নিউইয়র্ক ০৩:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

একজন অনুজের দৃষ্টিতে গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৪:১৫:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুলাই ২০১৫
  • / ১০৮৩ বার পঠিত

ইমরান আনসারী: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী- আমি কি ভূলিতে পারি’ এই একটি গানের জন্য প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রতি আমার দুর্বলতা বা শ্রদ্ধা যাই বলিনা কেন তাঁর মাত্রা কিছুটা হলেও বেশী।
এছাড়া সপ্তম শ্রেনী থেকে সেই কুমিল্লার সীমান্তবর্তী গ্রাম কুমিল্লার আনন্দপুর ভূঁইয়া বাড়িতে থাকার সময় বাবা ও বড় ভাইয়ের অতিব কষ্টে সংগৃহিত পত্রিকা পড়ার সুবাধে যে কয়জন কলামিস্টের লেখার সাথে পরিচিত হয়েছি তার মধ্যে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী অন্যতম।
পরবর্তীতে দৈনিক সমকালে এডিটরিয়েল বিভাগে কিছুদিন কাজ করার সুবাধে বাংলাদেশের কলামিস্টদের লেখার ঢং, আদর্শিক চিন্তা চেতনার সাথে কিছুটা হলেও নিবিড়ভাবে জানা শুনার সুযোগ হয়েছে।
অবশেষে একুশে টেলিভিশনে কাজ করার সুবাধে গত শুক্রবার (৩ জুলাই) নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে প্রথমবারের মতো অগ্রজ প্রখ্যাত সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর সাথে দেখা এবং বক্তব্য শুনার সুযোগ হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের পাশেই একটি চেয়ার খালি ছিল। সিনিয়র সহকর্মী দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ভাই বললেন ইমরান বসে বসে ফুটেজ নেন। যাহোক যায়গাটা পেয়ে খুবই ভাল লাগলো কারণ একেই তো রোজা তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও ফুটেজ নেয়া।
এখানে বলে রাখা ভাল গত দেড় বছরে বাংলাদেশ মিশন যতগুলো পোগ্রাম আয়োজন করেছে তারমধ্যে আমার দেখা সবচেয়ে প্রানবন্ত পোগ্রাম ছিল এটি।
এতো লোকের সমাগম বাংলাদেশ মিশনে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। কারণ সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী একাই বক্তব্য রাখছেন সামনে কোনো স্ক্রীপ্ট নেই।
একের পর এক অনর্গল বলে যাচ্ছেন। পিন পতন নিরবতা। তাঁর আলোচনার শুরুটা ছিল ইসলামী সংস্কৃতি বনাম বাংলাদেশী সংস্কৃতি নিয়ে। এটি যে একটি একাডেমিক আলোচনা ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। যদিও আমি তাঁর সব বক্তব্যের সাথে একমত নই। কিন্তু আমার শুনা অনেক ভাল বক্তব্যের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। কারণ তিনি তাঁর বক্তব্যে আমার সামনে অনেকগুলো বিষয় নতুনভাবে হাজির করেছিলেন।
সেই ওহাবী মতবাদের সাথে অটোমান খেলাফতের পার্থক্য ও সংঘাতের বিষয়টি তুলে এনেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ওহাবীজমের প্রভাব বিশ্লেষনে তিনি জামাত হেফাজতকে জড়িয়েছেন।
তাঁর বক্তব্যে তিনি জামায়াতকে ওহাবী মতবাদের সাথে সম্পূর্নভাবে একীভূত করেছেন। এটি আমার মতে তিনি ঠিক করেননি। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একাডেমিক পড়াশুনা ও রিপোর্টিং-এর সুবাধে জামায়াতকে যতটুকু জানি জামায়াত আর ওহাবীজম এক জিনিষ নয়। কারণ জামায়াতের উদ্দেশ্য ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর সালাফিজমের উদ্দেশ্য তা নয়।
ওহাবিরা রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, জামায়াত রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। যদি তাই হতো তাহলে মিশরের ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে অপসারণ করতে বিলিয়ন ডলার খরচ করতে সৌদির সালাফি তথা ওহাবি সরকার তৎপর হতেন না।
এটা সবারই জানা মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন তথা ব্রাদারহুড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইজরাইলের সাথে গোপন চুক্তিতে সৌদি সরকার আবদ্ধ হতে না।
তৃতীয়ত; ইরানে হামলা চালাতে সৌদি ওহাবী সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কানীদাতার ভূমিকা পালন করতেন না।
তবে এটি ঠিক যে অনেক আলেম সৌদি আরবের পয়সায় পড়াশুনা করার সুবাধে বাংলাদেশে সালাফিজম তথা ওহাবিজম প্রচার ও প্রসার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ।
দিন দিন তাদের এই প্রভাব জামায়াত ও কাওমী আলেমদের উপর বাড়ছে বই কমছে না। এটা জামায়াত ও বাংলাদেশ দুটোর জন্যই খুব ভাল বার্তা নিয়ে আসবে বলে আমি মনে করিনা।
তবে ওহাবীজম তথা সালাফিজমের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের পক্ষেই আমার অবস্থান। এধরণের মতবাদের জবাব বুদ্ধিভিত্তিক হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু এক্ষেত্রে জামায়াতের বড় অংশ ওহাবী তথা সালাফিজমে বিশ্বাস করে এটা আমি মনে করি না।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে ওহাবী তথা সালাফি মতবাদ বিরোধী একজন মানুষ। আর এর পেছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণতো রয়েছেই। কারণ এই ওহাবীরাই আহলে বাইতের দশজন ইমামকে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। যারা প্রকাশ্যে নবী (সা.) আহলে বাইতের বিরুধী তাদের পক্ষে কোনো মুসলমান অবস্থান নিতে পারে না।
এখন আসি গাফফার চৌধুরীর কথায় তিনি তাঁর বক্তব্যের এক যায়গায় ভাষার আত্মীয়করণ বুঝাতে গিয়ে বলেছেন আল্লাহর ৯৯ নাম কাফেরদের দেব দেবতার নাম ছিল।
উনী যেভাবে বলেছেন আমি এটা মনে করি না যে তিনি এটি ধর্মকে অবমাননার জন্য বলেছেন। তবে তিনি তথ্যটি ভূল দিয়েছেন। কারণ কাবা শরীফের ৩৬০ মূর্তি বা দেবতার ১০টি নামও তিনি আল্লাহর ৯৯টি নামের সাথে মিলিয়ে দিতে পারবেন না।
দ্বিতীয় তিনি যে ভূলটি করেছেন। একজন প্রশ্ন কর্তা জিজ্ঞেস করেছেন বাংলাদেশে টুপি ও বোরখা পড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন। এখানেও তিনি উত্তর দেবার ক্ষেত্রে টুপি ও বোরখা তথা পর্দাকে জামায়াতের সাথে জড়িয়ে ফেললেন।
তিনি বললেন, এটি জামায়াত তথা ওহাবিজমের সর্বশেষ সংযোজন। অথচ ১৪ শ বছর আগে পর্দার বিধান নাজিল হয়েছে আল কুরআনের শাশ্বত বানীর মাধ্যমে। পর্দা সম্পর্কিত কুরআনে বর্ণিত বিধানের আলোকে যা বুঝতে পারি তা হচ্ছে -বিবাহ বহির্ভূত শারিরীক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যই এই বিধান করা হয়েছে।
এখানে একেক দেশের মহিলারা একেকভাবে এই পর্দা করে থাকে। তবে বোরখা প্রথাটাই বিশ্বে বেশী সমাদৃত হয়েছে। শুধু জামায়াতিরাই বাংলাদেশে বোরখা পড়ে তা নয়।
আমার বাড়িটি কুমিল্লা শহরের পাশেই। আমার আম্মা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে চাকুরি করে আসছেন। বোরখা পড়ে, মুখ ঢেকেই চাকুরি করে আসছেন।
কেউ যদি বুড়িচং সদরে আমার আম্মাকে জামায়াত বলে গালি দিয়ে চলে আসতে চান। মনে হয় না এটা সম্ভব হবে। ওইখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ওই ব্যক্তিকে সুস্থভাবে ফিরে আসতে দিবেন কিনা যা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সুতরাং বোরখাটা জামায়াতের নয়, এটা একজন আওয়ামী সমর্থকেরও। যদি আওয়ামী লীগ এখন বোরখা থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় সেটা ভিন্ন কথা।
তৃতীয় বিতর্কটি যেটি নিয়ে শুরু হয়েছে সেটি হচ্ছে আমি আগে বাঙালী না পরে মুসলমান। গাফফার ভাইয়ের বক্তব্য ছিল আমি আগে বাঙালী, পরে মুসলমান। এটাই নাকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র।
কিন্তু বাংলাদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষরা মনে করেন আমি আগে মুসলমান পরে বাঙালী। এই দুই বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক করার সুযোগ আছে। তবে আমি মনে করি আমি বাংলাদেশী মুসলমান। এখানে আগে পরে নাই।
প্রথমত প্রত্যেক মানুষই পৃথীবিতে মুসলিম হিসেবে জন্ম গ্রহন করে। কুরআনের ভাষায় একে বলা হয় ‘ফিতরাহ’। এজন্য ইহুদি, খ্রিস্টান বা হিন্দু যাই বলি না কেন প্রত্যেকটি শিশুই জন্মগ্রহন করে মুমিন হিসেবে।
পরবর্তীতে কারো পিতা মাতা তাকে খ্রিষ্টান বানায়, হিন্দু বানায়, কিংবা মুসলিম বানায়। সেই হিসেবে আমি প্রথমে মুসলমান এবং বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সকল জন্মগ্রহনকৃত শিশুরা মুসলিম এবং মুমিন।
একথা সত্য যে ভারতীয় উপমহাদেশের বেশীরভাগ আলেম ভাষা সংস্কৃতি এসব নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু এটা অস্বীকার করবার কোনো জো নেই যে ইসলামের নিজস্ব কোনো সংস্কৃতি নেই। গাফফার ভাই ইসলামি সংস্কৃতিকে আরবের সংস্কৃতির সাথে একেবারেই একীভূত করে ফেলেছেন। যা আমি মানতে পারছি না।
যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবে জন্ম গ্রহণ করেছেন সেহেতু আরবের কৃষ্টি কালচারের সাথে ইসলামি কালচারের অনেক ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যাবে। কিন্তু ইসলামের দেয়া সংস্কৃতি সাড়া পৃথিবীর সকল যুগের সকল সময়ের জন্য সমান উপযোগী।
এটা আমি হলফ করেই বলতে পারি। জামায়াত ও হেফাজতের লোকেরা এ সংস্কৃতি (টুপি বোরখা) বেশী ধারণ করে বলেই এই সংস্কৃতিকে নির্মূল করার বক্তব্য কোনো ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। চোর ডাকাতরা নামাজ পড়ে এই জন্য নামাজকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে উঠিয়ে দিতে হবে এটা কেমন কথা।
জামায়াত-শিবিরের ম্যাস ও বাসায় বাংলা অনুবাদসহ কোরআন পাওয়া যায়, তাই বলে বাংলাদেশে যাদের ঘরেই এই কুরআন পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এটা মানবতা বিরোধী কাজ।
জামায়াতকে নির্মূল করার অযুহাতে ইসলামি তাহজীব তমুদ্দনকে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। যেটা বাংলাদেশে হরহামেশা হতে চলছে।
তবে বাংলাদেশে নাম রাখার ক্ষেত্রে মানুষের অজ্ঞতার বিষয়ে গাফফার ভাইয়ের বক্তব্যের সাথে আমি একমত। তিনিই ঠিকই পয়েন্ট আউট করেছেন আবু হুরায়রা অর্থ বিড়াল ছানার পিতা, আবু বকর অর্থ ছাগলের পিতা। যদিও এই নামগুলো সাহাবায়ে কেরামের নাম ছিল। এতে ধর্ম অবমাননার কিছু আমি দেখছিনা। কারণ ইসলামে অর্থপূর্ন নাম রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
তবে গাফফার ভাইয়ের বক্তব্যের অনেকগুলো ইতিবাচক দিক স্বীকার করতেই হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তৈরীর জন্য উচ্চ বর্ণের ব্রাক্ষ্মণরা জড়িত। একথা অনেক আলেমরা এখনও সাহস করে বলতে পারেননি।
এছাড়াও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন বাংলাদেশে এখন প্রকৃত কোনো বিরোধী দল নেই। এটি প্রয়োজনের বিরোধী দল। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের প্রয়োজনে ফাঁসির বিধান রাখার পক্ষেও মত দিয়েছেন। যদিও আলোচনাটি ছিল ‘বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত’ শীর্ষক।
কিন্তু তাঁর মতো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের কাছ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কোনো বক্তব্য পাইনি বলে হতাশই হয়েছি। কারণ একজন সাংবাদিকের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে গণতন্ত্রায়ন ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
ই-মেইল: Imran.ansary@gmail.com

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

একজন অনুজের দৃষ্টিতে গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য

প্রকাশের সময় : ০৪:১৫:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুলাই ২০১৫

ইমরান আনসারী: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী- আমি কি ভূলিতে পারি’ এই একটি গানের জন্য প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রতি আমার দুর্বলতা বা শ্রদ্ধা যাই বলিনা কেন তাঁর মাত্রা কিছুটা হলেও বেশী।
এছাড়া সপ্তম শ্রেনী থেকে সেই কুমিল্লার সীমান্তবর্তী গ্রাম কুমিল্লার আনন্দপুর ভূঁইয়া বাড়িতে থাকার সময় বাবা ও বড় ভাইয়ের অতিব কষ্টে সংগৃহিত পত্রিকা পড়ার সুবাধে যে কয়জন কলামিস্টের লেখার সাথে পরিচিত হয়েছি তার মধ্যে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী অন্যতম।
পরবর্তীতে দৈনিক সমকালে এডিটরিয়েল বিভাগে কিছুদিন কাজ করার সুবাধে বাংলাদেশের কলামিস্টদের লেখার ঢং, আদর্শিক চিন্তা চেতনার সাথে কিছুটা হলেও নিবিড়ভাবে জানা শুনার সুযোগ হয়েছে।
অবশেষে একুশে টেলিভিশনে কাজ করার সুবাধে গত শুক্রবার (৩ জুলাই) নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে প্রথমবারের মতো অগ্রজ প্রখ্যাত সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর সাথে দেখা এবং বক্তব্য শুনার সুযোগ হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের পাশেই একটি চেয়ার খালি ছিল। সিনিয়র সহকর্মী দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ভাই বললেন ইমরান বসে বসে ফুটেজ নেন। যাহোক যায়গাটা পেয়ে খুবই ভাল লাগলো কারণ একেই তো রোজা তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও ফুটেজ নেয়া।
এখানে বলে রাখা ভাল গত দেড় বছরে বাংলাদেশ মিশন যতগুলো পোগ্রাম আয়োজন করেছে তারমধ্যে আমার দেখা সবচেয়ে প্রানবন্ত পোগ্রাম ছিল এটি।
এতো লোকের সমাগম বাংলাদেশ মিশনে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। কারণ সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী একাই বক্তব্য রাখছেন সামনে কোনো স্ক্রীপ্ট নেই।
একের পর এক অনর্গল বলে যাচ্ছেন। পিন পতন নিরবতা। তাঁর আলোচনার শুরুটা ছিল ইসলামী সংস্কৃতি বনাম বাংলাদেশী সংস্কৃতি নিয়ে। এটি যে একটি একাডেমিক আলোচনা ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। যদিও আমি তাঁর সব বক্তব্যের সাথে একমত নই। কিন্তু আমার শুনা অনেক ভাল বক্তব্যের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। কারণ তিনি তাঁর বক্তব্যে আমার সামনে অনেকগুলো বিষয় নতুনভাবে হাজির করেছিলেন।
সেই ওহাবী মতবাদের সাথে অটোমান খেলাফতের পার্থক্য ও সংঘাতের বিষয়টি তুলে এনেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ওহাবীজমের প্রভাব বিশ্লেষনে তিনি জামাত হেফাজতকে জড়িয়েছেন।
তাঁর বক্তব্যে তিনি জামায়াতকে ওহাবী মতবাদের সাথে সম্পূর্নভাবে একীভূত করেছেন। এটি আমার মতে তিনি ঠিক করেননি। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একাডেমিক পড়াশুনা ও রিপোর্টিং-এর সুবাধে জামায়াতকে যতটুকু জানি জামায়াত আর ওহাবীজম এক জিনিষ নয়। কারণ জামায়াতের উদ্দেশ্য ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর সালাফিজমের উদ্দেশ্য তা নয়।
ওহাবিরা রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, জামায়াত রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। যদি তাই হতো তাহলে মিশরের ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে অপসারণ করতে বিলিয়ন ডলার খরচ করতে সৌদির সালাফি তথা ওহাবি সরকার তৎপর হতেন না।
এটা সবারই জানা মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন তথা ব্রাদারহুড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইজরাইলের সাথে গোপন চুক্তিতে সৌদি সরকার আবদ্ধ হতে না।
তৃতীয়ত; ইরানে হামলা চালাতে সৌদি ওহাবী সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কানীদাতার ভূমিকা পালন করতেন না।
তবে এটি ঠিক যে অনেক আলেম সৌদি আরবের পয়সায় পড়াশুনা করার সুবাধে বাংলাদেশে সালাফিজম তথা ওহাবিজম প্রচার ও প্রসার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ।
দিন দিন তাদের এই প্রভাব জামায়াত ও কাওমী আলেমদের উপর বাড়ছে বই কমছে না। এটা জামায়াত ও বাংলাদেশ দুটোর জন্যই খুব ভাল বার্তা নিয়ে আসবে বলে আমি মনে করিনা।
তবে ওহাবীজম তথা সালাফিজমের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের পক্ষেই আমার অবস্থান। এধরণের মতবাদের জবাব বুদ্ধিভিত্তিক হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু এক্ষেত্রে জামায়াতের বড় অংশ ওহাবী তথা সালাফিজমে বিশ্বাস করে এটা আমি মনে করি না।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে ওহাবী তথা সালাফি মতবাদ বিরোধী একজন মানুষ। আর এর পেছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণতো রয়েছেই। কারণ এই ওহাবীরাই আহলে বাইতের দশজন ইমামকে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। যারা প্রকাশ্যে নবী (সা.) আহলে বাইতের বিরুধী তাদের পক্ষে কোনো মুসলমান অবস্থান নিতে পারে না।
এখন আসি গাফফার চৌধুরীর কথায় তিনি তাঁর বক্তব্যের এক যায়গায় ভাষার আত্মীয়করণ বুঝাতে গিয়ে বলেছেন আল্লাহর ৯৯ নাম কাফেরদের দেব দেবতার নাম ছিল।
উনী যেভাবে বলেছেন আমি এটা মনে করি না যে তিনি এটি ধর্মকে অবমাননার জন্য বলেছেন। তবে তিনি তথ্যটি ভূল দিয়েছেন। কারণ কাবা শরীফের ৩৬০ মূর্তি বা দেবতার ১০টি নামও তিনি আল্লাহর ৯৯টি নামের সাথে মিলিয়ে দিতে পারবেন না।
দ্বিতীয় তিনি যে ভূলটি করেছেন। একজন প্রশ্ন কর্তা জিজ্ঞেস করেছেন বাংলাদেশে টুপি ও বোরখা পড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন। এখানেও তিনি উত্তর দেবার ক্ষেত্রে টুপি ও বোরখা তথা পর্দাকে জামায়াতের সাথে জড়িয়ে ফেললেন।
তিনি বললেন, এটি জামায়াত তথা ওহাবিজমের সর্বশেষ সংযোজন। অথচ ১৪ শ বছর আগে পর্দার বিধান নাজিল হয়েছে আল কুরআনের শাশ্বত বানীর মাধ্যমে। পর্দা সম্পর্কিত কুরআনে বর্ণিত বিধানের আলোকে যা বুঝতে পারি তা হচ্ছে -বিবাহ বহির্ভূত শারিরীক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যই এই বিধান করা হয়েছে।
এখানে একেক দেশের মহিলারা একেকভাবে এই পর্দা করে থাকে। তবে বোরখা প্রথাটাই বিশ্বে বেশী সমাদৃত হয়েছে। শুধু জামায়াতিরাই বাংলাদেশে বোরখা পড়ে তা নয়।
আমার বাড়িটি কুমিল্লা শহরের পাশেই। আমার আম্মা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে চাকুরি করে আসছেন। বোরখা পড়ে, মুখ ঢেকেই চাকুরি করে আসছেন।
কেউ যদি বুড়িচং সদরে আমার আম্মাকে জামায়াত বলে গালি দিয়ে চলে আসতে চান। মনে হয় না এটা সম্ভব হবে। ওইখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ওই ব্যক্তিকে সুস্থভাবে ফিরে আসতে দিবেন কিনা যা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সুতরাং বোরখাটা জামায়াতের নয়, এটা একজন আওয়ামী সমর্থকেরও। যদি আওয়ামী লীগ এখন বোরখা থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় সেটা ভিন্ন কথা।
তৃতীয় বিতর্কটি যেটি নিয়ে শুরু হয়েছে সেটি হচ্ছে আমি আগে বাঙালী না পরে মুসলমান। গাফফার ভাইয়ের বক্তব্য ছিল আমি আগে বাঙালী, পরে মুসলমান। এটাই নাকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র।
কিন্তু বাংলাদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষরা মনে করেন আমি আগে মুসলমান পরে বাঙালী। এই দুই বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক করার সুযোগ আছে। তবে আমি মনে করি আমি বাংলাদেশী মুসলমান। এখানে আগে পরে নাই।
প্রথমত প্রত্যেক মানুষই পৃথীবিতে মুসলিম হিসেবে জন্ম গ্রহন করে। কুরআনের ভাষায় একে বলা হয় ‘ফিতরাহ’। এজন্য ইহুদি, খ্রিস্টান বা হিন্দু যাই বলি না কেন প্রত্যেকটি শিশুই জন্মগ্রহন করে মুমিন হিসেবে।
পরবর্তীতে কারো পিতা মাতা তাকে খ্রিষ্টান বানায়, হিন্দু বানায়, কিংবা মুসলিম বানায়। সেই হিসেবে আমি প্রথমে মুসলমান এবং বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সকল জন্মগ্রহনকৃত শিশুরা মুসলিম এবং মুমিন।
একথা সত্য যে ভারতীয় উপমহাদেশের বেশীরভাগ আলেম ভাষা সংস্কৃতি এসব নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু এটা অস্বীকার করবার কোনো জো নেই যে ইসলামের নিজস্ব কোনো সংস্কৃতি নেই। গাফফার ভাই ইসলামি সংস্কৃতিকে আরবের সংস্কৃতির সাথে একেবারেই একীভূত করে ফেলেছেন। যা আমি মানতে পারছি না।
যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবে জন্ম গ্রহণ করেছেন সেহেতু আরবের কৃষ্টি কালচারের সাথে ইসলামি কালচারের অনেক ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যাবে। কিন্তু ইসলামের দেয়া সংস্কৃতি সাড়া পৃথিবীর সকল যুগের সকল সময়ের জন্য সমান উপযোগী।
এটা আমি হলফ করেই বলতে পারি। জামায়াত ও হেফাজতের লোকেরা এ সংস্কৃতি (টুপি বোরখা) বেশী ধারণ করে বলেই এই সংস্কৃতিকে নির্মূল করার বক্তব্য কোনো ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। চোর ডাকাতরা নামাজ পড়ে এই জন্য নামাজকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে উঠিয়ে দিতে হবে এটা কেমন কথা।
জামায়াত-শিবিরের ম্যাস ও বাসায় বাংলা অনুবাদসহ কোরআন পাওয়া যায়, তাই বলে বাংলাদেশে যাদের ঘরেই এই কুরআন পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এটা মানবতা বিরোধী কাজ।
জামায়াতকে নির্মূল করার অযুহাতে ইসলামি তাহজীব তমুদ্দনকে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। যেটা বাংলাদেশে হরহামেশা হতে চলছে।
তবে বাংলাদেশে নাম রাখার ক্ষেত্রে মানুষের অজ্ঞতার বিষয়ে গাফফার ভাইয়ের বক্তব্যের সাথে আমি একমত। তিনিই ঠিকই পয়েন্ট আউট করেছেন আবু হুরায়রা অর্থ বিড়াল ছানার পিতা, আবু বকর অর্থ ছাগলের পিতা। যদিও এই নামগুলো সাহাবায়ে কেরামের নাম ছিল। এতে ধর্ম অবমাননার কিছু আমি দেখছিনা। কারণ ইসলামে অর্থপূর্ন নাম রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
তবে গাফফার ভাইয়ের বক্তব্যের অনেকগুলো ইতিবাচক দিক স্বীকার করতেই হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তৈরীর জন্য উচ্চ বর্ণের ব্রাক্ষ্মণরা জড়িত। একথা অনেক আলেমরা এখনও সাহস করে বলতে পারেননি।
এছাড়াও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন বাংলাদেশে এখন প্রকৃত কোনো বিরোধী দল নেই। এটি প্রয়োজনের বিরোধী দল। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের প্রয়োজনে ফাঁসির বিধান রাখার পক্ষেও মত দিয়েছেন। যদিও আলোচনাটি ছিল ‘বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত’ শীর্ষক।
কিন্তু তাঁর মতো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের কাছ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কোনো বক্তব্য পাইনি বলে হতাশই হয়েছি। কারণ একজন সাংবাদিকের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে গণতন্ত্রায়ন ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
ই-মেইল: Imran.ansary@gmail.com