নিউইয়র্ক ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

উন্নয়ন মহাসড়কের ছোটখাট প্রাণহানি!

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৫৬:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬
  • / ৮৮৬ বার পঠিত

সাহেদ আলম: গত প্রায় ১ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে কাজ করলেও, গত নভেম্বর মাসটি বেশিরভাগ সময় ব্যস্থ ছিলাম আমার বর্তমানের আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনকে নিয়েই। এত জটিল আর উত্তেজনায় ভরপুর নির্বাচনে যে মিরকল চরম অনিশ্চয়তার খেলার মতই একটি ফলাফল হয়েছে সেটা হজম করতেই আমার প্রিয় জন্মভুমির অনেক বিষয়ে নজর দেয়া হয়নি। ফেসবুক আর সোসাল মিডিয়ার যতটুকু চোখ পড়েছে তাতে আমার নিজেকে দেশের প্রশ্নে ‘ভোতা বিবেক’ এর নাগরিক মনে হয়েছে। পক্ষান্তরে যারা ছোট খাট (!) অনেক বিষয় নিয়ে এত বেশি হা হুতাশ করছেন দেখে মনে হচ্ছে, ওরা গুটি কয়েকজন কেনই বা এত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে যে সব কিছুতেই এত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
গুটি কয়েকজন বলছি এই কারণে যে, এই প্রতিক্রিয়া দেখানোর মানুষগুলি কমতে কমতে এখন এমন সংখ্যায় নেমে এসেছে যে আপনি তাদেরকে গুনতে পারবেন, এক, দুই , তিন এভাবে। তারা এখনো সাওতাল মরলে, প্রতিবাদ করছে, হিন্দুদের বাড়ি পোড়ালে প্রতিবাদ করছে, শিক্ষক মরলে প্রতিবাদ করছে, রোহিঙ্গা নির্যাতনে কষ্ট পাচ্ছে। এই গোষ্টীর বিপরিতে আরেকটি গুটি কয়েক মানুষের দল আছে তারা প্রধানমন্ত্রীর বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, নতুন বিমান কেনার পক্ষে জনমত তৈরী করছে, সেলিনা হায়াত আইভিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া নেত্রীর স্তুতিস্থাবক গাইছে, আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্সিতে ‘ড. ইউনুস -তোর কি হবে রে কালিয়া’- ভেবে মনে মনে সুখের দিনিপাত করছে। স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা। বাদ বাকী মানুষ, ফোক ফেস্ট এর গান শুনে নিজেকে জাতে তোলার চেষ্টা করছে, কেউবা সুলতান সুলেমান নিয়ে যে নতুন সমস্য উদয় হয়েছে, সমস্যা সংকুল বাংলাদেশে সেটা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত। নতুন কিছু নেই, সবই আগের মত চলছে, প্রতিদিন দৈনিক ফেসবুকে নতুন নতুন ইস্যু তৈরী হচ্ছে, সেগুলি নিয়ে কপচানো চলছেই। কিন্তু কিছু ইস্যুর ফলোআপটা বেশি হচ্ছে, এই যেমন ১ জন শিক্ষককে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটা নিয়ে এত গাত্রদাহ (!) হচ্ছে কতিপয় মানুষের। সেটা কি ঠিক? আমরা কি উন্নয়নের দূর্বার যাত্রায় ছোটখাট প্রানহানিকে গন্তব্যে পৌছানোর চেয়ে বিশ গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি?
প্রায়শ আমরা একথা কথা শুনি, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে আর সেই উন্নয়নের গাড়ি চলছে দূর্বার গতিতে। দূর্বার গতিতে যখন কোন কিছু চলে তখন ছোট খাট অনেক প্রানীকুল যেমন, কুকুর বিড়াল, মোরগ মুরগি, তেলাপোকা, ইদুর বা সড়ক পার হতে যাওয়া বণ্যপ্রানীতো রাস্তায় দু একটা মরবেই।সেটাই বাংলাদেশের সব মহাসড়কের প্রতিদিনের চিত্র। সেখানে দু চারজন শিক্ষক মরবেন, সংখ্যালঘু মরবেন, সাওতাল মরবেন এগুলো মেনে নেয়ার মত যথেষ্ট উদারতা কি আমরা দেখাতে পারছি না?
গেল ২৮ নভেম্বর চাকুরী জাতীয় করণের দাবীতে ময়মনসিংহ এর ফুলবাড়িয়াতে শিক্ষকদের যে আন্দোলন সেখানে পুলিশ গুলি চালালে একজন শিক্ষক আর একজন পথচারী নিহত হয়েছে। তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখা গেল এ সপ্তাহের ফেসবুকে। যিনি নিহত হয়েছেন তিনি যেন তেন একজন শিক্ষক নয়, কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ আর পথচারীর নাম, ৫৫ বছর বয়সী সফর আলী। এই ছবির সাথে আরো দু চারটি ছবি ঘুরছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়, যে পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে শিক্ষকদের, আর তারা খুশিতে লাফালাফি করছে। সবদিক দিয়ে মানুষ যখন জবুথুবু তখন এমন লাফালাফির দু’চারটি ছবিই তো বলে দেয় যে আমরা এখনো লাফাতে জানি, আমরা এখনো প্রতিবাদ করতে জানি। এমন আশাব্যন্জক একটি ছবি নিয়ে প্রতিক্রিয়া তো ইতিবাচক হওয়ারই কথা। তা না হয়ে হচ্ছে উল্টো!
ফুলবাড়ীয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সরকারিকরণ আন্দোলন দাবি আদায় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক এস এম আবুল হাসেম জানান, ফুলবাড়ীয়া মহাবিদ্যালয় ১৯৭২ সালে স্থাপিত। এ কলেজটি সরকারি না করে অন্য একটি ননএমপিও কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে তারা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ৪টি মামলা দিয়ে দুই শতাধিক অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। সাংবাদিকদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে ‘কলেজ ক্যাম্পাসের অফিস রুমে ঢুকে পুলিশ গরুর মতো শিক্ষকদের পেটালো’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এই হলো আমাদের শিক্ষকদের একটা সমস্যা। এরা বেশি বেশি চান, আর চাইতেই থাকেন। সব কিছুকে চাইলেই পাওয়া কি যায়? দেশের এত উন্নয়ন কাজ চলছে, সেগুলি কি বাদ দিয়েই শিক্ষকদের চাওয়া পুরণ করতে হবে? পুলিশ, আমলা, সেনাবাহিনী, সরকারী কর্মচারী, এসবের চাওয়াটা মিটিয়েই তো অন্যদের চাওয়াটা দেখতে হবে তাই না? সরকার আর প্রসাশনের এই মহাযন্ত্র চালাচ্ছে কি শিক্ষকরা, যে তাদের আবদার শুনতে হবে? সরকারী কর্মচারী, সেনাবাহিনী, পুলিশ এমনকি এমপি-মন্ত্রীদের বেতন যে দ্বিগুন করা হয়েছে তাদের রাত দিন পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করে, সেই বাড়তি টাকা যোগাতেই তো হিমশিম। হিমশিম হলেও তাদের টা তো আগে পুরণ করতে হবে তাইনা? এর মধ্যে এমপি সাহেব তার আশে পাশের মানুষের ছোট্ট একটা চাওয়া পূরন করতে গিয়ে ফুলবাড়িয়া কলেজ এর পরিবর্তে অন্য একটিকে সরকারী সুবিধায় চালিত কলেজ কোটায় ঢুকিয়ে দিতে গিয়েছেন বলে নাখা ভুঙ্গা শিক্ষকদের এতই গাত্রদাহ হলো যে তাদের প্রতিবাদ করতে হবে? শান্তিগ্রামের শান্তি ভঙ্গ করে মিছিল মিটিং করতে হবে? সেটা তো আর অন্য কোথাও সম্ভব হলেও এই বঙ্গ দেশে সম্ভব না।
মিছিল, মিটিং , প্রতিবাদ! কি ভয়ানক অশান্তির কথা রে ভাই। এরা তো আতংকবাদী। এই দেশ থেকে এই একটি বিষয়কে তাড়াতে আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা কতই না পরিশ্রম করেছে গেল কয়েকটি বছর।এখনো করে যাচ্ছে চরম পেশাদারিত্বের সাথে।তাইতো ফুলবাড়িয়ার যে পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের অভিযোগ সম্ভবত তার ফেসবুকে পেইজ এ একটি জবাব তিনি দিয়েছেন যে, ‘ডাক্তারের যে কাজ , আইনজীবির যে কাজ, সাংবাদিকের যে কাজ, পুলিশ তার মতই তার কাজ করছে’। সাবাস, আসলেই তো পুলিশের কাজ হলো পেটানো।পিটিয়েছে, আচ্ছা করে পিটিয়েছে, একদম অনেকদিন পর পিটিয়েছে। ইস আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতো তাহারা, যখন রাজপথে মানুষ পিটাইতে পারা যেত, বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেত। নির্বাচনের দাবী টাবী এখন যেন একদম উবে গেছে ঢাকায়। অভ্যাস তো আর বদলে ফেলা যায় না।আগে ছিল ঢাকার পুলিশের দিন, এখন গ্রামের পুলিশের দিন।
আর তাইতো নভেম্বরে শুরুর দিকে, অচ্ছুত (!) সাওতালদের ৪ জনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।দেড় হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয় দেয়া হয়েছে। মামলার ভয়ে রাখা হয়েছে আরো কয়েক হাজার খাই খাই ( শুধু চায় যারা) টাইপের মানুষকে।সেই রেশ কেটে গেছে যদিও, এর পরে এসেছে শিক্ষক দের বিষয়টি। এটাও ভুলে যাবে ফেসবুকিও মানুষজন কয়েকদিনের মধ্যেই। এসব ভুলে যাবার খেলা আছে বলেই উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে। বাশখালিতে চট্টগ্রামের একজন ধন্যাট্য ব্যাক্তিকে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে দেবার কাজটা এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে বহুল কাঙ্খিত , প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্কন্নয়নের এক মাত্র বাটিকা ‘রামপাল পাওয়ার প্লান্ট এর কাজ।কিছু প্রতিক্রিয়াশিল এখনো ওৎ পেতে আছে সুযোগ পেলেই মাঠে নামবে বলে।তবে কাজ হবে না, উন্নয়নের মহাসড়কে যে ‘হ্যামার’ গাড়ি চলছে, সেখানে দু-চারটি প্রাণহানি ঘটলে কিছুই করার নেই।এটাই মোদ্দা কথা।
যাকগে, বেশি আত্ববিশ্বাসে সাওতালদের সমস্যাটাই আসলে বলা হয়নি। প্রফেসর আবুল বারাকাত এবছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালের এই সাওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘সত্য হলো জমি সাওতালদের-ই’ । ইতিহাস বলছে, ১৯৫৬ সালে গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ চিনি কলের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। সেখানে তখন ২০টি গ্রামের মধ্যে ১৫টিতে সাঁওতালদের বসবাস ছিল। বাকি পাঁচটি গ্রামে বাঙালীদের বসবাস ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে গেলে সাঁওতালরা সে জমিতে আবারো ফেরত আসার চেষ্টা করে। ১৯৫৬ সালের জমি অধিগ্রহণের কাগজ-পত্র দেখিয়ে দিনাজপুরের আইনজীবি মাইকেল মালো বলেন, জমি অধিগ্রহণের চুক্তিতে কিছু শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, অধিগ্রহণ করা জমিতে আখ চাষ ছাড়া অন্য কোন কিছু করা যাবেনা । যদি এখানে আখ চাষ ব্যতীত অন্য কিছু করা হয় তাহলে সে জমি পূর্বের অবস্থায় ফেরত নেবার শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে উল্লেখ করছেন মাইকেল মালো। ২০০৪ সালে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবার পর সেখানকার জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মি: মালো জানান। সে যুক্তির ভিত্তিতেই সাঁওতালরা তাদের পূর্ব-পুরুষের জমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে। সাঁওতালদের নেতারা বলছেন, ১৯৫৬ সালের পর তখনকার পরিবারগুলো উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যায়। কিন্তু গত জুন-জুলাই মাসে তারা আবারো গাইবান্ধায় আসে।
সত্যিতো, এরাও দেখি উন্নয়নের বড় ফ্যাকড়া। বাবারা তোমরা খামোখা কেন এই জমি জায়গা নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছো? এমনতো নয় যে এই জমিজমা ছাড়া তোমরা রাস্তায় বসব করছিলে। ১৯৫৬ সাল থেকে এতদিন কি কচু ছিড়েছো যে আবার আগের বাপ দাদার ভিটেয় ফিরে আসতে হবে। আদিবাদীদের ভুমি ব্যবহার নিয়ে যে ভুমি কমিশন আছে সেটা একবারে নির্ভেজাল উন্নয়নের সড়কে উঠে গাড়িতে ঘুম দিয়েছে। সেখানে নাকি একটি ধারা আছে যে, আদিবাসীদের জমি আদি অবস্থায় রাখা ছাড়া কোন পরিবর্তন পরিমার্জনের বিধান নেই। আরে বাপু দুনিয়া বদলিয়েছে, কি সব আগের নিয়মে পড়ে আছো তোমরা। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, পুলিশ এখন অনেক বদলিয়েছে। তার সাথে তিনি এটাও হয়তো বলতে চেয়েছেন দিন বদলিয়েছে, সরকার বদলিয়েছে, তোমরা আর এত প্যাচাল করোনা। করলে, টুশ করে হাতের বন্ধন খুলে গেলে, দু-চার জনের প্রান যেতে পারে। সেটা মহাসড়কে প্রাণহানি বলেই গন্য হবে!
ইতিহাসের পদটীকা: সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। সে সময় সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ।১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিলো বন্দুক ও কামান। তারা ঘোড়া ও হাতি যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে তারা শেষ হয়ে যায়নি, আজো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ব্রিটিশ উন্নয়নে বাধা দিতে চেয়েছিল পারেনি, আজও পারবে না। তারা বার বার পরাজিত হবেই।
আর যেই ১৯৫৬ সালের দিকে গোবিন্দগন্জে চিনিকল প্রতিষ্টার জন্য তাদের জমি নেয়া হয়েছিল, সেই সময়টা ছিল পাকিস্থানী সাল। আইয়ুব বা ইয়াহিয়াদের আমল। সেসময়ও উন্নয়ন করতে চিনিকল প্রতিষ্টা করা হয়। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রার জন্য সে সময় তারা আরো অনেক কিছুই করেছিল। দেশের নদ নদীর চার পাশে বেড়িবাধ, ওয়াপদা, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা ঘাট, সড়ক মহাসড়ক, এমনকি আমাদের বর্তমানের যে সংসদ ভবন সেটিও তারা করেছিল।১৯৬২ সালে আইয়ুব খান জাতীয় সংসদ ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে হাত দিয়েছিলেন।সেই থেকে ব্রিটিশ আর পাকিস্থানী উত্তরাধিকারের শাসন ব্যবস্থা চলছে উন্নয়নের পাগলা ঘোড়ার মত।কিন্তু অবিবেচক আর অকৃতজ্ঞ বাঙালী আইয়ু্বে’র উন্নয়ন মনে রাখেনি, রেখেছে ২৫ শে মার্চ কালোরাত্রির কথা, ব্রিটিশ শাসনের রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা মনে রাখেনি, রেখেছে তাদের ২ শ বছরের শোষন আর নীপিড়নের কথা। এবার নিশ্চই সেটা হবে না, শেখ হাসিনার উন্নয়ন- মহাযাত্রার অমর কথাই লেখা থাকবে ইতিহাসে, উন্নয়েনর মহাসড়কে দু-চারটি প্রাণহানি তাই মেনে নেই সানান্দে!
লেখক: সাংবাদিক
নিউইয়র্ক, ১ ডিসেম্বর।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

উন্নয়ন মহাসড়কের ছোটখাট প্রাণহানি!

প্রকাশের সময় : ০১:৫৬:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

সাহেদ আলম: গত প্রায় ১ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে কাজ করলেও, গত নভেম্বর মাসটি বেশিরভাগ সময় ব্যস্থ ছিলাম আমার বর্তমানের আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনকে নিয়েই। এত জটিল আর উত্তেজনায় ভরপুর নির্বাচনে যে মিরকল চরম অনিশ্চয়তার খেলার মতই একটি ফলাফল হয়েছে সেটা হজম করতেই আমার প্রিয় জন্মভুমির অনেক বিষয়ে নজর দেয়া হয়নি। ফেসবুক আর সোসাল মিডিয়ার যতটুকু চোখ পড়েছে তাতে আমার নিজেকে দেশের প্রশ্নে ‘ভোতা বিবেক’ এর নাগরিক মনে হয়েছে। পক্ষান্তরে যারা ছোট খাট (!) অনেক বিষয় নিয়ে এত বেশি হা হুতাশ করছেন দেখে মনে হচ্ছে, ওরা গুটি কয়েকজন কেনই বা এত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে যে সব কিছুতেই এত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
গুটি কয়েকজন বলছি এই কারণে যে, এই প্রতিক্রিয়া দেখানোর মানুষগুলি কমতে কমতে এখন এমন সংখ্যায় নেমে এসেছে যে আপনি তাদেরকে গুনতে পারবেন, এক, দুই , তিন এভাবে। তারা এখনো সাওতাল মরলে, প্রতিবাদ করছে, হিন্দুদের বাড়ি পোড়ালে প্রতিবাদ করছে, শিক্ষক মরলে প্রতিবাদ করছে, রোহিঙ্গা নির্যাতনে কষ্ট পাচ্ছে। এই গোষ্টীর বিপরিতে আরেকটি গুটি কয়েক মানুষের দল আছে তারা প্রধানমন্ত্রীর বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, নতুন বিমান কেনার পক্ষে জনমত তৈরী করছে, সেলিনা হায়াত আইভিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া নেত্রীর স্তুতিস্থাবক গাইছে, আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্সিতে ‘ড. ইউনুস -তোর কি হবে রে কালিয়া’- ভেবে মনে মনে সুখের দিনিপাত করছে। স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা। বাদ বাকী মানুষ, ফোক ফেস্ট এর গান শুনে নিজেকে জাতে তোলার চেষ্টা করছে, কেউবা সুলতান সুলেমান নিয়ে যে নতুন সমস্য উদয় হয়েছে, সমস্যা সংকুল বাংলাদেশে সেটা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত। নতুন কিছু নেই, সবই আগের মত চলছে, প্রতিদিন দৈনিক ফেসবুকে নতুন নতুন ইস্যু তৈরী হচ্ছে, সেগুলি নিয়ে কপচানো চলছেই। কিন্তু কিছু ইস্যুর ফলোআপটা বেশি হচ্ছে, এই যেমন ১ জন শিক্ষককে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটা নিয়ে এত গাত্রদাহ (!) হচ্ছে কতিপয় মানুষের। সেটা কি ঠিক? আমরা কি উন্নয়নের দূর্বার যাত্রায় ছোটখাট প্রানহানিকে গন্তব্যে পৌছানোর চেয়ে বিশ গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি?
প্রায়শ আমরা একথা কথা শুনি, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে আর সেই উন্নয়নের গাড়ি চলছে দূর্বার গতিতে। দূর্বার গতিতে যখন কোন কিছু চলে তখন ছোট খাট অনেক প্রানীকুল যেমন, কুকুর বিড়াল, মোরগ মুরগি, তেলাপোকা, ইদুর বা সড়ক পার হতে যাওয়া বণ্যপ্রানীতো রাস্তায় দু একটা মরবেই।সেটাই বাংলাদেশের সব মহাসড়কের প্রতিদিনের চিত্র। সেখানে দু চারজন শিক্ষক মরবেন, সংখ্যালঘু মরবেন, সাওতাল মরবেন এগুলো মেনে নেয়ার মত যথেষ্ট উদারতা কি আমরা দেখাতে পারছি না?
গেল ২৮ নভেম্বর চাকুরী জাতীয় করণের দাবীতে ময়মনসিংহ এর ফুলবাড়িয়াতে শিক্ষকদের যে আন্দোলন সেখানে পুলিশ গুলি চালালে একজন শিক্ষক আর একজন পথচারী নিহত হয়েছে। তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখা গেল এ সপ্তাহের ফেসবুকে। যিনি নিহত হয়েছেন তিনি যেন তেন একজন শিক্ষক নয়, কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ আর পথচারীর নাম, ৫৫ বছর বয়সী সফর আলী। এই ছবির সাথে আরো দু চারটি ছবি ঘুরছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়, যে পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে শিক্ষকদের, আর তারা খুশিতে লাফালাফি করছে। সবদিক দিয়ে মানুষ যখন জবুথুবু তখন এমন লাফালাফির দু’চারটি ছবিই তো বলে দেয় যে আমরা এখনো লাফাতে জানি, আমরা এখনো প্রতিবাদ করতে জানি। এমন আশাব্যন্জক একটি ছবি নিয়ে প্রতিক্রিয়া তো ইতিবাচক হওয়ারই কথা। তা না হয়ে হচ্ছে উল্টো!
ফুলবাড়ীয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সরকারিকরণ আন্দোলন দাবি আদায় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক এস এম আবুল হাসেম জানান, ফুলবাড়ীয়া মহাবিদ্যালয় ১৯৭২ সালে স্থাপিত। এ কলেজটি সরকারি না করে অন্য একটি ননএমপিও কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে তারা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ৪টি মামলা দিয়ে দুই শতাধিক অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। সাংবাদিকদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে ‘কলেজ ক্যাম্পাসের অফিস রুমে ঢুকে পুলিশ গরুর মতো শিক্ষকদের পেটালো’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এই হলো আমাদের শিক্ষকদের একটা সমস্যা। এরা বেশি বেশি চান, আর চাইতেই থাকেন। সব কিছুকে চাইলেই পাওয়া কি যায়? দেশের এত উন্নয়ন কাজ চলছে, সেগুলি কি বাদ দিয়েই শিক্ষকদের চাওয়া পুরণ করতে হবে? পুলিশ, আমলা, সেনাবাহিনী, সরকারী কর্মচারী, এসবের চাওয়াটা মিটিয়েই তো অন্যদের চাওয়াটা দেখতে হবে তাই না? সরকার আর প্রসাশনের এই মহাযন্ত্র চালাচ্ছে কি শিক্ষকরা, যে তাদের আবদার শুনতে হবে? সরকারী কর্মচারী, সেনাবাহিনী, পুলিশ এমনকি এমপি-মন্ত্রীদের বেতন যে দ্বিগুন করা হয়েছে তাদের রাত দিন পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করে, সেই বাড়তি টাকা যোগাতেই তো হিমশিম। হিমশিম হলেও তাদের টা তো আগে পুরণ করতে হবে তাইনা? এর মধ্যে এমপি সাহেব তার আশে পাশের মানুষের ছোট্ট একটা চাওয়া পূরন করতে গিয়ে ফুলবাড়িয়া কলেজ এর পরিবর্তে অন্য একটিকে সরকারী সুবিধায় চালিত কলেজ কোটায় ঢুকিয়ে দিতে গিয়েছেন বলে নাখা ভুঙ্গা শিক্ষকদের এতই গাত্রদাহ হলো যে তাদের প্রতিবাদ করতে হবে? শান্তিগ্রামের শান্তি ভঙ্গ করে মিছিল মিটিং করতে হবে? সেটা তো আর অন্য কোথাও সম্ভব হলেও এই বঙ্গ দেশে সম্ভব না।
মিছিল, মিটিং , প্রতিবাদ! কি ভয়ানক অশান্তির কথা রে ভাই। এরা তো আতংকবাদী। এই দেশ থেকে এই একটি বিষয়কে তাড়াতে আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা কতই না পরিশ্রম করেছে গেল কয়েকটি বছর।এখনো করে যাচ্ছে চরম পেশাদারিত্বের সাথে।তাইতো ফুলবাড়িয়ার যে পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের অভিযোগ সম্ভবত তার ফেসবুকে পেইজ এ একটি জবাব তিনি দিয়েছেন যে, ‘ডাক্তারের যে কাজ , আইনজীবির যে কাজ, সাংবাদিকের যে কাজ, পুলিশ তার মতই তার কাজ করছে’। সাবাস, আসলেই তো পুলিশের কাজ হলো পেটানো।পিটিয়েছে, আচ্ছা করে পিটিয়েছে, একদম অনেকদিন পর পিটিয়েছে। ইস আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতো তাহারা, যখন রাজপথে মানুষ পিটাইতে পারা যেত, বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেত। নির্বাচনের দাবী টাবী এখন যেন একদম উবে গেছে ঢাকায়। অভ্যাস তো আর বদলে ফেলা যায় না।আগে ছিল ঢাকার পুলিশের দিন, এখন গ্রামের পুলিশের দিন।
আর তাইতো নভেম্বরে শুরুর দিকে, অচ্ছুত (!) সাওতালদের ৪ জনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।দেড় হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয় দেয়া হয়েছে। মামলার ভয়ে রাখা হয়েছে আরো কয়েক হাজার খাই খাই ( শুধু চায় যারা) টাইপের মানুষকে।সেই রেশ কেটে গেছে যদিও, এর পরে এসেছে শিক্ষক দের বিষয়টি। এটাও ভুলে যাবে ফেসবুকিও মানুষজন কয়েকদিনের মধ্যেই। এসব ভুলে যাবার খেলা আছে বলেই উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে। বাশখালিতে চট্টগ্রামের একজন ধন্যাট্য ব্যাক্তিকে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে দেবার কাজটা এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে বহুল কাঙ্খিত , প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্কন্নয়নের এক মাত্র বাটিকা ‘রামপাল পাওয়ার প্লান্ট এর কাজ।কিছু প্রতিক্রিয়াশিল এখনো ওৎ পেতে আছে সুযোগ পেলেই মাঠে নামবে বলে।তবে কাজ হবে না, উন্নয়নের মহাসড়কে যে ‘হ্যামার’ গাড়ি চলছে, সেখানে দু-চারটি প্রাণহানি ঘটলে কিছুই করার নেই।এটাই মোদ্দা কথা।
যাকগে, বেশি আত্ববিশ্বাসে সাওতালদের সমস্যাটাই আসলে বলা হয়নি। প্রফেসর আবুল বারাকাত এবছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালের এই সাওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘সত্য হলো জমি সাওতালদের-ই’ । ইতিহাস বলছে, ১৯৫৬ সালে গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ চিনি কলের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। সেখানে তখন ২০টি গ্রামের মধ্যে ১৫টিতে সাঁওতালদের বসবাস ছিল। বাকি পাঁচটি গ্রামে বাঙালীদের বসবাস ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে গেলে সাঁওতালরা সে জমিতে আবারো ফেরত আসার চেষ্টা করে। ১৯৫৬ সালের জমি অধিগ্রহণের কাগজ-পত্র দেখিয়ে দিনাজপুরের আইনজীবি মাইকেল মালো বলেন, জমি অধিগ্রহণের চুক্তিতে কিছু শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, অধিগ্রহণ করা জমিতে আখ চাষ ছাড়া অন্য কোন কিছু করা যাবেনা । যদি এখানে আখ চাষ ব্যতীত অন্য কিছু করা হয় তাহলে সে জমি পূর্বের অবস্থায় ফেরত নেবার শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে উল্লেখ করছেন মাইকেল মালো। ২০০৪ সালে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবার পর সেখানকার জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মি: মালো জানান। সে যুক্তির ভিত্তিতেই সাঁওতালরা তাদের পূর্ব-পুরুষের জমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে। সাঁওতালদের নেতারা বলছেন, ১৯৫৬ সালের পর তখনকার পরিবারগুলো উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যায়। কিন্তু গত জুন-জুলাই মাসে তারা আবারো গাইবান্ধায় আসে।
সত্যিতো, এরাও দেখি উন্নয়নের বড় ফ্যাকড়া। বাবারা তোমরা খামোখা কেন এই জমি জায়গা নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছো? এমনতো নয় যে এই জমিজমা ছাড়া তোমরা রাস্তায় বসব করছিলে। ১৯৫৬ সাল থেকে এতদিন কি কচু ছিড়েছো যে আবার আগের বাপ দাদার ভিটেয় ফিরে আসতে হবে। আদিবাদীদের ভুমি ব্যবহার নিয়ে যে ভুমি কমিশন আছে সেটা একবারে নির্ভেজাল উন্নয়নের সড়কে উঠে গাড়িতে ঘুম দিয়েছে। সেখানে নাকি একটি ধারা আছে যে, আদিবাসীদের জমি আদি অবস্থায় রাখা ছাড়া কোন পরিবর্তন পরিমার্জনের বিধান নেই। আরে বাপু দুনিয়া বদলিয়েছে, কি সব আগের নিয়মে পড়ে আছো তোমরা। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, পুলিশ এখন অনেক বদলিয়েছে। তার সাথে তিনি এটাও হয়তো বলতে চেয়েছেন দিন বদলিয়েছে, সরকার বদলিয়েছে, তোমরা আর এত প্যাচাল করোনা। করলে, টুশ করে হাতের বন্ধন খুলে গেলে, দু-চার জনের প্রান যেতে পারে। সেটা মহাসড়কে প্রাণহানি বলেই গন্য হবে!
ইতিহাসের পদটীকা: সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। সে সময় সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ।১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিলো বন্দুক ও কামান। তারা ঘোড়া ও হাতি যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে তারা শেষ হয়ে যায়নি, আজো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ব্রিটিশ উন্নয়নে বাধা দিতে চেয়েছিল পারেনি, আজও পারবে না। তারা বার বার পরাজিত হবেই।
আর যেই ১৯৫৬ সালের দিকে গোবিন্দগন্জে চিনিকল প্রতিষ্টার জন্য তাদের জমি নেয়া হয়েছিল, সেই সময়টা ছিল পাকিস্থানী সাল। আইয়ুব বা ইয়াহিয়াদের আমল। সেসময়ও উন্নয়ন করতে চিনিকল প্রতিষ্টা করা হয়। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রার জন্য সে সময় তারা আরো অনেক কিছুই করেছিল। দেশের নদ নদীর চার পাশে বেড়িবাধ, ওয়াপদা, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা ঘাট, সড়ক মহাসড়ক, এমনকি আমাদের বর্তমানের যে সংসদ ভবন সেটিও তারা করেছিল।১৯৬২ সালে আইয়ুব খান জাতীয় সংসদ ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে হাত দিয়েছিলেন।সেই থেকে ব্রিটিশ আর পাকিস্থানী উত্তরাধিকারের শাসন ব্যবস্থা চলছে উন্নয়নের পাগলা ঘোড়ার মত।কিন্তু অবিবেচক আর অকৃতজ্ঞ বাঙালী আইয়ু্বে’র উন্নয়ন মনে রাখেনি, রেখেছে ২৫ শে মার্চ কালোরাত্রির কথা, ব্রিটিশ শাসনের রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা মনে রাখেনি, রেখেছে তাদের ২ শ বছরের শোষন আর নীপিড়নের কথা। এবার নিশ্চই সেটা হবে না, শেখ হাসিনার উন্নয়ন- মহাযাত্রার অমর কথাই লেখা থাকবে ইতিহাসে, উন্নয়েনর মহাসড়কে দু-চারটি প্রাণহানি তাই মেনে নেই সানান্দে!
লেখক: সাংবাদিক
নিউইয়র্ক, ১ ডিসেম্বর।