নিউইয়র্ক ১২:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আমেরিকান গণতন্ত্র, আইন ও ট্রাম্পের গ্রেফতার

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:২৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩
  • / ৫৮ বার পঠিত

মার্গারেট সুলিভান ডেস্ক :  যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির আদালত চত্বরে ডেনাল্ড ট্রাম্প! যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে আনা ৩৭টি অভিযোগ পড়ে শোনান বিচারক জনাথন গুডম্যান। বহুল আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কোর্টরুমে ঢুকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে বলেন, ‘আমি নির্দোষ।’

এরপর আদালত থেকে বের হয়ে মিয়ামির একটি কিউবান হোটেলে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গাড়িতে চেপে বসেন তিনি। ট্রাম্পের গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তখন দুপাশে বহু সমর্থক হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তার উদ্দেশে। কারো হাতে ব্যানার, কারো হাতে মেলে ধরা পতাকায় লেখা ‘ট্রাম্প’। কারো হাতের ব্যানারে আবার শোভা পাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল ট্রাম্পের ছবি। অনেকের হাতে বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত ব্যানারও দৃষ্টি কাড়ছে সমানভাবে। আছে বিপরীত চিত্রও—ট্রাম্পবিরোধী ব্যানারও উঁকি দিচ্ছে ভিড়ের মধ্য থেকে!

গতকাল ছিল ট্রাম্পের জন্মদিন। ৭৭ বছরে পা রেখেছেন তিনি। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আদালতে এভাবে চক্কর কাটতে দেখাটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বটে। কিন্তু এ কথা মানতে হবে, এতে করে গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই প্রস্ফুটিত হয়েছে। কারণ, প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার সময় তিনি এমন সব স্পর্শকাতর নথি সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, বলা হচ্ছে, কোনো  প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় ফাইলপত্র এভাবে তুচ্ছজ্ঞান করে বাথরুমের মতো জায়গায় রাখতে পারেন, এমন কথা চিন্তারও বাইরে!

ট্রম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ার সময় বেশ কিছু গোপনীয় নথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।আমেরিকান আইন অনুযায়ী, এমন কাজ আইনত করতে পারেন না তিনি। এ ধরনের ফাইল ফাঁস হলে তা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদের বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাত্, ট্রাম্প সঠিক কাজ করেননি এবং এ কারণেই সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়েও তাকে আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। উল্লেখ থাকে যে, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাম্পের জেল খাটতে হতে পারে বেশ কয়েক বছর!

সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের এভাবে আদালতে যাওয়ার ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। নিজেকে ‘নিরপরাধ’ বলার পর এখন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। যদিও তিনি সে সময় আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা এমনও ধারণা করছেন, বিচার শুরু হতে বছরখানেক লেগে যাবে। যা হোক, ট্রাম্প জানিয়েছেন যে, তিনি ‘নির্দোষ’। তিনি যাতে আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন, সে জন্যই এসব করা হচ্ছে। মামলায় যাই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন তিনি।

ট্রাম্পের নির্বাচনে লড়ার সংবাদ এতটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে এ কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন নথি নিজের কাছে রেখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! এ ছাড়া বহু সরকারি গোপন নথি ব্যক্তিগত জিম্মায় রেখেছিলেন তিনি, যা হতবাক করেছে সবাইকে। এর আগে ‘ডেনাল্ড ট্রাম্প ও পর্ন তারকা স্টরমি ড্যানিয়েল’ ইস্যুতে গত মার্চে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হন ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত করার ঘটনার সাক্ষী হয় যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প যে কেবল নিয়ম লঙ্ঘন করে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন, ব্যাপারটা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অজস্র মিথ্যা বলার কারণে আমেরিকার ভেতরে-বাইরে একধরনের ‘সুনাম’ও আছে তার! এসবের বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এভাবে বারবার বিচারের মুখোমুখি করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের (ইউএস ডেমোক্রেসি) গায়ে ধূলির আস্তরণ পড়েনি মোটেই—যেমনটা মনে করছেন অনেকেই; বরং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্র আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে, বলা যায়।

আমরা দেখেছি, প্রতিবারই নিজের নির্দোষতার ওপর জোর দিয়েছেন ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে ট্রাম্পের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তার আইনজীবীকেও বলতে শোনা গেছে, ‘আমার মক্কেল অবশ্যই দোষী নয়।’ সাধারণত এরকম কথাই সচারচর শোনা যায় অভিযুক্তের মুখে—এটাই স্বাভাবিক। তবে ট্রাম্প ও তার আইনজীবীর মুখে এ ধরনের কথা যেন বড্ড বেমানান! সহজ করে বলতে গেলে, সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন এবং এর পরও তিনি ও তার কর্মী-সমর্থকেরা যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে, যেন আমেরিকান রাজনৈতিক মহাকাব্যের ‘ঐতিহাসিক পর্ব (শো)’ চলছে। ব্যাপারটা বেশ উদ্ভট!

নীল স্যুট ও দীর্ঘ লাল টাই পরে মিয়ামির ফেডারেল কোর্ট হাউজের কাছে যাওয়ার সময় ট্রাম্পকে যেভাবে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা গেছে, তা দৃষ্টিতে আটকে গেছে অনেকের। ‘আমি একজন নির্দোষ মানুষ’—সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ট্রাম্পের এমন কথা বলার পর বিভিন্ন মহল থেকে অজস্র প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। মন্তব্যের ঘরে এমন কথাও লেখেন অনেকে—‘আমি কখনই ভাবিনি যে,  যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এমন কাজ করতে পারেন এবং তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন, তার অবস্থা যে এরকম পর্যায়ে যেতে পারে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য!’

ট্রাম্পের পক্ষে-বিপক্ষে এ ধরনের নানা কথা বলা হলেও এটাই আসল সত্য যে, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান শিবির থেকে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ট্রাম্প, তবে তা তার জন্য সহজ হবে না। এ দাবির পক্ষে সহজ যুক্তি হলো, আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে যথারীতি যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে ট্রাম্প ও তার পক্ষ থেকে, তা যথেষ্ট দুর্বল ও ভিত্তিহীন। অর্থাত্, আগামী প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে জিততে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে, এ থেকে পরিত্রাণের যত চেষ্টাই করুন না কেন তিনি।

মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতায় থাকাকালে কিংবা ‘সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে ট্রাম্প সম্ভবত চিন্তা করেছিলেন যে, একটু একটু করে, তথা ক্রমাগতভাবে এমন এক অবস্থা তৈরি করা সম্ভব, যার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হওয়াসহ নিজেকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ রাখার মতো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে। বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের এ ধরনের চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের ভাবনা হয়তো ‘কর্তৃত্ববাদী’ দেশে আলোর মুখ দেখতে পারে, তবে কোনোভাবেই আমেরিকার মাটিতে এর কোনো স্থান নেই।

ট্রাম্প বরাবরই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ দাবি করে আসছেন। নিজেকে তিনি সব সময়ই ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। ‘আমি কোনো ভুল করিনি’—এ কথার বৃত্তের মধ্যেই তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব দৃশ্য কী বলে? ট্রাম্পের বাসভবন মার-এ-লাগোর বাথরুমের ভেতরে ঝাঁ চকচকে ঝাড়বাতির নিচ থেকে যখন অত্যন্ত সংবেদনশীল নথিগুলো উদ্ধার করা হয়, তখন তা আমাদের যারপরনাই হতবাক করেছে! আমরা সবাই দেখেছি সেই দৃশ্য। এটা কি মেনে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় হতে পারে? এ ঘটনায় শুধু আশ্চর্য নয়, অত্যাশ্চর্য হয়েছেন অনেকে।

এমনকি তার নিজ দলের লোকজনই এতে হতবাক ! ট্রাম্পের দীর্ঘকালের অনুগত সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বারকে পর্যন্ত বলতে দেখা গেছে, ‘এই নথিগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে, এটা স্পষ্টভাবে হতবাক হওয়ার মতো!’ বার আরও বলেছেন, ‘এ ঘটনা অর্ধেক বা আংশিক সত্য হলেও ট্রাম্প ভালো কাজ করেননি বলে ধরে নিতে হবে।’ এর আগে দক্ষিণ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ট্রাম্পের দোষকে আপনি কীভাবে দেখছেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে গ্রাহাম বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সমস্যায় পড়বেন—এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে তিনি যদি অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড করে বসেন, তার জন্য ভুগতে হবে তাকেই।’ অর্থাত্, বলা যায়, ভালো কিছু করেননি ট্রাম্প!

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে ‘আইন’ একটি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রনির্ধারিত আইন রাষ্ট্রের প্রত্যেকের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। এবং অবশ্যই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ করাটা মুশকিল বা অসম্ভব। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যক্তিক্রম কিছু ঘটতে দেখা যায় বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে—এটা আমেরিকা, এখানে ওসব চলবে না, চলার কোনো সুযোগ নেই।

আর হ্যাঁ, ট্রাম্পের মাথায় সাজার খড়্গ চাপাতে হয়তো সময় লাগতে পারে। তবে আইনকে পাশ কাটিয়ে কিছু করার চিন্তা থেকে ট্রাম্প যা করেছেন বা করছেন, তা কখনোই আইনকে টেক্কা দিতে পারবে না—এটাই ‘আমেরিকার আইন’! কে জানে, সত্যি সত্যিই দীর্ঘ মেয়াদে গরাদের ওপাশে ট্রাম্প আটকে যান কি না! লেখক :‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মিডিয়া, রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক আমেরিকান কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন
সুমি/হককথা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আমেরিকান গণতন্ত্র, আইন ও ট্রাম্পের গ্রেফতার

প্রকাশের সময় : ১২:২৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩

মার্গারেট সুলিভান ডেস্ক :  যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির আদালত চত্বরে ডেনাল্ড ট্রাম্প! যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে আনা ৩৭টি অভিযোগ পড়ে শোনান বিচারক জনাথন গুডম্যান। বহুল আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কোর্টরুমে ঢুকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে বলেন, ‘আমি নির্দোষ।’

এরপর আদালত থেকে বের হয়ে মিয়ামির একটি কিউবান হোটেলে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গাড়িতে চেপে বসেন তিনি। ট্রাম্পের গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তখন দুপাশে বহু সমর্থক হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তার উদ্দেশে। কারো হাতে ব্যানার, কারো হাতে মেলে ধরা পতাকায় লেখা ‘ট্রাম্প’। কারো হাতের ব্যানারে আবার শোভা পাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল ট্রাম্পের ছবি। অনেকের হাতে বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত ব্যানারও দৃষ্টি কাড়ছে সমানভাবে। আছে বিপরীত চিত্রও—ট্রাম্পবিরোধী ব্যানারও উঁকি দিচ্ছে ভিড়ের মধ্য থেকে!

গতকাল ছিল ট্রাম্পের জন্মদিন। ৭৭ বছরে পা রেখেছেন তিনি। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আদালতে এভাবে চক্কর কাটতে দেখাটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বটে। কিন্তু এ কথা মানতে হবে, এতে করে গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই প্রস্ফুটিত হয়েছে। কারণ, প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার সময় তিনি এমন সব স্পর্শকাতর নথি সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, বলা হচ্ছে, কোনো  প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় ফাইলপত্র এভাবে তুচ্ছজ্ঞান করে বাথরুমের মতো জায়গায় রাখতে পারেন, এমন কথা চিন্তারও বাইরে!

ট্রম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ার সময় বেশ কিছু গোপনীয় নথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।আমেরিকান আইন অনুযায়ী, এমন কাজ আইনত করতে পারেন না তিনি। এ ধরনের ফাইল ফাঁস হলে তা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদের বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাত্, ট্রাম্প সঠিক কাজ করেননি এবং এ কারণেই সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়েও তাকে আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। উল্লেখ থাকে যে, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাম্পের জেল খাটতে হতে পারে বেশ কয়েক বছর!

সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের এভাবে আদালতে যাওয়ার ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। নিজেকে ‘নিরপরাধ’ বলার পর এখন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। যদিও তিনি সে সময় আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা এমনও ধারণা করছেন, বিচার শুরু হতে বছরখানেক লেগে যাবে। যা হোক, ট্রাম্প জানিয়েছেন যে, তিনি ‘নির্দোষ’। তিনি যাতে আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন, সে জন্যই এসব করা হচ্ছে। মামলায় যাই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন তিনি।

ট্রাম্পের নির্বাচনে লড়ার সংবাদ এতটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে এ কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন নথি নিজের কাছে রেখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! এ ছাড়া বহু সরকারি গোপন নথি ব্যক্তিগত জিম্মায় রেখেছিলেন তিনি, যা হতবাক করেছে সবাইকে। এর আগে ‘ডেনাল্ড ট্রাম্প ও পর্ন তারকা স্টরমি ড্যানিয়েল’ ইস্যুতে গত মার্চে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হন ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত করার ঘটনার সাক্ষী হয় যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প যে কেবল নিয়ম লঙ্ঘন করে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন, ব্যাপারটা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অজস্র মিথ্যা বলার কারণে আমেরিকার ভেতরে-বাইরে একধরনের ‘সুনাম’ও আছে তার! এসবের বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এভাবে বারবার বিচারের মুখোমুখি করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের (ইউএস ডেমোক্রেসি) গায়ে ধূলির আস্তরণ পড়েনি মোটেই—যেমনটা মনে করছেন অনেকেই; বরং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্র আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে, বলা যায়।

আমরা দেখেছি, প্রতিবারই নিজের নির্দোষতার ওপর জোর দিয়েছেন ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে ট্রাম্পের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তার আইনজীবীকেও বলতে শোনা গেছে, ‘আমার মক্কেল অবশ্যই দোষী নয়।’ সাধারণত এরকম কথাই সচারচর শোনা যায় অভিযুক্তের মুখে—এটাই স্বাভাবিক। তবে ট্রাম্প ও তার আইনজীবীর মুখে এ ধরনের কথা যেন বড্ড বেমানান! সহজ করে বলতে গেলে, সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন এবং এর পরও তিনি ও তার কর্মী-সমর্থকেরা যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে, যেন আমেরিকান রাজনৈতিক মহাকাব্যের ‘ঐতিহাসিক পর্ব (শো)’ চলছে। ব্যাপারটা বেশ উদ্ভট!

নীল স্যুট ও দীর্ঘ লাল টাই পরে মিয়ামির ফেডারেল কোর্ট হাউজের কাছে যাওয়ার সময় ট্রাম্পকে যেভাবে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা গেছে, তা দৃষ্টিতে আটকে গেছে অনেকের। ‘আমি একজন নির্দোষ মানুষ’—সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ট্রাম্পের এমন কথা বলার পর বিভিন্ন মহল থেকে অজস্র প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। মন্তব্যের ঘরে এমন কথাও লেখেন অনেকে—‘আমি কখনই ভাবিনি যে,  যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এমন কাজ করতে পারেন এবং তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন, তার অবস্থা যে এরকম পর্যায়ে যেতে পারে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য!’

ট্রাম্পের পক্ষে-বিপক্ষে এ ধরনের নানা কথা বলা হলেও এটাই আসল সত্য যে, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান শিবির থেকে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ট্রাম্প, তবে তা তার জন্য সহজ হবে না। এ দাবির পক্ষে সহজ যুক্তি হলো, আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে যথারীতি যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে ট্রাম্প ও তার পক্ষ থেকে, তা যথেষ্ট দুর্বল ও ভিত্তিহীন। অর্থাত্, আগামী প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে জিততে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে, এ থেকে পরিত্রাণের যত চেষ্টাই করুন না কেন তিনি।

মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতায় থাকাকালে কিংবা ‘সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে ট্রাম্প সম্ভবত চিন্তা করেছিলেন যে, একটু একটু করে, তথা ক্রমাগতভাবে এমন এক অবস্থা তৈরি করা সম্ভব, যার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হওয়াসহ নিজেকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ রাখার মতো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে। বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের এ ধরনের চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের ভাবনা হয়তো ‘কর্তৃত্ববাদী’ দেশে আলোর মুখ দেখতে পারে, তবে কোনোভাবেই আমেরিকার মাটিতে এর কোনো স্থান নেই।

ট্রাম্প বরাবরই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ দাবি করে আসছেন। নিজেকে তিনি সব সময়ই ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। ‘আমি কোনো ভুল করিনি’—এ কথার বৃত্তের মধ্যেই তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব দৃশ্য কী বলে? ট্রাম্পের বাসভবন মার-এ-লাগোর বাথরুমের ভেতরে ঝাঁ চকচকে ঝাড়বাতির নিচ থেকে যখন অত্যন্ত সংবেদনশীল নথিগুলো উদ্ধার করা হয়, তখন তা আমাদের যারপরনাই হতবাক করেছে! আমরা সবাই দেখেছি সেই দৃশ্য। এটা কি মেনে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় হতে পারে? এ ঘটনায় শুধু আশ্চর্য নয়, অত্যাশ্চর্য হয়েছেন অনেকে।

এমনকি তার নিজ দলের লোকজনই এতে হতবাক ! ট্রাম্পের দীর্ঘকালের অনুগত সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বারকে পর্যন্ত বলতে দেখা গেছে, ‘এই নথিগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে, এটা স্পষ্টভাবে হতবাক হওয়ার মতো!’ বার আরও বলেছেন, ‘এ ঘটনা অর্ধেক বা আংশিক সত্য হলেও ট্রাম্প ভালো কাজ করেননি বলে ধরে নিতে হবে।’ এর আগে দক্ষিণ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ট্রাম্পের দোষকে আপনি কীভাবে দেখছেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে গ্রাহাম বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সমস্যায় পড়বেন—এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে তিনি যদি অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড করে বসেন, তার জন্য ভুগতে হবে তাকেই।’ অর্থাত্, বলা যায়, ভালো কিছু করেননি ট্রাম্প!

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে ‘আইন’ একটি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রনির্ধারিত আইন রাষ্ট্রের প্রত্যেকের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। এবং অবশ্যই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ করাটা মুশকিল বা অসম্ভব। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যক্তিক্রম কিছু ঘটতে দেখা যায় বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে—এটা আমেরিকা, এখানে ওসব চলবে না, চলার কোনো সুযোগ নেই।

আর হ্যাঁ, ট্রাম্পের মাথায় সাজার খড়্গ চাপাতে হয়তো সময় লাগতে পারে। তবে আইনকে পাশ কাটিয়ে কিছু করার চিন্তা থেকে ট্রাম্প যা করেছেন বা করছেন, তা কখনোই আইনকে টেক্কা দিতে পারবে না—এটাই ‘আমেরিকার আইন’! কে জানে, সত্যি সত্যিই দীর্ঘ মেয়াদে গরাদের ওপাশে ট্রাম্প আটকে যান কি না! লেখক :‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মিডিয়া, রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক আমেরিকান কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন
সুমি/হককথা