নিউইয়র্ক ০৭:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বর্ণবাদ, আমেরিকান নির্বাচন ও মানবাধিকার

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৩৮:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০
  • / ৭১ বার পঠিত

সালাহউদ্দিন নাগরী: গত ২৫ মে সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের মিনোসোটা রাজ্যের মিনেপোলিস শহরের একটি দোকানের বাইরে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাতে ড়েুফতারের পর ৪৬ বছর বয়সের ফ্লয়েড নামের এক আফ্রো-আমেরিকান ব্যক্তির নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো পৃথিবীই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
স্থিরচিত্র ও ভিডিওতে দেখা গেছে ডেরেক চৌভিন নামের সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ একটি গাড়ির চাকার কাছে লুটিয়ে পড়া ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু গেড়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করা পর্যন্ত বসেছিল। ফ্লয়েড ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’, ‘আমাকে হত্যা করো না’ বলে অনুনয়-বিনয় করেছিলেন এবং বারবার তার মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে গত বিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়। এতে পুলিশের অনেক গাড়ি ও ভবনে আগুন দেয়া হয়। বেশ কয়েকটি শহরে কারফিউ জারি এবং বিচার চেয়ে হোয়াইট হাউসও ঘেরাও করা হয়। মিনেপোলিসের এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, এখানে যা ঘটেছে তা একদিনের সমস্যা নয়, বহুদিনের চাপা ক্ষোভ। ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে অন্য অনেক দেশের মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৫ আগস্ট উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের ওপর আবারও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখানে কারফিউ জারি করা হয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ ঘটনার কোনো প্রভাব কি পড়বে? কালো মানুষদের ব্যাপক আন্দোলন ও দাবি-দাওয়ায় সাদারাও একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে থাকে। প্রায় ৩ কোটি কালো মানুষ কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। আগামী দিনে যিনি ক্ষমতায় আসবেন, তিনি কি কালোদের অধিকার নিশ্চিত করতে কোনো ভূমিকা রাখবেন? আসলে কোনো আমলেই ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে কালোদের যৌক্তিক দাবির অনুকূলে কোনো দৃশ্যমান অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায়নি এবং কালো মানুষরা এ বিষয়টি খুব ভালো করেই জানে।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকান বিচারব্যবস্থার তথ্যমতে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। ট্রাফিক তল্লাশির জন্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের যানবাহন শতকরা অন্তত পাঁচ ভাগ বেশি থামানো হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষ্ণাঙ্গ ইস্যুতে আইনে বৈষম্য না থাকলেও তা প্রয়োগে যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
কিছুদিন আগেও আমেরিকায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় সাদাদের পাশে কালোদের বসার অনুমতি ছিল না। কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলীকেও একবার এক হোটেল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পাবলিক বাসে শ্বেতাঙ্গদের জন্য সিট ছেড়ে দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা পাবলিক বাসে কোনো এক শ্বেতাঙ্গকে সিট ছেড়ে না দেয়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার প্রতিবাদে মার্টিন লুথার কিং সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সূচনা করেন। কৃষ্ণাঙ্গদের পাবলিক বাসে চলাচল না করতে আহবান জানান এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তার জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’। তার সে আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন এবং ১৯৬৫ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখনকার উন্নত দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে কায়িক পরিশ্রমের পুরোটাই দিয়েছিল আফ্রিকার এ কালো মানুষগুলো। পরবর্তী সময়ে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও ওইসব দেশে বর্ণবাদ এখনও সমাজের গভীরে প্রথিত হয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা সবক্ষেত্রে তাদের নেটিভদের মতো সম-আচরণ পায় না। শুধু তামাটে গাত্রবর্ণের কারণে কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে কটুকথা ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়।
বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত আত্মীয়স্বজনদের কাছে তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং অকারণে কারও কারও গায়ে থুতু ছিটানোর কথাও শুনেছি। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এ ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে হাইপ্রোফাইলের ব্যক্তিদেরও। পার্শ্ববর্তী দেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শিল্পা শেঠীকে কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে মাসব্যাপী আয়োজিত প্রতিযোগিতা ‘বিগবসে’ ওই দেশের অন্য প্রতিযোগীদের কাছ থেকে শুধু তার গাত্রবর্ণের কারণে তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল একাধিকবার।
তারপরও প্রতিবছর ব্যাপক হারে মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে কেউ কেউ বৃদ্ধ বয়সেও চলে যাচ্ছেন। এই যে মানুষ সবকিছু ত্যাগ করে বিদেশে স্থায়ী হচ্ছে, ওখানে ক’জন যথাযোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে? আজীবন বসবাসের পরও তারা ওই সমাজের মূল ¯্রােতের বাসিন্দা হতে পারে না। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, আমাদের দেশের মানুষ যারা ওখানে ওই দেশের নেটিভ বা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে কর্মস্থলের বাইরে অন্য কোনো ধরনের হৃদ্যতা গড় ওঠে না। এর পেছনের মূল কারণ হল গাত্রবর্ণ।
ওখানে বসবাসরত আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবদের ওঠাবসা, চলাফেরা, গেটটুগেদার সবই নিজের কমিউনিটির মধ্যে; এর বাইরে তাদের কোনো সার্কেল গড়ে ওঠে না। ওখানে বসবাস করেও বাসাবাড়িতে টিভি দেখা ও সংবাদপত্র পড়া মানে নিজের দেশের টিভি চ্যানেল উপভোগ করা এবং অনলাইনে নিজের দেশের খবরের কাগজ পড়া। তবে স্থানীয় কোনো জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে ওরা দেশের বিষয়-আশয় সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না।
গায়ের রঙের কারণে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জিইয়ে রাখার মানসিকতা থেকে ওইসব দেশের মানুষ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু আমরা কি জানি এ কালো মানুষের পূর্বসূরিদের কাছে বর্তমান বিশ্ব কতভাবে ঋণী? আজ থেকে প্রায় ১২শ’ বছর আগে জীবনযাপনে আধুনিকতার যে উন্মেষ ঘটেছিল তা তো প্রায় পুরোটাই শুরু হয়েছিল কালো মানুষদের হাত ধরে।
দশম শতকে কর্ডোবা ছিল আল-আন্দালুসের (গড়ড়ৎরংয ঝঢ়ধরহ) রাজধানী। তখন বাগদাদ ও কনস্টানিপোলের পাশাপাশি কর্ডোবা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত হতো। সত্যিকার অর্থে আল-আন্দালুস সা¤্রাজ্যের কর্ডোবা, গ্রানাডা ও পর্তুগালে এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আল-আন্দালুসের শহরগুলো মুসলিম মুর (কালো মানুষ) শাসকদের কল্যাণে জৌলুসপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা যাজকরা আন্দালুসিয়া ভ্রমণের পরই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের অন্যান্য অংশ থেকে সম্ভ্রান্ত মানুষ দলে দলে মুসলিম স্পেনে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
আল-আন্দালুসের আমিরের (বাদশাহ) দরবারে বিখ্যাত সংগীত, ফ্যাশনিস্ট ও জীবনযাপনে আধুনিকতার প্রবর্তক জির’আব (৭৮৯-৮৫৯) ছিলেন একজন কালো মানুষ। ওই আমলে তিনি গানের স্কুল পরিচালনা করতেন। এখন যে বিউটি পার্লার আমাদের সাজপোশাকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে, সেই বিউটি পার্লার তিনি ওই সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন। এখনকার চুল কাটার পদ্ধতি ও স্টাইল, খাওয়ার টেবিলে ‘টেবিল ক্লথের’ ব্যবহার, বছরের বিভিন্ন ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান তিনি সর্বপ্রথম চালু করেন। আধুনিক যুগের ‘টেবিল ম্যানার’, খাবার গ্রহণের প্রচলিত স্টাইলও তারই অবদান।
২.
আমরা অন্যান্য দেশের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার; কিন্তু নিজেদের কি এ থেকে নিবৃত রাখতে পেরেছি? গাত্রবর্ণকে উপেক্ষা করতে পেরেছি? বিয়েশাদিতে পাত্রপাত্রী নির্বাচনে গায়ের রংকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আর গায়ের এ রংকে সাদা করার জন্য নানা ধরনের ক্রিম, লোশন ও ভেষজ দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বহু ধরনের আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি থেকে সরে আসতে হবে। আশার কথা, ফ্লয়েড হত্যার পর হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ থেকে ‘ফেয়ার’ শব্দটি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যে কোনো মানুষকে সবার আগে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করা নিয়ে আমাদের ‘বিশ্বব্যবস্থা’ এখন চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ থেকে ১৪শ’ বছর আগে মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.) মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন- হে মানুষ, আল্লাহ বলেছেন তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পার। তিনি আরও বলেন, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের যেমন কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, ঠিক তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদারও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হল।
জাতি, বর্ণকেন্দ্রিক সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর দেশে দেশে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজও করে যাচ্ছে।
কিন্তু অভিযোগ আছে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবিত রিপোর্ট, পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে মানুষের চিন্তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাদের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী প্রচারণা চালাচ্ছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে বঞ্চিতের অধিকার। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন যদি লোকদেখানো ও কাগজ-কলমকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বাড়তেই থাকবে।
লেখক: সরকারি চাকরিজীবী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য
ব-সধরষ: ংহধমধৎর২০১২@মসধরষ.পড়স

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বর্ণবাদ, আমেরিকান নির্বাচন ও মানবাধিকার

প্রকাশের সময় : ০১:৩৮:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০

সালাহউদ্দিন নাগরী: গত ২৫ মে সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের মিনোসোটা রাজ্যের মিনেপোলিস শহরের একটি দোকানের বাইরে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাতে ড়েুফতারের পর ৪৬ বছর বয়সের ফ্লয়েড নামের এক আফ্রো-আমেরিকান ব্যক্তির নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো পৃথিবীই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
স্থিরচিত্র ও ভিডিওতে দেখা গেছে ডেরেক চৌভিন নামের সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ একটি গাড়ির চাকার কাছে লুটিয়ে পড়া ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু গেড়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করা পর্যন্ত বসেছিল। ফ্লয়েড ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’, ‘আমাকে হত্যা করো না’ বলে অনুনয়-বিনয় করেছিলেন এবং বারবার তার মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে গত বিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়। এতে পুলিশের অনেক গাড়ি ও ভবনে আগুন দেয়া হয়। বেশ কয়েকটি শহরে কারফিউ জারি এবং বিচার চেয়ে হোয়াইট হাউসও ঘেরাও করা হয়। মিনেপোলিসের এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, এখানে যা ঘটেছে তা একদিনের সমস্যা নয়, বহুদিনের চাপা ক্ষোভ। ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে অন্য অনেক দেশের মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৫ আগস্ট উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের ওপর আবারও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখানে কারফিউ জারি করা হয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ ঘটনার কোনো প্রভাব কি পড়বে? কালো মানুষদের ব্যাপক আন্দোলন ও দাবি-দাওয়ায় সাদারাও একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে থাকে। প্রায় ৩ কোটি কালো মানুষ কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। আগামী দিনে যিনি ক্ষমতায় আসবেন, তিনি কি কালোদের অধিকার নিশ্চিত করতে কোনো ভূমিকা রাখবেন? আসলে কোনো আমলেই ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে কালোদের যৌক্তিক দাবির অনুকূলে কোনো দৃশ্যমান অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায়নি এবং কালো মানুষরা এ বিষয়টি খুব ভালো করেই জানে।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকান বিচারব্যবস্থার তথ্যমতে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। ট্রাফিক তল্লাশির জন্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের যানবাহন শতকরা অন্তত পাঁচ ভাগ বেশি থামানো হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষ্ণাঙ্গ ইস্যুতে আইনে বৈষম্য না থাকলেও তা প্রয়োগে যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
কিছুদিন আগেও আমেরিকায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় সাদাদের পাশে কালোদের বসার অনুমতি ছিল না। কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলীকেও একবার এক হোটেল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পাবলিক বাসে শ্বেতাঙ্গদের জন্য সিট ছেড়ে দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা পাবলিক বাসে কোনো এক শ্বেতাঙ্গকে সিট ছেড়ে না দেয়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার প্রতিবাদে মার্টিন লুথার কিং সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সূচনা করেন। কৃষ্ণাঙ্গদের পাবলিক বাসে চলাচল না করতে আহবান জানান এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তার জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’। তার সে আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন এবং ১৯৬৫ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখনকার উন্নত দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে কায়িক পরিশ্রমের পুরোটাই দিয়েছিল আফ্রিকার এ কালো মানুষগুলো। পরবর্তী সময়ে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও ওইসব দেশে বর্ণবাদ এখনও সমাজের গভীরে প্রথিত হয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা সবক্ষেত্রে তাদের নেটিভদের মতো সম-আচরণ পায় না। শুধু তামাটে গাত্রবর্ণের কারণে কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে কটুকথা ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়।
বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত আত্মীয়স্বজনদের কাছে তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং অকারণে কারও কারও গায়ে থুতু ছিটানোর কথাও শুনেছি। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এ ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে হাইপ্রোফাইলের ব্যক্তিদেরও। পার্শ্ববর্তী দেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শিল্পা শেঠীকে কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে মাসব্যাপী আয়োজিত প্রতিযোগিতা ‘বিগবসে’ ওই দেশের অন্য প্রতিযোগীদের কাছ থেকে শুধু তার গাত্রবর্ণের কারণে তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল একাধিকবার।
তারপরও প্রতিবছর ব্যাপক হারে মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে কেউ কেউ বৃদ্ধ বয়সেও চলে যাচ্ছেন। এই যে মানুষ সবকিছু ত্যাগ করে বিদেশে স্থায়ী হচ্ছে, ওখানে ক’জন যথাযোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে? আজীবন বসবাসের পরও তারা ওই সমাজের মূল ¯্রােতের বাসিন্দা হতে পারে না। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, আমাদের দেশের মানুষ যারা ওখানে ওই দেশের নেটিভ বা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে কর্মস্থলের বাইরে অন্য কোনো ধরনের হৃদ্যতা গড় ওঠে না। এর পেছনের মূল কারণ হল গাত্রবর্ণ।
ওখানে বসবাসরত আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবদের ওঠাবসা, চলাফেরা, গেটটুগেদার সবই নিজের কমিউনিটির মধ্যে; এর বাইরে তাদের কোনো সার্কেল গড়ে ওঠে না। ওখানে বসবাস করেও বাসাবাড়িতে টিভি দেখা ও সংবাদপত্র পড়া মানে নিজের দেশের টিভি চ্যানেল উপভোগ করা এবং অনলাইনে নিজের দেশের খবরের কাগজ পড়া। তবে স্থানীয় কোনো জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে ওরা দেশের বিষয়-আশয় সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না।
গায়ের রঙের কারণে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জিইয়ে রাখার মানসিকতা থেকে ওইসব দেশের মানুষ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু আমরা কি জানি এ কালো মানুষের পূর্বসূরিদের কাছে বর্তমান বিশ্ব কতভাবে ঋণী? আজ থেকে প্রায় ১২শ’ বছর আগে জীবনযাপনে আধুনিকতার যে উন্মেষ ঘটেছিল তা তো প্রায় পুরোটাই শুরু হয়েছিল কালো মানুষদের হাত ধরে।
দশম শতকে কর্ডোবা ছিল আল-আন্দালুসের (গড়ড়ৎরংয ঝঢ়ধরহ) রাজধানী। তখন বাগদাদ ও কনস্টানিপোলের পাশাপাশি কর্ডোবা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত হতো। সত্যিকার অর্থে আল-আন্দালুস সা¤্রাজ্যের কর্ডোবা, গ্রানাডা ও পর্তুগালে এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আল-আন্দালুসের শহরগুলো মুসলিম মুর (কালো মানুষ) শাসকদের কল্যাণে জৌলুসপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা যাজকরা আন্দালুসিয়া ভ্রমণের পরই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের অন্যান্য অংশ থেকে সম্ভ্রান্ত মানুষ দলে দলে মুসলিম স্পেনে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
আল-আন্দালুসের আমিরের (বাদশাহ) দরবারে বিখ্যাত সংগীত, ফ্যাশনিস্ট ও জীবনযাপনে আধুনিকতার প্রবর্তক জির’আব (৭৮৯-৮৫৯) ছিলেন একজন কালো মানুষ। ওই আমলে তিনি গানের স্কুল পরিচালনা করতেন। এখন যে বিউটি পার্লার আমাদের সাজপোশাকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে, সেই বিউটি পার্লার তিনি ওই সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন। এখনকার চুল কাটার পদ্ধতি ও স্টাইল, খাওয়ার টেবিলে ‘টেবিল ক্লথের’ ব্যবহার, বছরের বিভিন্ন ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান তিনি সর্বপ্রথম চালু করেন। আধুনিক যুগের ‘টেবিল ম্যানার’, খাবার গ্রহণের প্রচলিত স্টাইলও তারই অবদান।
২.
আমরা অন্যান্য দেশের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার; কিন্তু নিজেদের কি এ থেকে নিবৃত রাখতে পেরেছি? গাত্রবর্ণকে উপেক্ষা করতে পেরেছি? বিয়েশাদিতে পাত্রপাত্রী নির্বাচনে গায়ের রংকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আর গায়ের এ রংকে সাদা করার জন্য নানা ধরনের ক্রিম, লোশন ও ভেষজ দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বহু ধরনের আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি থেকে সরে আসতে হবে। আশার কথা, ফ্লয়েড হত্যার পর হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ থেকে ‘ফেয়ার’ শব্দটি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যে কোনো মানুষকে সবার আগে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করা নিয়ে আমাদের ‘বিশ্বব্যবস্থা’ এখন চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ থেকে ১৪শ’ বছর আগে মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.) মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন- হে মানুষ, আল্লাহ বলেছেন তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পার। তিনি আরও বলেন, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের যেমন কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, ঠিক তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদারও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হল।
জাতি, বর্ণকেন্দ্রিক সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর দেশে দেশে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজও করে যাচ্ছে।
কিন্তু অভিযোগ আছে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবিত রিপোর্ট, পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে মানুষের চিন্তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাদের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী প্রচারণা চালাচ্ছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে বঞ্চিতের অধিকার। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন যদি লোকদেখানো ও কাগজ-কলমকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বাড়তেই থাকবে।
লেখক: সরকারি চাকরিজীবী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য
ব-সধরষ: ংহধমধৎর২০১২@মসধরষ.পড়স