মাহমুদ রেজা চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষক এবং ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখাতে যা লিখেছেন তার শুরুর সারমর্ম হল: ১৯১১ সালে ডিসেম্বর মাসে যখন বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়, তখন মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বৃটিশ শাসক সেই অসন্তোষকে কিছুটা নিবৃত্ত করবার জন্য সিদ্ধান্ত নেন, অচিরেই তারা পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবেন। এতে তখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা কিছুটা খুশি হলেও তৎকালীন হিন্দুসমাজ বিষয়টাতে খুশি হননি।
ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই অখুশি দলের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা তার উল্লেখিত রচনাতে লিখেছেন। তাদের একজনের নাম হলো রাসবিহারী ঘোষ, অপর আরেকজনের নাম গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাদের যুক্তি ছিল এরকম যে, প্রশাসন ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়েছে কিন্তু তার বদলে এখন সাংস্কৃতিক বিভাগ করা হচ্ছে। এর ফলে এই বিষয়ে ভিন্ন ধরনের সঙ্কা এবং সংকট সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। (চোখের দেখা, প্রাণের কথা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই কনভেনশন ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-৯)
এই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির সূচনা থেকে এর সাথে যুক্ত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটের একটি চিত্রের কথা। শোনা যায় এবং অনেকেই বলেছেন যে, ওই সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্রকে বুঝতে তার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক স্তরায়ন কে-ও বোঝার গুরুত্ব আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা থেকেই এই গুরুত্বের ‘গুরুত্বটাকে’ আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি। সে কারণে-ই ভূমিকাতে এই কথা।
কে বা জানে হয়তো এরই একটি ঐতিহ্য আছে বলে বা ধারাবাহিকতা যাই বলি না কেন, তার রেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বর্তমান। বর্ণ কিংবা ধর্মবিদ্বেষের বিপরীতে এখনকার সময়টা অনেক বেশি আভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভালো-মন্দ এর সাথেজড়িত। আমরা অস্বীকার করতে পারবো কিনা জানিনা।
উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির যে দৃশ্য আমরা দেখি না অথবা যে ভূমিকা আমরা দেখি না সেটা অনেকাংশেই আমরা বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি দেখি এবং দেখেছিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অর্ন্তগত। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকের বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার কোন যুক্তি নেই।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ইতিবাচক ইতিহাস অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই ইতিবাচক ইতিহাসের ইতিবাচক দিককে আমরা যতটা ধারণ করতে পেরেছি তার চেয়ে অধিক বেশি আমরা ধারণ করেছি আমাদের আভ্যন্তরীণ অনৈক্য, নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সাথে বেশিরভাগ সময় নিজেদের মধ্যে নেতিবাচক সংঘর্ষ-কে। এই বিষয়টা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির নানারকম উত্তরণের সংকটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে একটি প্রধান দায়িত্ব হলো ভবিষ্যতের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিনির্মাণে নিজেকে গড়ে তোলা জ্ঞানে এবং বোধের পরিসীমায়। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই ভূমিকা পালন করতে পারিনা। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যতটা ভূমিকা তারচেয়েও বেশি ভূমিকা আছে সমাজ ও রাজনীতির একটি নেতিবাচক প্রভাবের।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি বা ভর্তি হই সেটা ১৯৭৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা প্রবেশ করেছি যখন, তখন বলা যেতে পারে সারাদেশ এবং দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এই সব কিছুর জন্যই একটা বিশেষ ক্রান্তিলগ্ন ছিল বলা যায়। আমরা সেই ক্রান্তিলগ্নে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিশংসভাবে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এরকম একটা দুঃস্বপ্ন এবং অস্বাভাবিকতা নিশ্চয়ই রাষ্ট্র ও সমাজকে নাড়া দিয়েছিল যা অস্বীকার করবার উপায় নেই। আমরা সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিঃসন্দেহে আমাদের উপর তখন একটি বিরাট রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ কাজ করেছে। সেই মূল্যবোধের একটি হচ্ছে, ভবিষ্যৎ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে আমাদের নিজেদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার আত্মপ্রত্যয়, দায়িত্ব এবং কর্তব্য ছিল। আমরা কতটা সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পেরেছি সময় তার অনেক দৃষ্টান্ত দিয়েছে, আগামীতে হয়তো আরো দেবে।
কেন বলছি এই কথা। কারণ আমাদের সময়ে আমরা যারা একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে হাঁটাহাঁটি করেছি, কেউ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অনেকে আড্ডায় ব্যস্ত ছিলাম। কেউ রাজনীতি নিয়ে উৎসাহিত ছিলাম। কিন্তু দ্ব›েদ্ব ছিলাম না সংঘর্ষের।
আমাদের মধ্যে দ্বিমত ছিল, কিন্তু একে অপরকে রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে খুন কিংবা হত্যা করার প্রবণতা কাজ করেনি। ডাকসু, সেটাকে বলা হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। আমাদের সময় ভীষণরকম সক্রিয় ছিল, তার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সমাজ বিনির্মাণে ভবিষ্যৎ নাগরিক এবং নেতৃত্ব তৈরীর ক্ষেত্রে। আমাদের সময়ে ডাকসুতে প্রধান ছিলেন ছাত্র রাজনীতিবিদ, এখন জাতীয় রাজনীতিক, অনেকের ভীষণ প্রিয় একজন সুবক্তা, সু-সাংগঠনিক মাহমুদুর রহমান মান্না ভাই। তার সাথে সহযোগিতায় ছিলেন আরেকজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আখতারুজ্জামান আখতার ভাই। আখতার ভাই এখন জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত।
ডাকসু’র উদ্যোগে এবং পরিচালনাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত নানান রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্পোর্টস প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি এবং নাটক প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা। নিয়মিত চর্চা চলত। ডাকসু’র এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের গৌরব ছিল যেমন তেমনিভাবে এইসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন যারা বের হয়েছেন প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বে। এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিকভাবে জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা দিতে ডাকসুর অসাধারণ ভূমিকা। আজ সেই ডাকসু আছে কিনা জানিনা।
আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর থেকে ফুটপাতে, ফুটপাত থেকে সবুজ ঘাসের মাঠে, লাইব্রেরী পাদদেশে, টিএসসিতে। সর্বত্রই আমাদের বন্ধুদের একটা অন্যরকম আধিপত্য এবং সৃজনশীল কাজের নানা রকম উদ্যোগ এবং আলোচনা সমালোচনা ভীষণভাবে চলত, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিনীত শ্রদ্ধা, বন্ধুত্বের ভালোবাসা এবং আবেগের জালে নিজেরা এক হয়ে থেকে। আজ সেটা কতটা হয় তা-ও অবশ্য জানি না। সাহিত্য বলি, গল্প কবিতা নাটক, গান, খেলাধুলা, বিভিন্ন সাংগঠনিক তৎপরতা, অধ্যায়ন ক্লাব, সিনে ক্লাব।
এইসবে আমরা বন্ধুরা ভীষণভাবে যুক্ত ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে। পরবর্তী সময়ে আমাদের মধ্য থেকেই অনেক গুণী মানুষ বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনো সেটা অব্যহত আছে। এই ক্ষেত্রে নাম করতে হয় আমাদের বন্ধু চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের কথা। আমরা সবাই ওই ক্রান্তিকালেই বড় হয়েছি নিজ নিজ দায়িত্ববোধকে মনে রেখে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর এত দ্রæত বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পরিবর্তন হয়েছিল ১৯৭৫ সালের অগাস্ট মাসে, জাতির সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের আমরা ছিলাম চাক্ষুষ প্রমাণ এবং অভিজ্ঞতায় ভরপুর। ওই বিশেষ একটা ক্রান্তিলগ্নে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম আমরা উশৃংখল হয়ে যায়নি কিন্তু। যে কারনেই আমাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব আজকে যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের গৌরব যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমি তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি মাত্র আজকের এই লেখাতে।
বন্ধু আলী রীয়াজ। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। এখন শুধু বন্ধু আলী রীয়াজ নয়। প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। ছাত্রজীবন থেকেই রীয়াজ ছাত্র রাজনীতির সাথে যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনি সক্রিয় ছিল ওর মেধা চর্চা-তে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগকে আমরা জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট বলি। রীয়াজ সেই বিভাগের স্বনামধন্য ছাত্র এবং পরে ও এই বিভাগের শিক্ষক ছিল। পরবর্তীতে রীয়াজ দেশের বাইরে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছে, বিবিসিতে একসময় ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছে। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতাও করেছে। ডাকসুতে-ও সাহিত্য সম্পাদক ছিল। ছাত্রজীবনে তার্কিক হিসাবেও ও বেশি পরিচিত ছিল। আগেই বলেছি রীয়াজ এখন শিক্ষকতা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি এবং সমাজ নীতির বিষয়ে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, পাশাপাশি সুপরিচিত এই ক্ষেত্রে রীয়াজ দেশে এবং বিদেশেও।
আরেক বন্ধু কামাল চৌধুরী। এখন ড. আবু নাসের কামাল চৌধুরী। কবি কামাল চৌধুরী। প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সচিব কামাল চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মুখ্য সচিব কামাল চৌধুরী। আরো অনেক পরিচয় আছে ওর। ছাত্রজীবন থেকেই বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ওর কবিতার জগতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে প্রবেশ করল বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে। একে একে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন সচিব পদমর্যাদার সম্মান অর্জন করেছেন নিজস্ব দক্ষতা এবং ওর মানবিক গুণের কারণে। কামাল যদিও অবসরে আছে এখন তবু দারুন প্রভাবশালী এবং প্রতাপশালী সরকারি মহলে। কবিতাতো আছেই।
বন্ধু মঈনুল আহসান সাবের। রাশভারী ব্যক্তিত্ব ছাত্রজীবন থেকেই। এখন সুপরিচিত গল্পকার মঈনুল আহসান সাবের নামে। ফিলিপস পুরস্কার সহ বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে সাবের। কামাল-সাবের আমরা একসাথে ছিলাম একই বিভাগে। খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমরা একে অপরের। আমাদের সময়ের আরেকজন বন্ধু গল্পকার এবং লেখক ও কবি মঈনুস সুলতানের কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। মঈনুস সুলতান এখন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে আছে। বহুদিন ওর সাথে যোগাযোগ নেই।
আমাদের আরেক বন্ধু এবং সাবের-কামালের সাথে আমরা একই ক্লাসে ছিলাম ফারজানা ইসলাম খুকু। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খুকু এখন ডক্টর ফারজানা ইসলাম খুকু, উপাচার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রফেসর ডক্টর ফারজানা ইসলাম খুকু-ই প্রথম মহিলা উপাচার্য। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অ¤øান থাকবে। আমাদের গর্ব তো বটেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার নিঃসন্দেহ। খুকু সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে কিছু লেখা বেশ কঠিন। একজন মানবিক মানুষ হিসাবে, ওকে বলা যেতে পারে তুলনাহীন। আচাওে, ব্যবহাওে, সহনশীলতায় এবং মুখে সর্বদা হাসিতে। খুকু আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটি বিশেষ জায়গা করে আছে। নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়।
বন্ধু ড. সলিমুল্লাহ খান। অত্যন্ত মেধাবী এবং একজন সমাজচিন্তক বলা যায় সলিমুল্লাহকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিল। আমাদের সময় ‘প্রাক্সিস’ জার্নাল নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা বের করত। এখন বাংলাদেশে একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানারকম আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
বন্ধু ড. এম এ মোমেন। এক সময় বাংলাদেশ সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিল। বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিল। ও বেশি সুপরিচিত একজন বিশিষ্ট অনুবাদক, গল্পকার, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং খুবই বিনয়ী একজন মানুষ হিসাবে। সাহিত্য জগতের ওর আরেকটি জনপ্রিয় নাম আছে সেটা হল আন্দালিব রাশদী।
ডক্টর সিনহা এম এ সাঈদ। ও আমাদের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। পরবর্তীতে সম্ভবত আইন বিষয়ে ডক্টরেট করেছে। অত্যন্ত সুপরিচিত একটি নাম সিনহা এম এ সাঈদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমরা দু’জনে ছিলাম এস এম হলের আবাসিক ছাত্র। এবং জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও ডাকসু বিতর্ক প্রতিযোগিতা আমরা দু’জন আমাদের এসএম হল-কে প্রতিনিধিত্ব করেছি। নিঃসন্দেহে একজন তুখোড় বক্তা, তার্কিক এবং বেশ পড়াশোনা আছে ওর যে বিষয়ে-ই ও কথা বলে না কেন। একজন ভূ রাজনীতি বিশ্লেষক হিসাবে এবং পাশাপাশি একজন লিডারশিপ অনুশীলনের মেন্টর হিসেবে ওর পরিচয় আছে দেশে এবং বিদেশে।
ড. মাহবুবুর রহমান। মাহবুব আর সিনহা ওরা একই বিভাগের ছাত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। মাহবুব পরবর্তী পর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডক্টরেট করে এখন ও ঢাকাতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। বলনে চলনে ও ছাত্রজীবন থেকেই ভীষণ রকম একজন নম্র প্রকৃতির মানুষ, বিনয়ী তো বটেই। ওর বিনয়ের কাছে ওর শত্রæও পরাজিত হয়।
আমাদের আরেক বন্ধু জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক জেনারেল সেক্রেটারী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বন্ধু শওকত মাহমুদ। আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিল। আচার-ব্যবহারে এরকম অমায়িক এবং হাসিখুশি মনের মানুষ বর্তমান সময়ে খুব কমই হয়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রেসক্লাবের নানাবিধ উন্নয়েনে ওর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক এবং পরিশ্রমের। দল-মত নির্বিশেষে প্রেসক্লাবে ওর যে জনপ্রিয়তা আছে সেটা আমাদের গৌরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই। উল্লেখ্য যে, শওকত জাতীয় প্রেসক্লাবের দুই দুইবার সভাপতিও ছিল। যা আমাদের অহংকার তো নিঃসন্দেহে।
আমাদের আড্ডায় আরেক প্রাণবন্ত বন্ধু আক্তার হোসেন। আক্তার একই সাথে আমরা সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। আক্তার এবং আমার অনেক আড্ডার স্মৃতি আছে। এখন অবশ্য ডক্টর আখতার হোসেন বলতে হয়। সম্প্রতি ও ডক্টরেট করেছে। আখতার লেখা-লেখি করে, ওর দুটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে।
সমাজ ও জীবনের ইতিহাস এবং বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছে উল্লিখিত ওর দুটি গল্পের বইয়ে। বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ওর দু’টি গল্পের বই। আক্তারের স্বনামধন্য বউ, ডক্টর ফারজানা ইসলাম খুকু এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আগেই যা উল্লেখ করেছি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আক্তার এখনো প্রাণবন্ত আছে আগের মতো।
মনে পড়ে বন্ধু খায়রুল আনোয়ার মুকুলের কথা। মুকুল বাংলাদেশের অন্যতম টেলিভিশন এনটিভিতে প্রায় তিন দশকের উপর হেড অফ দা নিউজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সময় ও ইতিহাস বিভাগে ছিল। সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিল ছাত্রজীবন থেকে। দীর্ঘ সময় কাজ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় পত্রিকা জনকন্ঠ পত্রিকায়। স্বভাবে ব্যবহারে আচার-আচরণে খুবই জনপ্রিয় মুকুল সবার কাছে। অত্যন্ত বিনয়ী মুকুল এখন অবসর জীবনযাপন করছে।
আরেক বন্ধু ডক্টর আউয়াল মজুমদার। বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব ছিল। এখন লেখাপড়া এবং বিভিন্ন গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছে।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আছে এখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য সালাউদ্দিন আকবর। অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বন্ধুদের মাঝে ওর অমায়িক ব্যবহারের কারণে। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবেও ওর সুনাম আছে।
আমাদের ঘনিষ্ঠ সার্কেলে মনে করতে হয় কবি জাফর ওয়াজেদকেও। বন্ধু হিসাবে জাফর যেমন জনপ্রিয় ছিল, কবি হিসেবেও ও বেশ জনপ্রিয় নিঃসন্দেহে বলা যায়।
উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের আরেক জনপ্রিয় বন্ধু আকবর হায়দার কিরনের কথা। কিরণ খুবই ন¤্র স্বভাবের হাসিখুশি একটা মানুষ। আড্ডায় প্রাণবন্ত সব সময়। ও এখন থাকে নিউইয়র্ক শহরে। ছাত্রজীবন থেকেই ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত রেখেছে নিজেকে। বাংলাদেশ রেডিও ক্লাবের ওকে প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তি বলা যায়। বর্তমানে ভয়েস আমেরিকার নিউইয়র্ক এর প্রতিনিধি। প্রায়ই দেখা হয় ওর সাথে চায়ের আড্ডায়। সেই যে আমাদের নানা রঙের দিনগুলি। আর কি ফিরে পাবো কখনো! মনে মনে পেতে পারি, বাস্তবে পাবো না।
সঙ্গীত বা গানের জগতেও আমাদের কিছু বন্ধু আছে যারা বেশ নাম করেছে সেই সময়ে এখনো যারা সুপরিচিত এই জগতে। প্রথমেই মনে পড়ে বন্ধু শহীদ খন্দকার টুকুর কথা। টুকু এখন উত্তর আমেরিকার টরন্টো অধিবাসী। কানাডার নাগরিক। একজন সফল ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা। ঢাকাতেও ওর অফিস আছে। ছাত্রজীবন থেকেই গানের সাথে যুক্ত ও । অসাধারণ গানের গলা, অসাধারণ উচ্চারণ ভঙ্গি। আমি যখন শুনি অবাক হয়ে শুনি এত সুন্দর গান করে ও। যেমন টুকু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব তেমনি আমাদেরও গৌরব। ওকে আমরা টুকু নামে ডাকি।
শিল্পী বা গায়ক বলতে আমাদের মধ্যে আরও যারা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয়ভাবে সুপরিচিত হয়েছে তাদের মধ্যে আছে বন্ধু চঞ্চল খান, মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, জাহিদ, বন্ধু নিগার। নিগারের গানের কণ্ঠস্বর দারুন। নিগার মাঝে কিছুদিন নিউইয়র্কে ছিল, এখন ও ঢাকাতেই আছে। জাহিদ সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে হিউস্টনে। মাঝে মাঝে শখে গান করে বন্ধু হাফিজ। হাফিজ থাকে হিউস্টনে।
আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাড ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন প্রিয় বন্ধু ছিল। ওরাও এখন সুপরিচিত দেশে ও বিদেশে। যেমন, শাফকাত আনোয়ার ওরফে মোস্তফা। একজন সফল আন্তর্জাতিক ব্যাংকার। এখন আছে বাহরাইনে। সমাজ-সংস্কৃতি বোধে ও সবসময়ই একজন আগ্রহী এবং উৎসাহী বন্ধু। এখনো তেমনি আছে প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ আমাদের বন্ধু শাফকাত।
বন্ধু মইন করিম চৌধুরী ওরফে মইন। ও পাবলিক এডের-ই ছাত্র ছিল। বর্তমানে মেরিল্যান্ডে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মঈনের বিশেষ একটি গুণ হলো ও ভিশন আন্তরিক বন্ধুদের ব্যাপারে। অত্যন্ত পরোপকারী একজন মানুষ। খুব সরাসরি কথা বলে, কিন্তু মনের দিক থেকে ও ভীষণ সরল একজন ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে। নিরবে অনেক কাজ করে দেশের জন্য।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অবশ্যই নাম করতে হয় আরো কয়েকজনকে। যারা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। যেমন বন্ধু কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, রাজনীতি বিশ্লেষক ড. পিয়াস করিম। বন্ধু আলী মোহাম্মদ টুটু। ওরা সবাই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে আমাদের আগে।
আমাদের আরেক বন্ধু ওর নাম শাহজাদী আঞ্জুমান আরা। ছাত্রজীবনে কবি হিসাবে বেশ জনপ্রিয় ছিল। পরে সরকারি চাকরিতে ঢুকে সম্ভবত সচিব হবার পর অবসরে গেছে। এখন কবিতা লেখে কিনা তেমন তা জানি না। কিন্তু আমাদের একজন ভীষণ ভালো বন্ধু, অমায়িক বন্ধু নিঃসন্দেহে।
এরকম অনেক বন্ধু আছে। যেমন মনে পরল মন্ট্রিয়লে আছে বন্ধু রেজাউর রহমান রেজা। একজন টেলিভিশন উপস্থাপক, অনুষ্ঠান পরিচালক এবং একজন সফল সংগঠক হিসেবে ছাত্রজীবন থেকে রেজা সুপরিচিত ছিল আমাদের সবার মধ্যে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক সময় প্রচারিত হতো ‘আইন-আদালত’ নামে একটি অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং আর্কিটেক্ট হিসেবে ওর যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এখন আছে। এখন কানাডায় একজন আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত।
আমাদের বন্ধু বৃত্তটা কিন্তু বেশ বড়। তাই সবার নাম এখানে আনতে না পারলেও মনে আছে। অবশ্যই মনে পরে আমাদের আরেক কবি বন্ধু বিপ্লবী কবি মোহন রায়হান ওর কথা। এখন আর আগের মতো লেখে না হয়তো বা। কিন্তু কবি মোহন রায়হান বাংলাদেশের কবিতার জগতে কারো চাইতে কম সুপরিচিত না কবি সোহেল অমিতাভ। ওকে ই বা ভুলি কি করে। ওর কবিতার মধ্যে এক ধরনের হতাশার দার্শনিকতা আছে, পাশাপাশি আছে যাপিত জীবন নিয়ে এক ধরনের উদাসীনতার আভাস। আমি ভুল হতেও পারি। কারণ কবিতা আমি সেভাবে বুঝিনা। যেটুকু সোহেলের কবিতা পড়ে বুঝেছি বা কম বুঝি। তাই বললাম।
যাইহোক, উল্লেখিত আলোচনা থেকে একটু বোঝা যায় যে আমরা জাতীয় জীবনের যে ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সেই ক্রান্তিলগ্নে আমরা কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের দায়িত্বটুকু পালনে। এখানে উল্লেখিত না হলেও যারা উল্লেখিত হয়েছেন যেমন তারা এবং সাথে যাদের নাম এখানে আসেনি কিন্তু আমাদের সময় আমাদের সারথি ছিল অধিকাংশই তারা জীবনে তাদের স্ব-স্ব অবস্থানে সফল এবং সমাজ এবং জাতির নেতৃত্বে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখেছেন এবং এখনো রাখছে।
এই কথাগুলোকে আমরা এবং আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটা কেমন ছিল তার একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত বলা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত এবং তারপর আমাদের সময় পর্যন্ত সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইতিবাচক সময় ছিল বলে বলা যেতে পারে। পাশাপাশি আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন, পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সমাজের মধ্যবিত্তদের প্রতিষ্ঠান। এখনো কিন্তু তাই আছে। তখন সমাজকে নেতৃত্ব দিত বা সমাজে কর্তৃত্ব করত সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী, এখনও তাই করছে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়।
পার্থক্য তো একটা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বলা যায় ঢাকাতে বা বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। তখন সমাজের মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাদের সুযোগ হতো বা সুযোগ পেত তারাই পড়তে আসত। কিন্তু ৯০ দশকের পর থেকে বাংলাদেশে একাধিক বেসরকারি ইউনিভার্সিটি হতে থাকে। তখন থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্রদের কিছুটা অংশ কমে যেতে থাকে। তখন আর একটি সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সন্তানেরা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে যেতে থাকে। এই পাবলিক ইউনিভার্সিটি ছাত্রদের মধ্যে সমাজ বা রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না কাজ করে তার চেয়ে এদের মধ্যে বেশি কাজ করে এক ধরনের অতি আত্মকেন্দ্রিকতা এবং শ্রেণিবিন্যাসের উচ্চাকাংখা। অনেকটা শ্রেণী বৈষম্যের চিন্তা চেতনা।
পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রের সরাসরি বিপক্ষে। তাই এখান থেকেই শুরু হতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। যে আন্দোলনে যুক্ত ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের সাধারণ জনগন। আজকে সরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সমাজ ও জাতির কোন ইনক্লুসিভ চিন্তাকে দেখতে পারি না। এটা দূর্ভাগ্য যেমন সমাজের তেমনি রাষ্ট্রেরও।
যাই হোক, আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্মৃতি লিখতে গিয়ে হয়তোবা কিছু অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা হয়ে গেছে। পাঠক সেটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে নেবেন। অনেক, অনেক কথা লেখার আছে এমনকি আমাদের সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েও। কিন্তু সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা লেখা সম্ভব না।
আরেকটি কথা লিখে শেষ করব, সেটা হলো আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সম্ভবত দেখিনি কোন ছাত্রের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে কোন শিক্ষকের কোনরকম নেতিবাচক ব্যবহারের শিকার হয়েছে ছাত্র। অথবা ছাত্রের কোন রাজনৈতিক দলের কারণে শিক্ষক লাঞ্চিত হয়েছেন কোনভাবে। আমরা সে রকম দেখিনি। আমাদের সময় ঘর বা নিজের পরিবারের বাইরে আমাদের অন্যতম শ্রদ্ধেয় গুরুজন ছিলেন আমাদের শিক্ষক। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এক-ইভাবে আমরা আমাদের শিক্ষকদের পেয়েছি সেইভাবে।
তাদের কাছ থেকে আমরা যেমন স্নেহ পেয়েছি তেমনি তাদের শাসনে বড় হয়েছি। একইভাবে আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন আমাদের জ্ঞানের গুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ আমরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই ইনক্লুসিভ চরিত্রকে চর্চা করেছি, ধারণ করেছি এবং এখনও সেটা করি।
আমরা যারা ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি সেই সময়টাও ছিল যেমন ক্রান্তিলগ্ন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি তখনো সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল অনেকটাই অস্থির কিছুটা বিভ্রান্ত।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েছিলাম, তখন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি-কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেই হত্যার মাত্র কয়েক মাস পরেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি। আবার যখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি কিংবা বের হবার পথে ছিলাম তখনো রাষ্ট্রের আরেক রাষ্ট্রপতি-কে হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। এটাকে বলা যায় আমরা যে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেই সময়ের একটি ঐতিহাসিক ক্যালেন্ডার সময় ১৯৭৬-১৯৮১. সমাজ এবং রাষ্ট্রের উভয় বাস্তবতায়।
আমরা বন্ধুরা আজ যে যেখানে আছি দেশে কিংবা বিদেশে, অধিকাংশই আমরা চেষ্টা করছি আমাদের নিজস্ব সীমানার ভেতরে বসে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের যেটুকু ইতিবাচক কর্তব্য আমরা পালন করতে পারি সেই কর্তব্যটুকু আন্তরিকতার সাথে এবং সততার সাথে পালন করতে। দল-মত শ্রেণী, ধর্ম, এইসব সংকীর্ণ বিভেদ এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে। বাকিটা সময় বলবে।
লেখক: রাষ্ট্র ও সমাজ বিশ্লেষক। নিউইয়র্ক।