নিউইয়র্ক ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কার বিজয়, জয়ীদের না পরাজিতদের

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৫৮:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ৪২ বার পঠিত

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: বাংলাদেশের নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে ডিসেম্বর মাসের গুরুত্ব বহুবিধ।
এক অর্থে আমরা সেদিন এক দড়জা দিয়ে কুকুর তাড়িয়েছিলাম, আর আরেক দরজা দিয়ে শূয়ুর ঢুকিয়ে ছিলাম কিনা। যত দিন যাবে, এই সত্যটা হয়তো ততই বেশি বোঝা যাবে। এরকম একটা ভাবনার কথা বলেছিলেন জাতির এক শ্রেষ্ঠ নেতা। আজকে সেই কথাটা মনে হল।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম কিসের জন্য। কোন বিজয়-কে স্বপ্নে ধারণ করে লাখো শহীদের রক্তে লাল হযয়েছিল বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদীর পানি। আজকের বাংলাদেশে বিজযয় দিবসের (১৬ ডিসেম্বর) স্মরণে যদি আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাই, একটু যদি আত্মজিজ্ঞাসায় সচেতন হই। তাহলে এটা বলা কি ভুল হবে যে, আজকে বাংলাদেশে আমরা কাদের বিজয় দেখছি। যারা সেই যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল তাদের বিজয়, নাকি যারা সেই দিন বিজয় এনে দিয়েছিল তাদের বিজয়। এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতেও পারে। কিন্তু বাস্তবতায় ভিন্নমত, আজকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে তাদেরই বিজয় দেখেছি চারিদিকে, যারা সেদিন পরাজিত হয়েছিল। এটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে, এই সত্যকে অগগ্রাহ্য করা যেতে পারে। তাতে সত্যের কিছুই যায় আসবেনা। সত্য যেটা সেটা সত্য-ই থাকবে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই আমাদের চারদিকে ভিড় করেছে স্বাধীনতার বিভিন্ন পরাজিত শক্তি ভিন্নরূপে। ভিন্ন পোশাকে। কখনো বা নানা রকম মুখোশের আড়ালে আসল রূপ কে আড়াল করে। দেশ কিন্তু এভাবেই চলছে এখন পর্যন্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিক মর্যাদার রক্ষা। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জন-মানুষের মুক্তিকে সুনিশ্চিত করা। মোটাদাগে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বড়োা লক্ষ্য, আমাদের বিজয়ের স্বপ্ন।
আমরা পারিনি নানা প্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে, এবং ‘স্বেচ্ছাচারী’ চরিত্রে নিজেদের আগ্রাধিকারের স্বার্থের কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কে খুব বেশিদিন ধরে রাখতে। পারিনি সুরক্ষা দিতে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে গণতন্ত্রের শত্রæ ফ্যাসিবাদ, যেটা এখনো অব্যাহত। এই ফ্যাসিবাদকে কেউ বলেন, সময় নাকি বদলেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ ত বদলাইনি। ফ্যাসিবাদের পোশাক বদলেছে। সবকিছুর আগে দেশ বড়, অথবা দলের চেয়ে দেশ বড়। কথাগুলি এখনো ¯েøাগানে আছে।
বাস্তবে আছে কি? এখনতো সবকিছুর আগে দল-ই বড়।
তারপরে দলের নেতা বড়। এরপর যদি সময় থাকে তখন যদি দেশ নিয়ে ভাবা যায়। এটা এখনকার রাজনীতির সংস্কৃতি। শুধু রাজনীতিতে কেন বলবো। আমাদের অন্যান্য সংস্কৃতির মধ্যেও এই দাপট দুর্দান্ত।
এইসব বৈষম্যের মধ্যে অর্থনীতির অবস্থা যে কতটা ‘ছেড়াবেড়া’ হয়ে গেছে। যেকোনো সচেতন নাগরিক সেটা বোঝেন।
উইনস্টন চার্চিল একসময় বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি রহস্য ঘেরা প্রহেলিকা আচ্ছন্ন হেঁয়ালি। (A riddle wrapped in a mystery inside an enigma)। অবশ্য চার্চিল যখন এই মন্তব্যটা করেছেন তখন আজকের বাংলাদেশ এই রূপে ছিল না। বাংলাদেশে তখন ছিল ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের একটি অংশ। তবু চার্চিলের এই কথাটার একটা গভীর অর্থ এখনও আমরা খুঁজে পাই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে। চারিদিকে যে অনিয়ম, যে উদ্দেশ্য হীনতা, যে স্বার্থপরতা এবং কোন্দল, জিঘাংসা, খুন, গুম, হত্যা। দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছতা, মিথ্যাচারিতা, ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগিতা।
এটা আজকের বাংলাদেশের আরেকটি চেহারা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতেই পারে বাংলাদেশ উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় রহস্য ঘেরা এক প্রহেলিকা আচ্ছন্ন হেঁয়ালি। হেঁয়ালি-ই যদি না হয় তাহলে স্বাধীনতার অর্জনের পর পরই আমরা কেমন করে ভুলে গেলাম আমাদের নয় মাসের মাঠের যুদ্ধের অসাধারণ ত্যাগ এবং তিতিক্ষা আর ঐক্যের বন্ধন-কে। কি করে ভুলে গেলাম গণতন্ত্রের শপথকে, কিভাবে হয়ে গেলাম এক নেতা, এক দেশ, এক নেতার বাংলাদেশ। এরকম একটা রাজনৈতিক অসুস্থ মনস্তাত্তি¡ক চিন্তা দিয়ে সবকিছু দেখতে শুরু করলাম বা কিভাবে।
গণতন্ত্রকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমরা ধারণ করলাম উগ্র জাতীয়তাবাদ চিন্তাকে। এই জাতীয়তাবাদ চিন্তা আসলে কতটা আমাদের স্বাধীনতার পরে জররুরি ছিল আমরা সেটা হয়তো বিবেচনা করি নি। জাতীয়তাবাদ আমাদের জন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা হলেও সেই অভিজ্ঞতা যতটা না সুখের তার চেয়ে বেশি হয়েছে দুর্ভাগ্যের। যেমন হয়েছিল অথবা যেমনটা ঘটেছে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের ললাটে, হিটলারের এবং মুসোলিনির জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে, ইসরাইলের জাতীয়তাবাদী নিষ্ঠুরতায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত দেখি ঘর থেকে বের হয়ে লাশ হয়ে কবরে যেতে।
এইসব-ই ‘জাতীয়তাবাদের’ অভিজ্ঞতা।
জাতীয়তাবাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা বলতে গেলে সাম্প্রতিককালের তেমন কিছু নাই বলা যায়।
আমাদের স্বাধীনতার পরপরই আমরা গণতন্ত্রের চাইতেও বেশি রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম এক ধরনের উগ্র জাতীযয়তাবাদী চিন্তাকে। ফলাফল যা হবার হয়ে গেল। জাতি বিভক্ত হল। রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়লো। সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য জটিল হতে থাকলো। ইংরেজের শিক্ষা, ‘ডিভাইড এন্ড রুল’।
বিজয়ী হল। পরাজিত হলো কারা, যারা বিজয় এনে দিয়েছিল, তারা হেরে গেল পরাজিতদের নুতন ফ্যাসিজমের কাছে। পুরোন রাজাকার মিলে গেল নূতন রাজাকারদের সাথে। সমাজে শত্রæ-মিত্রের চেহারাও অভিন্ন হয়ে গেল।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে আমরা যদি আজও বিজয় বলে আনন্দ উৎসব করি, তাতে আপত্তি নেই। ভেতরের প্রশ্ন থেকেই যাবে, এই বিজয়, কার বিজয়।
আজকের বাংলাদেশে আমরা এত বেশি বিভক্ত হচ্ছি প্রতিদিন, এতে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে হুমকি বা চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জ এর প্রধান কারণ, দেশের উন্নতি? না তা অবশ্যই না। মূল কারণ ‘দল’ এবং ‘ক্ষমতার’ অস্তিত্বের জিঘাংসার লড়াইয়ে আমাদের স্বাধীনতা এবং এর বিজয় আজকে অসহায় এবং নিভৃতে কাঁদে।
আমরা দেশ বিক্রি করে দিতে পারি ‘প্রয়োজনে’ নিজের দল বা নেতার স্বার্থে। এটাকেই সুনিশ্চিত রাখা আমাদের আসল বিজয় এখন। এর নাম-ই আজকে দেশ প্রেম। বিপক্ষে হলে দেশদ্রোহী।
আর এই ‘দল’ এবং দলের ‘নেতারা’ পরাজিত শত্রæদের থেকে আদর্শিক চিন্তা এবং চরিত্রে কি অভিন্ন। অবশ্যই তা না। এই শ্রেনী স্বার্থের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছিল, যুদ্ধ ছিল। জীবন উৎসর্গ হয়েছে। সেই যুদ্ধের সৈনিকদের স্বপ্ন হেরে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির কাছে অন্যায়ভাবে এবং অন্যভাবেও।
বিগত পাঁচ দশক ধরে আমরা পারিনি আমাদের ভাষার দায়-দায়িত্ব নিতে, পারিনি আমরা আমাদের শিক্ষার সংস্কারের কাজে অগ্রসর হতে। পরিবর্তন আসেনি আমাদের আমলাতন্ত্রের। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমেনি প্রকৃত অর্থে। সমাজে নারীদের তেমন কোনো অবস্থার পরিবর্তন হয়নি কিছু কিছু লিপিস্টিক পরিবর্তনকে বাদ দিলে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কমেনি, ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের অন্যতম একটি আদর্শ বলার পরেও। বৃহত্তর ঐক্যের ওপর টানাপোড়েন ঘটেছে রোজ-ই বলা যায়। গণতন্ত্রের মুক্তি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে দুর্নীতি এবং দূঃশাসনে। কারো, কাছে উন্নতির স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু রাখা নাকি দরকার। এই দরকারটা আসলে অনৈতিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতা চালানোর স্বার্থে। নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে। সমাজের বিভক্তির স্বার্থে। কোন বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে না। তবে একেবারেই কি গত পাঁচ দশক দেশ অগ্রসর হয়নি। সেটা বলা কোনো অর্থেই ঠিক হবে না। অগ্রসর হয়েছে।
প্রযুক্তি পরিবর্তনের কারণে, মানুষের বাঁচার যুদ্ধে মানুষের প্রতিদিনের লড়াইয়ে, ব্যক্তির নিজেকে টিকিয়ে রাখার কারণে। উন্নতি হয়েছে সমাজে প্রভাবশালীদের, লুটেরাদের, সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণী কিছু জনগোষ্ঠীর। কিছু পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাটের। উৎপাদন সেটা শিল্প হোক কিংবা কৃষি। এই উন্নতির প্রধান ভোগী সমাজের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চশ্রেণীর জনগোষ্ঠী যতটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সে তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশে এক ধরনের গণতন্ত্র আছে, স্বৈরতন্ত্রের আড়ালে। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য, ক্ষমতা রক্ষার নাটকের স্বার্থে। ক্ষমতাই এখানে প্রধান কথা, ব্যক্তি প্রধান ও শেষ চিন্তা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই আমরা দেখে আসছি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার এবং দলের শাসনামলের এটা একটা অভিন্ন চরিত্র।
আমাদের বিজয় দিবসের স্বপ্ন প্রতিদিন একটু একটু করে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাচ্ছে। রাজনীতিতে বিদেশি মুরুব্বীদের আধিপত্য বাড়ছে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনেকটাই মুরুব্বী- মক্কেল সম্পর্কে (Patron- client relationship) দিকেই বেশি অগ্রসর হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে আইন শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, পরমত শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। বিগত পঞ্চাশ বছর এসব দিকে আমাদের বিজয় পরাজিত হয়েছে একাত্তরের পরাজিত শ্রেণী শক্তির কাছে।
গণতন্ত্র আমাদের শুরুতে ও ছিল না, এখনো নাই। জনতন্ত্র আছে, দলতন্ত্র আছে। ব্যক্তিতন্ত্র আছে। নেই শুধু গণতন্ত্র। ভয়ের শাসন আছে, ভয়ের সংস্কৃতি আছে। নির্বাচন এখন শুধু নামে আছে। নির্বাচন নিয়ে ডিজিটাল চুরি, সাগর চুরি। এটা বাংলাদেশে ৯০ দশকের পরের ‘সিভিল পলিটিক্সের’ আরেক রূপ।
মোটা দাগে বিগত পাঁচ দশকে আমাদের এই অর্জন গুলিকেও একেবারে হালকা করে দেখবার অবকাশ কম। তাই আজকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মন বলে আমরা আজকে পরাজিত আমাদের একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেণী শত্রæর কাছে। এই শ্রেণী শত্রæদের দখলে বা কব্জায় আমাদের পপ্রকৃত বিজয় যা এখন অর্জিত হনি।
যে কারণে ঘটা করে বিজয় দিবসের বিজয় উৎসব পালিত হয়, কারা পালন করেন। ক্ষমতাসীন সরকার এবং দল। কোটি, কোটি বিজয়ী মানুষ পরাজিতদের মত ভিড় করে দেখে যারা ওদের বিজয়কে কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের একদল ফ্যাসিস্টদের হাতে। কার বিজয় বলব এটা কে। এই আনন্দ কাদের। যারা বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের খুনি এবং অপরাধীদের দোসর হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন শুধু নিজেদের প্রয়োজনে। ক্ষমতার কারণে এবং মূলত ক্ষমতার স্বার্থে।
আজকে আমাদের সবার আগে প্রয়োজন গণতন্ত্রকে সমাজ ও রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল অন্যসব জাতীয় লক্ষ্যগুলো আপনাতেই শত্রæ মুক্ত হবে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটবে। তখনই বলা যাবে ‘বিজয়’ দেখেছি। তা না হলে, প্রতিবছর বিজয় দিবসে সমাজ এবং রাষ্ট্রে আমরা বারবার পরাজিতদের দেখতেই থাকবো ওদের বিজয় উল্লাসে।
লেখক: লেখক, সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষক
০৮ ডিসেম্বর ২০২০
নিউইয়র্ক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

কার বিজয়, জয়ীদের না পরাজিতদের

প্রকাশের সময় : ১১:৫৮:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: বাংলাদেশের নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে ডিসেম্বর মাসের গুরুত্ব বহুবিধ।
এক অর্থে আমরা সেদিন এক দড়জা দিয়ে কুকুর তাড়িয়েছিলাম, আর আরেক দরজা দিয়ে শূয়ুর ঢুকিয়ে ছিলাম কিনা। যত দিন যাবে, এই সত্যটা হয়তো ততই বেশি বোঝা যাবে। এরকম একটা ভাবনার কথা বলেছিলেন জাতির এক শ্রেষ্ঠ নেতা। আজকে সেই কথাটা মনে হল।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম কিসের জন্য। কোন বিজয়-কে স্বপ্নে ধারণ করে লাখো শহীদের রক্তে লাল হযয়েছিল বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদীর পানি। আজকের বাংলাদেশে বিজযয় দিবসের (১৬ ডিসেম্বর) স্মরণে যদি আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাই, একটু যদি আত্মজিজ্ঞাসায় সচেতন হই। তাহলে এটা বলা কি ভুল হবে যে, আজকে বাংলাদেশে আমরা কাদের বিজয় দেখছি। যারা সেই যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল তাদের বিজয়, নাকি যারা সেই দিন বিজয় এনে দিয়েছিল তাদের বিজয়। এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতেও পারে। কিন্তু বাস্তবতায় ভিন্নমত, আজকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে তাদেরই বিজয় দেখেছি চারিদিকে, যারা সেদিন পরাজিত হয়েছিল। এটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে, এই সত্যকে অগগ্রাহ্য করা যেতে পারে। তাতে সত্যের কিছুই যায় আসবেনা। সত্য যেটা সেটা সত্য-ই থাকবে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই আমাদের চারদিকে ভিড় করেছে স্বাধীনতার বিভিন্ন পরাজিত শক্তি ভিন্নরূপে। ভিন্ন পোশাকে। কখনো বা নানা রকম মুখোশের আড়ালে আসল রূপ কে আড়াল করে। দেশ কিন্তু এভাবেই চলছে এখন পর্যন্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিক মর্যাদার রক্ষা। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জন-মানুষের মুক্তিকে সুনিশ্চিত করা। মোটাদাগে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বড়োা লক্ষ্য, আমাদের বিজয়ের স্বপ্ন।
আমরা পারিনি নানা প্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে, এবং ‘স্বেচ্ছাচারী’ চরিত্রে নিজেদের আগ্রাধিকারের স্বার্থের কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কে খুব বেশিদিন ধরে রাখতে। পারিনি সুরক্ষা দিতে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে গণতন্ত্রের শত্রæ ফ্যাসিবাদ, যেটা এখনো অব্যাহত। এই ফ্যাসিবাদকে কেউ বলেন, সময় নাকি বদলেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ ত বদলাইনি। ফ্যাসিবাদের পোশাক বদলেছে। সবকিছুর আগে দেশ বড়, অথবা দলের চেয়ে দেশ বড়। কথাগুলি এখনো ¯েøাগানে আছে।
বাস্তবে আছে কি? এখনতো সবকিছুর আগে দল-ই বড়।
তারপরে দলের নেতা বড়। এরপর যদি সময় থাকে তখন যদি দেশ নিয়ে ভাবা যায়। এটা এখনকার রাজনীতির সংস্কৃতি। শুধু রাজনীতিতে কেন বলবো। আমাদের অন্যান্য সংস্কৃতির মধ্যেও এই দাপট দুর্দান্ত।
এইসব বৈষম্যের মধ্যে অর্থনীতির অবস্থা যে কতটা ‘ছেড়াবেড়া’ হয়ে গেছে। যেকোনো সচেতন নাগরিক সেটা বোঝেন।
উইনস্টন চার্চিল একসময় বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি রহস্য ঘেরা প্রহেলিকা আচ্ছন্ন হেঁয়ালি। (A riddle wrapped in a mystery inside an enigma)। অবশ্য চার্চিল যখন এই মন্তব্যটা করেছেন তখন আজকের বাংলাদেশ এই রূপে ছিল না। বাংলাদেশে তখন ছিল ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের একটি অংশ। তবু চার্চিলের এই কথাটার একটা গভীর অর্থ এখনও আমরা খুঁজে পাই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে। চারিদিকে যে অনিয়ম, যে উদ্দেশ্য হীনতা, যে স্বার্থপরতা এবং কোন্দল, জিঘাংসা, খুন, গুম, হত্যা। দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছতা, মিথ্যাচারিতা, ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগিতা।
এটা আজকের বাংলাদেশের আরেকটি চেহারা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতেই পারে বাংলাদেশ উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় রহস্য ঘেরা এক প্রহেলিকা আচ্ছন্ন হেঁয়ালি। হেঁয়ালি-ই যদি না হয় তাহলে স্বাধীনতার অর্জনের পর পরই আমরা কেমন করে ভুলে গেলাম আমাদের নয় মাসের মাঠের যুদ্ধের অসাধারণ ত্যাগ এবং তিতিক্ষা আর ঐক্যের বন্ধন-কে। কি করে ভুলে গেলাম গণতন্ত্রের শপথকে, কিভাবে হয়ে গেলাম এক নেতা, এক দেশ, এক নেতার বাংলাদেশ। এরকম একটা রাজনৈতিক অসুস্থ মনস্তাত্তি¡ক চিন্তা দিয়ে সবকিছু দেখতে শুরু করলাম বা কিভাবে।
গণতন্ত্রকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমরা ধারণ করলাম উগ্র জাতীয়তাবাদ চিন্তাকে। এই জাতীয়তাবাদ চিন্তা আসলে কতটা আমাদের স্বাধীনতার পরে জররুরি ছিল আমরা সেটা হয়তো বিবেচনা করি নি। জাতীয়তাবাদ আমাদের জন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা হলেও সেই অভিজ্ঞতা যতটা না সুখের তার চেয়ে বেশি হয়েছে দুর্ভাগ্যের। যেমন হয়েছিল অথবা যেমনটা ঘটেছে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের ললাটে, হিটলারের এবং মুসোলিনির জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে, ইসরাইলের জাতীয়তাবাদী নিষ্ঠুরতায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত দেখি ঘর থেকে বের হয়ে লাশ হয়ে কবরে যেতে।
এইসব-ই ‘জাতীয়তাবাদের’ অভিজ্ঞতা।
জাতীয়তাবাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা বলতে গেলে সাম্প্রতিককালের তেমন কিছু নাই বলা যায়।
আমাদের স্বাধীনতার পরপরই আমরা গণতন্ত্রের চাইতেও বেশি রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম এক ধরনের উগ্র জাতীযয়তাবাদী চিন্তাকে। ফলাফল যা হবার হয়ে গেল। জাতি বিভক্ত হল। রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়লো। সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য জটিল হতে থাকলো। ইংরেজের শিক্ষা, ‘ডিভাইড এন্ড রুল’।
বিজয়ী হল। পরাজিত হলো কারা, যারা বিজয় এনে দিয়েছিল, তারা হেরে গেল পরাজিতদের নুতন ফ্যাসিজমের কাছে। পুরোন রাজাকার মিলে গেল নূতন রাজাকারদের সাথে। সমাজে শত্রæ-মিত্রের চেহারাও অভিন্ন হয়ে গেল।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে আমরা যদি আজও বিজয় বলে আনন্দ উৎসব করি, তাতে আপত্তি নেই। ভেতরের প্রশ্ন থেকেই যাবে, এই বিজয়, কার বিজয়।
আজকের বাংলাদেশে আমরা এত বেশি বিভক্ত হচ্ছি প্রতিদিন, এতে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে হুমকি বা চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জ এর প্রধান কারণ, দেশের উন্নতি? না তা অবশ্যই না। মূল কারণ ‘দল’ এবং ‘ক্ষমতার’ অস্তিত্বের জিঘাংসার লড়াইয়ে আমাদের স্বাধীনতা এবং এর বিজয় আজকে অসহায় এবং নিভৃতে কাঁদে।
আমরা দেশ বিক্রি করে দিতে পারি ‘প্রয়োজনে’ নিজের দল বা নেতার স্বার্থে। এটাকেই সুনিশ্চিত রাখা আমাদের আসল বিজয় এখন। এর নাম-ই আজকে দেশ প্রেম। বিপক্ষে হলে দেশদ্রোহী।
আর এই ‘দল’ এবং দলের ‘নেতারা’ পরাজিত শত্রæদের থেকে আদর্শিক চিন্তা এবং চরিত্রে কি অভিন্ন। অবশ্যই তা না। এই শ্রেনী স্বার্থের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছিল, যুদ্ধ ছিল। জীবন উৎসর্গ হয়েছে। সেই যুদ্ধের সৈনিকদের স্বপ্ন হেরে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির কাছে অন্যায়ভাবে এবং অন্যভাবেও।
বিগত পাঁচ দশক ধরে আমরা পারিনি আমাদের ভাষার দায়-দায়িত্ব নিতে, পারিনি আমরা আমাদের শিক্ষার সংস্কারের কাজে অগ্রসর হতে। পরিবর্তন আসেনি আমাদের আমলাতন্ত্রের। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমেনি প্রকৃত অর্থে। সমাজে নারীদের তেমন কোনো অবস্থার পরিবর্তন হয়নি কিছু কিছু লিপিস্টিক পরিবর্তনকে বাদ দিলে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কমেনি, ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের অন্যতম একটি আদর্শ বলার পরেও। বৃহত্তর ঐক্যের ওপর টানাপোড়েন ঘটেছে রোজ-ই বলা যায়। গণতন্ত্রের মুক্তি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে দুর্নীতি এবং দূঃশাসনে। কারো, কাছে উন্নতির স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু রাখা নাকি দরকার। এই দরকারটা আসলে অনৈতিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতা চালানোর স্বার্থে। নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে। সমাজের বিভক্তির স্বার্থে। কোন বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে না। তবে একেবারেই কি গত পাঁচ দশক দেশ অগ্রসর হয়নি। সেটা বলা কোনো অর্থেই ঠিক হবে না। অগ্রসর হয়েছে।
প্রযুক্তি পরিবর্তনের কারণে, মানুষের বাঁচার যুদ্ধে মানুষের প্রতিদিনের লড়াইয়ে, ব্যক্তির নিজেকে টিকিয়ে রাখার কারণে। উন্নতি হয়েছে সমাজে প্রভাবশালীদের, লুটেরাদের, সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণী কিছু জনগোষ্ঠীর। কিছু পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাটের। উৎপাদন সেটা শিল্প হোক কিংবা কৃষি। এই উন্নতির প্রধান ভোগী সমাজের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চশ্রেণীর জনগোষ্ঠী যতটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সে তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশে এক ধরনের গণতন্ত্র আছে, স্বৈরতন্ত্রের আড়ালে। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য, ক্ষমতা রক্ষার নাটকের স্বার্থে। ক্ষমতাই এখানে প্রধান কথা, ব্যক্তি প্রধান ও শেষ চিন্তা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই আমরা দেখে আসছি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার এবং দলের শাসনামলের এটা একটা অভিন্ন চরিত্র।
আমাদের বিজয় দিবসের স্বপ্ন প্রতিদিন একটু একটু করে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাচ্ছে। রাজনীতিতে বিদেশি মুরুব্বীদের আধিপত্য বাড়ছে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনেকটাই মুরুব্বী- মক্কেল সম্পর্কে (Patron- client relationship) দিকেই বেশি অগ্রসর হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে আইন শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, পরমত শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। বিগত পঞ্চাশ বছর এসব দিকে আমাদের বিজয় পরাজিত হয়েছে একাত্তরের পরাজিত শ্রেণী শক্তির কাছে।
গণতন্ত্র আমাদের শুরুতে ও ছিল না, এখনো নাই। জনতন্ত্র আছে, দলতন্ত্র আছে। ব্যক্তিতন্ত্র আছে। নেই শুধু গণতন্ত্র। ভয়ের শাসন আছে, ভয়ের সংস্কৃতি আছে। নির্বাচন এখন শুধু নামে আছে। নির্বাচন নিয়ে ডিজিটাল চুরি, সাগর চুরি। এটা বাংলাদেশে ৯০ দশকের পরের ‘সিভিল পলিটিক্সের’ আরেক রূপ।
মোটা দাগে বিগত পাঁচ দশকে আমাদের এই অর্জন গুলিকেও একেবারে হালকা করে দেখবার অবকাশ কম। তাই আজকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মন বলে আমরা আজকে পরাজিত আমাদের একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেণী শত্রæর কাছে। এই শ্রেণী শত্রæদের দখলে বা কব্জায় আমাদের পপ্রকৃত বিজয় যা এখন অর্জিত হনি।
যে কারণে ঘটা করে বিজয় দিবসের বিজয় উৎসব পালিত হয়, কারা পালন করেন। ক্ষমতাসীন সরকার এবং দল। কোটি, কোটি বিজয়ী মানুষ পরাজিতদের মত ভিড় করে দেখে যারা ওদের বিজয়কে কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের একদল ফ্যাসিস্টদের হাতে। কার বিজয় বলব এটা কে। এই আনন্দ কাদের। যারা বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের খুনি এবং অপরাধীদের দোসর হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন শুধু নিজেদের প্রয়োজনে। ক্ষমতার কারণে এবং মূলত ক্ষমতার স্বার্থে।
আজকে আমাদের সবার আগে প্রয়োজন গণতন্ত্রকে সমাজ ও রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল অন্যসব জাতীয় লক্ষ্যগুলো আপনাতেই শত্রæ মুক্ত হবে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটবে। তখনই বলা যাবে ‘বিজয়’ দেখেছি। তা না হলে, প্রতিবছর বিজয় দিবসে সমাজ এবং রাষ্ট্রে আমরা বারবার পরাজিতদের দেখতেই থাকবো ওদের বিজয় উল্লাসে।
লেখক: লেখক, সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষক
০৮ ডিসেম্বর ২০২০
নিউইয়র্ক।