এম হুমায়ুন কবির: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন। দুই দিনের সফরে ২৬ মার্চ সকালে ঢাকায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে গভীর সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছিল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিষয়টি সেই সম্পর্কের দিকেই আমাদের দৃষ্টিপাত করে।
স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা একটি সম্মানজনক অবস্থানে এসেছি। মোদির এ সফর তারই স্বীকৃতি দেয়। প্রত্যাশা করি বাংলাদেশ-ভারত আগামী দিনে একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের এ সফরে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ লাভবান হবে- এমন সব ক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন লাভের দিকে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে লাভবান হতে পারে, এমন সব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে কাজ করবে।
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ পানিসম্পদের ন্যায্য বণ্টন হওয়া উচিত। এর মধ্যে আলোচিত অভিন্ন নদীগুলো। বিষয়টি এখন শুধু পানি ভাগাভাগির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ শতাব্দীতে অভিন্ন নদীগুলো নানামুখী গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। অববাহিকাভিত্তিক পানিসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২০১১ সালেই বাংলাদেশ-ভারত সম্মত হয়েছিল। ওই বছর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন একটা ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে জলসম্পদ ব্যবহারের জন্য নদীর অববাহিকাভিত্তিক সমাধানে দু’পক্ষই একমত হয়েছিল। সুতরাং নতুন করে অভিন্ন নদীগুলোর পানি ব্যবহারের ফর্মুলার দরকার আছে বলে মনে করি না। ২০১১ সালের সেই চুক্তির আওতায় ভারত বাংলাদেশের অধিকারকে স্বীকার করে এবং স্বীকার করে বলেই আমরা আমাদের নির্ধারিত হিস্যা প্রাপ্তির কথা বলি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি একটি বড় বিষয়। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রক্রিয়া আমাদের ওপর পড়ার ঝুঁকি বেশি। সেই বিবেচনায় হিমালয়ের নদী প্রবাহগুলোকে সবাই মিলে সুসংহত করা এবং সেগুলোকে সুষমভাবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমরা জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবকে মোকাবিলা করতে পারি। আমরা যদি ওই নদীগুলোর পানিপ্রবাহ সুনিশ্চিত না করতে পারি, তাহলে সমুদ্রের পানি আমাদের ভূখন্ডে উঠে আসবে। এতে জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কাজেই অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। ভারতের নেতৃবৃন্দ অবশ্যই এ বিষয়ে অবহিত আছেন এবং তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বহন করছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চললেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। আমরা মনে করি, ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাইনি। কিন্তু ২০১৯ সালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, দ্রæত ও টেকসই প্রত্যাবাসন দরকার। এই প্রত্যাবাসন ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- এই তিন দেশের জন্যই জরুরি।’ আমরা প্রত্যাশা করি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাস্তবিক অর্থেই এ মনোভাব পোষণ করে। আমরা এও বিশ্বাস করি- বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার এক মতে পৌঁছলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বরাবরই একটি বিষয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা হলো সীমান্তে হত্যাকান্ড। সীমান্তে হত্যাকান্ড সম্পূর্ণভাবেই অগ্রহণযোগ্য। কারণ এ ধরনের বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে আমাদের সম্মুখমুখী চিন্তায় যেতে হবে। আমরা জানি, উভয় দেশের সীমান্ত এলাকা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে সীমান্তে কয়েকটি সীমান্ত হাট চালু করা হয়েছে। হাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো সীমান্ত এলাকাকে বিভিন্ন কর্মকান্ডের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে উভয় দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে লাভজনক করা যায় সেই জায়গায় মনোযোগী হওয়া দরকার। তাতে সীমান্তে অপরাধপ্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি সীমান্ত হত্যাকান্ডের সংখ্যাও কমে আসবে। কাজেই অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে বরং অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে এনে যদি নীতিগত উদ্যোগ নিয়ে সীমান্তগুলোকে সমস্যার সীমান্ত থেকে সমৃদ্ধির সীমান্তে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে সীমান্ত সংকট দূর হবে। সেক্ষেত্রে তা শুধু সীমান্ত সমস্যারই সমাধান করবে না, বরং দুই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। এটা দুঃখজনক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময় এ ধরনের ঘটনা বাঞ্ছনীয় ছিল না। কারও যদি বিরোধিতা করা বা প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ থাকে, তাদের সেই বিরোধিতা বা প্রতিবাদ হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করে নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ২৬ মার্চ আন্দোলন-বিরোধিতার মধ্যে বেশ কয়েকজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এটা কাম্য ছিল না।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ভারতের কাছে আমাদের কিছু সাধারণ প্রত্যাশা দীর্ঘদিনের। নদীর পানি বণ্টন, জলবায়ু ইস্যু, সীমান্ত নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে। আশা করি, এসব ক্ষেত্রে ভারতের যতটুকু ইতিবাচকতা প্রদর্শন প্রয়োজন, মোদির এ সফরের পর আমরা তা দেখতে পাব। বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত সহযোগী হবে- এমনটিও প্রত্যাশা করি। দুই দেশের উন্নয়নে যেসব সুযোগ রয়েছে সেগুলোকে সুষম ও সম্মানজনকভাবে কাজে লাগাতে হবে। মনে করি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের এ প্রত্যাশা উপলব্ধি করেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে বিকাশ ও পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। এখানে ভারত আপনাদের সহযাত্রী।’ আশা করি তার এ উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনে দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে। (দৈনিক সমকাল)
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত