নিউইয়র্ক ০৩:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

তিন তিনটি ‘ডে-অফ’ বাতিল ও মৃণাল হকের মানবতাবোধ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:১০:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২১
  • / ৫৯ বার পঠিত

শিবলী চৌধুরী কায়েস: চলে গেলেন মৃনাল হক ভাই। ইন্নালিল্লাহি…..রাজেউন! মহান রাব্বুল আল-আমিন তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুণ। ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সমান ভারসাম্য রাখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়! মৃণাল হকের শিল্পকর্ম নিয়ে অনেকেরই হয়তো মতবিরোধ থাকতে পারে! কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি মৃনাল হক ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ।
আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগের কথা। ২০১১ সালের জুলাই মাস। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছিল। কভার করতে ঢাকা থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরে যাই। আমাদের সঙ্গি ছিল বেশ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলর রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান এবং জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক। আমরা সবাই একটি ‘নোহা মাইক্রো বাসে’ চেপেই সেখানে গিয়েছি।
কুমিল্লা মুরাদনগর শ্রীকাইল ইউনিয়নে গিয়ে দেখি ভিন্ন চিত্র। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্র দখল ও ব্যাপক ভাঙচুর। আর বিরোধী প্রার্থীরা গ্রামছাড়া! কয়েকটি ভোট-কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে টেলিভিশনে ‘ফোনোথলাইভ’ই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
এরই মধ্যে দীর্ঘ অনেক পথ পাড়ি দিতে হলো। পায়ে হেঁটে/বাঁশেরপুল (সাঁকো) বেয়ে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্র পরিদর্শন। পথিমধ্যে দেখতে পাই….. শতবর্ষী এক বৃদ্ধার- আর্তনাদ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন তিনি। তাঁর আর্তচিৎকার আমার বুকে লাগে। সাথে থাকা প্রিয় সহকর্মী আজিম খান রনি’র সহযোগিতা চাইলাম। বললাম, ব্রাদার এই মহিলাকে নিয়ে আমি একটি রিপোর্ট করতে চাই। তিনি আমাকে সহায়তা করলেন। যদিও, সাথে থাকা অন্যান্য টিভি ও পত্রিকার সহকর্মীরা তেমন আগ্রহ দেখালেন না। শতবর্ষী ওই মহিলার নাম ‘জমিলাথ বিবি’। মন দিয়ে শুনলাম বৃদ্ধার কথা। পকেটে যার যা ছিল, সহায়তা করলাম।
ফুটেজ নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। ভাবলাম নিয়মতি ডে’র ডিউটিতে এই ‘সফটথ স্টোরি’ করবো। কিন্তু অন্যান্য অ্যাইসনমেন্টে ব্যস্ত রাখে অফিস। জমিলা বিবি ‘ডে-ইভেন্ট’ ক্যাটাগরির না হওয়ায় গুরুত্ব কমে যায়। একদিন পর ডে-অফ। সেই দিন অফিস এসে বার্তা কক্ষের ‘শিফট ইন চার্জের’ সাথে শেয়ার করি। তিনি স্টোরি বানাতে সায় দিলেন। স্ক্রিপ্ট লেখা শেষে ভিডিও সম্পাদনার কাজও শেষ হলো।
ওইদিন রাত ‘দশটার প্রাইম টাইম নিউজে’ জমিলা বিবি সম্প্রচার হলো।
ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=bDumcucMUmg
সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক বাহবা পাই। পরদিন এনটিভি’র এক সহকর্মীর ফোন। এরপরই আমাদের আরেক সহকর্মী মহিম মিজানের ফোন। তিনি বললেন, কায়েস তোমাকে ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হক খুঁজছেন। আমি তোমার মোবাইল নম্বর দিয়েছি।
মধ্যরাতে ‘মৃণাল হকের’ সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন ‘শতবর্ষী জমিলা বিবি’কে সবধরণের সহযোগিতা করতে চান। আমার পরামর্শ চাইলেন। সব কিছু ঠিকঠাক। জমিলা বিবিকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা এনে দিতে প্রস্তুত ‘মৃণাল হক’ও। আমাকে বললেন, পুরো পরিবার নিয়ে মুরাদনগর যাবেন। অফিসকে জানালেন। যেহেতু সফট-স্টোরি অফিস তেমন সাড়া দিলো না। তবে, ট্রান্সপোর্টেশন’সহ আমাদের যাত্রা পথের সকল ব্যয় মৃণাল হক বহন করবেন; সেহেতু অফিস ক্যামেরাম্যান দিতে রাজি হলো। তবে, শর্ত একটা আমার ‘ডে-অফের’ দিন যেতে পারবো।
এবারের সহযোগি হিসাবে পেলাম আরেক প্রিয় সহকর্মী মুজিবুর রহমান’কে। পেশাগত কাজে ক্যামারাম্যানদের সাথে বরাবরই আমার সখ্যতা ছিল বেশ। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমার রিপোর্টিংয়ের প্রাণ হচ্ছেন তিনি; যিনি ক্যামেরা অপারেট করেন। যাই হোক। এবার জমিলা বিবির ঘরে যাবার প্রস্তুতি। দিনক্ষণ ঠিক হলো।
সব কিছুই মৃণাল হক এবং আমি পরামর্শ করে ম্যানেজ করেছি। যথারিতি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এর আগে আমাদের তৎকালিন কুমিল্লা প্রতিনিধি খালেদ সাইফুল্লাহ এবং মুরাদনগরের স্থানীয় সাংবাদিক এম কে আই জাবেদ-কে জানিয়ে রাখলাম। তারাও আমার সাথে থাকার অঙ্গীকার করলেন।
আমার ‘ডে অফের’ নির্ধারিত দিনে সহকর্মী/ক্যামেরাম্যান এবং আমি অফিসে অপেক্ষমান। গুলশান থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের বিজয়নগর অফিসের সামনে হাজির হলেন মৃণাল হক। নেমে দেখি গুণী শিল্পীর গাড়িতে উনার বৃদ্ধা মাও বসা! আশ্চর্য হলাম। বললাম দাদা খালাম্মাতো বৃদ্ধা মহিলার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না! কারণ শতবর্ষী জমিলার কাছে যেতে, গাড়ির পথ শেষে অনেক দুর পাড়ে হেঁটে এবং নৌকা চড়তে হবে। হাসিমুখে জানালেন- ‘মা আমার যেতে চান। উনি রিপোর্টটি রাত দশটার সংবাদ এবং মধ্যরাত দেড়টার সংবাদও দেখেছেন। আমরা পরিবারের সবাই আপ্লুত। তাই মাকেও নিয়ে নিলাম। যতটুক পর্যন্ত গাড়ি থাকবে সেখানে মাকে ও ড্রাইভারদের রেখে যাবো।’ খালাম্মাও আমাকে বললেন, ‘সমস্যা হবে না বাবা’।
আমরা কুমিল্লার মুরাদনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যাত্রাপথে কুমিল্লার একটি ছোট বাজার থেকে বাছুরসহ দুধেলা গাই এবং নৌকা কেনা হলো। মিয়ামি হোটেলে দুপুরের খাবার সারলাম।
নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এলো। স্থানীয় সাংবাদিক জাবেদও এলাকাবাসীদের নিয়ে আমাদের অপেক্ষায়। ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হক ‘রতœগর্ভা মা’কে রেখে হাঁটতে শুরু করলেন। সাথে ছুটছেন মৃণাল হকের আমেরিকায় বেড়ে উঠা দুই সন্তান, স্ত্রী। এছাড়াও রয়েছেন, ভাতিজা/ভাতিজি’সহ পরিবারের অনেকেই। যাদের কারো….. কখনোই এভাবে ‘বাঁশের সাঁকো’ বেড়ে পথচলার অভিজ্ঞতা ছিলো না। অবাকই হলাম। ভাবলাম প্রকৃত বিত্তবান এদেরকেই বলে। পারিবারিক শিক্ষা, নিরহঙ্কার এবং মানবতাবোধ সবই দেখেছি মৃণাল হক ও তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে।
কথায় আছে না… ‘মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য- দরকার ‘পারিবারিক সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ’। যার ফলে, সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব। ‘সবটিই ছিল মৃণাল হকের মাঝে’।
নির্ধারিত সময়ে জমিলা বিবির কাছে পৌঁছালাম। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগের ‘ক্ষুধার্ত’ আর আজকের (ওই দিনের) জমিলাকে দেখে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করলাম। ভাবলাম; আমার একটি রিপোর্ট বদলে দিয়েছে শতবর্ষী জমিলাসহ তার পুরো পরিবারকে। এটাইতো আমার কর্মের/ক্ষদ্র সাংবাদিকতার সফলতা!
এরপর ঢাকায় ফিরে ফলো-আপ স্টোরি করলাম। সিনিয়র ভিডিও এডিটর ফজলুল করিম মিলন খুব যতœকরে রিপোর্টটি সম্পাদনা করলেন। যদিও… দু’টি ‘মানবিক স্টোরি’র জন্য আমাকে তিন দিনের ‘ডে-অফ’ ছুটি বাতিল করতে হয়েছে।
ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=CihpzKyHysA
মৃণাল হক

তবুও আমি অনেক আনন্দিত ছিলাম। দেশে দুটো টিভি চ্যানেল, একাধিক পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে; এভাবে অসংখ্য রিপোর্ট করেছি। অনেক সাড়া ও সাহস পেয়েছি। প্রবাসেও তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি।
যাই হোক। জমিলা বিবি- ‘আমি এবং মৃণাল হকের পরিবারের সাথে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে গেছেন’। মৃণাল ভাইয়ে বাসায় প্রায় আমার যাওয়া আসা ছিল। অনেক সহকর্মীদেরও নিয়ে গেছি। খাল্লামা, ভাবি, ভাতিজা, ভাতিজিরাও আমাকে অনেক পছন্দ করতো। এখনো তাদের কারো কারো সাথে সামাজিক মাধ্যমে আমার “হায়, হ্যালো” হয়। সবচেয়ে বেশি কথা অরিত্রের সাথে।
২০১৪ সালের শুরুতে আমি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমাই। তার আগে প্রায় ৩ বছরই মৃণাল হকের সাথে আমার নিয়মিত কথা হতো। তিনি মানুষকে সহযোগিতা করতে চাইতেন। যুক্তরাষ্ট্র বসবাসকারি তার পুত্র সন্তান শৈকত হককে নিয়ে নানা সময়ে আমার সাথে কথা বলতেন মৃণাল হক। গর্ব করতেন এক কন্যা ও পুত্র সন্তান নিয়ে। ভাবতেন ভাতিজা/ভাতিজিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আমি আমেরিকা আসার পূর্বেই মারা গেলেন ‘জমিলা বিবি’। এরপর মৃণাল হকের রতœগর্ভা মা। মহান রাব্বুল আল-আমিন তাদের বেহস্ত নসিব করুক। আমনি।
কিন্তু এত দ্রæত মৃণাল হক চলে যাবেন, ভাবতে পারি নি!। অনেক কথা হতো উনার সাথে। গতকাল রাতে যখন শুনলাম তিনি আর নেই। খারাপই লাগলো।
নশ্বর এই পৃথিবীতে, কোন কিছুই অবিনশ্বর নয়। আমরা বন্দি হয়ে আছি ভ্রান্ত ক্ষমতার লোভ আর বিভিন্ন মায়াজালে। অথচ সৃষ্টিকর্তা ক্ষণিকের জন্য আমাদের পাঠিয়েছেন। সেটা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অনেকে আবার আত্মপরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দেই। বস্তত, বিশ্বাস আর নিশ্বাস; এই দুটোই খুব আবশ্যক। কারণ নিশ্বাস আটকে গেলেই মানুষের মৃত্যু হয়। আর বিশ্বাস চলে গেলে মানুষের আতœবিশ্বাসের অপমৃত্যু হয়! তাই নিশ্বাস ও বিশ্বাস এই দুটো বাস্তবতাকেও আমরা অনেকে মানছি না! যার প্রমাণ তথাকথিত এই সেলফিযুগ!
কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার অবস্থান বুঝে অবস্থান নেই আমরা। খূঁজে বার করি অতিতের স্মৃতিনির্ভর ছবি। ক্যামেরা ফ্রেমে বন্দি, ‘ভালোবাসার’ নাকি ‘লোক দেখানো’ সেটা বড় নয়। আমাদের কাছে বড় হচ্ছে লোক দেখানো কর্ম। তাইতো একটি ছবি পেলেই তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মৃত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি! এর ভেতরে আন্তরিকতা কতটুকু; তা প্রশ্নসাপেক্ষ! যাই হোক; এসব যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মৃণনাল হক, উনার পরিবারের সদস্যদের সাথে আমারও অসংখ্য ছবি আছে। আমার কাছে সেসব বড় নয়। আমি দোয়া করি দুনিয়াতে তার ভালোকর্মের ফল যাতে তিনি পরপরারে ভোগ করতে পারেন। আর যদি কোন খারাপ কর্ম থাকে, সেগুলো থেকে বিধাতা যাতে তাঁকে নাজাত দেন।
সবশেষ প্রয়াত ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হকের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। ‘কুল্লু নাফসিন, যায়ীকাতুল মাউত’ প্রত্যেক প্রাণীকেই, মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। সূরা: আলে ইমরান আয়াত- ১৬৫। মহান রাব্বুল আল-আমিন আমাদের ভালো কর্মের সাথে চলার তৌফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: এডিটর, চ্যানেল টিটি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

তিন তিনটি ‘ডে-অফ’ বাতিল ও মৃণাল হকের মানবতাবোধ

প্রকাশের সময় : ১০:১০:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২১

শিবলী চৌধুরী কায়েস: চলে গেলেন মৃনাল হক ভাই। ইন্নালিল্লাহি…..রাজেউন! মহান রাব্বুল আল-আমিন তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুণ। ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সমান ভারসাম্য রাখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়! মৃণাল হকের শিল্পকর্ম নিয়ে অনেকেরই হয়তো মতবিরোধ থাকতে পারে! কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি মৃনাল হক ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ।
আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগের কথা। ২০১১ সালের জুলাই মাস। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছিল। কভার করতে ঢাকা থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরে যাই। আমাদের সঙ্গি ছিল বেশ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলর রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান এবং জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক। আমরা সবাই একটি ‘নোহা মাইক্রো বাসে’ চেপেই সেখানে গিয়েছি।
কুমিল্লা মুরাদনগর শ্রীকাইল ইউনিয়নে গিয়ে দেখি ভিন্ন চিত্র। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্র দখল ও ব্যাপক ভাঙচুর। আর বিরোধী প্রার্থীরা গ্রামছাড়া! কয়েকটি ভোট-কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে টেলিভিশনে ‘ফোনোথলাইভ’ই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
এরই মধ্যে দীর্ঘ অনেক পথ পাড়ি দিতে হলো। পায়ে হেঁটে/বাঁশেরপুল (সাঁকো) বেয়ে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্র পরিদর্শন। পথিমধ্যে দেখতে পাই….. শতবর্ষী এক বৃদ্ধার- আর্তনাদ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন তিনি। তাঁর আর্তচিৎকার আমার বুকে লাগে। সাথে থাকা প্রিয় সহকর্মী আজিম খান রনি’র সহযোগিতা চাইলাম। বললাম, ব্রাদার এই মহিলাকে নিয়ে আমি একটি রিপোর্ট করতে চাই। তিনি আমাকে সহায়তা করলেন। যদিও, সাথে থাকা অন্যান্য টিভি ও পত্রিকার সহকর্মীরা তেমন আগ্রহ দেখালেন না। শতবর্ষী ওই মহিলার নাম ‘জমিলাথ বিবি’। মন দিয়ে শুনলাম বৃদ্ধার কথা। পকেটে যার যা ছিল, সহায়তা করলাম।
ফুটেজ নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। ভাবলাম নিয়মতি ডে’র ডিউটিতে এই ‘সফটথ স্টোরি’ করবো। কিন্তু অন্যান্য অ্যাইসনমেন্টে ব্যস্ত রাখে অফিস। জমিলা বিবি ‘ডে-ইভেন্ট’ ক্যাটাগরির না হওয়ায় গুরুত্ব কমে যায়। একদিন পর ডে-অফ। সেই দিন অফিস এসে বার্তা কক্ষের ‘শিফট ইন চার্জের’ সাথে শেয়ার করি। তিনি স্টোরি বানাতে সায় দিলেন। স্ক্রিপ্ট লেখা শেষে ভিডিও সম্পাদনার কাজও শেষ হলো।
ওইদিন রাত ‘দশটার প্রাইম টাইম নিউজে’ জমিলা বিবি সম্প্রচার হলো।
ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=bDumcucMUmg
সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক বাহবা পাই। পরদিন এনটিভি’র এক সহকর্মীর ফোন। এরপরই আমাদের আরেক সহকর্মী মহিম মিজানের ফোন। তিনি বললেন, কায়েস তোমাকে ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হক খুঁজছেন। আমি তোমার মোবাইল নম্বর দিয়েছি।
মধ্যরাতে ‘মৃণাল হকের’ সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন ‘শতবর্ষী জমিলা বিবি’কে সবধরণের সহযোগিতা করতে চান। আমার পরামর্শ চাইলেন। সব কিছু ঠিকঠাক। জমিলা বিবিকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা এনে দিতে প্রস্তুত ‘মৃণাল হক’ও। আমাকে বললেন, পুরো পরিবার নিয়ে মুরাদনগর যাবেন। অফিসকে জানালেন। যেহেতু সফট-স্টোরি অফিস তেমন সাড়া দিলো না। তবে, ট্রান্সপোর্টেশন’সহ আমাদের যাত্রা পথের সকল ব্যয় মৃণাল হক বহন করবেন; সেহেতু অফিস ক্যামেরাম্যান দিতে রাজি হলো। তবে, শর্ত একটা আমার ‘ডে-অফের’ দিন যেতে পারবো।
এবারের সহযোগি হিসাবে পেলাম আরেক প্রিয় সহকর্মী মুজিবুর রহমান’কে। পেশাগত কাজে ক্যামারাম্যানদের সাথে বরাবরই আমার সখ্যতা ছিল বেশ। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমার রিপোর্টিংয়ের প্রাণ হচ্ছেন তিনি; যিনি ক্যামেরা অপারেট করেন। যাই হোক। এবার জমিলা বিবির ঘরে যাবার প্রস্তুতি। দিনক্ষণ ঠিক হলো।
সব কিছুই মৃণাল হক এবং আমি পরামর্শ করে ম্যানেজ করেছি। যথারিতি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এর আগে আমাদের তৎকালিন কুমিল্লা প্রতিনিধি খালেদ সাইফুল্লাহ এবং মুরাদনগরের স্থানীয় সাংবাদিক এম কে আই জাবেদ-কে জানিয়ে রাখলাম। তারাও আমার সাথে থাকার অঙ্গীকার করলেন।
আমার ‘ডে অফের’ নির্ধারিত দিনে সহকর্মী/ক্যামেরাম্যান এবং আমি অফিসে অপেক্ষমান। গুলশান থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের বিজয়নগর অফিসের সামনে হাজির হলেন মৃণাল হক। নেমে দেখি গুণী শিল্পীর গাড়িতে উনার বৃদ্ধা মাও বসা! আশ্চর্য হলাম। বললাম দাদা খালাম্মাতো বৃদ্ধা মহিলার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না! কারণ শতবর্ষী জমিলার কাছে যেতে, গাড়ির পথ শেষে অনেক দুর পাড়ে হেঁটে এবং নৌকা চড়তে হবে। হাসিমুখে জানালেন- ‘মা আমার যেতে চান। উনি রিপোর্টটি রাত দশটার সংবাদ এবং মধ্যরাত দেড়টার সংবাদও দেখেছেন। আমরা পরিবারের সবাই আপ্লুত। তাই মাকেও নিয়ে নিলাম। যতটুক পর্যন্ত গাড়ি থাকবে সেখানে মাকে ও ড্রাইভারদের রেখে যাবো।’ খালাম্মাও আমাকে বললেন, ‘সমস্যা হবে না বাবা’।
আমরা কুমিল্লার মুরাদনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যাত্রাপথে কুমিল্লার একটি ছোট বাজার থেকে বাছুরসহ দুধেলা গাই এবং নৌকা কেনা হলো। মিয়ামি হোটেলে দুপুরের খাবার সারলাম।
নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এলো। স্থানীয় সাংবাদিক জাবেদও এলাকাবাসীদের নিয়ে আমাদের অপেক্ষায়। ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হক ‘রতœগর্ভা মা’কে রেখে হাঁটতে শুরু করলেন। সাথে ছুটছেন মৃণাল হকের আমেরিকায় বেড়ে উঠা দুই সন্তান, স্ত্রী। এছাড়াও রয়েছেন, ভাতিজা/ভাতিজি’সহ পরিবারের অনেকেই। যাদের কারো….. কখনোই এভাবে ‘বাঁশের সাঁকো’ বেড়ে পথচলার অভিজ্ঞতা ছিলো না। অবাকই হলাম। ভাবলাম প্রকৃত বিত্তবান এদেরকেই বলে। পারিবারিক শিক্ষা, নিরহঙ্কার এবং মানবতাবোধ সবই দেখেছি মৃণাল হক ও তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে।
কথায় আছে না… ‘মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য- দরকার ‘পারিবারিক সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ’। যার ফলে, সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব। ‘সবটিই ছিল মৃণাল হকের মাঝে’।
নির্ধারিত সময়ে জমিলা বিবির কাছে পৌঁছালাম। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগের ‘ক্ষুধার্ত’ আর আজকের (ওই দিনের) জমিলাকে দেখে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করলাম। ভাবলাম; আমার একটি রিপোর্ট বদলে দিয়েছে শতবর্ষী জমিলাসহ তার পুরো পরিবারকে। এটাইতো আমার কর্মের/ক্ষদ্র সাংবাদিকতার সফলতা!
এরপর ঢাকায় ফিরে ফলো-আপ স্টোরি করলাম। সিনিয়র ভিডিও এডিটর ফজলুল করিম মিলন খুব যতœকরে রিপোর্টটি সম্পাদনা করলেন। যদিও… দু’টি ‘মানবিক স্টোরি’র জন্য আমাকে তিন দিনের ‘ডে-অফ’ ছুটি বাতিল করতে হয়েছে।
ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=CihpzKyHysA
মৃণাল হক

তবুও আমি অনেক আনন্দিত ছিলাম। দেশে দুটো টিভি চ্যানেল, একাধিক পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে; এভাবে অসংখ্য রিপোর্ট করেছি। অনেক সাড়া ও সাহস পেয়েছি। প্রবাসেও তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি।
যাই হোক। জমিলা বিবি- ‘আমি এবং মৃণাল হকের পরিবারের সাথে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে গেছেন’। মৃণাল ভাইয়ে বাসায় প্রায় আমার যাওয়া আসা ছিল। অনেক সহকর্মীদেরও নিয়ে গেছি। খাল্লামা, ভাবি, ভাতিজা, ভাতিজিরাও আমাকে অনেক পছন্দ করতো। এখনো তাদের কারো কারো সাথে সামাজিক মাধ্যমে আমার “হায়, হ্যালো” হয়। সবচেয়ে বেশি কথা অরিত্রের সাথে।
২০১৪ সালের শুরুতে আমি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমাই। তার আগে প্রায় ৩ বছরই মৃণাল হকের সাথে আমার নিয়মিত কথা হতো। তিনি মানুষকে সহযোগিতা করতে চাইতেন। যুক্তরাষ্ট্র বসবাসকারি তার পুত্র সন্তান শৈকত হককে নিয়ে নানা সময়ে আমার সাথে কথা বলতেন মৃণাল হক। গর্ব করতেন এক কন্যা ও পুত্র সন্তান নিয়ে। ভাবতেন ভাতিজা/ভাতিজিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আমি আমেরিকা আসার পূর্বেই মারা গেলেন ‘জমিলা বিবি’। এরপর মৃণাল হকের রতœগর্ভা মা। মহান রাব্বুল আল-আমিন তাদের বেহস্ত নসিব করুক। আমনি।
কিন্তু এত দ্রæত মৃণাল হক চলে যাবেন, ভাবতে পারি নি!। অনেক কথা হতো উনার সাথে। গতকাল রাতে যখন শুনলাম তিনি আর নেই। খারাপই লাগলো।
নশ্বর এই পৃথিবীতে, কোন কিছুই অবিনশ্বর নয়। আমরা বন্দি হয়ে আছি ভ্রান্ত ক্ষমতার লোভ আর বিভিন্ন মায়াজালে। অথচ সৃষ্টিকর্তা ক্ষণিকের জন্য আমাদের পাঠিয়েছেন। সেটা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অনেকে আবার আত্মপরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দেই। বস্তত, বিশ্বাস আর নিশ্বাস; এই দুটোই খুব আবশ্যক। কারণ নিশ্বাস আটকে গেলেই মানুষের মৃত্যু হয়। আর বিশ্বাস চলে গেলে মানুষের আতœবিশ্বাসের অপমৃত্যু হয়! তাই নিশ্বাস ও বিশ্বাস এই দুটো বাস্তবতাকেও আমরা অনেকে মানছি না! যার প্রমাণ তথাকথিত এই সেলফিযুগ!
কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার অবস্থান বুঝে অবস্থান নেই আমরা। খূঁজে বার করি অতিতের স্মৃতিনির্ভর ছবি। ক্যামেরা ফ্রেমে বন্দি, ‘ভালোবাসার’ নাকি ‘লোক দেখানো’ সেটা বড় নয়। আমাদের কাছে বড় হচ্ছে লোক দেখানো কর্ম। তাইতো একটি ছবি পেলেই তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মৃত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি! এর ভেতরে আন্তরিকতা কতটুকু; তা প্রশ্নসাপেক্ষ! যাই হোক; এসব যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মৃণনাল হক, উনার পরিবারের সদস্যদের সাথে আমারও অসংখ্য ছবি আছে। আমার কাছে সেসব বড় নয়। আমি দোয়া করি দুনিয়াতে তার ভালোকর্মের ফল যাতে তিনি পরপরারে ভোগ করতে পারেন। আর যদি কোন খারাপ কর্ম থাকে, সেগুলো থেকে বিধাতা যাতে তাঁকে নাজাত দেন।
সবশেষ প্রয়াত ভাস্কর শিল্পি মৃণাল হকের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। ‘কুল্লু নাফসিন, যায়ীকাতুল মাউত’ প্রত্যেক প্রাণীকেই, মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। সূরা: আলে ইমরান আয়াত- ১৬৫। মহান রাব্বুল আল-আমিন আমাদের ভালো কর্মের সাথে চলার তৌফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: এডিটর, চ্যানেল টিটি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র