নিউইয়র্ক ০১:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মৃত্যুঞ্জয়ী ফরিদ আলম বলছি…

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:৩৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০
  • / ১০৭ বার পঠিত

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের কুইন্স হাসপাতালে চিকি’সা শেষে পরিবারের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল সাংবাদিক ফরিদ আলম। ছবি সংগৃহীত
হককথা ডেস্ক: সারাবিশ্ব এখন এক অদৃশ্যমান জীবনঘাতী শত্রæর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। করোনা ভাইরাস নামের এই শত্রæকে খালি চোখে দেখাও যায় না, মারাও যায় না। আর তাই অভিন্ন শত্রæর বিরুদ্ধে এক হয়েও লক্ষ-কোটি মানুষ অসহায় জীবন-যাপন করছে দরজা-জানালা বন্ধ করে। লক্ষাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া এই ভাইরাসের কারণে পাল্টে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন। করোনার সাথে যুদ্ধ করে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও বিজয়ী হওয়ার উদাহরণও রয়েছে অনেক। আমি সেই বিজয়ী দলের সৌভাগ্যবানদের একজন। আমি করোনায় আক্রান্ত হবার আগে, পরে ও সুস্থ হবার পরের কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক নবযুগের নিয়মিত এবং অনিয়মিত পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই।
মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে নিউইয়র্কের মতো জনবহুল ষ্টেটে এর যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে সেটা নিয়েও খুব লেখালেখি হচ্ছিলো। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ভেবেছিলাম ১৫ মার্চের মধ্যেই বাসায় ঢুকবো। এই ভাইরাসের আগ্রাসন না থামা পর্যন্ত আর বাইরে বের হবো না। সেই চিন্তা থেকে নিজের নতুন ভেঞ্চার এটিভি’র স্টুডিও গোছানোর কাজটা দ্রæতই শেষ করতে চাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম করোনার প্রভাব কমলে তারপর টিভি’র সম্প্রচারের কাজ শুরু করবো। কিন্তু তা আর পারলাম না। ১৮ মার্চ পর্যন্ত স্টুডিওর অটোকিউ পাবার আশায় বসে থেকেও আর ডেলিভারী পেলাম না করোনার কারণে। মন খারাপ করে ভাবলাম শেষদিনে কিছু প্রয়োজনীয় বাজার করেই বরং বাসায় ফিরে যাই।
করোনা পেন্ডামিক হওয়ার কারণে আমি ১৫ মার্চ থেকেই মাস্ক পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৮ মার্চ যখন আমি বাজার করতে জ্যাকসন হাইটস-এর আপনা বাজার-এ গেলাম তখন শুধুমাত্র ওই সময়টুকুতেই আমার মুখে মাস্ক ছিল না। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ করে একজনের হাঁচি থেকেই সম্ভবত আমি আক্রান্ত হই। কারণ হাঁচি দেয়া ওই ব্যক্তিকে আমার খুব ক্লান্ত এবং অসুস্থ মনে হচ্ছিল। আমার মুখে মাস্ক নেই বলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমি চাপাতা, কয়েক প্যাকেট টোস্ট বিস্কুট আর সামান্য কিছু বাজার নিয়ে বাসায় ফিরি। বলে রাখতে চাই, ওই বিস্কুটের সবগুলোই ছিল মেয়াদউত্তীর্ণ এবং দূর্ঘন্ধময়। তাড়াহুড়ার কারণে তারিখ দেখার সময় এবং ধৈর্য তখন ছিল না। যাই হউক বাজার করার সময়টাতে আমার মাস্ক না থাকার কারণেই আমি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হই বলে আমার বিশ্বাস। এটা আমার অসচেতনার ফল বলেই আমি মনে করি।
পরিবারের সাথে ফরিদ আলম। ছবি সংগৃহীত
যাই হউক রাতে বাসায় ফিরে আমারও ক্লান্ত লাগছিল। রাতের খাবার শেষ করে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। খুব ভোরে খেয়াল করলাম অনেক ঠান্ডা লাগছে আর ভীষণ জ্বর। আমার স্ত্রী মেপে দেখলেন ১০৩ ডিগ্রী। পরদিন সারাদিন আমি বুঝার চেষ্টা করলাম রাতে আমার দিকে ফ্যান থাকার কারণে জ্বর বা শরীর খারাপ লাগছে কিনা? সারাদিনেও শরীরের তাপমাত্রা আর কমেনি। আমি ওইদিন ডাক্তারকে ফোন করিনি। তবে রাতে ২ টা ৫০০ এমজি টাইলানল খেলাম। পরদিন সকালে দেখলাম আমার অবস্থা আরও খারাপের দিকে। তাপমাত্রাও অপরিবর্তীত।
দুপুরের দিকে আমি আমার ডাক্তারের নম্বরে ফোন দিলাম। ডাক্তারকে পেলাম না। একজন ভদ্রমহিলা ধরে বললেন, আমাকে একটা অ্যাপস ফোনে ডাউনলোড করে ডাক্তারকে ভিডিও কল দিতে। এটা তাদের নিজস্ব অ্যাপস। সেদিন আর ডাক্তারের সাথে আমার কথা হলো না। কিন্তু সেই রাতে আমার শ্বাসকষ্ট এই পর্যায়ে চলে গেলো যে, আমার মনে হলো আমি এখনি মরে যাবো। পরের দিন আমি ডাক্তারকে ভিডিও কল দিলাম। আমার সমস্যা শুনে কোনো কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, শ্বাসকষ্ট কেনো হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছেন না। এমনটা তিনি কখনো শুনেনি।
এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই, হাসপাতালে ৭ দিন থাকার সময় এবং সুস্থ হবার পরে অনেক করোনা পজিটিভ রোগীর সাথে কথা বলেছি। করোনার উপসর্গ কারোটার সাথে কারো নাও মিলতে পারে। যেমন আমার জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট ছিল। আমি কিছুই খেতে পারতাম না পানি ছাড়া। হাসপাতালে অনেককেই দেখেছি তাদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার ডায়রিয়া, গলাব্যাথা ছিল না। কাশি ছিল খুব সামান্য। কিন্তু সেটা শুষ্ক কাশি ছিল না। অনেক করোনা পজিটিভ রোগীর সাথে কথা বলে, আমি এটা বলতে পারি জ্বরটা প্রায় সব আক্রান্তের জন্যই কমন। যেটা ১০০ ডিগ্রীর উপরে থাকবে। অন্য সমস্যাগুলো অনেকের ক্ষেত্রেই উপসর্গ হিসেবে নাও দেখা যেতে পারে। আরেকটা বিষয়ে অবহিত করতে চাই পাঠকদের। আমি মনে করছি ১৮ মার্চ রাতে আমি ইনফেক্টেড হয়েছি। এবং সে রাত থেকেই আমি অসুস্থ। যদি সেটা নাও হয়, আমি যদি আরও আগে থেকেই ইনফেক্টেড হয়ে থাকি তাহলে ১৮ তারিখের আগে আমি বিন্দুমাত্র অসুস্থ বোধ করিনি। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি, ইনফেক্টেড হবার আগে পরে এবং উপসর্গ সবার জন্য অবশ্যই এক না।
যাই হউক, এভাবে আমি ২৬ মার্চ পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সাথে ৩ দিন ভিডিও কলে কথা বললাম। তিনি আমাকে এজিতট্রোমাইসিন, জ্বরের ট্যাবলেট আর সিরাপ দিলেন। ইনহেলর দিলেন শ্বাসকষ্টের জন্য। সত্যি বলতে আমার কোনো কিছুতেই লাভ হলো না। ২৫ মার্চ রাতে আমার মনে হলো এটাই সম্ভবত আমার জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে।
এর আগে ২৫ মার্চ দিনের কোনো এক সময়ে আমি সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজ ভাই (মাহফুজরি রহমান), দৈনিক ইত্তফোক এবং সাপ্তাহিক বাঙালীর বিশেষ প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম এবং বাংলা চ্যানেলের সিইও শাহ জে. চৌধুরীর সাথে খুব শ্বাসকষ্ট নিয়ে পরামর্শ করলাম হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে। সবাই যেতে বললেন। তবে মাহফুজ ভাই বললেন, ‘তুই’ এক্ষনি ৯১১ কল করে হাসপাতালে চলে যা।’
সেই সময়ের বাস্তবতা ছিল হাসপাতালে এই ভাইরাস নিয়ে যে যাচ্ছে সেই মারা যাচ্ছেন। এই কারণে পরদিন শাহ জে. চৌধুরী আর শহীদুল ইসলাম আমার ফোন ধরলেন না। আমার মনে হলো- তারা কি বললে আমার জন্য ভাল হতে পারে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্ধে ছিলেন। ২৬ মার্চ আবার মাহফুজ ভাইকে ফোন দিলাম। ওই একই কথা বললেন। তার মতে আমার শ্বাসকষ্ট যে অবস্থায় ছিল সেটা হাসপাতাল ছাড়া আর নিরাময়যোগ্য না।
২৬ মার্চ বিকেলে আমি ৯১১ কল দিলাম। ২০ মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুল্যান্স চলে এলো। কিন্তু এই ২০ মিনিটে আমার স্ত্রী আমাকে একবার বলে, তোমার করোনা হয় নাই। হাসপাতালে গেলেই এখন করোনা হবে। ও এসব কথা বলছে আর কাঁপছে। এ্যাম্বুলেন্স আসার পরে সে আমার সাথে যাবার জন্য বায়না ধরলো। এ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা তাকে সাথে নেবার জন্য আবার সায়ও দিচ্ছে। আমি বললাম দেখো, ওখানে গেলে তুমিও ইনফেক্টেড হবে। আমাদের বাচ্চা মেয়েটার কি হবে? এ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে। কিন্তু আমার স্ত্রী একবার আমার হাত টেনে ধরে, আবার মেয়ের হাত ধরে। আমার দুই ছেলে রয়েছে ফ্লোরিডাতে। আমি, আমার স্ত্রী আর ১০ বছরের মেয়ে আছি নিউইয়র্কে।
কিন্তু আমার মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করেছে। অপেক্ষা করতে করতে যে ৮ দিন চলে গেলো এরই মধ্যে। কিন্তু আমি আর আমার স্ত্রীতো এই আট দিন এক সাথেই ছিলাম। ১৮ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত আমি নিজে নিজে কোনোভাবে নিশ্চিত ছিলাম না যে আমার করোনা পজিটিভ। কিন্তু ২৫ মার্চ কিছু আর্টিকেল পড়ে আমি নিশ্চিত হই যে আমি পজিটিভ। যদিও আমার কোনো টেস্ট হয়নি। আমি কেবল ভাবছি, আমার স্ত্রীও তো পজিটিভ হতে পারে আমার দ্বারা। আমার ১০ বছরের মেয়েটিও কি তবে আমার দ্বারা ইনফেক্টেড? কত যে ভাবনা। আমার মাথা যেনো ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২১ মার্চ আমার স্ত্রীর প্রচন্ড জ্বর এলো। আমার মেডিসিনই তাকে দিলাম দুই দিন। সে সুস্থ হয়ে গেলো। আমার মাথায় তখন এটা ছিল না যে, আমি করোনা পজিটিভ কি না অথবা আমার স্ত্রীও আমার দ্বারা ইনফেক্টেড হয়েছে কিনা ?
রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভর করলো যখন আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। ভাবছি আমার স্ত্রীর জ্বরটাও ছিল ওই করোনার প্রভাব। তাহলে আমার ছোট্ট মেয়েটার কি অবস্থা ? ওর উপসর্গ কি আরও পরে দেখা দিবে? আমার স্ত্রী কি আবার অসুস্থ হবে আমি হাসপাতালে থাকার সময়ে? অথবা আমি কি আর বেঁচে থাকবো ওদের অসুস্থতা দেখার জন্য?
আমি যে সময়টাতে হাসপাতালে যাই সেই সময়ে সবাই আতঙ্কে থাকতো যে, হাসপাতাল মানেই লাশ হয়ে ফিরে আসা। সন্ধ্যার আগে আমাকে কুইন্স হাসপাতালের ইমার্জেন্সতে ঢুকানো হলো। তখন আমার অবস্থা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে। কোনোভাবেই আমি শ্বাস নিতে পারছি না। পানি পিপাসায় মরে যাচ্ছি। অনেক নার্স আমার সামনে কিন্তু কেউ আমার কথা বুঝতেই পারছে না। আমার গলা এত মৃদু হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার কথা শোনার জন্য নার্সদের কান পাততে হতো। হঠাৎ দেখলাম একজন নার্স আমাকে কিছু বলছে। তার মুখে ডাবল মাস্ক, অন্য কোনো কিছু দিয়ে মুখ আচ্ছাদিত। আমি শুনতে পেলাম ‘ফরিদ ভাই আমি সীমা ভাবী। আমি শুধু বললাম ভাবী প্লিজ আমাকে একটু পানি দেন। তিনি পানি নিয়ে আসলেন। পানি পান করে যেনো জীবন ফিরে পেলাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আর কিছু লাগবে? আমি বললাম অনেক ঠান্ডা লাগছে। আরেকটা চাদর দেয়া যাবে কি না? তিনি চাদর না এনে দুটো বøাংকেট নিয়ে আসলেন। আমি আরও একটি বøাংকেটের জন্য অনুরোধ কললাম। তিনি আরেকটি বøাংকেট দিলেন। ৭ দিনের হাসপাতাল অবস্থাকালে এই বøাংকটে তিনটি আমার কত যে কাজে লেগেছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। ভাবী বললো, ‘আমার ডিউটি অন্য জায়গায় কিন্তু আমি আবার আসবো আপনার খোঁজ নিতে।’ আমি আশ্বস্ত হলাম, অন্তত একজন আপনজন পেয়ে। যে কি না আমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। সীমা ভাবী সাংবাদিক দর্পণ কবীরের ওয়াইফ।
যাই হোক হাসপাতালে নেয়ার পর যে কক্ষে রাখা হলো সেখানে ৭০/৮০ জন রোগী। কোনো সিটের সাথে কোনো সিটের এক ফিটও দুরত্ব নেই। অথচ বেশির ভাগই করোনায় আক্রান্ত রোগী সেখানে। কারো টেস্ট হয়েছে, কারো হয়নি। ওই রাতে কোনো ওষুধ দেয়া হয়েছিল কিনা আমার মনে পড়ছে না। তবে স্যালাইন চললো টানা তিন দিন। কিন্তু আমার শরীর ঝড়ে বেগে কাঁপছিল।
সন্ধ্যার পরে অথবা রাতে আমি প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি শ্বাস নেয়ার। যদিও আমাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু আমি ভাল বোধ করছিলাম না। রাতেই কিংবা পরদিন সকালে আমার বøাড নেয়া হলো। পরের দিন বিকেলের দিকে আমার করোনা পরীক্ষা করার জন্য নাকে কিছু একটা লম্বা জিনিস ঢুকিয়ে নমুনা নেয়া হলো। সন্ধ্যার আগে আমি গেলাম বাথরুমে। ফেরার পথে চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখলাম অন্তত ১০ জন নার্স আমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এর পরের দুই দিন কয়েকজন ডাক্তার এবং সিনিয়র নার্স আমার কাছে কেবল একটি প্রশ্নেরই উত্তর জানতে আসতেন। সেটা হচ্ছে, আমি কেনো পড়ে গিয়েছিলাম? জানি না কেনো? আমি শুধু বলতাম এটা শরীরের দুর্বলতার কারণে হয়ে থাকতে পারে বলে আমার ধারণা।
এর পরের দিন আমার বুকের এক্সরে করা হলো, আবারও বøাড নিয়ে গেলো। একজন বাঙালী নার্স ভাইকে আমি বললাম, ভাই রিপোর্ট কখন পেতে পারি? তিনি বললেন, কাল-পরশু। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। মনে সাহস রাখেন। ভয় পেলে মরে যাবেন। তিনি বললেন, এখানে অনেক নার্স এবং ডাক্তার এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভাল হয়ে আবারও ডিউটি করছে। আমি সাহস পেলাম। কিন্তু সারাক্ষণই আল্লাহকে ডাকতাম মনে মনে।
বিকেলে আবারও সীমা ভাবী এলেন। আমার টেম্পারেচার, পালস ইত্যাদি চেক করলেন। দু’গøাস পানিও এনে দিলেন। আমি রিপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে বললেন, ‘কাল পেতে পারেন’। পরদিন ভাবী জানালেন, ‘চিন্তা করবেন না কিন্তু। আপনার করোনা পজিটিভ।’ আমাকে চিন্তা করতে না করলেন, কিন্তু তার মুখ দেখে আমি খুবই হতাশ হলাম। একই সাথে খবর দিলেন, স্বপন ভাই মারা গেছেন একটু আগেই করোনায়।’ আমার হাসপাতালে অবস্থানকালে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীসহ অনেক করোনা রোগী মারা যায় একই রুমের। যারা আমার আশে-পাশের সিটেই থাকতেন।
জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে নিজের সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের কথা ভাবছি। আমি কি বাঁচবো? মনে সাহস আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেক পরিচিতজন, বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেছি। কি অদ্ভুদ ব্যাপার। আমার অনেক বন্ধু আছে যাদেরকে আমি অনেক শক্ত মনের মানুষ বলেই জানি, কিন্তু তারা ফোন করেই কান্না শুরু করে দিতেন। আমিও কাঁদতাম। আমি তাদের কথা কোনোদিন ভুলবো না। তাদের কেউ কেউ নিউইয়র্কে, কেউ অন্য স্টেটে আবার কেউ কেউ বাংলাদেশের। আমার স্ত্রী, ভাই-বোন এবং ঘনিষ্টরা ফোন করেই কান্না জুড়ে দিতনে। আর শুধু আল্লাকে ডাকতে বলতেন।
চতুর্থ দিনে আমাকে আইসোলেসন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রায় ২৪ ঘন্টাই আমার শারিরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো সেখানে। একজন নার্স সর্বক্ষণ পাশে থাকতেন আমার বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম বলে। আইসোলেসন রুমে গিয়েই মনে হলো আমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছি।
হাসপাতালের দিনগুলোতে চরম অসুস্থ থাকা সত্বেও সাংবাদিকের দৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করেছি। কিভাবে তারা রোগীর সেবা করছে। কি কি সীমাবদ্ধতা আছে।
আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স সবার কাছে কৃতজ্ঞ নি:স্বার্থভাবে আমাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য। আমার করোনা পজিটিভ এই জিনিসটা আমি কোনো ডাক্তার বা নার্সকে দেখে বুঝতে পারিনি। তারা আমাকে এমনভাবে সেবা দিয়েছেন, যেনো আমার কিছুই হয়নি। শুধু আমাকে না। অন্য করোনা পজিটিভদেরকেও একইভাবে সেবা করতে দেখেছি। তবে তারা সতর্ক ছিলেন সবাই। কিন্তু কোনো ঘৃণা, ক্ষোভ অথবা অবহেলার কিছুই কখনো দেখিনি। এটা শুধু আমার সাথে না, আমার আশে পাশে অন্য কোনো রোগীর সাথে এটা করতে দেখিনি। অনেক নার্সকে দেখেছি ওভার টাইম করছে অথচ টানা ১৫ ঘন্টায় খাবার খাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। আমার কাছে মনে হয়েছে তারা একেকজন দ্বেবদূত।
আল্লাহর অশেষ রহমত আর মানুষের দোয়ায় আমি সুস্থ হয়ে যাই ৭ দিনের মাথায়।
২ এপ্রিল সকালে ডাক্তার এসেই আমার অক্সিজেন, হার্টবিট, টেম্পারেচার পরীক্ষা করে বললেন, আপনি সুস্থ। আজ আপনাকে আমরা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। তার আগে আমাকে হাঁটতে দিলো, নিজের কিছু কাজ করতে দিলো। দেখে নিলো আমি ঠিক আছি কি না?
একজন করোনা পজিটিভ থেকে সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসা মানে নিজের জীবন রক্ষা নয়। একটি পরিবারের সুখস্মৃতি ফিরে পাওয়া। এটা শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্যই। আমি শুধু একটি অনুরোধ করতে চাই বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার এবং চিকিৎসক এবং সেবকদের কাছে। তা হলো করোনা ঘৃণা করার মতো কোনো রোগ নয়। সুচিকিৎসা এবং ভালবাসা পেলে যে কোনো রোগীই ভাল হতে পারেন। ফিরে পেতে পারেন নতুন জীবন। তবে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হওয়া দরকার। ঘরে থাকা দরকার যতক্ষণ না কর্তৃপক্ষের অনুমতি হয় বাইরে যাবার। আসুন আমি এবং আমরা আমাদের পরিবারের স্বার্থে, আমাদের আদরের সন্তানের স্বার্থে, আমাদের প্রিয়জনদের স্বার্থে হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলি।
ফরিদ আলম, সিনিয়র সাংবাদিক এবং নিউইয়র্কের এটিভি’র কর্ণধার।
(সাপ্তাহিক নবযুগ, ১৭ এপ্রিল ২০২০)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

মৃত্যুঞ্জয়ী ফরিদ আলম বলছি…

প্রকাশের সময় : ১২:৩৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের কুইন্স হাসপাতালে চিকি’সা শেষে পরিবারের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল সাংবাদিক ফরিদ আলম। ছবি সংগৃহীত
হককথা ডেস্ক: সারাবিশ্ব এখন এক অদৃশ্যমান জীবনঘাতী শত্রæর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। করোনা ভাইরাস নামের এই শত্রæকে খালি চোখে দেখাও যায় না, মারাও যায় না। আর তাই অভিন্ন শত্রæর বিরুদ্ধে এক হয়েও লক্ষ-কোটি মানুষ অসহায় জীবন-যাপন করছে দরজা-জানালা বন্ধ করে। লক্ষাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া এই ভাইরাসের কারণে পাল্টে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন। করোনার সাথে যুদ্ধ করে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও বিজয়ী হওয়ার উদাহরণও রয়েছে অনেক। আমি সেই বিজয়ী দলের সৌভাগ্যবানদের একজন। আমি করোনায় আক্রান্ত হবার আগে, পরে ও সুস্থ হবার পরের কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক নবযুগের নিয়মিত এবং অনিয়মিত পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই।
মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে নিউইয়র্কের মতো জনবহুল ষ্টেটে এর যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে সেটা নিয়েও খুব লেখালেখি হচ্ছিলো। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ভেবেছিলাম ১৫ মার্চের মধ্যেই বাসায় ঢুকবো। এই ভাইরাসের আগ্রাসন না থামা পর্যন্ত আর বাইরে বের হবো না। সেই চিন্তা থেকে নিজের নতুন ভেঞ্চার এটিভি’র স্টুডিও গোছানোর কাজটা দ্রæতই শেষ করতে চাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম করোনার প্রভাব কমলে তারপর টিভি’র সম্প্রচারের কাজ শুরু করবো। কিন্তু তা আর পারলাম না। ১৮ মার্চ পর্যন্ত স্টুডিওর অটোকিউ পাবার আশায় বসে থেকেও আর ডেলিভারী পেলাম না করোনার কারণে। মন খারাপ করে ভাবলাম শেষদিনে কিছু প্রয়োজনীয় বাজার করেই বরং বাসায় ফিরে যাই।
করোনা পেন্ডামিক হওয়ার কারণে আমি ১৫ মার্চ থেকেই মাস্ক পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৮ মার্চ যখন আমি বাজার করতে জ্যাকসন হাইটস-এর আপনা বাজার-এ গেলাম তখন শুধুমাত্র ওই সময়টুকুতেই আমার মুখে মাস্ক ছিল না। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ করে একজনের হাঁচি থেকেই সম্ভবত আমি আক্রান্ত হই। কারণ হাঁচি দেয়া ওই ব্যক্তিকে আমার খুব ক্লান্ত এবং অসুস্থ মনে হচ্ছিল। আমার মুখে মাস্ক নেই বলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমি চাপাতা, কয়েক প্যাকেট টোস্ট বিস্কুট আর সামান্য কিছু বাজার নিয়ে বাসায় ফিরি। বলে রাখতে চাই, ওই বিস্কুটের সবগুলোই ছিল মেয়াদউত্তীর্ণ এবং দূর্ঘন্ধময়। তাড়াহুড়ার কারণে তারিখ দেখার সময় এবং ধৈর্য তখন ছিল না। যাই হউক বাজার করার সময়টাতে আমার মাস্ক না থাকার কারণেই আমি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হই বলে আমার বিশ্বাস। এটা আমার অসচেতনার ফল বলেই আমি মনে করি।
পরিবারের সাথে ফরিদ আলম। ছবি সংগৃহীত
যাই হউক রাতে বাসায় ফিরে আমারও ক্লান্ত লাগছিল। রাতের খাবার শেষ করে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। খুব ভোরে খেয়াল করলাম অনেক ঠান্ডা লাগছে আর ভীষণ জ্বর। আমার স্ত্রী মেপে দেখলেন ১০৩ ডিগ্রী। পরদিন সারাদিন আমি বুঝার চেষ্টা করলাম রাতে আমার দিকে ফ্যান থাকার কারণে জ্বর বা শরীর খারাপ লাগছে কিনা? সারাদিনেও শরীরের তাপমাত্রা আর কমেনি। আমি ওইদিন ডাক্তারকে ফোন করিনি। তবে রাতে ২ টা ৫০০ এমজি টাইলানল খেলাম। পরদিন সকালে দেখলাম আমার অবস্থা আরও খারাপের দিকে। তাপমাত্রাও অপরিবর্তীত।
দুপুরের দিকে আমি আমার ডাক্তারের নম্বরে ফোন দিলাম। ডাক্তারকে পেলাম না। একজন ভদ্রমহিলা ধরে বললেন, আমাকে একটা অ্যাপস ফোনে ডাউনলোড করে ডাক্তারকে ভিডিও কল দিতে। এটা তাদের নিজস্ব অ্যাপস। সেদিন আর ডাক্তারের সাথে আমার কথা হলো না। কিন্তু সেই রাতে আমার শ্বাসকষ্ট এই পর্যায়ে চলে গেলো যে, আমার মনে হলো আমি এখনি মরে যাবো। পরের দিন আমি ডাক্তারকে ভিডিও কল দিলাম। আমার সমস্যা শুনে কোনো কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, শ্বাসকষ্ট কেনো হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছেন না। এমনটা তিনি কখনো শুনেনি।
এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই, হাসপাতালে ৭ দিন থাকার সময় এবং সুস্থ হবার পরে অনেক করোনা পজিটিভ রোগীর সাথে কথা বলেছি। করোনার উপসর্গ কারোটার সাথে কারো নাও মিলতে পারে। যেমন আমার জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট ছিল। আমি কিছুই খেতে পারতাম না পানি ছাড়া। হাসপাতালে অনেককেই দেখেছি তাদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার ডায়রিয়া, গলাব্যাথা ছিল না। কাশি ছিল খুব সামান্য। কিন্তু সেটা শুষ্ক কাশি ছিল না। অনেক করোনা পজিটিভ রোগীর সাথে কথা বলে, আমি এটা বলতে পারি জ্বরটা প্রায় সব আক্রান্তের জন্যই কমন। যেটা ১০০ ডিগ্রীর উপরে থাকবে। অন্য সমস্যাগুলো অনেকের ক্ষেত্রেই উপসর্গ হিসেবে নাও দেখা যেতে পারে। আরেকটা বিষয়ে অবহিত করতে চাই পাঠকদের। আমি মনে করছি ১৮ মার্চ রাতে আমি ইনফেক্টেড হয়েছি। এবং সে রাত থেকেই আমি অসুস্থ। যদি সেটা নাও হয়, আমি যদি আরও আগে থেকেই ইনফেক্টেড হয়ে থাকি তাহলে ১৮ তারিখের আগে আমি বিন্দুমাত্র অসুস্থ বোধ করিনি। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি, ইনফেক্টেড হবার আগে পরে এবং উপসর্গ সবার জন্য অবশ্যই এক না।
যাই হউক, এভাবে আমি ২৬ মার্চ পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সাথে ৩ দিন ভিডিও কলে কথা বললাম। তিনি আমাকে এজিতট্রোমাইসিন, জ্বরের ট্যাবলেট আর সিরাপ দিলেন। ইনহেলর দিলেন শ্বাসকষ্টের জন্য। সত্যি বলতে আমার কোনো কিছুতেই লাভ হলো না। ২৫ মার্চ রাতে আমার মনে হলো এটাই সম্ভবত আমার জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে।
এর আগে ২৫ মার্চ দিনের কোনো এক সময়ে আমি সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজ ভাই (মাহফুজরি রহমান), দৈনিক ইত্তফোক এবং সাপ্তাহিক বাঙালীর বিশেষ প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম এবং বাংলা চ্যানেলের সিইও শাহ জে. চৌধুরীর সাথে খুব শ্বাসকষ্ট নিয়ে পরামর্শ করলাম হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে। সবাই যেতে বললেন। তবে মাহফুজ ভাই বললেন, ‘তুই’ এক্ষনি ৯১১ কল করে হাসপাতালে চলে যা।’
সেই সময়ের বাস্তবতা ছিল হাসপাতালে এই ভাইরাস নিয়ে যে যাচ্ছে সেই মারা যাচ্ছেন। এই কারণে পরদিন শাহ জে. চৌধুরী আর শহীদুল ইসলাম আমার ফোন ধরলেন না। আমার মনে হলো- তারা কি বললে আমার জন্য ভাল হতে পারে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্ধে ছিলেন। ২৬ মার্চ আবার মাহফুজ ভাইকে ফোন দিলাম। ওই একই কথা বললেন। তার মতে আমার শ্বাসকষ্ট যে অবস্থায় ছিল সেটা হাসপাতাল ছাড়া আর নিরাময়যোগ্য না।
২৬ মার্চ বিকেলে আমি ৯১১ কল দিলাম। ২০ মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুল্যান্স চলে এলো। কিন্তু এই ২০ মিনিটে আমার স্ত্রী আমাকে একবার বলে, তোমার করোনা হয় নাই। হাসপাতালে গেলেই এখন করোনা হবে। ও এসব কথা বলছে আর কাঁপছে। এ্যাম্বুলেন্স আসার পরে সে আমার সাথে যাবার জন্য বায়না ধরলো। এ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা তাকে সাথে নেবার জন্য আবার সায়ও দিচ্ছে। আমি বললাম দেখো, ওখানে গেলে তুমিও ইনফেক্টেড হবে। আমাদের বাচ্চা মেয়েটার কি হবে? এ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে। কিন্তু আমার স্ত্রী একবার আমার হাত টেনে ধরে, আবার মেয়ের হাত ধরে। আমার দুই ছেলে রয়েছে ফ্লোরিডাতে। আমি, আমার স্ত্রী আর ১০ বছরের মেয়ে আছি নিউইয়র্কে।
কিন্তু আমার মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করেছে। অপেক্ষা করতে করতে যে ৮ দিন চলে গেলো এরই মধ্যে। কিন্তু আমি আর আমার স্ত্রীতো এই আট দিন এক সাথেই ছিলাম। ১৮ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত আমি নিজে নিজে কোনোভাবে নিশ্চিত ছিলাম না যে আমার করোনা পজিটিভ। কিন্তু ২৫ মার্চ কিছু আর্টিকেল পড়ে আমি নিশ্চিত হই যে আমি পজিটিভ। যদিও আমার কোনো টেস্ট হয়নি। আমি কেবল ভাবছি, আমার স্ত্রীও তো পজিটিভ হতে পারে আমার দ্বারা। আমার ১০ বছরের মেয়েটিও কি তবে আমার দ্বারা ইনফেক্টেড? কত যে ভাবনা। আমার মাথা যেনো ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২১ মার্চ আমার স্ত্রীর প্রচন্ড জ্বর এলো। আমার মেডিসিনই তাকে দিলাম দুই দিন। সে সুস্থ হয়ে গেলো। আমার মাথায় তখন এটা ছিল না যে, আমি করোনা পজিটিভ কি না অথবা আমার স্ত্রীও আমার দ্বারা ইনফেক্টেড হয়েছে কিনা ?
রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভর করলো যখন আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। ভাবছি আমার স্ত্রীর জ্বরটাও ছিল ওই করোনার প্রভাব। তাহলে আমার ছোট্ট মেয়েটার কি অবস্থা ? ওর উপসর্গ কি আরও পরে দেখা দিবে? আমার স্ত্রী কি আবার অসুস্থ হবে আমি হাসপাতালে থাকার সময়ে? অথবা আমি কি আর বেঁচে থাকবো ওদের অসুস্থতা দেখার জন্য?
আমি যে সময়টাতে হাসপাতালে যাই সেই সময়ে সবাই আতঙ্কে থাকতো যে, হাসপাতাল মানেই লাশ হয়ে ফিরে আসা। সন্ধ্যার আগে আমাকে কুইন্স হাসপাতালের ইমার্জেন্সতে ঢুকানো হলো। তখন আমার অবস্থা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে। কোনোভাবেই আমি শ্বাস নিতে পারছি না। পানি পিপাসায় মরে যাচ্ছি। অনেক নার্স আমার সামনে কিন্তু কেউ আমার কথা বুঝতেই পারছে না। আমার গলা এত মৃদু হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার কথা শোনার জন্য নার্সদের কান পাততে হতো। হঠাৎ দেখলাম একজন নার্স আমাকে কিছু বলছে। তার মুখে ডাবল মাস্ক, অন্য কোনো কিছু দিয়ে মুখ আচ্ছাদিত। আমি শুনতে পেলাম ‘ফরিদ ভাই আমি সীমা ভাবী। আমি শুধু বললাম ভাবী প্লিজ আমাকে একটু পানি দেন। তিনি পানি নিয়ে আসলেন। পানি পান করে যেনো জীবন ফিরে পেলাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আর কিছু লাগবে? আমি বললাম অনেক ঠান্ডা লাগছে। আরেকটা চাদর দেয়া যাবে কি না? তিনি চাদর না এনে দুটো বøাংকেট নিয়ে আসলেন। আমি আরও একটি বøাংকেটের জন্য অনুরোধ কললাম। তিনি আরেকটি বøাংকেট দিলেন। ৭ দিনের হাসপাতাল অবস্থাকালে এই বøাংকটে তিনটি আমার কত যে কাজে লেগেছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। ভাবী বললো, ‘আমার ডিউটি অন্য জায়গায় কিন্তু আমি আবার আসবো আপনার খোঁজ নিতে।’ আমি আশ্বস্ত হলাম, অন্তত একজন আপনজন পেয়ে। যে কি না আমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। সীমা ভাবী সাংবাদিক দর্পণ কবীরের ওয়াইফ।
যাই হোক হাসপাতালে নেয়ার পর যে কক্ষে রাখা হলো সেখানে ৭০/৮০ জন রোগী। কোনো সিটের সাথে কোনো সিটের এক ফিটও দুরত্ব নেই। অথচ বেশির ভাগই করোনায় আক্রান্ত রোগী সেখানে। কারো টেস্ট হয়েছে, কারো হয়নি। ওই রাতে কোনো ওষুধ দেয়া হয়েছিল কিনা আমার মনে পড়ছে না। তবে স্যালাইন চললো টানা তিন দিন। কিন্তু আমার শরীর ঝড়ে বেগে কাঁপছিল।
সন্ধ্যার পরে অথবা রাতে আমি প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি শ্বাস নেয়ার। যদিও আমাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু আমি ভাল বোধ করছিলাম না। রাতেই কিংবা পরদিন সকালে আমার বøাড নেয়া হলো। পরের দিন বিকেলের দিকে আমার করোনা পরীক্ষা করার জন্য নাকে কিছু একটা লম্বা জিনিস ঢুকিয়ে নমুনা নেয়া হলো। সন্ধ্যার আগে আমি গেলাম বাথরুমে। ফেরার পথে চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখলাম অন্তত ১০ জন নার্স আমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এর পরের দুই দিন কয়েকজন ডাক্তার এবং সিনিয়র নার্স আমার কাছে কেবল একটি প্রশ্নেরই উত্তর জানতে আসতেন। সেটা হচ্ছে, আমি কেনো পড়ে গিয়েছিলাম? জানি না কেনো? আমি শুধু বলতাম এটা শরীরের দুর্বলতার কারণে হয়ে থাকতে পারে বলে আমার ধারণা।
এর পরের দিন আমার বুকের এক্সরে করা হলো, আবারও বøাড নিয়ে গেলো। একজন বাঙালী নার্স ভাইকে আমি বললাম, ভাই রিপোর্ট কখন পেতে পারি? তিনি বললেন, কাল-পরশু। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। মনে সাহস রাখেন। ভয় পেলে মরে যাবেন। তিনি বললেন, এখানে অনেক নার্স এবং ডাক্তার এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভাল হয়ে আবারও ডিউটি করছে। আমি সাহস পেলাম। কিন্তু সারাক্ষণই আল্লাহকে ডাকতাম মনে মনে।
বিকেলে আবারও সীমা ভাবী এলেন। আমার টেম্পারেচার, পালস ইত্যাদি চেক করলেন। দু’গøাস পানিও এনে দিলেন। আমি রিপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে বললেন, ‘কাল পেতে পারেন’। পরদিন ভাবী জানালেন, ‘চিন্তা করবেন না কিন্তু। আপনার করোনা পজিটিভ।’ আমাকে চিন্তা করতে না করলেন, কিন্তু তার মুখ দেখে আমি খুবই হতাশ হলাম। একই সাথে খবর দিলেন, স্বপন ভাই মারা গেছেন একটু আগেই করোনায়।’ আমার হাসপাতালে অবস্থানকালে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীসহ অনেক করোনা রোগী মারা যায় একই রুমের। যারা আমার আশে-পাশের সিটেই থাকতেন।
জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে নিজের সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের কথা ভাবছি। আমি কি বাঁচবো? মনে সাহস আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেক পরিচিতজন, বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেছি। কি অদ্ভুদ ব্যাপার। আমার অনেক বন্ধু আছে যাদেরকে আমি অনেক শক্ত মনের মানুষ বলেই জানি, কিন্তু তারা ফোন করেই কান্না শুরু করে দিতেন। আমিও কাঁদতাম। আমি তাদের কথা কোনোদিন ভুলবো না। তাদের কেউ কেউ নিউইয়র্কে, কেউ অন্য স্টেটে আবার কেউ কেউ বাংলাদেশের। আমার স্ত্রী, ভাই-বোন এবং ঘনিষ্টরা ফোন করেই কান্না জুড়ে দিতনে। আর শুধু আল্লাকে ডাকতে বলতেন।
চতুর্থ দিনে আমাকে আইসোলেসন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রায় ২৪ ঘন্টাই আমার শারিরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো সেখানে। একজন নার্স সর্বক্ষণ পাশে থাকতেন আমার বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম বলে। আইসোলেসন রুমে গিয়েই মনে হলো আমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছি।
হাসপাতালের দিনগুলোতে চরম অসুস্থ থাকা সত্বেও সাংবাদিকের দৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করেছি। কিভাবে তারা রোগীর সেবা করছে। কি কি সীমাবদ্ধতা আছে।
আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স সবার কাছে কৃতজ্ঞ নি:স্বার্থভাবে আমাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য। আমার করোনা পজিটিভ এই জিনিসটা আমি কোনো ডাক্তার বা নার্সকে দেখে বুঝতে পারিনি। তারা আমাকে এমনভাবে সেবা দিয়েছেন, যেনো আমার কিছুই হয়নি। শুধু আমাকে না। অন্য করোনা পজিটিভদেরকেও একইভাবে সেবা করতে দেখেছি। তবে তারা সতর্ক ছিলেন সবাই। কিন্তু কোনো ঘৃণা, ক্ষোভ অথবা অবহেলার কিছুই কখনো দেখিনি। এটা শুধু আমার সাথে না, আমার আশে পাশে অন্য কোনো রোগীর সাথে এটা করতে দেখিনি। অনেক নার্সকে দেখেছি ওভার টাইম করছে অথচ টানা ১৫ ঘন্টায় খাবার খাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। আমার কাছে মনে হয়েছে তারা একেকজন দ্বেবদূত।
আল্লাহর অশেষ রহমত আর মানুষের দোয়ায় আমি সুস্থ হয়ে যাই ৭ দিনের মাথায়।
২ এপ্রিল সকালে ডাক্তার এসেই আমার অক্সিজেন, হার্টবিট, টেম্পারেচার পরীক্ষা করে বললেন, আপনি সুস্থ। আজ আপনাকে আমরা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। তার আগে আমাকে হাঁটতে দিলো, নিজের কিছু কাজ করতে দিলো। দেখে নিলো আমি ঠিক আছি কি না?
একজন করোনা পজিটিভ থেকে সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসা মানে নিজের জীবন রক্ষা নয়। একটি পরিবারের সুখস্মৃতি ফিরে পাওয়া। এটা শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্যই। আমি শুধু একটি অনুরোধ করতে চাই বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার এবং চিকিৎসক এবং সেবকদের কাছে। তা হলো করোনা ঘৃণা করার মতো কোনো রোগ নয়। সুচিকিৎসা এবং ভালবাসা পেলে যে কোনো রোগীই ভাল হতে পারেন। ফিরে পেতে পারেন নতুন জীবন। তবে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হওয়া দরকার। ঘরে থাকা দরকার যতক্ষণ না কর্তৃপক্ষের অনুমতি হয় বাইরে যাবার। আসুন আমি এবং আমরা আমাদের পরিবারের স্বার্থে, আমাদের আদরের সন্তানের স্বার্থে, আমাদের প্রিয়জনদের স্বার্থে হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলি।
ফরিদ আলম, সিনিয়র সাংবাদিক এবং নিউইয়র্কের এটিভি’র কর্ণধার।
(সাপ্তাহিক নবযুগ, ১৭ এপ্রিল ২০২০)