এক শাসক, এক দেশ
- প্রকাশের সময় : ০৩:৪২:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই ২০১৮
- / ৮০০ বার পঠিত
আবু জাফর মাহমুদ: এক শাসক, এক দেশ, শেখ হাসিনা বাংলাদেশ। ভারতবর্ষ বিভক্তির ধারায় এই বাংলাদেশ মাণচিত্রে অস্তিত্ব অর্জন করেছে পাকিস্তানী আগ্রাসনী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয় লাভের ফলে। “এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ” শ্লোগান দিয়ে এক ব্যক্তির শাসনের সূচনাকারী বাংলাদেশ বেশীর ভাগ বয়স কাটিয়েছে স্বেচ্ছাচারিদের গণতন্ত্রে। প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যা করার পর প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও হত্যা করা হয়েছে। পরের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীরা জেলখানা অথবা বাহিরে থাকলেও সবাইকে একটা ছকের মধ্যে সম্মানহীন মর্যাদাহীন জীবনের দাগ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একাধারে ১০বছর যাবত শাসক। তাকে প্রকাশ্যে বলতে হয়েছে আমি ভারতকে যা দিয়েছি,তা আর কেউ দেয়নি। এতোদিন দিয়েছি,এখন বিনিময় চাই।অনেকের আশা ভারত এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থনে তিনি আরো অনেক বাড়তে মেয়াদ পাবেন।
ইউরোপীয় শাসক এবং তাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যখন যেভাবে পেরেছে সেভাবে ভাড়াটিয়া রাজনীতির পৃষ্টপোষকতা দিয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীতে গজিয়ে ওঠা ক্ষুদ্র শাসক পরিবারগুলো সামন্ত সর্দারের আদলেই দেশবাসীর কাছে পরিচিত। নামেমাত্র রাজনৈতিক দল থাকলেও দু’তিনটা পরিবারের ছাড়পত্র নিয়েই এখনো গণতন্ত্রের তালা খোলা ও বন্ধ করা হয় বাংলাদেশে। ওখানে ব্যক্তি ও পরিবারের আনুগত্য মাফিক ঠিক করা হয়, কে রাজনীতিতে থাকবেন আর থাকবেন না। প্রতিরক্ষাবাহিনী-বিজিবি পুলিশের দায়িত্ব এসব পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতার পাহারা দেয়া। যিনি ক্ষমতায় থাকেন তার আজ্ঞাবহ থাকা। প্রজা জনসাধারণেরও দায়িত্ব শাসকের আদেশ বিনা তর্কে মেনে নেয়া এবং সবকিছু দেশ ও জনসাধারণের কল্যাণের বলে স্বীকার করা।রাষ্ট্রের চেয়ে শাসকের আনুগত্যই সুনাগরিকের প্রধানযোগ্যতা বলে বিবেচিত বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে স্থানীয় শাসকদের একটা বড় মাপের অনুষ্ঠান হবে কিছু দিন পর। এটাকে তারা বলছেন জাতীয় নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা। তবে এটা যে মনোনয়নের আনুষ্ঠানিকতা তা ইতিমধ্যে দেখাও গেছে। তবুও নিয়ম বলে কথা। নিয়ম পালন ঠিক রেখে তা যেনো উদ্দেশ্য ঠিক রেখেই সম্পন্ন করা যায় সেজন্যে কিছু সভা যোগাযোগের খবরাখবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। এই সংবাদ নিয়েই আমরা সামান্য আলাপ পর্যালোচনা করছি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীনদের এবং বিএনপি একযুগ যাবত ক্ষমতাচ্যুত পরিবারের রাজনৈতিক দল। দু’পরিবারের মধ্যে তলে তলে কিধরণের ভাব আছে তা জনগণের জানার কথা নয়। খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র যথাক্রমে বন্দী এবং দেশান্তর। এদের রাজনৈতিক জীবনের চলছে রাতের আঁধার এবং শেখ হাসিনা এবং তার পুত্রের চলছে দিনের ভরা দুপুরের উজ্জ্বল আলো।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে “আওয়ামী লীগের মুখপাত্র” না বললেও পক্ষপাত দোষের অভিযোগ উল্লেখ করে বিএনপি ব্রাসেলসে ওদের সা¤প্রতিক সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। অপরদিকে একই সময় তারা রাজধানী ঢাকায় গোলটেবিল আয়োজন করে তাতে আওয়ামী লীগের ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শাসনকালে মানবাধিকার লংঘনের চিত্রের প্রামাণ্য দলিল দেখিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং উপদেষ্টা “আমেরিকার দূতাবাস বিএনপির মুখপাত্র” বলে মন্তব্যের পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বৈদেশিক অংশীদারদের প্রশ্নে ঘুম ভাঙছে অনেকের। সরকার ও সরকার প্রধানের কোমরের জোরের সূতার নাটাই খুঁজতে গিয়ে অবাক বিস্মিত বিএনপি অনেকটা হতাশ হলেও কিছুটা সতর্ক হবার চেষ্টা করছে অনিবার্য্য ডুবো পরিস্থিতিতে।আমেরিকার ষ্টেট ডিপার্টমেন্টও বাংলাদেশের কোন দলের পক্ষপাতিত্ব না করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বিবৃতি দিয়েছে গত সপ্তাহে।
আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈদেশিক অংশীদারদের চাপে এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-বৈষম্যের শিকার বিএনপি চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে আছে দৈত্যের বিশাল থাবায়। নিঃশ্বাস তার যায় যায় করছে। একসময়ের বিশাল সম্ভাবনাময় দলটির দন্তহীন চোয়াল দেখতে চায়নি মানুষ। তবুও তাদের এই দশা আজ। তাই,বলা যায়, ‘এক শাসক এক দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’-নীতিকে প্রতিযোগীতার পর্যায়ে আটকে দেয়ার কোন অবস্থা বিএনপির নেই, অপর রাজনৈতিক দলগুলোরও নেই বাংলাদেশে। অপরদিকে এই রাজনীতিতে জাতীয় ইস্যুতে সম্মিলিত ঐক্যজোট হবার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছেনা। তাই, এই অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচন কমিশন বেশী বেগ পেতে হবেনা। সহজেই সরকার দলীয় এবং সরকারী জোট প্রার্থী দের বিজয়ী ঘোষণা দিয়ে দিতে পারেন এক দিকের রাজনৈতিক বাতাসে পাল তুলে দিয়ে।
এপর্যায়ে আমরা বাংলাদেশ রাজনীতির কিছুটা পেছনে ফিরে তাকালে কি দেখি? সৈনিক জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে পাবার পর তৎকালীন শক্তিশালী রাজনৈতিক যুবশক্তি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদকে কাছে টানার চেষ্টায় সব কিছু করলো আওয়ামী লীগকে তার সমর্থনে না পেয়ে। জাসদ ও অনড় থাকলো জিয়াকে সমর্থন করলনা। জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহারে ব্যাপক পরিকল্পনায় হলেন অগ্রসর। তার কাছে লক্ষ্যে পৌঁছার সংকল্পটাই হলো শেষ কথা।
নিজেকে এবং দেশকে নিরাপদ করার পথ চিন্তা করে তিনি রাজনৈতিক পথ সাজাতে নেমে গেলেন। কি ভাবে তার কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত করলেন তিনি? তিনি মুজিব বলয়ের বিপরীতের সকলের মধ্য থেকে অভিজ্ঞ ও যোগ্যলোকদেরকে তার সরকারে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করলেন। তাতে চীন-পাকিস্তানপন্থীরাই তার গড়া রাজনৈতিক দলের নিয়ামক শক্তিরূপে আতœপ্রকাশ করলেন এবং যুবশক্তির ভ‚মিকায় সাংগঠনিক শুণ্যতা পূরণ করতে যোগাড় করলেন জাসদ থেকে সংগৃহীত সংগঠকদেরকে। বাকি গুরুত্বপূর্ণ দেয়াল গড়েন তার পক্ষে অনুগত সেনাকর্মকর্তাদের টেনে নিয়ে। এভাবেই উত্থান হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র।
বাংলাদেশী রাজনৈতিক আকাশ ভারতের চোখে আরেক পাকিস্তানী চেহারায় ভেসে উঠলো। দীর্ঘদিন যাবত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা যে ভাঙ্গা গড়ার অভিযানে একের পর এক টার্গেট কবজা করে এসেছিলো তার মধ্যে পাকিস্তানী এবং চীনা গোয়েন্দা সংস্থা হঠাৎ বিজয় ছিনিয়ে নিলো। সিআইএ মজা ভোগ করবার সম্পূর্ণ খোলা পথ পেয়ে গেলো। বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ আলাদাভাবে দরকার না হওয়ায় পাকিস্তান এবং ভারত এই দুই পকেটের মাধ্যমে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা সম্পন্ন হয়ে যেতো। দরিদ্র ও সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার আলাদা আগ্রহের কোন যুক্তিও তখন দেখা দেয়নি। তাই প্রাকৃতিক ধারায় ভৌগোলিক ও যোগাযোগের বহু ধরণের সুবিধার সাথে রাজনৈতিক বাস্তবতা অবশেষে বাংলাদেশকে ভারতের স¤প্রসারণ নীতির আওতায় অঙ্গীভ‚ত হতে বাধ্য করে, যেখানে পাকিস্তান পিছু হটতে বাধ্য হয়।
একাত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ভারতের কারণে কিছুটা বেকায়দায় পড়া আমেরিকা চীনের সাথে নয়া বন্ধুত্বকে স্থায়ী সুযোগের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের জন্যে সাজিয়ে নিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের একক আনুগত্য থেকে আমেরিকার অধীনে ভারতের চলে যাবার অনিবার্য্যতা নিশ্চিত হলো সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন ভেঙে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হবার প্রেক্ষাপটে। এসময় ভারতের একা টিকে থাকার বিপদ চলে আসে। চীন-মার্কিন বলয়ের একান্ত ও একক নির্ভরযোগ্য মিত্র পাকিস্তানের সাথে ভারতের শত্রæতা জন্মকাল থেকেই। এসময় একদিকে তার হাত বাড়াতেই হয়।
চীনের দিকে না গিয়ে ভারত অস্তিত্ব রক্ষার পথ নিয়েছে আমেরিকার মিত্রতার বাহুডোরের স্থান পেয়ে। পাকিস্তানের জন্মকাল থেকে মিত্র থাকার পাশাপাশি ভারতকে পেয়ে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতের পুরো এলাকা (পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ) চলে এলো আমেরিকার সামরিক কর্তৃত্বের বলয়ে। দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী ক্ষমতাধরের সাথে নিজের থাবা বিস্তৃতিতে মিল রেখেছে ভারত। আজকের বাংলাদেশ অবিভক্ত ভারতে প্রবেশের দরজা পথ বলেই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা ভারতের জন্যে খুবই দরকার। ভারতের নেহেরু ডক্ট্রিন উল্লেখ করেছে তৎকালীন পূর্ববাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে ভারতের সাথে মিশে বিলীন হয়ে যাবে। তারও প্রায়ই ৯ শত বছর আগে মুসলমান আউলিয়াদের ভবিষ্যৎ নির্দ্দেশনা অনুসারে এই মুসলমান অধ্যুষিত সম্পদশালী এবং বিশ্বযোগাযোগ কেন্দ্রটি মূর্তি পূজারি শক্তি পদানত করবার জন্যে লেগে থাকবে।
জন্মকাল থেকে বাংলাদেশকে দেখা গেছে দরিদ্র ও উচ্ছৃঙ্খল। অব্যবস্থাপনা ও শৃংখলাবিমুখ রাজনীতির অসুস্থ মানসিকতা ও চেতনার বন্ধ্যাত্বের ভয়ানক হীনমন্যতায় বন্দী হয়ে যায় উজ্জীবনবাদী প্রকৃতি ও উদ্ভাবনী শক্তিধর মানুষের বাংলাদেশ। এক অনন্য জনযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং তার মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে ক‚পমÐূক ও অপরিণত রাজনীতির ক্ষমার অযোগ্য তাড়াহুড়ো ছদ্মবেশী পরাধীনতার শেকল গলায় পরে দেয় বাংলাদেশকে। তৎকালীন সময় রাষ্ট্র-সম্পর্কিত জ্ঞানের তলাবিহীন জ্ঞানশুণ্যতার ফলে রাজনীতিবিদদের ধারণাই হয়নি বাংলাদেশের জন্মলাভ সম্ভব করা হয়েছে রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতি বুঝবার সূচনা কালেরও সামান্য আগে। যে বাস্তবতায় স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া একটা জাতির রাষ্ট্র গঠনের সবকিছু সুযোগের অপেক্ষায় থাকা প্রতিবেশীদের হায়েনার আওতায় ছেড়ে দেয়।কি আশ্চর্য্য! বাংলাদেশ তার মনভোলা আনন্দে নৃত্যতালে সমৃদ্ধির উঁচুতে লাফ দিতে যায়।আর বারে বারে খাদের তলায় পড়ে প্রতি লাফে।
ছদ্মবেশী স্বাধীনতা ভেতর থেকেই পদাবনত হয় তার বাহিরের অংশীদারের দাসত্বে। এই দাসত্বের রাজনীতির বিভেদ বিচ্ছেদ ও বিনাশের ধারা চালু হয়েছে ১৯৭২ সাল জুড়ে, স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই। সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের দেশাতœবোধের জ্যোতিতে মানবতার প্রেমসিক্ত যোদ্ধাদেরকে আবারও বিভ্রান্ত করলো অদূরদর্শী ও অপরিণত রাজনীতি। তারই ফল বেয়ে ¯্রােতের ধারাবাহিকতায় আজকের বাস্তবতা। বাংলাদেশের নাগরিক ও সমাজ জীবনকে দুরারোগ্য সন্ত্রাসের কাছে বন্দী করার রাজনীতিই আজ বাংলাদেশের আইন, বিচার, প্রশাসন, শিক্ষা, শিক্ষকতা, ক‚টনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, সাংবাদিকতা, শিল্প, উৎপাদন, বন্টন, যোগাযোগ, রাস্তা ঘাট, রেল-নদী-আকাশপথ, আমদানী-রফতানী, সঙ্গীত, নাটক ও সিনেমা সহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরাধকে এসবের প্রধান পৃষ্টপোষক হবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যাতে বাংলাদেশ তার নিজের আয়কৃত মুদ্রা নিজের কাছে রাখতে পারছেনা। নিয়ে যাচ্ছে ভারত।
বাংলাদেশ আজ ভয়ানক অপরাধী মাফিয়ার এক স্বর্গ। সমগ্র জনগণ তাদের কাছে জিম্মি ও বন্দী। এই মাফিয়া রাজনৈতিক নেতারা কখনো ঝগড়া করে আবার গোপনে ভাগাভাগি করে। মাফিয়াদের মাফিয়া হচ্ছেন রাজনৈতিক মাফিয়া। তারা হচ্ছেন মহামাফিয়া। এক সময় এদের মাফিয়াবৃত্তির বাধা ছিলো সেনাবাহিনী। তাই সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করে করে মানুষের মনোযোগ বিভ্রান্ত করে আপনরূপে আতœপ্রকাশ শেষে বিজয়ীর সিংহাসন দখল করেছে মাফিয়া রাজনীতি। সেনাবাহিনীর ভয়ে আগে রাজনৈতিক মাফিয়ারা ছিলো তূলনামূলক সংযত। বিশেষ পরিস্থিতির পর মাফিয়াবৃত্তি হলো রাজনৈতিক ও ধন সম্পদ আহরণে সর্বোচ্চ সমাদৃত বাংলাদেশে। ইউরোপীয় পার্লামেণ্ট কি অপরাপর আন্তর্জাতিক অংশীদার সহ দেখবে তদন্ত করে বাংলাদেশে আসলে হচ্ছেটা কি? মহাসন্ত্রাসী মহামাফিয়া কারা?
“বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ নিরাপদ, সুষ্ঠূ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য স্বাধীন এবং দৃঢ়চেতা নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন সবার শান্তিপূর্ণ প্রচার ও মতপ্রকাশ এবং ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা”। মঙ্গলবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কিত আলোচনায় এ অভিমত প্রকাশ করে বলেন, “দেশটির উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ”। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাংলাদেশ বিষয়ক গ্রæপের প্রধান মিস জ্যাঁল্যামবার্ট সা¤প্রতিককালে বিভিন্ন নির্বাচনে সহিংসতা সৃষ্টিকারী সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান করেন। এক্ষেত্রে তিনি দলীয় যুবগোষ্ঠীগুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। মিস ল্যামবার্ট বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চিত করারও আহবান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে কনজার্ভেটিভ পার্টির পররাষ্ট্র ও মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র চার্লস ট্যানকের উদ্যোগে ব্রাসেলসে আয়োজিত সভাটি আয়োজিত হয়।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই সভাকে গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশ। সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রতিনিধি যোগ দেন। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মণি ছিলেন প্রতিনিধিত্বে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি আমন্ত্রিত হলেও তাতে না যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং আগেভাগেই জানিয়ে দেন উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে অতীতে আওয়ামীলীগের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দেখিয়ে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম মিডিয়া-কে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে এ রকম ভদ্র ভাষার পরামর্শ গ্রহণ করার মতো মানসিকতা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেই। তাই বর্তমান সরকারকে গণতান্ত্রিক আচরণে বাধ্য করার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই সভায় সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সিগফ্রেড উলফ বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থা বিস্তারের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হলেও আগামী নির্বাচনে তারা প্রভাব ফেলবে। তিনি মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে বলে দাবি করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রসংগে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এবং কারাগারগুলো জঙ্গিদের মতবাদ বিস্তারের লক্ষ্য হয়ে উঠছে। তবে পার্লামেন্ট সদস্য মিস ল্যামবার্ট বলেন, সন্ত্রাসবাদ প্রসারের কাজ যে শুধু একটি দল করছে তা নয়, অনেক গোষ্ঠীই এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বিভিন্ন গ্রæপকে লক্ষ্য করে জিহাদিরা কাজ করছে। চার্লস ট্যানক বলেন, বিএনপি যদি জামায়াতকে গ্রহণ যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে, তবে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
সভায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্যে সাইয়েদ কামাল, ব্যারিষ্টার মোবারক, সাজ্জাদ করিম, আমজাদ বশির বক্তব্য দেন। সাইয়েদ কামাল বলেন, “আই এসের মতো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর হুমকি মোকাবিলার জন্য সুষ্ঠূ ও আবাধ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ”। বাণিজ্য বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি গ্রæপের সদস্য সাজ্জাদ করিম ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরি বিষয়ক সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। ব্যারিষ্টার মোবারক, নারীর ক্ষমতায়নে আরও উদ্যোগ গ্রহনের ওপর জোর দেন। আমজাদ বশির বলেন,“রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির দেখে আসার অভিজ্ঞতা বড়ই নির্মম। উদবাস্তুদের এই অবস্থা স্থায়ী হতে দেওয়া যায়না”।
এই সভায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেইন ফর দ্য রিলিজিয়াস মাইনরিটি ইন বাংলাদেশের অজিত সাহা এবং সেক্যুলার মুভমেন্ট অব বাংলাদেশের পুষ্পিতা গুপ্ত তুলে ধরেন, সংখ্যালঘু, বিশেষতঃহিন্দু স¤প্রদায়ের ওপর সহিংসতা ও বৈষম্যের কথা। তারা দুজনেই “নির্বাচন হলেই হিন্দুদের ওপর হামলা হয়” বলে জানান ওসবের কোন বিচার হয়না। তাই আগামী নির্বাচন নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন। অজিত সাহা গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন হামলার ঘটনার ছবি ও তথ্য তুলে ধরে বলেন, সরকার এসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে বিচার ব্যবস্থা।
এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভায় আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর রাজধানী ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেন একটি হোটেলে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভিত্তিক ১৫মিনিটের “রাইট টু লাইফ ঃ এ ফার ক্রাই ইন বাংলাদেশ” শিরোনামে একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।এতে থাকে ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নমুনা। যেখানে বিভিন্ন সময় বিএনপির গুম-হত্যা ও নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যদের আহাজারি ও বক্তব্য দেখানো হয়েছে।
বিরোধীদলের উপর সরকারি নিপীড়নের পরিসংখ্যান তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন,“আজকে শুধু গুম বা এনফোর্স ডিজেপিয়ারেন্স নয়, আমাদের হিসেবে পাঁচ শতাধিক নেতৃবৃন্দ হারিয়ে গেছেন। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা তাদেরকে। আমাদের হিসেবে ১০ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সারা দেশে আমাদের নেতৃবৃন্দের ৭৮হাজার মামলা করা হয়েছে ১৮লাখ মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দেশে মানবাধিকার লংঘন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এসব সরকারের কানে ঢুকছেনা। এই সরকার ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। একারণে নিয়পমকানুন কোনো কিছু খেয়াল করছেনা। সংবিধান লংঘন করছে। ১১দিন ধরে খালেদা জিয়ার সাথে তার পরিবারের কাউকে দেখা সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছেনা। এটা স্পষ্ঠতঃসংবিধান লংঘন”।
বিএনপি’র কথা শোনলাম। সংবিধান লংঘনের দায় বিএনপির উপরও আছে। তবে ভারতের চাহিদা এবং শেখ হাসিনাদের আকাক্সক্ষার মিলনের ফলে একে অপরে হয়েছেন একাকার। এতেই ভারতের বাংলাদেশ-নীতির কার্যকর সফলতা ফলেছে। হাসিনা হয়েছেন হয়েছেন বিজয়ী। শেখ হাসিনাদের রাজনীতির সহজ ফর্মূলাটাই হচ্ছে ভারত শক্তির পদতলে আতœসমর্পণ বজায় রাখা। এই আতœসমর্পণে বিএনপি কিছুটা সংশয় এবং কিছুটা আতœসমর্পণ নীতির দোদল্যমানতায় থাকায় ভারত বুদ্ধিমানের কাজটাই করেছে। নিঃশর্তে অনুগতকেই নিয়েছে টেনে। কে পৃষ্টপোষকতার অধীনতায় পুরস্কৃত করবেনা? সে কাজটাই তারা করেছে। তাই,একা ভারতকে দায়ী করা যায়না বাংলাদেশ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের দায়ে। ভারতের জন্যে এটা অপরাধও নয়, দেশপ্রেম। বরঞ্চ অপরাধ সেসব বাংলাদেশীদের যারা নিজ দেশ এবং দেশবাসীদের সাথে প্রতারণা করেছে নিজেদের লোভ ও হীনমন্যতা চরিতার্থ করার বিনিময়ে।
(লেখক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযোদ্ধা)।