ডা. ওয়াজেদ খান: করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে যুদ্ধ করছে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশও লড়ছে এ যুদ্ধে। সেনানিবাস ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে সিপাহীরা। দেশজুড়ে অঘোষিত লকডাউন চলছে সরকারী নির্দেশে। সবকিছু বন্ধ, জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া। চাকা ঘুরছে না গণপরিবহনের। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গলদঘর্ম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকার সাধারণ ছূটি বলবৎ করেছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশে দ্রæত বাড়ছে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার। দু’ একজন করে বাংলাদেশেও ক্রমশ বাড়ছে এ সংখ্যা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা আতঙ্ক, উদ্বেগ- উৎকন্ঠা। কখন মহামারী আকার ধারন করে করোনা। শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে সেচ্ছা গৃহবন্দী মানুষ।
শুধুমাত্র জীবনের মায়ায় সবকিছু মেনে নিয়েছে তারা। চলমান জাতীয় এ সংকট ও ক্রান্তিকালে দেশবাসীকে হতবাক করেছে গার্মেন্টস মালিকদের হঠকারী ও অমানবিক আচরণ। সরকারী ছুটির আদেশ অগ্রায্য করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৫ এপ্রিল কাজে যোগদানের নির্দেশ দেন তারা। এতে চাকুরী হারানোর ভয়ে ভীত দরিদ্র শ্রমিকরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। শত মাইল গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করে যানবাহনহীন রাস্তা ধরে। বিভিন্ন জেলা থেকে কারখানামূখী লাখো শ্রমিকের পদভারে কেঁপে উঠে দেশের মহাসড়কগুলো। অস্থির এ দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় একাত্তরে ভারতের পথে যাত্রাকারী শরনার্থীদের কথা। নৌপথে ফেরি গুলোতে ছিল শ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড়। কিসের করোনা। কিসের সামাজিক দূরত্ব। সবকিছু গুলিয়ে যায় একটি নির্দেশে। এ ঘটনায় আঁতকে উঠে দেশের বিবেকবান মানুষ। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বাধ্য হয় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে। কারখানা ১১ এ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন সংগঠনের সভাপতি ড. রুবানা হক। এ সময়ে শ্রমিকেরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় পায়ে হেঁটে। অনেকে পৌঁছে যায় কর্মস্থলে।
ড. রুবানা হক
আমাদের প্রশ্ন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা কি এখন ড. রুবানাদের হাতে? তাহলে কি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে দেশে? কোন শক্তি বলে গার্মেন্টস মালিকরা হতদরিদ্র শ্রমিকদের মৃত্যুমূখে ঠেলে দেয়ার স্পর্ধা দেখায়। কোথায় তাদের খুঁটির জোর। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ অমান্য করে তারা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সমগ্র জাতিকে। সরকার কিভাবে এড়াবে এর দায়? প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন গত ২৫ মার্চ। তাতে তিনি স্পষ্ট করেননি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়টি। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সি ১ এপ্রিল বলেছেন, মালিকরা চাইলে কারখানা খোলা রাখতে পারেন নিজ দায়িত্বে। তাই যদি হয় তাহলে সবাই কি যার যার দায়িত্বে হবে কিছু চালু করতে পারবে? মন্ত্রীর দায়িত্বহীন আত্মঘাতি এ বক্তব্য উস্কে দিয়েছে গার্মেন্টস মালিকদেরকে।
এছাড়া গার্মেন্ট সেক্টরে সরকারী প্রণোদনার ৫ হাজার কোটি টাকার লোভ সামলাতে পারেননি তারা। গার্মেন্টস মালিকরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী, কথিত অভিজাত শ্রেণীর। বড় রাজনৈতিক দলের নেতারাই সিংহভাগ কারখানার মালিক। এদের মধ্যে কম করে হলেও ২৮ জন সংসদ সদস্য আছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ঋণের অর্থেই গড়ে উঠেছে গার্মেন্ট শিল্প। অথচ এ খাতের রপ্তানি আয়ের যৎ সামান্যই ফিরে আসে দেশে। বিদেশে জমানো এ টাকায় তারা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তাদের বিলাসী জীবন কাহিনী রূপকথাকেও হার মানায়। গার্মেন্টস মালিকদের অনেক পীর মুর্শেদ’র ঢাকায় নাকি বুলেট প্রæফ বাড়ি আছে!
রাষ্ট্রও দিয়েছে তাদেরকে অবাধ অধিকার। কিন্তু রাষ্ট্রতো জনগণের। রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব থাকর কথা তাদের। কোন গোষ্ঠীর নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের শতভাগ মালিকানা জনগণের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটির মধ্যদিয়ে তা স্পষ্ট করেছে সংবিধান। দেশের জনগণ বা জাতি রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তারপরও রাষ্ট্র কখনো কখনো অবতীর্ণ হয় দানবের ভূমিকায়। ভূলে যায় পিতৃত্ব সূলভ আচরণ। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারও লিপ্ত হয় জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে। আমরা জানি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স’র পর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় অবস্থানে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত। দেশের প্রায় ৫ হাজার কারখানায় কর্মরত ৩০ লাখ শ্রমিক। আর তাদের ৯০ শতাংশই নারী। যাদের গায়ের রক্ত- ঘাম মজবুত করে চলেছে দেশের অর্থনীতি। সামান্য মজুরিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। অথচ তারা অবহেলিত। বঞ্চিত প্রাপ্য নাগরিক অধিকার থেকে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মানুষ মনে করলে এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না মালিকপক্ষ। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের যেমন সম অধিকার। তেমনি তাদের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শতভাগ দায় রাষ্ট্রের। সংবিধানের শুরুতেই তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কোন মহল বিশেষ নয়। জনস্বার্থে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তই মানতে হবে সবাইকে। কিন্তু সরকারের দূদুল্যমান ও নতজানুসিদ্ধান্তে জনগণ হতবাক ক্ষুব্ধ।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ
নিউইয়র্ক।