নিউইয়র্ক ০৭:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

এত কেলেঙ্কারির পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজি কেন বহাল তবিয়তে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৩:২১:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জুলাই ২০২০
  • / ২৩ বার পঠিত

রফিকুল ইসলাম রতন: স্বাস্থ্য খাতে এত এত কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, অনিয়ম ও চরম অব্যবস্থাপনার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি কেন বহাল তবিয়তে? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র, সবার মুখে মুখে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলের নামে সিন্ডিকেট, মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারি, হাসপাতালের সরঞ্জাম ক্রয়, মালামাল সরবরাহ, টেকনোলজিস্ট নিয়োগ ও ঠিকাদার তালিকাভুক্তিতে দুর্নীতি-অনিয়মসহ হাজারো অভিযোগের পর মন্ত্রী ও অধিদপ্তরের ডিজির কোনো নড়চড় নেই? পুরো স্বাস্থ্য খাতের চরম সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে করোনার জাতীয় কমিটির সদস্যরাও মহা বিরক্ত। করোনার এই সময় বিশে^র বিভিন্ন দেশে যেখানে স্বাস্থ্য খাতে সামান্য দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সবাইকে বরখাস্ত করা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আমরা চেয়ে চেয়ে সব অপকর্ম দেখছি। করোনায় মানুষ মরছে, হাসপাতালগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনা, অক্সিজেন নেই, ভেন্টিলেটর নেই, আইসিইউতে বেড নেই, সঠিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, নেই মনিটরিং ও তদারকি। সব জায়গাতেই চলছে ফ্রিস্টাইল বাণিজ্য।
এত কিছুর পর জনসম্মুখে চোখ খুলে গেল রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজিতে র‌্যাবের অভিযানের পর। এ দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কীভাবে শত শত কোটি টাকা নয়ছয় করে কেউ কেউ ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছে। ৬ বছর আগে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হলেও রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে করোনা চিকিৎসার চুক্তি হলো কীভাবে। ২১ মার্চ চুক্তি অনুষ্ঠানে আবার গদগদভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিতও ছিলেন। আর এখন বলা হচ্ছে, এটা নাকি হয়েছিল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তাহলে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা ও কেলেঙ্কারির দায় কার? তারা যে ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে ৩ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিলেন, তার দায় কে নেবে? মন্ত্রী, সচিব না ডিজি? তাছাড়া দেশের ১৭ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশির নিবন্ধন ছাড়াই চলছে ফ্রি স্টাইলে ব্যবসা। এগুলো দেখার দায়িত্ব কার? এর জন্য দায়ীই বা কে? এই নিবন্ধনহীন নিম্নমানের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বছরের পর বছর ধরে মানুষের জীবন নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলছে, এর জন্য কোন ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী এতদিন চোখ বুঝে ঘুমিয়ে ছিলেন? না ‘কিছু মিছুর’ বিনিময়ে সব ‘ম্যানেজ’ করেই ওরা চিকিৎসার নামে ব্যবসা চালাচ্ছে? আরেক প্রতারণায় নেমেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার স্বামী। তারা জেকেজি হেলথকেয়ারের নামে করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ বিতরণ করে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এলো জেকেজি অফিসের ল্যাপটবে ১৫ হাজারেও বেশি ভুয়া করোনা পরীক্ষার সনদ বিক্রির তথ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি তার দায় এড়াতে পারবেন? কি করে জেকেজি করোনা নমুনা সংগ্রহের ও পরীক্ষার অনুমতি পেল? শেষ পর্যন্ত রোববার (১২ জুলাই) বিকেলে কুকর্মের হোতা ডা. সাবরিনাকে তেজগাঁও পুলিশের ডিসি অফিসে ডেকে ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিঠু সিন্ডিকেট, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয়-স্বজনদের নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বছরে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম, নিম্নমানের মালামাল সরবরাহসহ অসংখ্য অপকর্ম চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
এত দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের পরেও উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে স্বাস্থ্য সচিব, ৩ জন অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে তড়িঘড়ি করে বদলি করা হলেও মূল হোতারা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গত ৩০ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে তার পদত্যাগ ও বহিষ্কার দাবি করলেন। বামজোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাসহ নানামহল থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়ার জোরালো দাবি উঠলেও এখনো তা কার্যকর হচ্ছে না। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এমপি নিজেই। তিনি বললেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভূতের আশ্রয় হয়েছে। এ দুটি স্থানের প্রতি পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি। খোল নলচে না পাল্টালে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা।
সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, চিকিৎসকদের সংগঠন এফডিএসআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত মিল্টন এবং করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদসদের কেউ কেউ এমনকি বিএমএ-স্বচিপের নেতারাও স্বাস্থ্যখাতের এই ব্যর্থতার জন্য সরাসরি জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকার সাবেক মেয়র কর্নেল (অব.) মালেকের ছেলে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেন। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় এমপি হওয়ার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া জাহিদ মালেক ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারী পূর্ণ মন্ত্রী হন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিমন্ত্রীর ৫ বছর ও পূর্ণ মন্ত্রীর এক বছর ধরেই পুরো স্বাস্থ্য খাতে খবরদারি করেছে তার ছেলেসহ চিহ্নিত সিন্ডিকেট। যা তিনি জেনেও না জানার ভান করেছেন অথবা পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন। করোনা অব্যবস্থাপনার সুবাদে এখন সব খবর নানা গণ ও সামাজিক মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ পেলেও কারও কোনো নরচর নেই। আমরা আশা করছি সবই প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং তিনি নিশ্চয়ই খুব শিগগির ব্যবস্থা নেবেন।
গত ১১ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনসহ অন্য আরও কয়েকটি সংগঠন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্ব্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অপসারণের দাবিতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ও টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি ও অনিয়মের দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরে। সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল পিপিই ও মাস্ক কেলেঙ্কারি, আরটি পিসিআর মেশিন নিয়ে দুর্নীতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষকের টেন্ডার কেলেঙ্কারি, জেকেজির নমুনা পরীক্ষার নামে অর্থ আত্মসাৎ, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা বিস্তারিত তথ্য ধরেন। তারা বলেন, অযোগ্য ও অদক্ষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজির ব্যর্থতার দায় কেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বহন করবেন? তাছাড়া মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে কি জিম্মি হয়ে থাকবে গোটা স্বাস্থ্য খাত?
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এত কিছুর পরও যে লজ্জা সরম নেই, তার আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গত শনিবার (১১ জুলাই) একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা দাবি করেছে, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান নাকি র‌্যাব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যৌথভাবে করেছে? এটি একটি ডাহা মিথ্যাচার। র‌্যাবের ম্যাজিস্টেট রিজেন্ট হাসপাতালে পর পর দু’দিন উত্তরা ও মিরপুরে অভিযান চালিয়ে হাসপাতাল দুটি সিলগালা করে দিল, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো নাম-গন্ধ উচ্চারণ হয়নি। তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বীকার করেছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির সঙ্গে নাকি তাদের চুক্তি হয়েছিল। আর তারা এখন বলছে, প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ছি! বড়ই লজ্জা। রিজেন্ট হাসপাতালের যে ৬ বছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন হয়নি এ তথ্য গোপন করেছে কারা? রিজেন্টের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদের সঙ্গে চুক্তি অনুষ্ঠানে যখন খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রী, তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব, অধিদপ্তরের ডিজিসহ আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, তখন কেউ কি হাসপাতালের উপযুক্ততা খতিয়ে দেখার বিষয়টি বলেছিলেন। না, ‘অজানা সুবিধা’ নিয়ে সাহেদের ম্যাজিক দেখে সবাই চিৎপটাং হয়ে পড়েছিলেন? এভাবে দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই মন্ত্রী, সচিব ও ডিজিসহ কর্মকর্তাদের। তারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেন না।
করোনা টেস্টে জেকেজির প্রতারণার পেছনে নাকি রয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠনের এক নেতার হাত। জেকেজির চেয়ারম্যান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা নাকি ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক নেতার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। প্রতারণা ও দুর্নীতির দায়ে ডা. সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরী ও এক নার্সসহ ৮ জনকে র‌্যাব গ্রেফতার করার পরেই বেড়িয়ে আসে থলের বেড়াল। র‌্যাবের দায়ের করা ৪ টি মামলা থেকে দেখা যা, জেকেজি ইতিমধ্যেই ২৭ হাজার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার রিপোর্ট তারা আইসিডিডিআরবি থেকে করালেও বাকি প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন ওই প্রেমিক ডাক্তার সাবরিনা নাকি তার ছেলে বন্ধু ও চিকিৎসক নেতাদের নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এসব দেখার দায়িত্ব কার? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তাহলে মূল কাজটি কি?
করোনার এই মহা দুর্যোগে আমরা কি দেখেছি? সারা বিশ^ যখন টালমাটাল, তখন সব দেশেই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে সরকারগুলো। যেখানেই দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা পেয়েছে, সেখানেই কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারগুলো। করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ব্রাজিল, চিলি ও জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাৎক্ষনিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত জুন ও জুলাই মাসে করোনা নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতার দায়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো স্বাস্থ্যমন্ত্রী লুইস হেনরিককে, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরো তাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেইমি মানালিচকে এবং জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মানানগাগোয়া বরখাস্ত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওবাদিয়া মায়োকে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অসংখ্য তথ্যপ্রমান সম্বলিত অভিযোগ থাকলেও অজানা কারণে তারা বহাল তবিয়তে; কিন্তু কেন? সব কিছুই যেখানে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলা যায় এক হাতেই সামলাচ্ছেন, সেখানে সরকারের সুনাম বিনষ্টকারি, নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বোঝা টেনে লাভ কি? দীর্ঘদিন ধরে যারা ত্যাগী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলিয়ান, দেশ ও জনগণের জন্য যাদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে, যারা বিশ্বস্থ ও সব মহলের আস্থাভাজন তাদের এসব গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন? আমরা জেনেছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেংকারির সব তথ্যই প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। এমনকি সর্বশেষ রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
আমরা জানি দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রকৃত দশাটা কি? আর তাইতো এই খাতকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের আমলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র নেতারা। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অধ্যাপক ডা. রুহুল হক, মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আর তাদের স্থলে এখন মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন জাতীয় পার্টি নেতা কর্ণেল মালেকের পুত্র জাহিদ মালেক। কী তার রাজনৈতিক অতীত বা দলের জন্য কতটুকুই বা তাঁর ত্যাগ-তা কেউ জানে না। কিন্তু ভাগ্যের জারে নাকি সবই মিলে—।
গত সাড়ে ৪ মাস ধরে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলছে ব্যাপক অনিয়ম। হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নেই কোন কাজের সমন্বয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে যেসব চমৎকার তথ্য দেওয়া হয়, বাস্তবে তার কোন মিল নেই। প্রতিদিনই করোনায় মানুষ মরছে। আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার। পরীক্ষার সনদ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী চলছে জালিয়াতি ও বাণিজ্য। করোনার সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গলাকাটা ব্যবসা করলেও মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর কোন কিছুই করতে পারছে না। দেশব্যাপী স্বাস্থ্যখাতে এক চরম অবস্থা বিরাজ করছে। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার নামে রোগীকে জিম্মি করে লক্ষ লক্ষ টাকা বিল হাতিয়ে নিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মুখে কুলুপ এটে রইলেন। তাদের এই নিরবতা কাদের স্বার্থে? তাহলে জনগণ কি ধরেই নেবে না যে, উভয় পক্ষের মধ্যে ‘আন্ডার হ্যান্ড ডিল ডিলিংস’ হয়েছে?
আসলে অনিয়মের শুরুটা হয়েছে অনেক আগ থেকেই। সেটা প্রকাশ্যে এসেছে করোনার পর। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলের পরোক্ষ মদদে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে লুটেপুটে খেলেও এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। মরনঘাতি করোনাভাইরাস তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রনাধীন কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহকে ২৩ মে আকস্মিক বদলি করার পরেই প্রকৃত সত্যিটা বেড়িয়ে আসে। ব্রিগেডিয়ার শহীদ উল্লাহ ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে লিখিতভাবে জানান যে, মালামাল সরবরাহে সিন্ডিকেট, ঠিকাদার তালিকাভূক্তিতে দূর্নীতি, টেকনোলজিস্ট ও আউট সোর্সিং জনবল নিয়োগে জালিয়াতি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারির আত্মীয় স্বজনের জমজমাট ঠিকাদারি ব্যবসা, প্রায় সব ব্যাপারেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশসহ অনেক অজানা তথ্য তিনি তুলে ধরেন তাঁর চিঠিতে। কিন্তু থলের বেড়াল বেড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে ওই চিঠির অভিযোগ যেমন খতিয়ে দেখা হয়নি, তেমনি কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল হককে বদলি করা হলো অনেকটা আকস্মিকভাবেই। এই বদলির ৪ দিনের মাথায় অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন ও হাবিবুর রহমানকেও সরিয়ে দেওয়া হলো। সচিবকে বদলির মাত্র কয়েকদিনের মাথায় তাকে আবার পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সচিবও করা হলো। নতুন স্বাস্থ্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হলো মো. আবদুল মান্নানকে। কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদ উল্লাহকে সামরিক বাহিনীতে ফিরিয়ে, তার স্থলে পদায়ান করা হলো অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে। কিন্তু এসবের ফল কি হলো? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উল্লেখিত অভিযোগের কি কোন সুরাহা হয়েছে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য প্রমানসহ বিস্তারিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয় ছিল নিশ্চুপ।
আমরা জানতে পেরেছি, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য, মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় না করা, মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই যোগ্য-অযোগ্য বিবেচনা না করে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পদায়ন-পদাবনতি, মন্ত্রণালয়ের সভা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে না করে ডিজির বাসভবনে করা, মানসম্মত মাস্ক সরবরাহ না করা, সর্বোপরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত সমন্বিতভাবে না নেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, যারাই করোনাভাইরাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি বা ফোনে বা অন্য কোনো বিকল্প মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন, তারাই মৌখিক বা চিরকুট ধরিয়ে তাকে এ দু’জনের নামে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। মন্ত্রীর ছেলের নামেও নানা অনিয়মের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও মন্ত্রী ও ডিজির নামে অভিযোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন খাতের প্রধানদের সঙ্গে যখনই আলাপ-আলোচনা করছেন দেখা যায় তারা সুযোগ করে অভিযোগ আকারে কিছু না কিছু বলছেনই। সব অভিযোগ আমলে না নিলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনেক অবহেলা রয়েছে এটা বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনা। তাই কিছু বিষয়ে তদন্ত চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী ও ডিজিকে নিয়ে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব সমালোচনা চলছে তাও মনিটরিং চলছে। এগুলোও নজরে আছে শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, মন্ত্রী ও ডিজিকে নিয়ে অভিযোগ যারাই দিচ্ছেন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। তবে কাউকে কাউকে বলেছেন, ‘এত অনিয়ম আমাকে আগে জানাওনি কেন?’ ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় ওই নেতা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত। তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এখনই হয়তো ব্যবস্থা নিতে চান না। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বা কোনো বৈরী অবস্থায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না প্রধানমন্ত্রী। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর হয়তো ওই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় ঠিকই আনবেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) এক নেতা বলেন, ‘দেশের ডাক্তারদের বড় একটি অংশ যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজির ওপর ক্ষুব্ধ তাও আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেখানে ডাক্তারদের অগ্রাধিকার থাকার কথা সেখানে ডাক্তারদের বেশি নিগৃহীত হতে হয়েছে মন্ত্রী আর ডিজির কারণে। তাই এ পরিস্থিতিতে ডাক্তারদেরও ক্ষোভ রয়েছে। (স্বদেশ প্রতিদিন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

এত কেলেঙ্কারির পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজি কেন বহাল তবিয়তে

প্রকাশের সময় : ০৩:২১:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জুলাই ২০২০

রফিকুল ইসলাম রতন: স্বাস্থ্য খাতে এত এত কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, অনিয়ম ও চরম অব্যবস্থাপনার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি কেন বহাল তবিয়তে? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র, সবার মুখে মুখে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলের নামে সিন্ডিকেট, মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারি, হাসপাতালের সরঞ্জাম ক্রয়, মালামাল সরবরাহ, টেকনোলজিস্ট নিয়োগ ও ঠিকাদার তালিকাভুক্তিতে দুর্নীতি-অনিয়মসহ হাজারো অভিযোগের পর মন্ত্রী ও অধিদপ্তরের ডিজির কোনো নড়চড় নেই? পুরো স্বাস্থ্য খাতের চরম সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে করোনার জাতীয় কমিটির সদস্যরাও মহা বিরক্ত। করোনার এই সময় বিশে^র বিভিন্ন দেশে যেখানে স্বাস্থ্য খাতে সামান্য দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সবাইকে বরখাস্ত করা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আমরা চেয়ে চেয়ে সব অপকর্ম দেখছি। করোনায় মানুষ মরছে, হাসপাতালগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনা, অক্সিজেন নেই, ভেন্টিলেটর নেই, আইসিইউতে বেড নেই, সঠিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, নেই মনিটরিং ও তদারকি। সব জায়গাতেই চলছে ফ্রিস্টাইল বাণিজ্য।
এত কিছুর পর জনসম্মুখে চোখ খুলে গেল রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজিতে র‌্যাবের অভিযানের পর। এ দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কীভাবে শত শত কোটি টাকা নয়ছয় করে কেউ কেউ ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছে। ৬ বছর আগে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হলেও রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে করোনা চিকিৎসার চুক্তি হলো কীভাবে। ২১ মার্চ চুক্তি অনুষ্ঠানে আবার গদগদভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিতও ছিলেন। আর এখন বলা হচ্ছে, এটা নাকি হয়েছিল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তাহলে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা ও কেলেঙ্কারির দায় কার? তারা যে ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে ৩ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিলেন, তার দায় কে নেবে? মন্ত্রী, সচিব না ডিজি? তাছাড়া দেশের ১৭ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশির নিবন্ধন ছাড়াই চলছে ফ্রি স্টাইলে ব্যবসা। এগুলো দেখার দায়িত্ব কার? এর জন্য দায়ীই বা কে? এই নিবন্ধনহীন নিম্নমানের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বছরের পর বছর ধরে মানুষের জীবন নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলছে, এর জন্য কোন ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী এতদিন চোখ বুঝে ঘুমিয়ে ছিলেন? না ‘কিছু মিছুর’ বিনিময়ে সব ‘ম্যানেজ’ করেই ওরা চিকিৎসার নামে ব্যবসা চালাচ্ছে? আরেক প্রতারণায় নেমেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার স্বামী। তারা জেকেজি হেলথকেয়ারের নামে করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ বিতরণ করে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এলো জেকেজি অফিসের ল্যাপটবে ১৫ হাজারেও বেশি ভুয়া করোনা পরীক্ষার সনদ বিক্রির তথ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি তার দায় এড়াতে পারবেন? কি করে জেকেজি করোনা নমুনা সংগ্রহের ও পরীক্ষার অনুমতি পেল? শেষ পর্যন্ত রোববার (১২ জুলাই) বিকেলে কুকর্মের হোতা ডা. সাবরিনাকে তেজগাঁও পুলিশের ডিসি অফিসে ডেকে ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিঠু সিন্ডিকেট, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয়-স্বজনদের নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বছরে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম, নিম্নমানের মালামাল সরবরাহসহ অসংখ্য অপকর্ম চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
এত দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের পরেও উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে স্বাস্থ্য সচিব, ৩ জন অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে তড়িঘড়ি করে বদলি করা হলেও মূল হোতারা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গত ৩০ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করে তার পদত্যাগ ও বহিষ্কার দাবি করলেন। বামজোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাসহ নানামহল থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়ার জোরালো দাবি উঠলেও এখনো তা কার্যকর হচ্ছে না। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এমপি নিজেই। তিনি বললেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভূতের আশ্রয় হয়েছে। এ দুটি স্থানের প্রতি পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি। খোল নলচে না পাল্টালে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা।
সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, চিকিৎসকদের সংগঠন এফডিএসআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত মিল্টন এবং করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদসদের কেউ কেউ এমনকি বিএমএ-স্বচিপের নেতারাও স্বাস্থ্যখাতের এই ব্যর্থতার জন্য সরাসরি জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকার সাবেক মেয়র কর্নেল (অব.) মালেকের ছেলে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেন। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় এমপি হওয়ার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া জাহিদ মালেক ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারী পূর্ণ মন্ত্রী হন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিমন্ত্রীর ৫ বছর ও পূর্ণ মন্ত্রীর এক বছর ধরেই পুরো স্বাস্থ্য খাতে খবরদারি করেছে তার ছেলেসহ চিহ্নিত সিন্ডিকেট। যা তিনি জেনেও না জানার ভান করেছেন অথবা পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন। করোনা অব্যবস্থাপনার সুবাদে এখন সব খবর নানা গণ ও সামাজিক মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ পেলেও কারও কোনো নরচর নেই। আমরা আশা করছি সবই প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং তিনি নিশ্চয়ই খুব শিগগির ব্যবস্থা নেবেন।
গত ১১ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনসহ অন্য আরও কয়েকটি সংগঠন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্ব্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অপসারণের দাবিতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ও টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি ও অনিয়মের দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরে। সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল পিপিই ও মাস্ক কেলেঙ্কারি, আরটি পিসিআর মেশিন নিয়ে দুর্নীতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষকের টেন্ডার কেলেঙ্কারি, জেকেজির নমুনা পরীক্ষার নামে অর্থ আত্মসাৎ, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা বিস্তারিত তথ্য ধরেন। তারা বলেন, অযোগ্য ও অদক্ষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজির ব্যর্থতার দায় কেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বহন করবেন? তাছাড়া মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে কি জিম্মি হয়ে থাকবে গোটা স্বাস্থ্য খাত?
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এত কিছুর পরও যে লজ্জা সরম নেই, তার আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গত শনিবার (১১ জুলাই) একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা দাবি করেছে, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান নাকি র‌্যাব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যৌথভাবে করেছে? এটি একটি ডাহা মিথ্যাচার। র‌্যাবের ম্যাজিস্টেট রিজেন্ট হাসপাতালে পর পর দু’দিন উত্তরা ও মিরপুরে অভিযান চালিয়ে হাসপাতাল দুটি সিলগালা করে দিল, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো নাম-গন্ধ উচ্চারণ হয়নি। তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বীকার করেছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির সঙ্গে নাকি তাদের চুক্তি হয়েছিল। আর তারা এখন বলছে, প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ছি! বড়ই লজ্জা। রিজেন্ট হাসপাতালের যে ৬ বছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন হয়নি এ তথ্য গোপন করেছে কারা? রিজেন্টের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদের সঙ্গে চুক্তি অনুষ্ঠানে যখন খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রী, তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব, অধিদপ্তরের ডিজিসহ আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, তখন কেউ কি হাসপাতালের উপযুক্ততা খতিয়ে দেখার বিষয়টি বলেছিলেন। না, ‘অজানা সুবিধা’ নিয়ে সাহেদের ম্যাজিক দেখে সবাই চিৎপটাং হয়ে পড়েছিলেন? এভাবে দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই মন্ত্রী, সচিব ও ডিজিসহ কর্মকর্তাদের। তারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেন না।
করোনা টেস্টে জেকেজির প্রতারণার পেছনে নাকি রয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠনের এক নেতার হাত। জেকেজির চেয়ারম্যান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা নাকি ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক নেতার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। প্রতারণা ও দুর্নীতির দায়ে ডা. সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরী ও এক নার্সসহ ৮ জনকে র‌্যাব গ্রেফতার করার পরেই বেড়িয়ে আসে থলের বেড়াল। র‌্যাবের দায়ের করা ৪ টি মামলা থেকে দেখা যা, জেকেজি ইতিমধ্যেই ২৭ হাজার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার রিপোর্ট তারা আইসিডিডিআরবি থেকে করালেও বাকি প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন ওই প্রেমিক ডাক্তার সাবরিনা নাকি তার ছেলে বন্ধু ও চিকিৎসক নেতাদের নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এসব দেখার দায়িত্ব কার? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তাহলে মূল কাজটি কি?
করোনার এই মহা দুর্যোগে আমরা কি দেখেছি? সারা বিশ^ যখন টালমাটাল, তখন সব দেশেই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে সরকারগুলো। যেখানেই দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা পেয়েছে, সেখানেই কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারগুলো। করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ব্রাজিল, চিলি ও জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাৎক্ষনিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত জুন ও জুলাই মাসে করোনা নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতার দায়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো স্বাস্থ্যমন্ত্রী লুইস হেনরিককে, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরো তাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেইমি মানালিচকে এবং জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মানানগাগোয়া বরখাস্ত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওবাদিয়া মায়োকে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অসংখ্য তথ্যপ্রমান সম্বলিত অভিযোগ থাকলেও অজানা কারণে তারা বহাল তবিয়তে; কিন্তু কেন? সব কিছুই যেখানে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলা যায় এক হাতেই সামলাচ্ছেন, সেখানে সরকারের সুনাম বিনষ্টকারি, নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বোঝা টেনে লাভ কি? দীর্ঘদিন ধরে যারা ত্যাগী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলিয়ান, দেশ ও জনগণের জন্য যাদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে, যারা বিশ্বস্থ ও সব মহলের আস্থাভাজন তাদের এসব গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন? আমরা জেনেছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেংকারির সব তথ্যই প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। এমনকি সর্বশেষ রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
আমরা জানি দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রকৃত দশাটা কি? আর তাইতো এই খাতকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের আমলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র নেতারা। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অধ্যাপক ডা. রুহুল হক, মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আর তাদের স্থলে এখন মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন জাতীয় পার্টি নেতা কর্ণেল মালেকের পুত্র জাহিদ মালেক। কী তার রাজনৈতিক অতীত বা দলের জন্য কতটুকুই বা তাঁর ত্যাগ-তা কেউ জানে না। কিন্তু ভাগ্যের জারে নাকি সবই মিলে—।
গত সাড়ে ৪ মাস ধরে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলছে ব্যাপক অনিয়ম। হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নেই কোন কাজের সমন্বয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে যেসব চমৎকার তথ্য দেওয়া হয়, বাস্তবে তার কোন মিল নেই। প্রতিদিনই করোনায় মানুষ মরছে। আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার। পরীক্ষার সনদ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী চলছে জালিয়াতি ও বাণিজ্য। করোনার সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গলাকাটা ব্যবসা করলেও মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর কোন কিছুই করতে পারছে না। দেশব্যাপী স্বাস্থ্যখাতে এক চরম অবস্থা বিরাজ করছে। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার নামে রোগীকে জিম্মি করে লক্ষ লক্ষ টাকা বিল হাতিয়ে নিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মুখে কুলুপ এটে রইলেন। তাদের এই নিরবতা কাদের স্বার্থে? তাহলে জনগণ কি ধরেই নেবে না যে, উভয় পক্ষের মধ্যে ‘আন্ডার হ্যান্ড ডিল ডিলিংস’ হয়েছে?
আসলে অনিয়মের শুরুটা হয়েছে অনেক আগ থেকেই। সেটা প্রকাশ্যে এসেছে করোনার পর। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলের পরোক্ষ মদদে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে লুটেপুটে খেলেও এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। মরনঘাতি করোনাভাইরাস তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রনাধীন কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহকে ২৩ মে আকস্মিক বদলি করার পরেই প্রকৃত সত্যিটা বেড়িয়ে আসে। ব্রিগেডিয়ার শহীদ উল্লাহ ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে লিখিতভাবে জানান যে, মালামাল সরবরাহে সিন্ডিকেট, ঠিকাদার তালিকাভূক্তিতে দূর্নীতি, টেকনোলজিস্ট ও আউট সোর্সিং জনবল নিয়োগে জালিয়াতি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারির আত্মীয় স্বজনের জমজমাট ঠিকাদারি ব্যবসা, প্রায় সব ব্যাপারেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশসহ অনেক অজানা তথ্য তিনি তুলে ধরেন তাঁর চিঠিতে। কিন্তু থলের বেড়াল বেড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে ওই চিঠির অভিযোগ যেমন খতিয়ে দেখা হয়নি, তেমনি কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল হককে বদলি করা হলো অনেকটা আকস্মিকভাবেই। এই বদলির ৪ দিনের মাথায় অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন ও হাবিবুর রহমানকেও সরিয়ে দেওয়া হলো। সচিবকে বদলির মাত্র কয়েকদিনের মাথায় তাকে আবার পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সচিবও করা হলো। নতুন স্বাস্থ্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হলো মো. আবদুল মান্নানকে। কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদ উল্লাহকে সামরিক বাহিনীতে ফিরিয়ে, তার স্থলে পদায়ান করা হলো অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে। কিন্তু এসবের ফল কি হলো? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উল্লেখিত অভিযোগের কি কোন সুরাহা হয়েছে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য প্রমানসহ বিস্তারিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয় ছিল নিশ্চুপ।
আমরা জানতে পেরেছি, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য, মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় না করা, মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই যোগ্য-অযোগ্য বিবেচনা না করে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পদায়ন-পদাবনতি, মন্ত্রণালয়ের সভা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে না করে ডিজির বাসভবনে করা, মানসম্মত মাস্ক সরবরাহ না করা, সর্বোপরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত সমন্বিতভাবে না নেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, যারাই করোনাভাইরাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি বা ফোনে বা অন্য কোনো বিকল্প মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন, তারাই মৌখিক বা চিরকুট ধরিয়ে তাকে এ দু’জনের নামে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। মন্ত্রীর ছেলের নামেও নানা অনিয়মের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও মন্ত্রী ও ডিজির নামে অভিযোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন খাতের প্রধানদের সঙ্গে যখনই আলাপ-আলোচনা করছেন দেখা যায় তারা সুযোগ করে অভিযোগ আকারে কিছু না কিছু বলছেনই। সব অভিযোগ আমলে না নিলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনেক অবহেলা রয়েছে এটা বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনা। তাই কিছু বিষয়ে তদন্ত চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী ও ডিজিকে নিয়ে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব সমালোচনা চলছে তাও মনিটরিং চলছে। এগুলোও নজরে আছে শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, মন্ত্রী ও ডিজিকে নিয়ে অভিযোগ যারাই দিচ্ছেন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। তবে কাউকে কাউকে বলেছেন, ‘এত অনিয়ম আমাকে আগে জানাওনি কেন?’ ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় ওই নেতা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত। তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এখনই হয়তো ব্যবস্থা নিতে চান না। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বা কোনো বৈরী অবস্থায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না প্রধানমন্ত্রী। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর হয়তো ওই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় ঠিকই আনবেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) এক নেতা বলেন, ‘দেশের ডাক্তারদের বড় একটি অংশ যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজির ওপর ক্ষুব্ধ তাও আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেখানে ডাক্তারদের অগ্রাধিকার থাকার কথা সেখানে ডাক্তারদের বেশি নিগৃহীত হতে হয়েছে মন্ত্রী আর ডিজির কারণে। তাই এ পরিস্থিতিতে ডাক্তারদেরও ক্ষোভ রয়েছে। (স্বদেশ প্রতিদিন)