নিউইয়র্কের একটি অনুষ্ঠান ও আমার কথা
- প্রকাশের সময় : ০৭:০৮:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ মে ২০১৬
- / ১৩০২ বার পঠিত
সামছুল ইসলাম মজনু: বিষয়টা কিভাবে শুরু করি বুঝে উঠতে পারছি না। তারপরও বলতে হবে ভেবেই কলম ধরলাম। ঘটনাটা ছিল অপ্রত্যাশিত তাই এই লেখার জন্য মনস্থির করি। বেশ কিছুদিন আগের কথা, একটা অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যনারে অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েই কিছুটা হতভম্ব হয়ে যাই। কারণ সংগঠনের সাথে সরাসরি জড়িত সংশ্লিষ্টদের সংখ্যা ছিল নগন্য। ভাবলাম হয়ত শেষের দিকে অন্যরা আসবেন। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘন্টা দেরীতে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরও তেমন উপস্থিতি ছিল না। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলে একে একে সবার সাথে আমাকেও মঞ্চে ডাকা হলো। নিজে থেকেই মঞ্চে যাওয়ার অপারগতা প্রকাশ করি। পরবর্তীতে ‘লোক দেখানো মঞ্চ’ থেকে চলে আসি দর্শক সারিতে।
অনুষ্ঠান শুরু হলে আলোচনা সভার আলোচকরা একে একে সবাই বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। একটা বিষয় আমার পর্যবেক্ষণে এলো অনুষ্ঠানের সকল আলোচকই রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ অরাজনৈতিক অতিথিদেরকেও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে যায়। অরাজনৈতিক সংগঠনে কেন রাজনীতি, রাজনীতি করার অনেক জায়গা আছে। যেখানে বলা হয়েছে অরাজনৈতিক সংগঠন। পরিবার পরিজন নিয়ে এদেশে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি আনন্দ করার জন্য। যদি একটা ভিন্ন ধর্মী অনুষ্ঠান উপহার দেয়া যেতো তা অবশ্যই প্রশংসিত হতো। উল্লেখ্য, সংগঠনটিকে বুদ্ধিজীবি সংগঠন হিসাবেও গণ্য করা চলে।
আলোচনার অনুষ্ঠানে যথারীতি একের পর একজন বক্তা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। এক পর্যায়ে আমাকে ডাকা হলে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে অপরাগতা প্রকাশ করি। মনের মধ্যে নিজের অজান্তে কেন জানি বাধ সাধছিল। তারপরও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বার বার অনুরোধে বক্তব্য দিতে রাজি হই। এক সময় আলোচনা সভায় কিছু বলার জন্য বললে খুব খুশি হতাম, চেষ্টা করতাম নতুন কিছু ভাবনা, নতুন চিন্তা সুন্দরভাবে বলার। ইদানিং তা আর হয়ে উঠে না। কারণ হিসাবে উল্লেখ করার মত শ্রোতা থেকে বক্তা বেশী। বক্তব্য আসে মুল বিষয়ের বাহিরে তার উপর সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ যা পীড়াদায়ক। হয়তবা আমিও এর বাইরে নই, তারপরও চেষ্টা করি বিষয়কেন্দ্রিক কিছু বলার। সেদিন যে কথাগুলো বলা হয়ে উঠেনি, সে কথাগুলো বলার জন্যেই আজকের এই লেখা।
সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং অতিথিদের সম্বোধন করে বক্তব্য দিতে শুরু করি এভাবে- ‘আজকের এই দিনে আমি কিভাবে আমার কথাগুলো বলব, আমার পূর্বাপর আলোচকদের কথাশুনে কিছু বলার খেই হারিয়ে ফেলেছি। একটি অরাজনৈতিক প্লাটফর্মে সবাই যেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন এখানে কিছু বলার জন্য নিজেকে বেমানান মনে করছি। সম্মানিত অতিথিবৃন্দ আজকের এই দিনটা আমাদের জন্য বিশাল দিন, যে দিনটাকে নিয়ে জাতি হিসাবে আমরা গর্বিত। এই দিনটাকে স্বরণীয় করার জন্য এই ক্ষুদ্র আয়োজন করাতে নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে। আশা করি আগামীতে আরো বড় আয়োজনে অনুষ্ঠান করার প্রত্যাশা রাখি। আজকের এই দিনে দেশ বা জাতির জন্য ভাল কিছু করার উদ্যোগ বা ইচ্ছা যথাযথই সম্মানের। আমরা পত্রিকার পাতায় প্রবন্ধ লিখি। তা পড়ি না। কবিতা পড়ি তা শুনিনা। ভাল ভাল সৃজনশীল সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়, তা নিয়ে গবেষণা করি না। কেউ কি একবার চিন্তা করে দেখেছেন এগুলোর মধ্যেও অনেক সুন্দর সুন্দর চিন্তা চেতনা আছে। আছে বাস্তবতার নিরিখে কিছু বিশ্লেষণ। এই কথাগুলো নিয়ে একটা নড়াচড়া ও গবেষণা করলে আমাদের সবার জন্য একটা সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়ার পথ সুগম হবে। আজকের চেষ্টা আগামীর সফলতা এটাই আমার বিশ্বাস। আপনারা যারা মঞ্চে বসে আছেন সবাই নিজের অজান্তে এক একজন সমাজতাত্ত্বিক। আপনারা সমাজকে দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আপনাদের তাত্ত্বিক গবেষণা এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার উপর নির্ভর করে। রাজনীতিবিদরা গবেষণা করে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিবেন। রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, তাই বলে বিশ্লেষণধর্মী কিছু কার্যকরী চর্চা থাকবে না, তা আমি মানতে পারি না। এই প্রবাসে অনেক সাংবাদিক আছেন যারা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না। একজন সাংবাদিকদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে দেশ ও জাতি তার উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা কি দেখি, কেউ কেউ তার নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে, অসৎ পথের আশ্রয় নেয়। বঞ্চিত করে ভাল কিছু করার উদ্যোগ এবং এরাই নিজেদের অগোচরে ভাল কিছু করার উদ্যোগটাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। সর্বস্তরে দলবাজী রাজনীতিকরণ কিছুতেই কাম্য নয়।’ কথাগুলো বলে দ্বিতীয় ব্যখ্যার দিকে যেতে পারিনি। আমার এটুকু বক্তব্যের পরই অনুষ্ঠানের সভাপতিসহ কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন।
‘বিচারের বাণী নিরবে, নিভৃতি কাঁদে’ প্রবাদ বাক্যটি যেন সেদিন আমার জন্যই প্রযোজ্য ছিল। এজন্য একটিবার কথাগুলোর ব্যাখা কেউ চাইলেন না। উপরন্তু কারো কারো বিরাগভাজন হয়েছি। তাই চিন্তা করছি কি লাভ এগুলো করে। যে দেশে বসবাস করছি, সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে, যে দেশে আছি সেখানে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ বলে একটা কথা বহুল প্রচলিত। সেখানে কেন এমন হলো! তাও মেনে নিতাম যদি তা কোন আঞ্চলিক সংগঠনের ব্যানারে হতো। আলোচনা সভা কি শুধু রাজনীতির কথামালা বা গুনকীর্তন অথবা অতি কথন! এখানে কি মুক্তচিন্তার কোন চর্চা হতে পারে না?
এই প্রবাসে প্রতিদিন সময় ও অর্থ ব্যয় করে প্রচুর অনুষ্ঠান হয়, তার মধ্যে কতগুলো অনুষ্ঠান ভাল উদ্যোগে নেয়া হয় তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? ধরে নেই আমার বলার ভঙ্গিমা বা প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না, অথবা কারো মনে আমার অজান্তে কষ্ট লেগেছে। তারা এ বিষয়ে আমার কাছে ব্যাখা চাইতে পারতেন অথবা তার নিজের বক্তব্যের প্রতিবাদ বা ভিন্নমত পোষণ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করা এবং সভাপতি বার বার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা ততটুকু যুক্তিযুক্ত। এটা কি কেউ চিন্তা করে দেখেছেন? মুক্তচিন্তা বা মুক্ত আলোচনা কখনই দোষের নয়, যদি তাতে কারো আঘাত লাগে। অবশ্যই প্রতিবাদ থাকবে অথবা ব্যাখ্যা চাওয়া বা দেওয়ার সুযোগ থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্ েসুযোগের ব্যবহার না করে কাউকে চপেটাঘাত করা কি ঠিক? এখানে যদি আমাকে কথা বলার সময় দেয়া হথো অথবা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সাহেব আমাকে সময় দিতেন অবশ্যই আমি আমার কথাগুলোর ব্যাখা দিতাম বা চেষ্টা করতাম। সব আলোচনাই শ্রেষ্ঠ না বা সব কথাই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ব্যাখা বিশ্লেষণ করলে ভাল কিছু বেরিয়ে আসে তার জলন্ত প্রমাণ টিভি টকশোগুলোর জনপ্রিয়তা। বিষয়টাকে এভাবে দেখেন পক্ষে বিপক্ষে দু’জন বলে যাচ্ছেন, অনুষ্ঠান শেষে সঞ্চালক সুন্দরভাবে উপসংহার টেনে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন। এখানে কি সব আলোচনাই জ্ঞানগর্ভ। সব আলোচকই কি বোদ্ধা আবার সব সঞ্চালকই কি সবজান্তা তা কিন্তু নয়। তবে একটা ভাল উপসংহার পুরো অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন।
আমার এই লেখার উপসংহার টেনে এটাই বলতে চাই- একটা সুন্দর পরিবার, একটা সুন্দর সমাজ বা একটা সুন্দর দেশ কোনটাই রাতারাতি অর্জন করা যায় না। কাউকে না কাউকে উদ্যোগ নিতে হয়। সে হয়তো আপনি?
আসুন না একধাপ এগিয়ে প্রথম আলো পত্রিকার সেই কথাটা বলি ‘বদলে যাও বদলে দাও’। প্রবাসে এসেছি উন্নত জীবন-যাপন করার মানসিকতা নিয়ে। মাতৃভূমির প্রেম অপরাধ নয়, তবে কেন হানাহানি, কেন দালাদলী, কেন ডাকা হবে পুলিশ, কেউ কি বিষয়গুলো নিয়ে কোন সেমিনার বা সিম্পোজিয়াম করেছেন। একটা ভাল কথা বা ভাল কাজ কেন আমরা সবাই নিজের মধ্যে ভাগাভাড়ি করে নিতে পারি না। আসুন, মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটনাই বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে উন্নয়নের দ্বারে পৌঁছার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি।
লেখক: প্রাক্তন সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন, ইউএসএ