প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন
![](https://hakkatha.com/wp-content/uploads/2024/05/hakkathafav.png)
- প্রকাশের সময় : ০২:১২:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০২০
- / ৫৬ বার পঠিত
ডা. ওয়াজেদ খান: যুক্তরাষ্ট্র এখন স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে নিপতিত। করোনা মহামারীতে প্রাণহানি এখনো থামেনি। অনেক শহরে লকডাউন বিদ্যমান। স্থবিরতা কাটেনি জনজীবনে। এর মধ্যেই দেশজুড়ে চলছে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। শ্লোগান ও বিক্ষোভে উত্তাল শতাধিক নগরী। সামাল দিতে পারছেনা সরকার। সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে জাতীয় নেতৃত্বহীনতা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। একমাত্র অপ্রতিদ্ব›দ্বী পরাশক্তি। আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান ও খবরদারিতে সিদ্ধহস্ত। এই দেশ এখন হিমশিম খাচ্ছে অভ্যন্তরীন সংকট নিরসনে। এ সংকট ত্রিমাতৃক।
১. পুলিশি নির্যাতন ও বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ: মিনেসোটায় গত ২৫ মে, একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ মামুলি ঘটনায় জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় হত্যাকারী ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ অবসানের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ চলছে। শুরুতে নিউইয়র্কসহ অনেক শহরে সহিংস রূপ ধারণ করে বিক্ষোভ। অবাধ লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে মেতে উঠে অনেক সুযোগ সন্ধানী। এসব সামাল দিতে বিভিন্ন শহরে জারি করা হয় কারফিউ। পুলিশের পাশাপাশি রাস্তায় নেমেছে ন্যাশনাল গার্ড। সহিংসতা ও আইন অমান্য করায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১০ সহ¯্রাধিক বিক্ষোভকারীকে। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের ইতোমধ্যেই গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তারপরও থামেনি আন্দোলন। টানা দুই সপ্তাহ ধরে দিনরাত বিরামহীন চলছে বিক্ষোভ। ‘বø্যাক লাইভস ম্যাটার’ শ্লোগানে মুখর রাজপথ। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে বিবেক সম্পন্ন মানুষ নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন আন্দোলনে। সাদা পুলিশের হাতে কালো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। অতীতে এসব নিয়ে অনেক আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েড খুনের ঘটনায় সৃষ্ট আন্দোলন নজির বিহীন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডবিøউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও জিমি কার্টার এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ফ্লয়েড খুনের ঘটনাই কি আন্দোলনকে এতোটা বেগবান করেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে উঠে এসেছে নাগরিক হতাশার কথা। বিগত তিন বছরে ট্রাম্পের অপশাসনে হাঁপিয়ে উঠা জনগন নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। তারা বড় বেশি ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ট্রাম্প তাদেরকে ঠেলে দিয়েছেন খাদের কিনারে। সীমাহীন অনিশ্চিয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে। এসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অপ্রাপ্তি ও যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বর্ণবাদী আন্দোলনে। দীর্ঘ লকডাউনে বন্দী মানুষ কিছুটা স্বস্তি খুঁজছেন রাস্তার বিক্ষোভে। এ বিক্ষোভকারীরা বয়সে তরুণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণের বাছ-বিচার নেই তাদের মাঝে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে আন্দোলনের বর্ণবাদী চরিত্র। মিছিলে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজনৈতিক উচ্চারণ। পরিবর্তনের দাবি উঠেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও জাতীয় নেতৃত্বে।
২. করোনা মহামারী সংকট: মহামারী করোনায় আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র। লাশে লাশে সয়লাব হাসপাতাল-নার্সিং হোম। দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাধিক্ষেত্র। সরকারি হিসেবেই মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজার। একজন মৃত ব্যক্তি মানে একটি পরিবার। ঘরে ঘরে শোকের মাতম। প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লক্ষাধিক। এখনো প্রতিদিন মরছে মানুষ। অথচ সংক্রমণের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন সচেতন হলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হতো। এমনটি মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। করোনার ভয়াবহতার বিষয়টি মোটেও আমলে নেননি ট্রাম্প। উল্টো করোনা নিয়ে বাহাস করেছেন তিনি। এমন বিপদজনক একজন নেতার হাতে নাগরিকদের জানমাল নিরাপদ নয়। অনেক রাজ্যে এখনও উঠেনি লকডাউন। করোনায় বিপর্যস্ত জনজীবন কবে স্বাভাবিক হবে জানা নেই কারো। তাই সহসাই কাটছে না আতঙ্ক। করোনার কারণে বেকার হয়েছেন চার কোটি মানুষ। সামনে ধেয়ে আসছে আর্থিক মন্দা। সবকিছু মিলিয়ে ঝুলে গেছে করোনা সংকট।
৩. জাতীয় নেতৃত্বহীনতার সংকট: গোটা বিশ্বই এখন ভূগছে নেতৃত্ব শূন্যতায়। রাজনৈতিক নেতার ছড়াছড়ি থাকলেও দেশে দেশে প্রকট হয়ে উঠেছে জাতীয় নেতৃত্বের অভাব। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টই প্রথানুযায়ী এদেশের জাতীয় নেতা। যিনি শপথ নেন ৩৩ কোটি নাগরিককে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও শপথ নিয়েছেন যথারীতি। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই ভুল পথে হাঁটছেন তিনি। বারবার দাঁড়াচ্ছেন জনস্বার্থের বিপরীতে। জাতীয়তাবাদের জিকির তূলে আসকারা দিচ্ছেন সাদা উগ্রবাদী জনগোষ্ঠীকে। প্রবক্তা সাজছেন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীত্বের। উস্কে দিচ্ছেন বর্ণবাদ। আর এখানেই থেমে নেই তিনি। একের পর এক সই করছেন অভিবাসন বিরোধী আইনে। ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে মনে হয়না সংবিধান, নিজ দায়িত্ব ও এখতিয়ার সম্পর্কে ট্রাম্পের নূন্যতম কোনো ধারণা আছে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি বৈরী আচরণের জন্য বরাবরই নিন্দিত তিনি। গণমাধ্যমকে ট্রাম্প বলেন, ‘ফেক নিউজ’ বা ভূয়া খবর প্রচারকারী। তার আচার আচরণে মানুষিক বৈকল্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিনেসোটায় হত্যাকান্ডের পর পরই জাতীয় নেতা হিসেবে ট্রাম্পের উচিত ছিল ফ্লয়েড পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা। অতিদ্রæত তদন্ত ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতের নির্দেশ দেয়া। পুলিশি নির্যাতন, আচরণ বিধি ও ফৌজদারি অপরাধ আইন সংশোধনে রাজ্য সরকারগুলোকে পরামর্শ দেয়া। তা না করে ক্ষমতার দাপট দেখান তিনি। হুমকি দেন সেনাবাহিনী দিয়ে বিক্ষোভ ভন্ডুল করার। ফলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি চলে যায় বিক্ষোভকারীদের অনূকূলে। বেগবান হয় আন্দোলন। দাবি-দাওয়ায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জিম ম্যাটিস ট্রাম্পকে একজন অপরিপক্ক, অদূরদর্শি ও অমানবিক নেতা বলে মন্তব্য করেন। তাকে অভিযুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ধর্নাঢ্য, বয়স্ক ও অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ট্রাম্প। অথচ একই পদে অধিষ্ঠিত থেকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চির স্মরণীয় হয়ে আছেন আব্রাহাম লিংকন, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, জর্জ ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য প্রেসিডেন্ট।
৪. বর্ণবাদ ও রাজনীতি: রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দাসত্ব প্রথার অবসান ঘটে ১৮৬৫ সালে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সংবিধানে ১৩ তম সংশোধনী এনে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করে দেন। তারপরও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন তারা। পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধে ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’। ১৯৬৪ সালে প্রণীত ‘সিভিল রাইটস আ্যকট’র মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে কর্মস্থলে নিষিদ্ধ করা হয় বৈষম্য। কালোরাও সাদাদের মতো লাভ করে ভোটাধিকার, ন্যায় বিচার, সরকারি চাকরি, জনশিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় গণ সুবিধাসহ পাঁচটি মৌলিক অধিকার। এরপর কেটে গেছে অর্ধ শতাব্দী। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলায়নি শুধু কালোদের জীবনযাত্রা। এখনো তারা লিপ্ত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আর এসব নিয়ে প্রায়শই গরম হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন। এবারো যেমনটি হচ্ছে। কিন্তু কেন, এর শেষই বা কোথায়? সময় এসেছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার। বারাক ওবামাসহ চারজন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো বর্ণবাদ কি গত তিন বছরে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে? বারাক ওবামা তো এর আগে টানা আট বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্ণবাদ অবসানে তিনি কি অবদান রেখেছেন? নিজ অধিকার আদায়ে কালোদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ও দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা এদেশে নতুন। তারপরও কর্ম ও দক্ষতা গুণে মূল ধারায় তরতর করে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে তারা। কালোদের মাঝেও অনেকে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছেন। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে আমেরিকানরা এখনো নারী প্রেসিডেন্টের মুখ দেখেননি। কিন্তু বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ঠিকই। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিকল্প নেই কালোদের। নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন ও ভোটাধিকার প্রয়োগ দুটোই জরুরি। আগামী ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ধারিত হবে ট্রাম্পের রাজনৈতিক আয়ু। তিনি হারলে হয়তোবা ফলাফল মানতে চাইবেন না। আর জয়ী হলে আগামী দিনের ভোর হবে রাতের চেয়েও অন্ধকার। রাজনৈতিক দেউলিয়া ট্রাম্প নৈতিক মূল্যবোধ ও মূলধন দুটোই হারিয়েছেন। নাগরিকদের প্রতি তার কোন দায়বদ্ধতা নেই। নেই কোনো শ্রদ্ধাবোধ। তিনি কার্যত একজন ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা এখনো মহান-অদ্বিতীয়। আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতিভু। স্বদেশ অভিবাসীদের যেসব অধিকার ও সুরক্ষা দিতে পারেনি, আমেরিকা তা নিশ্চিত করেছে। আমেরিকায় এখন প্রয়োজন আব্রাহাম লিংকনের মতো একজন দূরদর্শী ও হৃদয়বান প্রেসিডেন্ট। যিনি লিংকনের প্রথম অভিষেকের ভাষণের মতো উদাত্ত কণ্ঠে বলবেন-We are not enemies, but friends.। কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন বিরাজমান বর্ণবাদ অবসানে। উদ্যোগ নিবেন পুলিশি নির্যাতন বন্ধ ও আচরণবিধি সংস্কারের। নিশ্চিত করবেন মুক্ত বাতাসে ফ্লয়েডদের স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার অবাধ অধিকার।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক।