নেতৃত্বের জন্য বিখ্যাত যেই পরিবার
![](https://hakkatha.com/wp-content/uploads/2024/05/hakkathafav.png)
- প্রকাশের সময় : ০১:০৬:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অক্টোবর ২০২১
- / ৭৫ বার পঠিত
কাজী ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন: আমেরিকার মহাকাশ জয়ের স্বপ্নচারী ও নায়ক ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। উন্মুক্ত মহাকাশকে জয় করে নিজ দেশের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা তার অদম্য আগ্রহের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। বিশ্বে প্রথম চাঁদে মানুষ প্রেরণ করার কৃতিত্ব অর্জন করে আমেরিকা। এরই ধারাবাহিকতায় অতি সম্প্রতি পৃথিবীর প্রথম প্রাইভেট চার সাধারণ নাগরিক নভোচারী এক্স স্পেস অভিযানের নামে মহাকাশ ঘুরে এসে সাধারণ মানুষের স্পেস ভ্রমণের পথ উন্মোচন করে, নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে, মহাকাশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখছে আমেরিকা।
মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিন বছরেরও কম সময়ে বিচক্ষণতা ও ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে নিজেকে আমেরিকার সর্বাত্মক সফল এবং প্রথম কাতারের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জাতির কাছে এই কেনেডি পরিবারের রাজনৈতিক অবদান সর্বজনবিদিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও এই কেনেডি পরিবারেরই সদস্য প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কনিষ্ঠ ভাই তৎকালীন সিনেটর টেড কেনেডি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ৭১ সালে ভারত ভ্রমণে গিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বাঙালী নিধন স্বচক্ষে দেখে এসে আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে, পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে ইউএস কংগ্রেসে জোরালো বক্তব্য রাখেন। যার ফলে আমেরিকান সরকার পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও জনগণ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার পক্ষে।
তাই এই পরিবারটি নিয়ে রাজনৈতিক সচেতন বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ায় তাদের তিন ভাইকেই একত্রে ঘুলিয়ে ফেলে অনেকে। কেনেডি বলতে অনেকেই কেবল প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকেই চেনে বা জানে। যিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেই নিহত হন ১৯৬৩ সালে। রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক মানদন্ড বিচারে আমেরিকার প্রথম কাতারের একটি প্রভাবশালী, শিক্ষিত, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধিশালী এই বিলোনিয়ার কেনেডি পরিবার।
জন এফ কেনেডি ও জ্যাকুলিন কেনেডি
প্রেসিডেন্ট কেনেডিরা তিন ভাই ও তাদের পিতা ছিলেন হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট এবং সিনেটর। বাবা জোসেফ পি কেনেডি ছিলেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সময়ে ব্রিটিশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত। এমনকি আইরিশ ইমিগ্র্যান্ট তার পিতামহও ছিলেন প্রথিতযশা আমেরিকান রাজনৈতিক।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির দ্বিতীয় ভাই সাবেক সিনেটর, অ্যাটর্নি জেনারেল ও পরিবারের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডির হত্যাকারী সিরহান তিপান্ন বছর কারাভোগের পর পেরোলে জামিন লাভ করেছেন গত ২৭ আগস্ট। রবার্ট কেনেডির নয় সন্তনের দুই পুত্র, পিতার হত্যাকারীকে পেরোলে জামিনের পক্ষে আদালতে বক্তব্য দিয়ে ক্ষমার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে পরিবারটি আবারও আলোচনায় আসে। পেরোলে মুক্তির বিষয়টি যেহেতু সাজাভোগকারীর বর্তমান মানসিক অবস্থা, আচরণজনিত উন্নয়ন ও রিহেবিটিশনের ওপর নির্ভরশীল তাই প্রসিকিসনের বিরোধিতা করেনি। বাইশ বছর বয়সি সিরহান ১৯৬৮ সালের ৬ জুন নির্বাচনি জনসভায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধে, মৃত্যুদন্ডাদেশ পেয়েছিল। ১৯৭২ সালে মৃত্যুদন্ড বিলুপ্ত হওয়ায় সে যাবজ্জীবন কারাভোগের সাজা প্রাপ্ত হয়। জামিন শুনানিতে কেনেডির পুত্র ডগলাস কেনেডি ও রবার্ট কেনেডি জুনিয়র বলেন, হত্যাকান্ডের সময় তারা ছিলেন তিন-চার বছরের শিশু। সেই থেকে হত্যাকারীর ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। প্রাণের ভয়ে ভীত থেকেছেন সর্বদা। আজ প্রথম সামনাসামনি হত্যাকারীকে দেখে সেই ভয় তাদের দূর হয়েছে। সিরহানের ক্ষমা চাওয়া, ভুল স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সংশোধন করার প্রতিজ্ঞায় তারা সন্তুষ্ট।
দেশের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর মোটর শোভাযাত্রায় ২৪ বছরের এক কিউবান আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। বিচার শুরুর আগেই পুলিশ হেফাজতে এক যুবকের গুলিতে হত্যাকারী নিহত হওয়ায়, হত্যাকান্ডটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।
কথিত আছে যে, ডেমোক্রেটিক পার্টির ঐতিহ্যবাহী এই কেনেডি পরিবারকে রাজনীতি থেকে সরানোর চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র থেকেই তাদের দুই ভাইকেই হত্যা করানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বা দুই হত্যাকান্ডের মধ্যে কোনো যোগসাজশের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। দুই হত্যাকারীই নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হত্যাকান্ড ঘটায়।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেভির এক সাহসী কর্নেল ও যোদ্ধা। প্রখর মেধাবী, সুদর্শন, সুবক্তা, হিউমারাস ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। সেসব গুণের কারণেই সুন্দরী রমণীরা তার সাহচর্যে সহজেই প্রেমে পড়তেন। বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরী মডেল ও অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোও তার প্রেমে পড়েছিলেন। তিনিই তার প্রেসিডেন্সিয়াল শপথ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে বলেছিলেন, Don’t ask what your country will give you, ask what you can give your country. ইতিহাস ও সাহিত্যেও ছিল তার অগাধ পান্ডিত্য। তার লেখা বই Profile in courage আমেরিকার নোবেল হিসেবে খ্যাত ‘পুলিত্জার’ পুরস্কার লাভ করে।
চোখধাঁধানো সুন্দরী ৩১ বছর বয়সি জ্যাকুলিন কেনেডিকে বিয়ে করার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই স্ত্রীসহ প্রথম বিদেশ সফর করেন ফ্রান্স। কথিত আছে, ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্টসহ প্যারিসের জনগণের মূল আকর্ষণই ছিলেন তার স্ত্রী। মোটর শোভাযাত্রায় জনগণ জ্যাকুলিন জ্যাকুলিন বলে চিৎকার করে তাদের স্বাগত জানায়। কেনেডি দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, ‘আমি জ্যাকুলিন কেনেডির সফরসঙ্গী হিসেবে প্যারিস ভ্রমণকে খুব এনজয় করেছি।’ এখনো পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে জ্যাকুলিনই হলেন সর্বকনিষ্ঠ ফার্স্ট লেডি।
রাজনীতির এই বিশ্বখ্যাত পরিবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, একাধিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, তিন জন সিনেটর, অ্যাটর্নি জেনারেল, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, বিভিন্ন সিটির মেয়র, কংগ্রেসম্যান, রাষ্ট্রদূতসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিথযশা রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তার ভাই সিনেটর, অ্যাটর্নি জেনারেল ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী রবার্ট কেনেডি আততায়ীর হাতে নিহত হলেও এখনো শিক্ষা, সেবা, রাজনীতি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যেও এই পরিবারের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে মার্কিন সা¤্রাজ্যে। (দৈনিক ইত্তেফাক)
লেখক: সোশ্যাল সিকিউরিটি ল স্পেশালিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল গভর্নমেন্ট