ট্রাম্পের অভিশংসন ও আমেরিকান গণতন্ত্র
- প্রকাশের সময় : ০১:০৩:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২১
- / ১১৩ বার পঠিত
মুঈদ রহমান: গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি রাজনৈতিক দর্শন। এর বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্স ছিল গ্রিসের একটি নগররাষ্ট্র। এটি এথেন্স ও তার চারপাশের দু-চারটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত। সেখানকার শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন উপজাতীয় নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তা বাতিল করে করা হয় সব জনতার মতামত। সেই থেকে ডেমোক্রেসি।
গ্রিক শব্দ ‘দেমাস’ মানে জনগণের এবং ‘ক্রেতাস’ মানে শক্তি অর্থাৎ জনগণের শক্তি। তারও প্রায় ২ হাজার ৪শ বছর পর ১৮৬৩ সালে আমেরিকায় আব্রাহাম লিংকন তার ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে-‘এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব’. অর্থাৎ জনগণের সরকার, জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য। সেই থেকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে খুব একটা টানাটানি হয়নি। হ্যাঁ, তবে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। বর্তমান সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে, এমনকি দল কিংবা পরিবারেও গণতন্ত্রের আদলটি চর্চা করা হয়। সাধারণ অর্থে আমরা যা বুঝি তা হলো রাষ্ট্র কিংবা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে কে থাকবেন বা কোন দল থাকবে, তা নির্ধারণ করার একক ক্ষমতা সাধারণ মানুষের। সেই মতের প্রতিফলন ঘটাতেই নির্বাচনি ব্যবস্থা। আজকের বিশ্বে যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয়, সেখানে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমেই তাদের নেতৃত্ব নির্ধারণ করেন। আর জন্ম হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছি, খোদ আমেরিকা এর চুলচেরা বিশ্লেষণে আগ্রহ দেখায়। সেই বিশ্লেষকের মাথায়ই আজ পোকা ধরেছে। গেল সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র নিয়ে যা ঘটে গেল তা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের শত বছরের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে দিয়েছে।
আজ থেকে ২৩১ বছর আগে ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি মোট ভোটারের মাত্র ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর গত নভেম্বরে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এত বেশিসংখ্যক ভোটের উদাহরণ অতীতে নেই। কিন্তু পরাজিত রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে থেকেই অনেক অগণতান্ত্রিক আচরণ ও মন্তব্য করে আসছিলেন। আর নির্বাচনের পর যা বললেন, তা অতীতের সব গণতান্ত্রিক রীতিকে ¤øান করে দিল। তিনি সরাসরিই বললেন, তিনি নির্বাচনে জিতেছিলেন ঠিকই; কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা সে বিজয় চুরি করে নিয়েছে। এর পক্ষে কোনো যুক্তি নেই, ব্যাখ্যা নেই-বলতে হবে, তাই যেন বলা। ট্রাম্প হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন, তিনি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট; তার প্রতিটি কথার প্রতিটি শব্দের প্রতি সারা বিশ্বের নজর থাকে। তিনি জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে আরেকটি নিন্দিত অধ্যায়ের সূচনা করলেন। নির্বাচন নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত ছিল না। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখেছেন; কিন্তু কোনো সত্যতা খুঁজে পাননি। তারপরও তিনি সাধারণ মানুষের রায়কে মেনে নিতে পারেননি। এ অপ্রিয় ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো এখানেই শেষ হলেও এক ধরনের স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু পর্যায়ক্রমে অঘটনগুলো ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ের দিকে পা বাড়াল।
৭ জানুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ঘটে গেল বুর্জোয়াদের দ্বারা নজিরবিহীন তান্ডব। সেদিন কংগ্রেস জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার জন্য বসেছিল। এরই মধ্যে ট্রাম্প সমর্থক উগ্র রিপাবলিকানরা হামলা চালায় ক্যাপিটল হিলে। সে হামলা কেবল বাইরে থেকেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শত শত বিক্ষোভকারী বিনা বাধায় ঢুকে পড়ে কংগ্রেস হাউজে। তারা ভবনটি শুধু ভাংচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং একজন বিক্ষোভকারী স্পিকারকে হটিয়ে তার চেয়ারে বসে সেলফিও তুলেছে। মোদ্দা কথা, ট্রাম্প সমর্থক দ্বারা পুরো ক্যাপিটল হিল অরক্ষিত ও অসহায় হয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন এবং ৫২ জন গ্রেফতার হন। সারা বিশ্ব এতে হতবাক হয়ে পড়ে। এর তীব্রতা আরও বেড়ে যায়, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলাকারীদের ‘মহান দেশপ্রেমিক’ বলে আখ্যা দেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন ওই এলাকায় ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়। আমরা জানি, ক্ষমতার নেশা একটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে, তবে উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করতেই হবে। ট্রাম্পের উসকানির মাত্রা এতটাই তীব্রতর হয়, আমেরিকান জনগণের শান্তিশৃঙ্খলার স্বার্থে টুইটার ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তার নিজস্ব অ্যাকাউন্ট বাতিল করতে বাধ্য হয়। এমন উগ্রতা অন্য কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের কথায় কিংবা আচরণে পাওয়া যাবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন না।
ক্যাপিটল হিলের এ তান্ডবকে কেউ কেউ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হালকা করে দেখছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘ চার বছর ধরে ট্রাম্পের যে ‘হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি’র প্রচারণা ও চর্চা, এটি তারই চূড়ান্ত পরিণতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই আমেরিকান নাগরিকদের বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকান্ডের পর যখন সারা আমেরিকা ‘বø্যাক লাইভস ম্যাটার’ ব্যানারে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, তখনও ট্রাম্প অনেকটাই ¤্রয়িমাণ ছিলেন। তার অনুসারীরাও অব্যক্ত বাসনাকে লালন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন। দীর্ঘ চার বছরের সেই অগণতান্ত্রিক, বর্ণবাদী রাজনীতির ফলই হলো ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ। এখানে মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প সেদিন টুইটারে আপত্তিকর ও উসকানিমূলক বার্তা দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু বিক্ষোভকারীদের মনে উগ্রতার বীজ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকেই বপন করা ছিল। ৭ জানুয়ারী তার সফল প্রতিফলন ঘটেছে মাত্র। এ ন্যক্কারজনক ঘটনাকে ট্রাম্পের অনেক ঘনিষ্ঠ সহযোগীও মেনে নিতে পারেননি। ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনার পর এ পর্যন্ত তিনজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ পদত্যাগকারী হলেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শাদ উলফ। এ দপ্তরটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তারা বর্তমান ও সাবেক প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। তাছাড়া নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বও এ বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বরাতও ভালো যায়নি। তার এ অপকর্মের জন্য তিনি প্রতিনিধি পরিষদে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হয়েছেন। এটি কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টের একই মেয়াদে দু’বার অভিশংসিত হওয়ার প্রথম ঘটনা। ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ন্যান্সি পেলোসির নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি পরিষদ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাধাদানের তদন্তে নামে। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদ ট্রাম্পকে অভিশংসিত করে সিনেটে পাঠায়। সিনেট যেহেতু রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তারা ২০২০ সালে ৫ ফেব্রæয়ারী ট্রাম্পকে খালাস দিয়ে দেয়। ক্যাপিটল ভবনে হামলা ও পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসন প্রস্তাব পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। এর ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার কথা ছিল ১৯ জানুয়ারী, জো বাইডেনের শপথ গ্রহণের আগের দিন। সিনেটের বিদায়ি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা রিপাবলিকান পার্টির মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, প্রস্তাাবটি ২০ জানুয়ারীর পর বিবেচিত হবে। ২০ তারিখের পর যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হবেন-ডেমোক্র্যাট চাক শুমার, তিনি বলেছেন, আজ হোক কাল হোক, বিচার হবেই। সারা বিশ্বের মানুষ মনে করেন, এ অপকর্মের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার হওয়া উচিত।
বিশ্বের এখন প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হয়। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সাধারণ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক; কিন্তু একমাত্র নির্ণায়ক নয়। গণতান্ত্রিক রীতি চালু ও সচল রাখতে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে হয়। তা না হলে যে কোনো সময়, যে কারও খেয়ালে সমগ্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ক্যাপিটল হিলে যা-ই ঘটুক না কেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে না। কেননা সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক আবহে তৈরি করা হয়েছে, যা অনেক দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় নেই। ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর কোনো কোনো রাজ্যে ভোট পুনরায় গণনার দাবি করেন। তার দাবিমতে সেসব রাজ্যে পুনরায় ভোট গণনা করা হয় এবং নির্ভুল হওয়ায় ফলাফলের পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এতে ট্রাম্পের করার কিছুই ছিল না, কারণ নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যে কোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত। সেই সঙ্গে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সংস্থার ওপরও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ ছিল না। তাই ট্রাম্প শত অগণতান্ত্রিক হয়েও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে টলাতে পারেননি। তবে যদি তা কোনো ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক দেশ হতো, তাহলে ক্ষমতাসীন শাসকের কথাই হতো শেষ কথা। এ কারণে যে কোনো দেশেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে করে কোনো একক ব্যক্তির স্বেচ্ছাকামনা বাস্তবায়িত না হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
(দৈনিক যুগান্তর)