সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান ৬ আন্তর্জাতিক সংস্থার
- প্রকাশের সময় : ০৩:২০:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩
- / ৪৬ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : আটটি নিরপেক্ষ সংগঠন বলেছে, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অধীনে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে আছেন। সরকার সমর্থকদের দ্বারা হয়রানি, নজরদারি এবং শারীরিক হামলার শিকার হচ্ছেন। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, এ বছর প্রথম তিন মাসে সরকার এবং তার সমর্থকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন ৫৬ জন সাংবাদিক। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে ৬টি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। এগুলো হলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড এলায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স। এতে বলা হয়েছে, সরকারি নীতি এবং কর্মকা-ের বিরুদ্ধে যেসব সাংবাদিক এবং অন্যরা মুক্তভাবে সমালোচনা করেন, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হওয়ার শিডিউল আছে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে উন্মুক্তভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের শর্তকে খর্ব করা হচ্ছে মুক্ত মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিধিনিষেধ দিয়ে। এতে ৫ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তা হলো-
১. আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার স্থগিত করতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে।
২. সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংস সব আক্রমণের বিরুদ্ধে দ্রুত, পক্ষপাতিত্বহীন, স্বচ্ছ এবং কার্যকর তদন্ত করতে হবে।
সন্দেহজনক অপরাধীকে সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. মুক্তভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা করার জন্য যারা অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে, মানুষ যেন অনলাইনে বা অফলাইনে কোনো ভীতি ছাড়াই সমালোচনা করতে পারে, তাদের উদ্বেগ জানাতে পারে।
৫. বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন আইনগুলোর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যাতে মিডিয়াগুলো অবাধে, নিরপেক্ষভাবে তাদের কর্মকা- পরিচালনার অধিকার ভোগ করতে পারে। নিউজ আউটলেট থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে এবং বিধিনিষেধ ছাড়াই জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে এ প্রসঙ্গে এ বছর ৪ঠা এপ্রিলের ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক সাংবাদিক আইয়ুব মেহজির ওপর সশস্ত্র একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালায়। তাকে দোতলা একটি ভবন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মেহজি বেঁচে যান। কিন্তু তিনি বলেছেন, একটি গ্রুপ অন্যায়ভাবে ভূমি গ্রাস করছিল এবং পাহাড় কাটছিল। এর সঙ্গে জড়িত সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা। এ নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে তার ওপর প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয়েছে।
৩০শে মার্চ শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করে। তিনি দেশে জীবনযাত্রার খবর নিয়ে রিপোর্ট করার প্রতিশোধ নিতে এটা করা হয়েছে। তাকে মধ্যরাতে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, তিনি ওই রিপোর্ট করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। এ ছাড়া আরও অভিযোগ তোলা হয়। একই রিপোর্টের জন্য এই আইনের অধীনে মামলা করা হয় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ, এর একজন ক্যামেরাম্যান ও অন্য অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে। পরে জামিনে মুক্ত রয়েছেন শামস। তাকে গ্রেপ্তারের ১২ দিন পরে পার্লামেন্টে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম আলোকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন। তার এ বিবৃতির পর একদল যুবক প্রথম আলো অফিসে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায় অফিসের বাইরের দিকে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের নীতি, কথিত দুর্নীতি এবং বাংলাদেশে কলুষিত বাণিজ্যিক চর্চাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিকদের কাজের প্রতিশোধ নেয়ার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অব্যাহত ব্যবহারে আমরা হতাশ। এই আইনের অধীনে কেউ ভিন্ন মত পোষণ করলে তাকে বড় অঙ্কের জরিমানা এবং শাস্তি হিসেবে জেলের বিধান আছে। অনলাইনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এমন সন্দেহেই ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার অনুমোদন করে। এ বছর মে মাসের শুরু পর্যন্ত ২০১৮ সালে এই আইন হওয়ার সময় থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩৩৯টি মামলা করা হয়েছে। এমন হিসাব ঢাকাভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের। ফলে নিউজরুমগুলো আরও বেশি সেলফ সেন্সরশিপের দিকে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ চায় এমন খবর তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হোক। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারকে অনুমোদন দেয় এসব আর্টিকেল মুছে দিতে এবং তথ্য বা ডাটা ইন্টারনেটে ব্লক করে দেয়ার অনুমোদন দেয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনকেও হাতিয়ার করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট লঙ্ঘন করার অভিযোগে সরকার দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ২০শে ফেব্রুয়ারি কর্তৃপক্ষ দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। কর্তৃপক্ষ ব্লক করে দেয় ৫৪টি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট। এক্ষেত্রে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বলে বলা হয়। ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দ-বিধির অধীনে চলমান তদন্তের মুখোমুখি রয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম। তিনি সরকারের কথিত দুর্নীতি এবং করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। দৃশ্যত তার প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি দেয়াতে আমরা উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে আছে ২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহরেুন রুনি হত্যাকা-। এই হত্যার তদন্তে অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কমপক্ষে ৯৫ বার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বাড়িয়েছে র্যাব। এতে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান নিষ্পেষণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার মধ্যদিয়ে সাংবাদিক, সুশীল সমাজের ওপর শীতল এক প্রভাব পড়ছে। সাংবাদিকতায় যে স্বাধীনতা আছে তাকে গুরুতরভাবে গলাটিপে ধরা হচ্ছে। ২০২২ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স করে রিপোর্টার্স উইদাআউট বর্ডার্স। এতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৬২ নম্বরে। এর মধ্যদিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ পারফরমেন্স করে বাংলাদেশ। সূত্র : মানবজমিন
সুমি/হককথা