে ইউরোপকে দিতে হবে বলে ট্রাম্প দাবি করেননি?
তা হলে সেসব প্রশ্নের সদুত্তর কী? বাইডেনের কাছে এসব খরচের ব্যয়ভার প্রসঙ্গে সমাধান কী আছে? অর্থাৎ খরচ বইবার প্রশ্নে ন্যাটো এখন একটি পর্যদুস্ত সংগঠন হয়ে আছে! অথচ এসব নিয়ে কোনো কথা না বলে, এক দিনের ন্যাটো বৈঠকে গিয়ে চীনকে হুমকি দিয়ে এলেন বাইডেন! এটি কি তামাশা?
অভ্যন্তরীণ বিতর্কও আছে গভীরে
তবে মনে হচ্ছে, ইউরোপের সবাই এখনো বোকা ধামাধরা নেতাদের দেশ হয়ে যায়নি। তাই খোদ সিএনএন খবর দিচ্ছে কানাডা বাদে জি-৭ এর বাকি নেতাদের মধ্যে বাইডেনের চীনের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে অস্বস্তি ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। গরম তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় অস্বস্তি প্রকাশ করেছে ইতালি। এ নিয়ে চীনা ব্যাখ্যা হলো, ইতালীই ইইউর প্রথম দেশ যে চীনের বেল্ট-রোডে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বললে, চীনের বিরুদ্ধে কামান দাগানো যৌথ বিবৃতি ধরনের কাগজে চীনকে কী ভাষায় কতটা অভিযুক্ত করছে মূলত এই প্রশ্নেই ভিন্নতাগুলো দেখা দিয়েছে। স্বভাবতই সবচেয়ে শক্ত ভাষায় বাইডেন ওই সব ড্রাফট দেখতে চাচ্ছেন। কিন্তু কেউই চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত যাতে না হয় ততটুকুতেই থাকতে চায়। যেমন জাপান টাইমস, যৌথ বিবৃতি ড্রাফট করতে গিয়ে বড় মতভেদের কথা তুলে ধরেছে। বিশেষ করে মানবাধিকার প্রসঙ্গে চীনকে কতটা সমালোচনা করা হবে সে বিষয়ে।
এ দিকে ভয়েস অব আমেরিকা লিখেছে, ইতালী-জার্মানী আর ইইউ প্রতিনিধিকে দেখা গেছে, চীনের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিতে এরা অনিচ্ছুক; বরং সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে থাকতে আগ্রহী। আবার এসব প্রশ্নে কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর আমেরিকা নিজে এভাবে এরা চারজন চার মাত্রায় চীনের বিরোধিতা করতে চায়। আর জাপান যে কোন দিকে অবস্থান নেবে, তা সবচেয়ে অনিশ্চিত।
সিএনএন লিখছে, এক আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট তাদেরকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি খুবই অস্বস্তিতে ছিল বিবৃতির ভাষা নিয়ে। যেন চীন এটিকে কোনোভাবেই উসকানিমূলক হিসেবে না দেখে। চ্যান্সেলর মার্কেল তো বলেই বসেছিলেন যে, চীন আমাদের প্রতিদ্ব›দ্বী বটে কিন্তু আবার অনেক ইস্যুতে আমাদের পার্টনারও তো বটে। ফরাসি নেতা ম্যাক্রোঁও যোগ করেছেন, জি-৭ কে তো ওই চীনের সাথেই আবার জলবায়ু, বাণিজ্য, উন্নয়ন ও অন্য অনেক ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও একসাথে কাজ করতে হবে। তাই তিনি পরিষ্কার করে রাখার পক্ষে যে, তাদের জি-৭ কখনো চীনবিরোধী কোনো ক্লাব হতে পারে না।
সারকথায়, ভেতরে বড় মাত্রায় বাইডেন বিরোধিতা বজায় আছে। তবে সবচেয়ে মজার অবস্থানে ভারত। ভারতের মিডিয়াই ভেতরের বিরোধের খবরগুলো সামনে এনেছে। যেমন ন্যাটো মিটিংয়ে একসময় এমন উত্তপ্ত ভাষায় বাইডেনের সাথে ইউরোপীয়দের বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে কমিউনিকেশন সুইচ অব করে রাখতে হয়েছিল, যাতে বাইরে মিডিয়ার কাছে তা না পৌঁছায়। আবার আরেক ভারতীয় মিডিয়া খবর দিয়েছে, মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে কিছু অবস্থান প্রসঙ্গে খোদ ভারতেরই অস্বস্তি দেখা দিতেছে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির প্রশ্ন ছিল, উইঘুর বা ফোর্সড লেবার ইস্যুতে কতটা চাপ দিয়ে তা বলা হবে, এ নিয়ে বিতর্ক।
প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশেরও বলার আছে। প্রথমত, বাইডেন আমাদেরকে যে পটেনশিয়াল বিপদের মধ্যে রেখেছেন তা হলো, সত্যিই যদি তিনি চীন-আমেরিকার সম্পর্ককে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমি হয়ে উঠতে পারে তাদের দুই দেশের যুদ্ধের রণক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কেমন ধরনের সরকার থাকবে বা কে থাকবেÑ এ প্রশ্নে আমরা নিশ্চয় বাংলাদেশকে চীন-আমেরিকার রণক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চাইতে পারি না। আমরা তাদের স্বার্থের ওই যুদ্ধের বলি হতে পারি না। যেমন বার্মা নিয়ে তাদের স্বার্থের লড়াইয়ের কোনো অংশ হয়ে যেতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের দেশেও নানা পক্ষ আছে স্বাভাবিক। তাদের সবার প্রতি পরামর্শ থাকবে আমরা যাই করি আমরা কারো হাতিয়ারে যেন পরিণত না হই। বিশেষত বাংলাদেশকেই না তাদের বিবাদের রণক্ষেত্রে বানিয়ে ফেলি সেটি আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে। আর উইঘুর বা মানবাধিকার প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবে আমাদের অবস্থানটা হবে সবাইকেই হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স অবস্থানে যেতে হবে। আমরা কি উইঘুরে সত্যি মানবাধিকারের বাস্তবায়ন দেখতে চাই? নাকি এ নিয়ে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ নিতে চাই, যাতে সেটি আমেরিকার বাণিজ্য সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হয়? এ দুয়ের মধ্যে ঠিক কোনটা চায় তা আমেরিকাকে স্পষ্ট করতে হবে।
কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাট
এবার দাবি করা হচ্ছে, এবারের জি-৭ মিটিং নাকি কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাটের লড়াই।
আচ্ছা এই জি-৭ এটি কী এককালে জি-৮ করে নেয়া হয়নি? রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে। পরে যদিও ইউক্রেন-ক্রিমিয়া প্রশ্নে এক বিবাদে ২০০৭ সালে আবার রাশিয়াকে বের করে দেয়া হয়েছিল এবং সেই থেকে রাশিয়ার ওপর আমেরিকান অবরোধ আরোপ হয়ে আছে। তা হলে সেসব সময় রাশিয়া যখন ভেতরে ছিল, তখন সবাই জি-৮ এর সবাই ডেমোক্র্যাসির লোক হয়ে গেছিল? হায়রে ডেমোক্র্যাসি!
আবার সৌদিদেরকে ইয়েমেন তছনছ করতে আমেরিকান সমর্থন এটিও কি ডেমোক্র্যাসির তান্ডব অথবা দুই দিন পরে পরে নিয়মিত গাজায় ইসরাইলী হামলা এটিই বা কোন ডেমোক্র্যাসি? আমেরিকার এসব বক্তব্য আসলে চরম বিরক্তিকর জায়গায় পৌঁছেছে।
তবে চীনের প্রসঙ্গেও অন্তত দুটো কথা বলার আছে। বিশেষ করে বাইডেনের সমালোচনা করছি বলে ভুল বোঝার সুযোগ নেই। হিউম্যান রাইট ইস্যুটা জাতিসংঘের জন্মের সময় ও পরে ১৯৪৮ সালের সম্মেলনে উঠলেও এর অগ্রগতি খুবই হতাশজনক। অথচ এরই মধ্যে গেøাবাল অর্থনীতির নেতৃত্বে বদলের সময়কাল আসন্ন। এত দিন কমিউনিস্টদের রাজনীতি ও দেশ যেভাবেই চলুক, এখনকার প্রশ্ন আলাদা। অন্তত গেøাবাল নেতা হওয়ার স্বার্থে চীনের ন্যূনতম একটি অবস্থান গ্রহণ পূর্বশর্ত। নইলে প্রতি পদে এই ইস্যুতে সঙ্ঘাতে গেøাবাল সব কাজ বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। চীন নিশ্চিত থাকতে পারে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে ন্যূনতম একটি অবস্থান ছাড়া চীনের নেতা থাকা খুবই কঠিন হবে। ফেলও করতে পারে। (নয়া দিগন্ত)
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বাইডেনের ন্যাটো-যুদ্ধের খরচ দেবে কে?

প্রকাশের সময় : ০১:৩২:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগাস্ট ২০২১

গৌতম দাস: জো বাইডেন ক্ষমতার শপথ নেয়ার চার মাসের মাথায় চীনের বিরুদ্ধে জি-৭ জোট আর ন্যাটোকে দিয়ে আসলে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ চীন বলেছে, কয়েকটি ছোট দেশের জোট দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করার দিন শেষ। তবে বাইডেনের ওই সব কথাবার্তা অপ্রস্তুত থেকে বলা। কারণ ঠিক কোথায় কিভাবে তিনি পৌঁছাতে চান, তাতে আমেরিকার লাভ কী? অথবা বলা যায় সেটি সম্ভব কি না, আমেরিকার সেই মুরোদ এখনো আছে কি না, হোমওয়ার্ক যথেষ্ট করেছেন কি না, এসব প্রশ্নের জবাব বাইডেনের সাথে আছে, তা তার পদক্ষেপের মধ্যে ছাপ বা প্রমাণ নেই।
ন্যাটোর হুমকি দিয়েছেন তিনি? অথচ তার কী মনে নেই, কেন ওবামা ইরানের সাথে আপস করেছিলেন? ইরানের জন্ম থেকে আরোপিত নানা অবরোধ ওবামা তুলে নিয়েছিলেন, P5+1 এর পারমাণবিক চুক্তি করেছিলেন- কেন? কারণ ইরাকে আইএসের তৎপরতা ও দখলদারি শুরু হলেও তাতে আমেরিকার খরচ বইবার মুরোদ ছিল না যে, আবার ইরাকে সৈন্য পাঠায়। আর এ কাজটিই ইরানী সেনাবাহিনী করে দেবে বলে তিনি আপস করেছিলেন। কাজেই…।
চীন-আমেরিকার বিরোধকে হালকা ভাষায় বললে এটি বাণিজ্য বিরোধ বা বড় জোর বাণিজ্যযুদ্ধ বলা শুরু হয়েছিল, যা চলে আসছে কেবল ট্রাম্প আমল থেকে এ পর্যন্ত। কারণ ওবামা আমল পর্যন্ত এটি বিরোধ বা বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও দেখা দিতে দেয়া হয়নি। তবে ওবামা দুবারই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীন সফরে গেছেন আর চীন তাকে একগাদা বাণিজ্য সুবিধা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আর তা দিয়েই সেটি আর কখনো বিরোধ বা কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও হাজির হয়নি। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম বছরেও (২০১৭) তিনি এমনই ভাবে সফরে গিয়ে আরো বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে এসেছিলেন যেটা পরের বছর (২০১৮) থেকে আর ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ টার্মটা ব্যবহার না করে পারেনি। তা হলে এটি কি ব্যক্তি ট্রাম্পের জাতিবাদী ভাব নিয়ে আগানোর সমস্যা, নাকি এটি অনিবার্য ছিল? জবাব হলো, এটি অবশ্যই অনিবার্য ছিল। তবে ট্রাম্পের জাতিবাদ এটিকে সহজ করবে মনে করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছেন।
আসলে এটি যে অনিবার্য তা নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেন। এটি হলো আমরা যখন রিফুজি হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজছি সেই একাত্তরের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার প্রথম গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন। ফলে মাওয়ের চীন সফরে যাওয়া প্রথম কোনো আামেরিকান প্রেসিডেন্ট হলেন নিক্সন। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারীতে চীন সফরে যান। আর সেই থেকে সেকালের বিনিয়োগ-খরায় থাকা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হামলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমেরিকার বিনিয়োগপাড়া ওয়ালস্ট্রিট ছিল সবচেয়ে খুশি।
কিন্তু সে দিনও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই জানতেন এই সুখ সাময়িক। কারণ এতে একদিন চীনই বড় হয়ে এই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু সেসব ভুলে বিনিয়োগ গ্রাহক চীনের বিশাল বাজার তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকাকে বিশাল লাভালাভ রিলিফ দেবে, পাওয়া যাবে- এটিই ছিল মুখ্য বিবেচনা। ক্যাপিটালিজমের আদি এবং অনিবার্য স্ববিরোধ হলো, সে নিজেই ক্রমেই বাজার সঙ্কুচিত করবেই। তাতে আবার একসময় নতুন বাজার পাওয়ার সঙ্কটে পুরনো মালিকরা দিশেহারা হবেন আর নতুন উত্থিত মালিক তাকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। তাই বলছি, সেই ১৯৭২ সাল থেকেই সবাই জানত এ দিন আসবেই। এমনকি এখনকার ওয়ালস্ট্রিটের লিডার (গোল্ডম্যান স্যাক্সে) যারা তারা ইতোমধ্যেই আমেরিকান রাষ্ট্র ছেড়ে চীনা রাষ্ট্রের ভক্ত-পরামর্শক হয়ে গেছেন।
বাইডেন এবারের জি-৭ মানে ধনী সাত দেশের এক ক্লাবের বৈঠকে যোগ দিতে আয়োজনস্থল ব্রিটেনের কর্নওয়ালে গিয়েছিলেন। সত্যিকারভাবে জি-৭ হলো গেøাবাল নেতা আমেরিকার একক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার এক সভা যাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ গেøাবাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক স্বরে পশ্চিমাদেশগুলো যেন কথা বলে বাকি রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারে। জি-৭ এর জন্ম হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তবে এভাবে জি-৭ নামে বসা একেবারেই ইনফরমাল। মানে হলো যেমন, বিশ্বব্যাংকের উপরে কোনো ফরমাল মাতব্বরি প্রতিষ্ঠান জি-৭ নয়।
এভাবে সত্তরের দশক থেকে জি-৭ এর শীর্ষ বৈঠক ব্যবস্থা চলে এলেও এবারই প্রথম চীনকে পশ্চিমা দেশ তাদের যেন এনিমি করে দেখেই কিছু কথা বলা হয়েছে; এমনকি গত ২০১৮ সালের সম্মেলনেও কারো নাম উল্লেখ করেনি।
জি-৭ ফ্যাক্টসশিট
এবারের জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ থেকে এক ফ্যাক্টসশিট বুলেটিন বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাইডেন চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ প্রসঙ্গে এখানে জি-৭ বৈঠকে নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীনের নাম নিয়েই কথাটা তিনি বলেছেন। আবার দ্বিতীয়ত তিনি ঠিক শত্রæ দেশ বলেননি; বলেছেন যার সাথে তার ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ আছে, এভাবে বলেছেন। অর্থাৎ এবার স্বীকার করে নিলেন চীনের সাথে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে কথা এবারই প্রথম বলা হলো কেন?
আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকে চীন তো আমেরিকার কাছে খুবই আদরের দেশ ছিল। কারণ চীন ছিল সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বড় ঋণ খাতক দেশ। আর সেই সাথে আমেরিকার হাইটেক পণ্যের আমদানি দেশ। কিন্তু চীনই ২০১০ সালের পর থেকে হয়ে যায় সরাসরি আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধের দেশ, প্রতিযোগী যেখান থেকে আজ গেøাবাল অর্থনীতির নেতৃত্ব আগামীতে আমেরিকা থেকে কেড়ে নেয়ার দেশ। তাই এই প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে বাইডেন স্বীকার করেছেন যে, চীন আমেরিকার সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে আছে। ফলে সরাসরি না হলেও নাম উল্লেখ করে স্বীকার করে নিলেন চীনের কাছে আমেরিকা নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে, তাই ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’।
এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকা প্রতিযোগিতা করার যোগ্য কী? কতটা? জবাব হলো, না যোগ্য নয়। কারণ আমেরিকা চীনের কাছে হেরে যাবে। ঠিক যেমন এককালে ব্রিটেনও আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল। কারণ বিষয়গুলো অবজেকটিভ ফেনোমেনা বা ঘটনা। ক্যাপিটালিজমের কপালই এমন!
যেসব গরিব ব্রিটেনবাসীকে এককালে আমেরিকায় কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে- পরে ১৭৭৬ সালে ওই গরিব ও চাষাবাদ করে খাওয়া লোকেরা কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সশস্ত্রভাবে উৎখাত করে নিজেদের আমেরিকাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। এরও পরে ১৮৮২ সালের পর থেকে আমেরিকা ক্যাপিটাল একুমুলেশনের বা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের দিক থেকে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটি থেকে পরে ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা হয়ে যায়। ঠিক যেন একইভাবে এখনকার পূর্বাভাস হলো, ২০২৮ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতায় এসে এখন বাইডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটি অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার দিকে যাত্রা। সেটি হলো, আমেরিকা আবার দুনিয়াকে শাসন করেই যাবে। সে জন্যই গত নির্বাচনের সময় থেকে জিতার পরও এখন তার ¯েøাগান হলো ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। না এটি আমেরিকার (নেতাগিরিতে) ফেরত আসা নয়, বরং বাইডেন মানে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, মাত্র। আমেরিকা নয়। সোজাসাপ্টা বললে তিনি মিথ্যা আশ্বাসের ¯েøাগান দিচ্ছেন।
তা হলে তিনি সঠিক কী করতে পারতেন? বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা চীনকে নেতা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে নিজের অবস্থান যতটা সম্ভব ভালো ও উঁচুতে ধরে রাখার চেষ্টা করে যেতেন অর্থাৎ পরিস্থিতিকে অন্তত খামোখা যুদ্ধ-সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া নয়। কারণ পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার মানে হবে, স্বাভাবিক অবস্থায় যদি আমেরিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার সুযোগ থাকে তবে সেটাকেই নষ্ট বা নড়বড়ে করে ফেলা হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু কেন আমরা যুদ্ধের কথা তুলছি? বাইডেন কেবল চীনের সাথে স্ট্রাটেজিক প্রতিযোগিতার কথা বলেছেন, যুদ্ধের কথা তো বলেননি!
হ্যাঁ, এটুকু আপাত-সত্য হলেও বাইডেন আরেক কিছু বড় আকাম করেছেন। যেমন একই নিঃশ্বাসে তিনি প্রায় নেই হয়ে ন্যাটোর (সেক্রেটারির) সাথে মিটিং করেছেন; জি-৭ এর সভা শেষের এক দিন পরে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের উসকানিমূলক কথা বা হুমকি দিয়েছেন। এমনিতেই এটি ছিল বাইডেনের ‘এক ঢিলে অনেক পাখি মারা’র সফর। কারণ তিনি ব্রাসেলসে গিয়ে ইইউ-আমেরিকার শীর্ষ বৈঠকও করে নিয়েছেন আগের দিন। এ দিকে জি-৭, ন্যাটো বা ইইউর সাথে বৈঠক মানে হলো, মূল টপ সাত-দশ নেতার সাথে তিন ফোরামেই বসা মিটিং। একই লোক অথচ ফোরামগুলো ভিন্ন।
ফলে জি-৭ এর বৈঠকে সব কিছুতে আলোচনার ইস্যু হলো চীন। আবার বাইডেন ন্যাটোতে এলে ন্যাটোর দেয়া বিবৃতি লিখছে যে, ‘চীনের উচ্চাকাঙ্খা ও চাপানো আচরণ তাদের অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তাকে সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ করছে বিশেষত তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম আইনের প্রতি অনুগত থাকার বিরুদ্ধে।’ এ ছাড়া ন্যাটোর আরো অভিযোগ হলো, চীন-রাশিয়া মিলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ঢিবি বানাচ্ছে। অর্থাৎ সার কথায় বাইডেন চীনের সাথে আমেরিকার বিরোধকে মিলিটারিলি লড়ার দিকে ঠেলে দিতে চান এই পরিষ্কার ইঙ্গিত এখানে আছে। আর ন্যাটো এই প্রথম যে অজুহাতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোট গড়া হয়েছিল তা এখন বাইডেনের উপস্থিতির সভা থেকে ন্যাটোরও অজুহাত হয়ে গেল।
ঘটনা হলো, আপনি যদি কারো বাসার প্রধান প্রবেশমুখ কোন অজুহাতে বাধা খাড়া করতে যান তবে ভুয়া আইনি বা বেআইনি যে যুক্তিতেই হোক ওই বাড়িওয়ালা আপনাকে উৎখাত করবেই। চীনের কেবল উত্তর-পূর্ব দিকটাই সমুদ্রের দিকে খোলা। বাকি সাড়ে তিন দিকে এটি ল্যান্ডলকড। এখন আমেরিকার সিনেটের পেশ করা লিখিত পরিকল্পনায় মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল। আর চীনে সমুদ্রপথের প্রবেশমুখের চার দিকে প্রায় ১০টি দেশের সাথে সামুদ্রিক সীমানা আছে। আর বলাই বাহুল্য তা আন-ডিমার্কেটেড। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব বিরোধ মীমাংসার সালিস করে দেয়। তবে এটি আমাদের রাষ্ট্রের আদালত বা জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা নয়। এটি আসলে আরবিট্রেশন অর্থাৎ যেটাকে আমরা গ্রামের সালিসি বা আপসে মীমাংসা বৈঠক বলি, এটি তাই। যেমন এখানে দুই পক্ষেরই বিচারক নিয়োগ দেয়ার সুযোগও থাকে। এই আনক্লসের সালিস আদালতে কেবল চীন-ফিলিপাইনের সমুদ্র সীমানাবিরোধের কেসটাই উঠেছিল। তাতে এই জাপানী বিচারকের ব্যাপারে, তাকে বদল করে অন্য বিচারক দেয়ার আবেদন করেছিল চীন, যা মানা হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ চীন সেই থেকে বিচার কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর এতে ব্যাপারটা আর আপস সালিসি না হয়ে (অর্থাৎ বিচারক বদলে না দিয়ে) রাষ্ট্রের আদালতের ভূমিকাই যেন হয়েছিল। আর সেই রায় দেয়া হয়েছিল ফিলিপাইনের পক্ষে। স্বভাবতই চীন সেই রায় মানেনি। আর সেই থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোটের প্রপাগান্ডা শুরু হয় যে, আন্তর্জাতিক আইন না-মানা দেশ হলো চীন। অথচ শুরু থেকেই এটি ছিল গায়ে পড়ে চীনের প্রবেশপথে বাধা তৈরির জন্য আমেরিকার কৌশল যে কথা ওই সিনেট রিপোর্টে লেখা আছে।
এ দিকে ওই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের একমাত্র উত্তর-পূর্ব সমুদ্র প্রবেশপথেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের সব জ্বালানি আসে। তাই এই পথ ও এর বিকল্প পোর্টও চীন খুঁজবে, সেটিই স্বাভাবিক। সে কারণে পাকিস্তান, বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত), মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো চীনের নিজের স্বার্থেই জরুরি। অথচ এসব বন্দর বানাতে গেলে এবার ভারতকে দিয়ে আমেরিকা কান্নার রোল উঠাবে যে, আমাকে চীন চার দিকে ‘মুক্তামালা’র মতো ঘিরে ফেলল! মানে চোর উল্টো পুলিশ ডাকে! এমনকি থাইল্যান্ডের ভূখন্ড কেটে সুয়েজ খালের মতো আরেকটা মালাক্কা বাইপাস তৈরির আলাপ চলছে চীনের থাইল্যান্ডের সাথে।
আমেরিকা ভূখন্ড এশিয়াতে নয়। তা হলে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াডে আমেরিকার এই নেতাগিরি কেন? আমেরিকা বলবে আমার বন্ধুরা এখানে আছে তাদের রক্ষা করতে। এই অজুহাতও না হয় মেনে নেয়া যাক।
প্রেসিডেন্ট ওবামা হলেন সেই লোক যিনি এশিয়া পিভোট (PIVOT) পলিসি চালু করতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কী ছিল সেটি?
উপরে যেটা বলেছিলাম চীনের প্রবেশপথের দুই দিকেসহ চার দিকে প্রায় ১০টি দেশ আছে (যাদের বেশির ভাগই আবার আসিয়ান জোটের সদস্য) এবং যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা মীমাংসিত নয়। আমেরিকার সব প্রশাসনের খুবই মন-কামনা যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে এরা সবাই চীনের সাথে সামরিক বিরোধে জড়াক। আর তাতে আমেরিকা তাদের সবাইকে নিজের কোলে বা কোনো জোটে তুলে নিয়ে এবার তাদের পক্ষ হয়ে চীনের সাথে বিরোধে আমেরিকা সামরিক নেতা হিসেবে হাজির হোক। এটিই ছিল আমেরিকার কথিত স্বপ্ন বা আমেরিকার পিভোট বা ভরকেন্দ্র-ভূমিকা; চীনের বিরুদ্ধে এক আলগা মাতবর আমেরিকা।
আলগা বললাম কেন? বললাম এ জন্য যে, বাস্তবে অমন ১০ দেশের কেউ আমেরিকার প্ররোচনায় পা দেয়নি। তাদের অবস্থান বুদ্ধিমানের। সেটি হলো, তারা মনে করে, চীনের সাথে সমুদ্রসীমা অমীমাংসিত বলে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু সে জন্য আমেরিকার সামরিক জোটে যাওয়া বিপজ্জনক। তারা মনে করে, চীন বিরোধিতার স্বার্থে আমেরিকার কোলে উঠে বসার মানে হয় না। আর সমুদ্রবিরোধে চীনের সাথে আপসে না গেলে তো তাদের দাবি লোপাট হবে না।
আবার ওই ১০ দেশের সবার বাণিজ্য স্বার্থের দিক থেকে চীন তাদের কাম্য। কারণ চীন অবকাঠামো-ঋণ দেয়ার উত্থিত দেশ। এ ছাড়া চীনে রফতানির বাজার পাওয়াও সম্ভব। কাজেই এই স্বার্থকে মেরে ফেলাও তো বোকামি। এ কারণে ওই সব দেশের (এমনকি চীনের বিরুদ্ধে জেতা ফিলিপাইনও) কেউ আমেরিকার কোলে ওঠেনি। উল্টো চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়া যার সাথে চীনের ঠিক সমুদ্রসীমা বিতর্ক নেই, তবে জেলেদের মাছ ধরার রাইট নিয়ে বিরোধ আছে, সেও এই টিকা পাওয়ার কালে চীনা টিকার টেস্টে অংশগ্রহণ ও টিকা কেনার সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর প্রকাশ্যে বলছে, দুটো আলাদা ইস্যু, আমরা আমাদের মাছ ধরার রাইট ছাড়িনি।
এক কথায় বললে এটি ওবামার পিভোট শুধু পাত্তা না পাওয়া নয়, এশিয়াতেই আমেরিকার পা ফেলার জায়গাও কেউ দিতে, যুদ্ধে জড়াতে কেউ রাজি না হওয়া।
এখন ওবামার আমেরিকার এত বড় ব্যর্থতার পরও বাইডেন একই ফর্মুলা নিয়ে আবার এসেছেন কেন? যারা কেউ পিভোটে যোগ দেয়নি তারা কেন আবার ইন্দো-প্যাসিফিক না কোভিডে যোগ দেবে বলে বাইডেনের আশাবাদ? তা হলে কিসের ভরসায় তিনি জি-৭ বা ন্যাটোকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে ও ঢোল বাজাতে এলেন?
চীনের সাথে আমেরিকার গেøাবাল নেতৃত্ব নেয়া বা দেয়া নিয়ে বিরোধ আছে, যাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটিকে ফয়সালার জন্য বাইডেন যুদ্ধের দিকে এটিকে ঠেলে দেবেন আর এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যেতে পোলারাইজড হতে যাবে কেন? ইতোমধ্যেই এটি পরীক্ষিত যে তারা কেউ যাবে না এবং পিভোট প্রকল্প আজ মৃত!
তা হলে এবার ইউরোপ অনেক সাড়া দিচ্ছে মনে হচ্ছে; সেটি কেন? খুব সম্ভবত এটি এক ‘সাদা’-বাদী শঙ্কা ও তা থেকে একাত্মবোধ। বাইডেন এ ভয়টাই ইউরোপে বিক্রি করেছেন। কথাটাকে প্রতীকীভাবে অনেক সময় বলা হয়, এশিয়া বা চীন গেøাবাল নেতৃত্বে শক্ত হয়ে বসে যাওয়ার মানে কী? মানে হলো, আমরা দেখব, গুলিস্তানের কামানের পাশ দিয়ে সাদা পশ্চিমা তরুণরা ক্লান্ত হলে ফাইল হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকার কুইন্সে বা পশ্চিমের কোনো শহরের বাঙালী পাড়ায় আমরা ভিড় করি- কখনো চাকরি কখনো স্কলারশিপের লোভে! এ ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করে তাদের তিনি নিজের পেছনে জড়ো করেছেন যে, দেখি না চীনের নেতা হয়ে যাওয়াকে ১০ বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারি কি না!
বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)
বাইডেন জি-৭ বৈঠকে শুধু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি তুলেছেন তাই নয়, সাথে আরেক চালচুলাহীন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছেন। সেটি বিনা তুলনায় বললে কেউ কিছু বুঝবে না। বলতে হবে এটি চীনের বেল্ট-রোডের বিকল্প এক বাইডেন জোটের কর্মসূচি। এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)’। প্রথম তিনটি শব্দ ইংরেজি বি দিয়ে বলে B3 আর পরে ওয়ার্ল্ডের ড। এ কারণে সংক্ষিপ্ত B3W। এক কথায় বললে বেল্ট-রোড জাতীয় বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ার খাতের ঋণ, তবে যার পরিমাণ বিশাল। B3W এর কি সেই মুরোদ আছে?
আমেরিকার এই দিন শেষের বেলায়? এখানে আমেরিকান বিনিয়োগ বলতে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মাধ্যমে তাদের জন্মকালে যা চাঁদা দিয়েছিল। একালে ইউএসএইডের মতো সরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণের অর্থ কমে আসা দেখলেই তো বোঝা যায় কিভাবে আমেরিকান সক্ষমতা কমে এসেছে, কী হাল হয়েছে! এর ওপর বাইডেন আশাবাদ রেখেছেন ব্যবসায়ীদের তারা মটিভেট করে এখানে আনবেন! এসব কল্পকাহিনী তুলে রেখে বাইডেনের পরামর্শকদের উচিত বিশ্বব্যাংকের জন্য ফান্ড তুলতে ওর জন্মের সময় কী কষ্ট করতে হয়েছিল তা স্মরণ করা।
আর চীন কিভাবে করেছে? চীন একালে বিপুল সারপ্লাস একুমুলেশনের দেশ। সেই সরকারি ফান্ডটাই পরে কোথায় লাগানো যায় সেই বুদ্ধি করতেই প্রসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মাথায় কেউ বুদ্ধি দিয়েছিল বলে ২০১৩ সাল থেকে বেল্ট-রোডের জন্ম। এখন B3W হলো অনিশ্চিত আর ফকিরি চাঁদা তোলা এক ফান্ডমাত্র- সে কী করে চীনা সরকারি বিপুল সারপ্লাসের সাথে প্রতিযোগিতা করবে? আমেরিকার হাতে বিপুল সারপ্লাস সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে, সেই আমেরিকা কবেই মরে গেছে। সেই বুড়া বাঘকে এখন নয়া চাবুক দিয়ে চাবকালেই কি সে বাঘ তরুণ হয়ে চীনের সমতুল্য বা প্রতিদ্ব›দ্বী হতে পারবে? না সম্ভব? এগুলো কি স্বপ্ন কল্পনার গল্প দিয়ে পূরণ হওয়ার মতো কাজ?
আবার মনে করিয়ে দেই। বেল্ট-রোডের বেলায় প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল এটি নাকি ঋণগ্রস্ত করে দিয়ে সে দেশের সম্পদের মালিকানা চীনের নিয়ে নেয়ার ব্যবসা। তা হলে এখন বাইডেন B3W করতে চাচ্ছেন কেন? একই ঋণব্যবসা করতে? এর জবাব কী দেবেন বাইডেন?
এ দিকে আফ্রিকায় চীনা এমন বিনিয়োগ নিয়ে যারা প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল তাদের আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এক নয়া সার্ভে রিপোর্টে আফ্রিকায় চীনা সাকসেস নিয়ে গবেষণা রিপোর্ট বের হয়েছে।
শেষ কথা হলো, বিনিয়োগ আর গল্প আসলে এক কথা নয়। ‘ট্যাকার মুরোদ’ থাকা লাগে চাচা!

যুদ্ধের খরচ জরুরি, হিউম্যান রাইটও
কলোনি যুগের আমেরিকা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের জোরে বড় অর্থনীতি হিসেবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেই তাকে দুনিয়ার ‘গেøাবাল অর্থনীতিতে নেতা’ বলে সবাই মেনে নিয়েছিল। এককালে আমেরিকা নেতা হয়নি। তাকে প্রায় ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্য। মূল কারণ দুনিয়া তখন কলোনি দখলের রামরাজত্বে ডুবেছিল, যার অবসান দরকার ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) দুনিয়ার কলোনি দখলদার শক্তিগুলা যারা দুনিয়ার ওপর একচ্ছত্র খবরদারি চালিয়ে বেড়াত তারা যুদ্ধের মাঝপথে সবাই দেউলিয়া হয়ে গেছিল। ফলে নেতা হিটলার (সাথে মুসোলিনির ইতালি আর মার্শাল তেজো জাপানসহ অন্যরা) এক দিকে আর অন্য দিকে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিরা এভাবে এক পোলারাইজেশন ঘটতে পেরেছিল বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বের অংশ জয়লাভ করেছিল।
এই যুদ্ধের আসল ফ্যাক্টর যে যুদ্ধের পোলারাইজেশন এবং তা এমন কেন হয়েছিল ও কিসের ভিত্তিতে; তা আমাদেরকে তখন পরিষ্কার জানতে দেয়া হয়নি। তবে দুটো শক্তি ঘটনা যেভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল আমরা খাপছাড়াভাবে তাই জানতাম।
এরই একটা হলো, ইউরোপ যেন ব্রিটিশদের মতো ভালো মানুষদের নেতৃত্বে মানে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নেতৃত্বে খারাপ মানুষ হিটলার আর তার বন্ধুদের পরাজিত করেছিল। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প। এ ছাড়া ওদিকে আরেক ব্যাখ্যা চালু ছিল কমিউনিস্টদের। এটিও আরেক ভালভালাইয়া; মানে চার দিকে সব খালি ভালো আর ভালো। ভালো মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনের হাতে জর্মানীর হিটলারের পরাজয়, এটিই নাকি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল গল্প। কিন্তু আমরা খুবই সরি, এ দুটোর একটিও বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, পোলারাইজেশন ও মুখ্য ফ্যাক্টর ছিল না। কেন?
আমরা চার্চিলকে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বুঝতে গেছিলাম আর সেটি এ জন্য যে তারাই তো আমাদেরকে ইউরোপ চিনিয়েছিল। তারাই আমাদের প্রভু ছিল। ইউরোপের ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র ইংরেজি আমাদের এলিটরা বুঝত আর তারা কেবল ব্রিটিশ মিডিয়া পড়ে সেগুলো অনুবাদ করত। এভাবে গেøাবাল কাহিনীর যতটুকু নাগালে আসত তা দিয়েই কেবল আমরা বিশ্বযুদ্ধ যতটুকু যা বুঝতাম। তাই আমেরিকা বলে কোনো দেশ আছে কি না ঠিকমতো বুঝতাম না; অর্থাৎ চার্চিলের চোখ দিয়েই আমরা বিশ্বযুদ্ধ বুঝেছিলাম।
অথচ হার্ডকোর সত্য এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের মতো কলোনি হয়ে থাকা দেশগুলো আর ইউরোপের কারো না কারো কলোনি শাসন হয়ে থাকবে কি না- এটিই ফয়সালা করে দিয়েছিল। কঠিন সত্যটা ছিল, চার্চিল আমাদের ত্রাতা বা মুক্তিদাতা ছিলেন না। কলোনি থেকে আমাদের আসল মুক্তিদাতা হয়েছিল আমেরিকা। যদিও তা আমেরিকার নিজ স্বার্থেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দুনিয়ার সব কলোনি দখলদার চার্চিলসহ সব কুতুবকে দাসখত দিতে বাধ্য করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে শেষ হলে পরে তাদের সবাইকে দুনিয়া থেকে কলোনি ব্যবস্থা উঠিয়ে ফেলতেই হবে; যাতে দুনিয়া কলোনিমুক্ত প্রায় শ দুয়েক স্বাধীন রাষ্ট্রের এক দুনিয়া হয়। মূল কথাটা হলো, আমাদের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে চার্চিলও আসলে আমাদের ভিলেন ছিল। কিন্তু হিটলারের মারের মুখে নিজের যুদ্ধের খরচ চালানোর মুরোদ ছিল না বলে আমেরিকান শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অতএব যুদ্ধ শেষে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ১৯৬৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে অসংখ্য দেশের কলোনিমুক্তি ঘটে গিয়েছিল।
অখন্ড ভারতের দিক থেকে দেখলে বিশ্বযুদ্ধের এটিই ছিল আসল ইতিহাস, আমাদের কলোনিমুক্তির ইতিহাস। গেøাবাল ইতিহাসের দিক থেকে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসল ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে আর তাই স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশেষে প্রথম গেøাবাল অর্থনীতির নেতা হয়েছিল আমেরিকা।
এই আমেরিকান নেতৃত্ব মানে কী? এর মানে আর আবছা রেখে লাভ নেই, যা স্টালিন বা চার্চিল আমাদেরকে সেকালে জানতে দেয়নি তা হলো, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে খরচের বড় অংশটি একাই বহন করেছিল আমেরিকা। মানে ইউরোপ এমনি এমনি আমেরিকান নেতাগিরি মেনে নেয়নি।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরেক যে ব্যাখ্যা- আমাদের রাজনীতি ভালো বোঝে এমন ভাবধারা কমিউনিস্টদের মুখ থেকে জানি, সেটিও আসলে সোভিয়েত ভাষ্য। আর সেখানেও যুদ্ধের বড় খরচদাতা ওই একই আমেরিকা হলেও কমিউনিস্টদের ইতিহাস ভাষ্যে সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়ে এসেছে।
তবে ফ্যাক্টস হলো, আমেরিকাও দাসখত বা ‘সহযোগিতা’ চুক্তিতে স্তালিন বা চার্চিলকে অপমানজনকভাবে শামিল হতে বাধ্য করেননি। এসব চুক্তিতে অপরপক্ষ হিসেবে প্রথম ও একক স্বাক্ষরদাতা ছিলেন চার্চিল আর সেটির নাম আটলান্টিক চুক্তি, ১৬ আগস্ট ১৯৪১। আর পরে সেই ড্রাফটটাই কিন্তু এবার চার রাষ্ট্র ব্রিটেন, আমেরিকা চীন ও সোভিয়েত মিলে আবার স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। তবে এবার ওই চুক্তির নাম দেয়া হয়েছিল ‘জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণায়’ স্বাক্ষর এই নামের আড়ালে। সাথে একই দিনে আরো ২৬ দেশ ওই একই ডকুমেন্টে প্রতি স্বাক্ষর করেছিল। এটিই আমেরিকার নেতৃত্বে হিটলারবিরোধী জোটের দলিল। কিন্তু তবু কোথাও কলোনি ছেড়ে দিতে চলে যেতে হবে এই ভাষা বা শব্দ কোথাও নেই। তবে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে যেকোনো ভূখন্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক হবে যে ওই ভূখন্ডের শাসন কিভাবে চলবে; অর্থাৎ কলোনি করা নিষিদ্ধ হলেও এ ভাষায় তা বলা হয়নি।
এ প্রসঙ্গকথা এবার গুছিয়ে বলে শেষ করা যাক। তা হলে আমেরিকা কিভাবে গেøাবাল নেতা হয়েছিল সেটি আমাদের মতো দেশের এলিট বা কুতুবরা কেউ জানত বা টের পেয়েছিল তা মনে হয় না। এর কাহিনী বা ঘটনার দিক এটিই। আর এটিই এখন আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ গত ১১-১৬ জুন জুড়ে বাইডেন জি-৭ আর ন্যাটোর মিটিংয়ে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি বা হুমকি তুলেছিলেন। অথচ আসল কথাটা এই যুদ্ধের খরচ কে দেবে সেটিই বলেননি। অথচ আমরা উপরে দেখলাম যুদ্ধের খরচই আসল। এটিই সেকালে ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র বহন করতে সক্ষম ছিল রুজভেল্টের আমেরিকা। তাই ইউরোপ হিটলারের হাতে দখল ও বিলীন হওয়ার বদলে আমেরিকান নেতৃত্বকেই বেটার বিকল্প বোধ করেছিল। আর আমেরিকার স্বার্থ শুধু গেøাবাল নেতা হওয়া ছিল তা নয়, তার হাতে জমা থাকা বিপুল সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত সম্পদ তখন বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল, কারণ দুনিয়া তখন কলোনিমুক্ত স্বাধীন। ফলে এরা সবাই তখন আমেরিকার ঋণের সরাসরি অথবা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে খাতক। আমেরিকা এসব স্বাধীনমুক্ত দেশকে ঋণের খাতক হিসেবে পেয়েছিল।
কাজেই একালে বাইডেনের ভাবি যুদ্ধের খরচের সংস্থান না করে চীনকে যুদ্ধের হুমকি দেখানো এগুলোকে কী বলা যায়? এর মানে কি আমেরিকা-চীনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ নামে যে বিরোধ প্রকাশ্যে বাজারে হাজির আছে, তা বাইডেন এখন যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান করতে চাইছেন? হ্যাঁ তাই। সে জন্যই এটিকে ছেলেমানুষি চিন্তা বলছি। কারণ এক তো খরচের ব্যাপার আছে; সেটি ছাড়াও চীনের সাথে আমেরিকান বিরোধ মূলত হাতে থাকা উদ্বৃত্ত সম্পদ না থাকা থেকে উদ্ভূত বিরোধ- এমন বিরোধকে বাইডেন যুদ্ধে গিয়ে সেটিকে নিজের পক্ষে জিতে আনবেন কী করে?
ধরা যাক, যুদ্ধ একটি হলো আর আমেরিকা তাতে জিতেও গেল। কিন্তু তার পরে এতে কি আমেরিকার হাতে যথেষ্ট ‘সঞ্চিত উদ্বৃত্ত সম্পদ’ না থাকার সঙ্কট, সেটি এখন আছেও তা কেটে যাবে? বিপুল সম্পদটা আসবে কোথা থেকে? কিভাবে?
আসলে তখনো দুনিয়ায় সম্ভাব্য একমাত্র উদ্বৃত্ত সম্পদের উৎস দেশ হয়ে থাকবে এ চীনই। আর সেই চীনের কাছে হাত পেতে আমেরিকা তার জনগণকে খাওয়াবে, দুনিয়া রুল করবে- এমন কল্পনা এবসার্ড বলারও সুযোগ দেখি না। এ জন্য বলেছি, সম্পদ থাকা না থাকার সঙ্কট যুদ্ধে জিতেও কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তা হলে অথর্ব ন্যাটোকে সামনে আনা কেন?
বাইডেন ন্যাটোকে সামনে রেখে হুমকিটা দিয়েছেন। ন্যাটোকে দিয়ে তিনি আর্টিকেল পাঁচ চালু করার সামরিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার হাসির কথা হলো, চীন-রাশিয়া নাকি পারমাণবিক অস্ত্রে তাদের সমান হয়ে যাচ্ছে। এতে আমেরিকা হুমকি দেখছে। আচ্ছা খোদ পারমাণবিক অস্ত্রই যেখানে সবার জন্যই হুমকি, সেটি যার হাতেই থাকুক; সেখানে ওরা আমার সমান হয়ে যাচ্ছে কেন? এটি কী নাকিকান্নাময় যুদ্ধের অজুহাত তোলা নয়!
কিন্তু আসল কথাটা হলো, সেই ওবামা আমল থেকে, চাক হেগেল যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (২০১৩-১৫), তখন থেকেই ন্যাটো যে একটি খরচের ডিব্বা, আর সেই খরচের বেশির ভাগ (প্রায় ৯৫ শতাংশ) কেন আমেরিকা একা বইবে- এসব প্রশ্ন আর অজুহাত তুলে কি চাক হেগেল সেকালেই ইউরোপকে অপমান করেনি? ট্রাম্পও তো একই প্রশ্ন তুলেছিলেন। আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, একালে ন্যাটো একটি অপ্রয়োজনীয় সংগঠন। আফগানিস্তানের পর ন্যাটোর আর দুনিয়ায় কোনো ভূমিকা নেই- ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এমন সব ঘোষণা দেয়নি কি? এমনকি তিনি ইউরোপে (জার্মানীতে) ও জাপানে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনো আমেরিকান সৈন্যের সামরিক ব্যারাক মেনটেন করে যাওয়ার খরচ এবার থেকে ইউরোপকে দিতে হবে বলে ট্রাম্প দাবি করেননি?
তা হলে সেসব প্রশ্নের সদুত্তর কী? বাইডেনের কাছে এসব খরচের ব্যয়ভার প্রসঙ্গে সমাধান কী আছে? অর্থাৎ খরচ বইবার প্রশ্নে ন্যাটো এখন একটি পর্যদুস্ত সংগঠন হয়ে আছে! অথচ এসব নিয়ে কোনো কথা না বলে, এক দিনের ন্যাটো বৈঠকে গিয়ে চীনকে হুমকি দিয়ে এলেন বাইডেন! এটি কি তামাশা?
অভ্যন্তরীণ বিতর্কও আছে গভীরে
তবে মনে হচ্ছে, ইউরোপের সবাই এখনো বোকা ধামাধরা নেতাদের দেশ হয়ে যায়নি। তাই খোদ সিএনএন খবর দিচ্ছে কানাডা বাদে জি-৭ এর বাকি নেতাদের মধ্যে বাইডেনের চীনের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে অস্বস্তি ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। গরম তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় অস্বস্তি প্রকাশ করেছে ইতালি। এ নিয়ে চীনা ব্যাখ্যা হলো, ইতালীই ইইউর প্রথম দেশ যে চীনের বেল্ট-রোডে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বললে, চীনের বিরুদ্ধে কামান দাগানো যৌথ বিবৃতি ধরনের কাগজে চীনকে কী ভাষায় কতটা অভিযুক্ত করছে মূলত এই প্রশ্নেই ভিন্নতাগুলো দেখা দিয়েছে। স্বভাবতই সবচেয়ে শক্ত ভাষায় বাইডেন ওই সব ড্রাফট দেখতে চাচ্ছেন। কিন্তু কেউই চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত যাতে না হয় ততটুকুতেই থাকতে চায়। যেমন জাপান টাইমস, যৌথ বিবৃতি ড্রাফট করতে গিয়ে বড় মতভেদের কথা তুলে ধরেছে। বিশেষ করে মানবাধিকার প্রসঙ্গে চীনকে কতটা সমালোচনা করা হবে সে বিষয়ে।
এ দিকে ভয়েস অব আমেরিকা লিখেছে, ইতালী-জার্মানী আর ইইউ প্রতিনিধিকে দেখা গেছে, চীনের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিতে এরা অনিচ্ছুক; বরং সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে থাকতে আগ্রহী। আবার এসব প্রশ্নে কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর আমেরিকা নিজে এভাবে এরা চারজন চার মাত্রায় চীনের বিরোধিতা করতে চায়। আর জাপান যে কোন দিকে অবস্থান নেবে, তা সবচেয়ে অনিশ্চিত।
সিএনএন লিখছে, এক আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট তাদেরকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি খুবই অস্বস্তিতে ছিল বিবৃতির ভাষা নিয়ে। যেন চীন এটিকে কোনোভাবেই উসকানিমূলক হিসেবে না দেখে। চ্যান্সেলর মার্কেল তো বলেই বসেছিলেন যে, চীন আমাদের প্রতিদ্ব›দ্বী বটে কিন্তু আবার অনেক ইস্যুতে আমাদের পার্টনারও তো বটে। ফরাসি নেতা ম্যাক্রোঁও যোগ করেছেন, জি-৭ কে তো ওই চীনের সাথেই আবার জলবায়ু, বাণিজ্য, উন্নয়ন ও অন্য অনেক ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও একসাথে কাজ করতে হবে। তাই তিনি পরিষ্কার করে রাখার পক্ষে যে, তাদের জি-৭ কখনো চীনবিরোধী কোনো ক্লাব হতে পারে না।
সারকথায়, ভেতরে বড় মাত্রায় বাইডেন বিরোধিতা বজায় আছে। তবে সবচেয়ে মজার অবস্থানে ভারত। ভারতের মিডিয়াই ভেতরের বিরোধের খবরগুলো সামনে এনেছে। যেমন ন্যাটো মিটিংয়ে একসময় এমন উত্তপ্ত ভাষায় বাইডেনের সাথে ইউরোপীয়দের বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে কমিউনিকেশন সুইচ অব করে রাখতে হয়েছিল, যাতে বাইরে মিডিয়ার কাছে তা না পৌঁছায়। আবার আরেক ভারতীয় মিডিয়া খবর দিয়েছে, মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে কিছু অবস্থান প্রসঙ্গে খোদ ভারতেরই অস্বস্তি দেখা দিতেছে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির প্রশ্ন ছিল, উইঘুর বা ফোর্সড লেবার ইস্যুতে কতটা চাপ দিয়ে তা বলা হবে, এ নিয়ে বিতর্ক।
প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশেরও বলার আছে। প্রথমত, বাইডেন আমাদেরকে যে পটেনশিয়াল বিপদের মধ্যে রেখেছেন তা হলো, সত্যিই যদি তিনি চীন-আমেরিকার সম্পর্ককে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমি হয়ে উঠতে পারে তাদের দুই দেশের যুদ্ধের রণক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কেমন ধরনের সরকার থাকবে বা কে থাকবেÑ এ প্রশ্নে আমরা নিশ্চয় বাংলাদেশকে চীন-আমেরিকার রণক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চাইতে পারি না। আমরা তাদের স্বার্থের ওই যুদ্ধের বলি হতে পারি না। যেমন বার্মা নিয়ে তাদের স্বার্থের লড়াইয়ের কোনো অংশ হয়ে যেতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের দেশেও নানা পক্ষ আছে স্বাভাবিক। তাদের সবার প্রতি পরামর্শ থাকবে আমরা যাই করি আমরা কারো হাতিয়ারে যেন পরিণত না হই। বিশেষত বাংলাদেশকেই না তাদের বিবাদের রণক্ষেত্রে বানিয়ে ফেলি সেটি আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে। আর উইঘুর বা মানবাধিকার প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবে আমাদের অবস্থানটা হবে সবাইকেই হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স অবস্থানে যেতে হবে। আমরা কি উইঘুরে সত্যি মানবাধিকারের বাস্তবায়ন দেখতে চাই? নাকি এ নিয়ে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ নিতে চাই, যাতে সেটি আমেরিকার বাণিজ্য সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হয়? এ দুয়ের মধ্যে ঠিক কোনটা চায় তা আমেরিকাকে স্পষ্ট করতে হবে।
কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাট
এবার দাবি করা হচ্ছে, এবারের জি-৭ মিটিং নাকি কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাটের লড়াই।
আচ্ছা এই জি-৭ এটি কী এককালে জি-৮ করে নেয়া হয়নি? রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে। পরে যদিও ইউক্রেন-ক্রিমিয়া প্রশ্নে এক বিবাদে ২০০৭ সালে আবার রাশিয়াকে বের করে দেয়া হয়েছিল এবং সেই থেকে রাশিয়ার ওপর আমেরিকান অবরোধ আরোপ হয়ে আছে। তা হলে সেসব সময় রাশিয়া যখন ভেতরে ছিল, তখন সবাই জি-৮ এর সবাই ডেমোক্র্যাসির লোক হয়ে গেছিল? হায়রে ডেমোক্র্যাসি!
আবার সৌদিদেরকে ইয়েমেন তছনছ করতে আমেরিকান সমর্থন এটিও কি ডেমোক্র্যাসির তান্ডব অথবা দুই দিন পরে পরে নিয়মিত গাজায় ইসরাইলী হামলা এটিই বা কোন ডেমোক্র্যাসি? আমেরিকার এসব বক্তব্য আসলে চরম বিরক্তিকর জায়গায় পৌঁছেছে।
তবে চীনের প্রসঙ্গেও অন্তত দুটো কথা বলার আছে। বিশেষ করে বাইডেনের সমালোচনা করছি বলে ভুল বোঝার সুযোগ নেই। হিউম্যান রাইট ইস্যুটা জাতিসংঘের জন্মের সময় ও পরে ১৯৪৮ সালের সম্মেলনে উঠলেও এর অগ্রগতি খুবই হতাশজনক। অথচ এরই মধ্যে গেøাবাল অর্থনীতির নেতৃত্বে বদলের সময়কাল আসন্ন। এত দিন কমিউনিস্টদের রাজনীতি ও দেশ যেভাবেই চলুক, এখনকার প্রশ্ন আলাদা। অন্তত গেøাবাল নেতা হওয়ার স্বার্থে চীনের ন্যূনতম একটি অবস্থান গ্রহণ পূর্বশর্ত। নইলে প্রতি পদে এই ইস্যুতে সঙ্ঘাতে গেøাবাল সব কাজ বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। চীন নিশ্চিত থাকতে পারে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে ন্যূনতম একটি অবস্থান ছাড়া চীনের নেতা থাকা খুবই কঠিন হবে। ফেলও করতে পারে। (নয়া দিগন্ত)
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক