দূর প্রবাসের ঈদ : তবুও মায়ের অপেক্ষা
- প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০২০
- / ২৭ বার পঠিত
এসএম সোলায়মান: আমি ঈদের নামাজে যাচ্ছি। যা’ বাবা, নামাজ পড়ে বাড়ী চলে আয়’। আমি কই (কোথায়) আছি মা? বুঝি ত, তুই আমেরিকায়। ত’ কি অইছে”। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি আসি গরু কোরবানী করে খানা পিনা করে বিয়ালে (বিকালে) চলে যাবি, অসুবিধা কি? গলা থেকে কথা আর বের হয় না আমার। চোখের জলে গলা ধরে আসছে। রাখি মা, নামাজে যাই, দোয়া করো। “আচ্ছা আয় বাবা, তাড়াতাড়ি চলি আয়”। ফোন রেখে দিলাম কথা আর না বাড়িয়েই।
অনেক কথা বলার ইচ্ছে ছিল মায়ের সাথে। যদি মা আমার বুঝতে পারে আমি কাঁদছি। তাই দ্রæতই ফোন কেটে দিলাম। অন্য সময় যেমনটা বলি। মা, ভাত খেয়েছো? ঔষধ খেয়েছো? আমার আপা’রা ফোন করেছে কিনা। ঔষধ আর কতদিন যাবে। টাকা লাগবে কিনা। কোন অসুবিধা আছে কিনা। মা-পুতের কত কথা। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু ঈদের দিন। গত ৫ বছরের প্রতিটি ঈদের দিনই হ্যাঁ না বলে দায়সাড়া কথা সেড়ে ফোন লাইন কেটে দেই। অথচ ঈদ মানে আনন্দের, ঈদ মানেই মা ছেলের অফুরন্ত হাসি আনন্দ। দূর্ভাগ্য আমার। আমার মত দূর প্রবাসের সকল সন্তানদের একই গল্প। তার উপরে আমি মায়ের আঁচল ছেড়া ছোট মানিক ধন। নিউইয়র্কে আছি গত ৫ বছর। রোজার ঈদ বা কুরবানীর ঈদ। দুই ঈদেই মা যেমন আমার অপেক্ষায় থাকে। আমিও মা’কে সালাম করা, একসাথে বসে খাওয়া, ঈদের আগের দিন থেকে পরের দিন পর্যন্ত রাতভর মা ছেলের অফুরন্ত গল্পকথা। মায়ের মুখে কিসসা (রূপকথার গল্প) শুনা, মায়ের খাটে এলোপাতারি শুয়ে থাকা, সারা গায়ে মাথায় মায়ের হাত বুলানো, এগুলো অ-নে-ক মিস করি। খিদে না থাকলেও জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা। বিরক্ত হয়ে বলি। কেন জোর করো মা? বাইরে কি না কি খাস, জানিনা। তেলে ভাজা মচমচে নারকেল পুলিপিঠার ঘ্রানে বাড়িতে ঘুম ভাংগে ঈদের খুব সকালে। ঈদ’র দিন মাকে খুব খুশি দেখার একটা দারুন মন্ত্র জানি। বাবার কবরের পাশে গিয়েছি। দোয়া পড়েছি। সাথে ঈদ গাঁ’র হুজুর ও অনেক মুসল্লি ছিলো। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে মাকে এই কথাটা বললেই খুব খুশি আমার মা। আরও খুশি করার জন্য পারলে হুজুরকে (ইমাম) সহ আরো কয়েকজনকে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। তাদের মুখেও শুনেন মা। বাবার কবরের পাশে দোয়া পড়ার গল্প। মায়ের চোখ খুশিতে চক চক করতো। প্রায় ৪০ বছর আগে গত হয়েছেন আমার বাবা। কিন্তু বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসার এতটুকু কমতি নেই এখনও।
যা বলছিলাম, তবুও মায়ের অপেক্ষা। ঈদের পরের দিন আমার ছোট আপা মাকে দেখতে যায়। সোলেমান (আমি) ঈদের দিন তোদের (ছোট আপার বাড়িতে নাকি গিয়েছিলাম, মায়ের ধারনা) বাড়িতে থেকে চলে গেলো? আমারে একটু দেখে গেলো না। গোস্ত, রুটি, নারকেল পিঠা সেমাই রাখি দিলাম। তুই তারে (আমাকে) নিয়া আসতি। ছোট আপাও চোখ মুছে মায়ের অগোচরে। দিন শেষে ফোনে আমাকে বলে এসব। কে দেখে ভাই-বোনের কান্নার দৃশ্য।
অন্যদিকে ছোট মায়ের (আমার মেয়ে ঈশা) আবদার। আব্বু এবার ঈদে আসো। কতদিন তুমি আমাদের সাথে ঈদ করোনা। একবার আসলে কি হয় আব্বু? উত্তর নেই বাবার। চাপা কন্ঠে বলি আসবো মা, আসবো, ইনশাল্লাহ। ছোট্ট ছেলে সামিন। সে জানেই না বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজে যাওয়া। ছয় বছরের সামিনকে রেখে আসলাম ছয় মাস বয়সে। আশে পাশে তার বয়সী বাচ্চারা যখন ঈদ নামাজে যায়। তাদের বাবাদের হাত ধরে। আব্বু কখন আসবে আম্মু? কোন জবাব নেই তার মায়ের। মাঝে মাঝে বিউটি (আমার স্ত্রী) আমাকে ফোনে বলে, তোমার ছোট ছেলে ঈদ, জুম্মা এমনকি স্কুলে যেতেও প্রায় বলে। তার বাবা (আমি) কবে আসবে। তার স্কুল বন্ধুরা বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, মসজিদে যায়। এতটা বিরক্ত আগে করেনি। যতদিন ভাইয়াটা (আমার বড় ছেলে সাফিন) সাথে ছিলো।
সাফিন এখন কানাডা লেখাপড়া করছে। সময় যেন কাটেনা ছোট্ট সামিনের। সেদিন তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে অনেকগুলো চিঠি পেলো তার মা। প্রতিটি কাগজেই লিখা লাভ ইউ ভাইয়া, বেষ্ট অব লাক, মিস ইউ ভাইয়া। এসব অনেক ছোট্ট মনের ভালোবাসার কথা। ফোনে শুনি আর হ্যাঁ, হু করে কথা শেষ করি। ভালোবাসার সঙ্গী বিউটিও বলতে চায় অনেক কিছু। কিন্তু সুযোগ না দিয়ে কথা সংক্ষেপ করি। বুঝতে দিইনা চাপা কান্না। ফোন রেখেই নিজের সাথে চোখের জলের যুদ্ধ। এসব আর কতদিন। আজকের ঈদের সকাল (৩১ জুলাই, শুক্রবার) ছেলে আমার (সাফিন) খুব সকালেই না খেয়েই বের হয়ে গেলো কাজে। ফজর পড়ে গোসল সেড়ে ঈদ জামাতের প্রস্তুতি নিলাম। অনেকদিন পর পাঞ্জাবী পড়লাম। কি খাবো। মুড়ি বিস্কুট শেষ। মাক্রোওয়েবে এক কাপ রং চা, সাথে এক পিচ লেবু। বের হওয়ার আগেই চিরচরিত নিয়মে, মাকে ফোন দিলাম। মায়ের অপেক্ষা শুনে ছলছল চোখে বাইরে তাকালাম। আকাশটাও আমার সাথে চোখের জল ফেলছে। ছাতাও নেই। পত্রিকা মাথায় ধরে সাবওয়েতে (ট্রেন স্টেশন) নামলাম। তার আগেই নদীর (নিউইয়র্কের ম্যানহাটন ইষ্ট রিভার) পাড়ে একটি সেলফি নিলাম। কিন্তু মায়ের অপেক্ষা শুনে, ১৩ হাজার মাইল দূরের মন ভারাক্রান্ত যেন প্রিয় নদী হার্ডসনেরও। যে (নদী) এখন আমার একাকিত্বের সাথী।
এই তো কাল চাঁন রাতের আনন্দাশ্রæ শেয়ার করলাম প্রিয় সঙ্গী হার্ডসনের সাথে। রাত জাগা সময়গুলো তার সাথেই মিতালী। ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম নিউইয়র্কের একখন্ড বাংলাদেশ জ্যাকসন হাইটসে। রুজবেল্ট আইল্যান্ড (আমার বাসা) মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নিলাম না স্বদেশীরা কেউ নেই বলে। কষ্ট করে জ্যাকসন হাইটস মসজিদে গিয়েও জানাশুনা তেমন কাউকে পাইনি। ঈদ জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়েছি। লক্ষকোটি শোকরিয়া মহান আল্লাহ’র দরবারে। নিত্য সঙ্গী প্রিয় মানুষদের ফোন করলাম কয়েকবার করে। কিন্তু হয়তো ঘুম ভাংগেনি তখনো তাদের। আগের রাতে কথা হয়েছিল। সকালে সবাই জ্যাকসন হাইটসে একত্রিত হবো। নামাজ শেষে বেশ জমিয়ে রুটি মাংস খাবো। আশা মনোরথ। তবুও রেষ্টুরেন্ট থেকে মাংস পরোটা নিলাম। সাথে ঈদের মিষ্টিমুখ হিসেবে একটু সেমাই পেলাম। বাইরে বসে খেয়ে ট্রেনে চেপে আবারো নিজের ঠিকানায়। জ্যাকসন হাইটসে কমিউনিটির পরিচিত কয়েকজনের সাথে সেলফি নিলাম।
“কালার ইজ নাইস, আই লাইক ইট”। তাকিয়ে দেখি রুজবেল্ট আইল্যান্ডের নদীর ধারে বেঞ্চিতে বসা শ্বেতাঙ্গ এক যুবক আমার গায়ের পাঞ্জাবীর কালার প্রশংসা করেছে। কষ্টের মুচকি হাসিতে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরলাম। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম পাঞ্জাবীদাতা মনিকা দি’কে (মনিকা রায় চৌধুরী, কালচারাল সেক্রেটারী, বাংলাদেশ সোসাইটি, নিউইয়র্ক)। গতবছর উনি রোজার ঈদে দান করেছিলেন গাড় সবুজের এই পাঞ্জাবীটি। দেশ থেকে আসতে উনি বেশ কয়েকটি পাঞ্জাবীই আমার জন্য এনেছিলেন। কিন্তু এই রংটি বেশি পছন্দ। তা আজকের যুবকের প্রশংসায়ও বুঝলাম।
কানাডার টরেন্টোতে থাকা ছেলে সাফিনের ঈদের খাওয়া আর রান্না নিয়ে কথা বলছিলাম। প্রবাসী বাপ-ছেলের ঈদ প্রস্তুতি নিয়ে। ছেলে আমার চিকেন (মুরগীর মাংস) রান্না করেছে যতটুকু পেরেছে। আব্বু তুমি কি রান্না করছো? রান্নার অভাব নেই বাবা। এই বলেই হেসে অন্য প্রসংগে চলে গেলাম। অবশ্য আমার মা জিজ্ঞাসা করলেও এমনটিই করি আমি।আলু সিদ্ধ ডিম- ঈদের দিনের এই আদর্শ রান্নার কথা শুনলে মন খারাপ হতে পারে ছেলেটার। মায়ের কোল ছেড়ে বিদেশে প্রথম কোরবানীর ঈদ তার। ওর জন্য আমার মনটাও খারাপ আরো বেশি। এসব আমার সয়ে গেছে। শিশু বয়সে যার বাবা মারা যায়। ৪৬ বছর বয়সে আবেগ অনুভুতি এসব হাস্যকর। জন্ম থেকেই মাথার উপরে যার ছাতা নেই, কেবল সে-ই বুঝে রোদ, ঝড়, বৃষ্টির আঘাত। বুঝেনা শুধু মায়ের মন। ছেলে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবেনা। তবু অপেক্ষা মায়ের। আমিও অনেক মিস করি মা। কবে দেখা হবে জানিনা, কিন্তু তবুও থাকি অপেক্ষায়। দূর প্রবাস থেকে একটি কথাই বলবো।
মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
লেখকঃ সাংবাদিক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।