নিউইয়র্ক ০১:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

চতুর্দিকে কেবলই ভয়

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:০৭:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০
  • / ১৭১ বার পঠিত

মরহুম কাজী কে ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মোহাম্মদ সাঈদুল হক নিপু: নিউইয়র্ক শহরের কুইন্স বরোর অন্তর্গত জ্যামাইকাতে অমি আজ প্রায় এক মাস হল নিজ গৃহে বন্দী। যেখানে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা পৃথিবীর যে কোন অংশের চেয়ে বেশী। শুধু আমি কেন এই গৃহের সবাই আমরা কম-বেশি বিভিন্ন মেয়াদে গৃহবন্দী। এখন পর্যন্ত সবাই আমরা ছিলাম বৈশ্বিক মহামারীর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আর সীমাহীন উৎকন্ঠার মধ্যে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সাথে এসে যোগ হচ্ছে আরেক নতুন অনুভূতি যার নাম ‘ভয়’।
ভয় বা আতংকের বিস্তারটা চুড়ান্তভাবে শুরু হয়েছে, যখন জানা গেল হাপাতালে স্থান সংকুলান নেই। অসুস্থ হলে ৯১১-এ কল দিয়েও লাভ নেই, কেননা ঊগঝ (ঊসবৎমবহপু গবফরপধষ ঝবৎারপবং) আসবে কিন্তু ‘আপনি যথেষ্ট অসুস্থ নন’ বলে হাসপাতালে না নিয়েই চলে যাবে। মনে হবে যেন যমরাজের অপেক্ষায় আছেন, তিনি ধাওয়া না করা পর্যন্ত আপনি হাপাতালে যাবার যোগ্য বিবেচিত হবেন না!
আর কেউ যদি চিৎকার চেচামেচি করে হাসপাতাল নামক যমপুরিতে পৌঁছার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য অর্জন করেন, তবে তো আর কথাই নেই, মৃত্যু আপনার অনিবার্য। কেননা অবস্থা ভেদে চার থেকে বার ঘন্টা পর্যন্ত হাসপাতালের যে অংশে আপনাকে রাখা হবে, আপনি যদি ‘কভিট-১৯’ এ আক্রান্ত নাও হন নিশ্চিত জানবেন সেখানে থেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন এবং পরিণতি আপনার অজানা নঢ। এতএব হাসপাতাল গমন নাস্তি।
হাসপাতালে গিয়ে মরলে (অবধারিত) আসবে আরেক পরিস্থিতি, ফিউনারেল হোমের নির্বাচন, সিরিয়াল ও ফরমালিটিস, কবরের জায়গা জোগাড়, গোসল ও কাফনের সিডিউল, লাশ দেখতে (ড়হষরহব ৎবসড়ঃব ধপপবংং ারধ ফবফরপধঃবফ ষরহশ ঢ়ৎড়ারফবফ নু ঃযব ঋবঁহধৎবষ ঐড়সব) দেবে কিনা, দিলেও কবে, কখন ও কতক্ষণের জন্য। এ পর্যায়ে আসবে ফিউনারেল হোমের মোটা দক্ষিণা আদায়ের পালা, জানাযাতেও আপনাকে যেতে দেবেনা ওরাই (ফিউনারেল হোম) নাম মাত্র জানাযা দেবে কি, দেবেনা তাদের কথাই আপনার বিশ্বাস করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আর যদি আপনি নিজ বাসায় দেহত্যাগ করেন তবে আপনার পরিবারকে আরো কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা শবদেহ নেবার মত দ্রæততম কোন ব্যবস্থা বর্তমানে এ শহরে নেই। ফিউনারেল হোমগুলো হাসপাতালের উপচেপড়া লাশ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। তাই যারা নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করে তাদের লাশ অবস্থাভেদে ২/৩ দিন নিজ বাসায় বিশেষ ব্যবস্থায় রাখতে হয়। কী নির্মম, কী নির্মম, পাশের ঘরে বাক্সবন্দী প্রিয়জনের লাশ রেখে একই ছাদের নিচে কয়েকদিন অনিশ্চিত বসবাস কতটা রোমহর্ষক তা একটিবার ভেবে দেখুন। কারো কারো ক্ষেত্রে চিত্রটি আরো নির্মম। প্রিয়জনের লাশ নিজ হাতে ঘর থেকে বের করে ফিউনারেল হোমের গাড়িতে উঠিয়ে দেবার মত ঘটনাও ঘটেছে এই শহরে। কেননা তাদের জনবল সীমিত আর মৃতের সংখ্যা কল্পনাতীত।
শুরু করেছিলাম ভয় দিয়ে, বিশ্বাস করুন, যখন বাস্তবে এরূপ মৃত্যু সামাল দিতে হয় তা আরো বহুগুন ভয়াবহ। করোনা ভাইরাসে যে গেল, সে ত চলেই গেল কিন্তু যাদেরকে সংক্রামিত করে রেখে গেল, তাদেরকে সামলায় কে? আত্মীয় পরিজন কেউ কাছে যেতে চায়না নিজে সংক্রমিত হবার ভয়ে। প্রিয়জন হারানোর শোক সাথে ভাইরাসের ছোবল সে এমনি এক ভয়াবহ অবস্থা যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় যারা পারেন তাদের সম্বল একমাত্র মনোবল, যে আমাকে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হবে আমার সন্তানদের জন্য। আমার কিছু হলে আমার সন্তানদের কে লালন পালন করবে?
এরূপ মনোবলের অধিকারি আমার ছোটবোন ঝুমা। সে কি অসীম প্রাণশক্তি আর সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে কায়কোবাদের মৃত্যুর পর থেকে আজ প্রায় ২৫ দিন যাবত করোনা ভায়রাসের প্রতিটি লক্ষণের সাথে যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে মৃত্যু উপত্যকা পার হতে শুরু করেছে। সে কি নির্মম দৃশ্য, ছোট্ট এক বাসায় দুটো সদ্য পিতৃহারা নাবালক সন্তান দুই ঘরে আর মা নিজে লিভিং রুমে কোয়রেন্টাইনে। বাবা হারানোর শোকে পাগলপ্রায় শিশু দুটোর গগণ বিদারী আর্তনাদ আর অপর দিকে সদ্য স্বামী হারানোর শোক ও করোনার উপস্বর্গে জর্জরিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় মা, সে না পারছে কলিজার টুকরো সন্তান দুটোকে বুকে জড়িয়ে শান্তনা দিতে, না পারছে সহ্য করতে। না পারছে স্বামী হারানোর শোক ভুলে ভাইরাস জনিত অসুস্থতার সাথে বেঁচে থাকার চিকিৎসাহীন অসম যুদ্ধে লিপ্ত হতে। সে যে কী ভয়াবহ যুদ্ধ তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি তাদের সাথে সর্বক্ষণ ফোনে ফোনে থেকে তাদের মনোবল বাড়াতে গিয়ে। প্রতিনিয়ত একই আকুতি আমার ছোট বোনের। আমি কি বাঁচব? আমি বাঁচতে চাই। আমার সন্তান দুটোকে বাঁচাতে চাই। কায়কোবাদ গেছে, আমার কিছু হলে আমার বাচ্চাদের কি হবে? ওরা বাঁচবে কিভাবে, কাকে নিয়ে?
পাঠক যদি এ পর্যন্ত পাঠ করে থাকুন তবে আমার অবস্থাটা একটিবারের জন্য ভাবুন। একদিকে সদ্য স্বামী হারা ছোট বোনের প্রাণে বাঁচার করুণ আকুতি। অপরদিকে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়ে ও আমার স্ত্রী-সন্তানদের পাহাড়ার (যাতে বাইরে না যাই, কেননা তারা চান তাদের জন্য আমি বেঁচে থাকি) কারণে আমার নিষ্ঠুর নিষ্ক্রিয়তা এযে কতটা দম বন্ধকর ও অপরাধপ্রবণ অনুভূতি তা বলার ভাষা আমার নেই।
বর্তমান সময়টা কি নির্মম নিষ্ঠুর পাশের গলিতে থেকেও আমার বোনের মৃত স্বামীর জানাযা ও দাফনের সময় কবরস্থানে যেতে পারিনি মৃত্যুবাহী অদৃশ্য ঘাতকের ভয়ে। পারিনি বোন ও তার এতিম সন্তানদের কাছে টেনে শান্তনার অভয়বানী শোনাতে। শুধুমাত্র ফোনের মাধ্যমে মনোবল বাড়ানোর “ডোজ” যতটা সম্ভব দেবার হঠকারী প্রচেষ্টা চালিয়েছি প্রতি ঘন্টা, প্রতিদিন।
শুধু ভয় আর ভয় চতুর্দিকে কেবলই ভয়। করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ভয়, ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়, বেঁচে থাকার ভয়, মরে যাবার ভয়, স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভয়, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-বন্ধুর জন্য ভয়, কর্মসংস্থানের ভয়, খাদ্য সংস্থানের ভয়, সমাজ সংসার ও তার পরিবেশের জন্য ভয়। পৃথিবী তার আগের আবেশে ফিরে যাবে কিনা তার ভয়। মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কিনা সেই ভয়।
এতসব ভয়ের সাথে আরেকটি প্রয়োাজনীয় ভয়ের কথা আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তা হল আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের ভয়। আসুন আমরা সবাই সকল ভয়কে জয় করে একমাত্র তার কাছে ভীত হই। একমাত্র সে-ই মহান রব, যে পারে আমাদেরকে ভাইরাস মুক্ত পৃথিবীতে নতুন জীবন দান করতে।

মোহাম্মদ সাঈদুল হক নিপু , ব্যবসায়ী
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

চতুর্দিকে কেবলই ভয়

প্রকাশের সময় : ১১:০৭:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০

মরহুম কাজী কে ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মোহাম্মদ সাঈদুল হক নিপু: নিউইয়র্ক শহরের কুইন্স বরোর অন্তর্গত জ্যামাইকাতে অমি আজ প্রায় এক মাস হল নিজ গৃহে বন্দী। যেখানে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা পৃথিবীর যে কোন অংশের চেয়ে বেশী। শুধু আমি কেন এই গৃহের সবাই আমরা কম-বেশি বিভিন্ন মেয়াদে গৃহবন্দী। এখন পর্যন্ত সবাই আমরা ছিলাম বৈশ্বিক মহামারীর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আর সীমাহীন উৎকন্ঠার মধ্যে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সাথে এসে যোগ হচ্ছে আরেক নতুন অনুভূতি যার নাম ‘ভয়’।
ভয় বা আতংকের বিস্তারটা চুড়ান্তভাবে শুরু হয়েছে, যখন জানা গেল হাপাতালে স্থান সংকুলান নেই। অসুস্থ হলে ৯১১-এ কল দিয়েও লাভ নেই, কেননা ঊগঝ (ঊসবৎমবহপু গবফরপধষ ঝবৎারপবং) আসবে কিন্তু ‘আপনি যথেষ্ট অসুস্থ নন’ বলে হাসপাতালে না নিয়েই চলে যাবে। মনে হবে যেন যমরাজের অপেক্ষায় আছেন, তিনি ধাওয়া না করা পর্যন্ত আপনি হাপাতালে যাবার যোগ্য বিবেচিত হবেন না!
আর কেউ যদি চিৎকার চেচামেচি করে হাসপাতাল নামক যমপুরিতে পৌঁছার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য অর্জন করেন, তবে তো আর কথাই নেই, মৃত্যু আপনার অনিবার্য। কেননা অবস্থা ভেদে চার থেকে বার ঘন্টা পর্যন্ত হাসপাতালের যে অংশে আপনাকে রাখা হবে, আপনি যদি ‘কভিট-১৯’ এ আক্রান্ত নাও হন নিশ্চিত জানবেন সেখানে থেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন এবং পরিণতি আপনার অজানা নঢ। এতএব হাসপাতাল গমন নাস্তি।
হাসপাতালে গিয়ে মরলে (অবধারিত) আসবে আরেক পরিস্থিতি, ফিউনারেল হোমের নির্বাচন, সিরিয়াল ও ফরমালিটিস, কবরের জায়গা জোগাড়, গোসল ও কাফনের সিডিউল, লাশ দেখতে (ড়হষরহব ৎবসড়ঃব ধপপবংং ারধ ফবফরপধঃবফ ষরহশ ঢ়ৎড়ারফবফ নু ঃযব ঋবঁহধৎবষ ঐড়সব) দেবে কিনা, দিলেও কবে, কখন ও কতক্ষণের জন্য। এ পর্যায়ে আসবে ফিউনারেল হোমের মোটা দক্ষিণা আদায়ের পালা, জানাযাতেও আপনাকে যেতে দেবেনা ওরাই (ফিউনারেল হোম) নাম মাত্র জানাযা দেবে কি, দেবেনা তাদের কথাই আপনার বিশ্বাস করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আর যদি আপনি নিজ বাসায় দেহত্যাগ করেন তবে আপনার পরিবারকে আরো কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা শবদেহ নেবার মত দ্রæততম কোন ব্যবস্থা বর্তমানে এ শহরে নেই। ফিউনারেল হোমগুলো হাসপাতালের উপচেপড়া লাশ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। তাই যারা নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করে তাদের লাশ অবস্থাভেদে ২/৩ দিন নিজ বাসায় বিশেষ ব্যবস্থায় রাখতে হয়। কী নির্মম, কী নির্মম, পাশের ঘরে বাক্সবন্দী প্রিয়জনের লাশ রেখে একই ছাদের নিচে কয়েকদিন অনিশ্চিত বসবাস কতটা রোমহর্ষক তা একটিবার ভেবে দেখুন। কারো কারো ক্ষেত্রে চিত্রটি আরো নির্মম। প্রিয়জনের লাশ নিজ হাতে ঘর থেকে বের করে ফিউনারেল হোমের গাড়িতে উঠিয়ে দেবার মত ঘটনাও ঘটেছে এই শহরে। কেননা তাদের জনবল সীমিত আর মৃতের সংখ্যা কল্পনাতীত।
শুরু করেছিলাম ভয় দিয়ে, বিশ্বাস করুন, যখন বাস্তবে এরূপ মৃত্যু সামাল দিতে হয় তা আরো বহুগুন ভয়াবহ। করোনা ভাইরাসে যে গেল, সে ত চলেই গেল কিন্তু যাদেরকে সংক্রামিত করে রেখে গেল, তাদেরকে সামলায় কে? আত্মীয় পরিজন কেউ কাছে যেতে চায়না নিজে সংক্রমিত হবার ভয়ে। প্রিয়জন হারানোর শোক সাথে ভাইরাসের ছোবল সে এমনি এক ভয়াবহ অবস্থা যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় যারা পারেন তাদের সম্বল একমাত্র মনোবল, যে আমাকে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হবে আমার সন্তানদের জন্য। আমার কিছু হলে আমার সন্তানদের কে লালন পালন করবে?
এরূপ মনোবলের অধিকারি আমার ছোটবোন ঝুমা। সে কি অসীম প্রাণশক্তি আর সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে কায়কোবাদের মৃত্যুর পর থেকে আজ প্রায় ২৫ দিন যাবত করোনা ভায়রাসের প্রতিটি লক্ষণের সাথে যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে মৃত্যু উপত্যকা পার হতে শুরু করেছে। সে কি নির্মম দৃশ্য, ছোট্ট এক বাসায় দুটো সদ্য পিতৃহারা নাবালক সন্তান দুই ঘরে আর মা নিজে লিভিং রুমে কোয়রেন্টাইনে। বাবা হারানোর শোকে পাগলপ্রায় শিশু দুটোর গগণ বিদারী আর্তনাদ আর অপর দিকে সদ্য স্বামী হারানোর শোক ও করোনার উপস্বর্গে জর্জরিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় মা, সে না পারছে কলিজার টুকরো সন্তান দুটোকে বুকে জড়িয়ে শান্তনা দিতে, না পারছে সহ্য করতে। না পারছে স্বামী হারানোর শোক ভুলে ভাইরাস জনিত অসুস্থতার সাথে বেঁচে থাকার চিকিৎসাহীন অসম যুদ্ধে লিপ্ত হতে। সে যে কী ভয়াবহ যুদ্ধ তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি তাদের সাথে সর্বক্ষণ ফোনে ফোনে থেকে তাদের মনোবল বাড়াতে গিয়ে। প্রতিনিয়ত একই আকুতি আমার ছোট বোনের। আমি কি বাঁচব? আমি বাঁচতে চাই। আমার সন্তান দুটোকে বাঁচাতে চাই। কায়কোবাদ গেছে, আমার কিছু হলে আমার বাচ্চাদের কি হবে? ওরা বাঁচবে কিভাবে, কাকে নিয়ে?
পাঠক যদি এ পর্যন্ত পাঠ করে থাকুন তবে আমার অবস্থাটা একটিবারের জন্য ভাবুন। একদিকে সদ্য স্বামী হারা ছোট বোনের প্রাণে বাঁচার করুণ আকুতি। অপরদিকে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়ে ও আমার স্ত্রী-সন্তানদের পাহাড়ার (যাতে বাইরে না যাই, কেননা তারা চান তাদের জন্য আমি বেঁচে থাকি) কারণে আমার নিষ্ঠুর নিষ্ক্রিয়তা এযে কতটা দম বন্ধকর ও অপরাধপ্রবণ অনুভূতি তা বলার ভাষা আমার নেই।
বর্তমান সময়টা কি নির্মম নিষ্ঠুর পাশের গলিতে থেকেও আমার বোনের মৃত স্বামীর জানাযা ও দাফনের সময় কবরস্থানে যেতে পারিনি মৃত্যুবাহী অদৃশ্য ঘাতকের ভয়ে। পারিনি বোন ও তার এতিম সন্তানদের কাছে টেনে শান্তনার অভয়বানী শোনাতে। শুধুমাত্র ফোনের মাধ্যমে মনোবল বাড়ানোর “ডোজ” যতটা সম্ভব দেবার হঠকারী প্রচেষ্টা চালিয়েছি প্রতি ঘন্টা, প্রতিদিন।
শুধু ভয় আর ভয় চতুর্দিকে কেবলই ভয়। করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ভয়, ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়, বেঁচে থাকার ভয়, মরে যাবার ভয়, স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভয়, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-বন্ধুর জন্য ভয়, কর্মসংস্থানের ভয়, খাদ্য সংস্থানের ভয়, সমাজ সংসার ও তার পরিবেশের জন্য ভয়। পৃথিবী তার আগের আবেশে ফিরে যাবে কিনা তার ভয়। মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কিনা সেই ভয়।
এতসব ভয়ের সাথে আরেকটি প্রয়োাজনীয় ভয়ের কথা আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তা হল আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের ভয়। আসুন আমরা সবাই সকল ভয়কে জয় করে একমাত্র তার কাছে ভীত হই। একমাত্র সে-ই মহান রব, যে পারে আমাদেরকে ভাইরাস মুক্ত পৃথিবীতে নতুন জীবন দান করতে।

মোহাম্মদ সাঈদুল হক নিপু , ব্যবসায়ী
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক।