প্রবাসে আমার দেশ এর নব অধ্যায়
- প্রকাশের সময় : ১১:৩৭:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / ২৮ বার পঠিত
মাহমুদুর রহমান: বাংলাদেশ নামের অরওয়েলিয়ান রাষ্ট্রের জুলুমবাজ পুলিশ দস্যুনেত্রীর নির্দেশে ঢাকায় পত্রিকার ছাপাখানা দখল করেছিল ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল। সেই থেকে ছাপান কাগজ আর পৌঁছান যায়নি পাঠকের দোরগোড়ায়। আমার দেশ দখলের দিনেই আমাকেও নেওয়া হয়েছিল ডিবির রিমান্ড সেলে। একটু বোধহয় ভুল হয়ে গেল। ১১ এপ্রিলের পর সম্ভবত আর দুই দিন আমার সহকর্মীরা দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমার দেশ প্রকাশ করেছিলেন। সেই দোষে পুলিশের বুট ওই পত্রিকাকেও নোংরা করে ছেড়েছিল। বেশ কয়েকজন দপ্তরি আর তিনজন সাংবাদিককেও রিমান্ড এবং জেলের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। আমার তখন ৭৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা মা এবং সংগ্রামের বর্ষীয়ান সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধেও মামলা দিতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেনি নারী ফ্যাসিস্ত শাসক। অথচ সাময়িকভাবে অন্য ছাপাখানা থেকে পত্রিকা বের করা পুরোপুরি আইনসম্মত।
পাঠকরা অবশ্যই বলে উঠতে পারেন শেখ হাসিনার জমিদারিতে আবার কিসের আইন। শতভাগ হক কথা। দেশের দুই জন বর্ষীয়ান নাগরিকের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দিয়ে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ডিবির নির্যাতনে অসুস্থ আমাকেই আমার মায়ের মামলার জন্যে দোষী সাব্যস্ত করে বিবৃতি দিয়েছিল। ইনু সাহেবদের লজ্জা গ্রন্থি যে বহু পূর্বেই খসে পড়েছে তা অবশ্য কারো অজানা নেই।
আমার দেশের লড়াকু সাংবাদিকরা এরপরও হার মানতে চাননি। তারা অনলাইনে আমার দেশ চালিয়েছিলেন ২০১৬ সালের আগষ্টের ৩ তারিখ পর্যন্ত। সেদিন বিটিআরসির নির্দেশে আমার দেশের অনলাইন সংস্করণও বন্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়েছিল আরো ৩৪টি অনলাইন। এর আগে ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর রহস্যজনকভাবে আগুন দিয়ে কারওয়ান বাজারে আমার দেশের প্রধান অফিসও আক্ষরিক অর্থেই ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। বিপুল আর্থিক ক্ষতির চেয়েও যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা হল আরকাইভ পুড়ে যাওয়া। তৎকালিন আর এক লজ্জাগ্রন্থিহীন মন্ত্রী আমির হোসেন আমু পুড়ে যাওয়া অফিস দেখতে গিয়ে সমবেদনা জানানোর পরিবর্তে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে বলেছিলেন যে পত্রিকার মালিকপক্ষই নাকি বিমার টাকার লোভে নিজেরাই আগুন দিয়েছে। চোর-লুটেরার দল সবাইকে সমগোত্রিও বিবেচনা করবে এতে অবাক হওয়া উচিত নয়। তবে এক্ষেত্রে আমুর জানা ছিল না যে আমার দেশ ছাপাখানার বিমা থাকলেও অফিসের বিমা করা হয়নি। অতএব ক্ষতিপুরণের লোভে আগুনের সন্দেহ অবান্তর। তবে আওয়ামী মন্ত্রীদের মাথায় সারাক্ষণ যাবতীয় কুমতলবই খেলা করে।
এবার আমার কথা কিছু বলি। দ্বিতীয় দফায় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর। জেলের প্রতিকূল পরিবেশেও একটা প্রত্যাশা সর্বদা ছিল যে কোনদিন মুক্তি পেলে আল্লাহর ঘরে আরও একবার যাব। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পরও প্রায় আরও এক বছর লাগলো পাসপোর্ট, ভিসা আর বিদেশ যাওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশ পেতে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মহান আল্লাহতালা মনবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন। পবিত্র ওমরাহ্ পালন করতে সৌদি আরব যেতে পারলাম। ওখানেই খবর পেলাম আওয়ামী পান্ডারা বাংলাদেশের জেলায় জেলায় নতুন করে ৩৬টি মামলা দায়ের করেছে। ঢাকা ছাড়ার কদিন আগে প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় ফ্যাসিষ্ট প্রধানমন্ত্রী, তার পিতা মরহুম শেখ মুজিব এবং ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকির মিডিয়া বিদ্বেষ সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। তাই মানহানির সংগে একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। উদ্বিগ্ন শুভানুধ্যায়ীরা বিদেশে থেকে যেতে অনেক জোরাজুরি করলেও দেশেই ফিরলাম।
যাওয়া এবং ফেরা উভয় দফাতেই ঢাকা ইমিগ্রেসনের কর্মকর্তারা আমাকে আটকে রেখে উপরের নির্দেশ চেয়ে পাঠায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই ইমিগ্রেশনে পৌঁছে জানতে চাইলাম কোথায় নেওয়া হচ্ছে আমাকে। গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিয়ে বিমানের ভিতরেই ঘড়ি, ফোন আর মানিব্যাগ স্ত্রীর কাছে দিয়ে রেখেছিলাম। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর ইমিগ্রেশন জানাল যে ওই রাতে আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কেন গ্রেফতার হলাম না সেটা বুঝতে মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যাই হোক সে রাতে বাড়িতে অপেক্ষারত মায়ের কাছে ফিরতে পেরেছিলাম।
এরপর জেলায় জেলায় হাজিরা দিয়ে বেড়াই আর সুযোগ পেলে ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ এবং বিরোধী দলগুলোকে বলার চেষ্টা করি যে বিপ্লব ছাড়া ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। জনগণ হয়ত আমার কথা বুঝত কিন্তু ভীতির কাছে তারা অসহায়। এদিকে বিরোধী দলের নেতারা আমার কোথায় মহা বিরক্ত বোধ করতে লাগলেন। এর মধ্যেই ৮ ফেব্রæয়ারী বেগম খালেদা জিয়াকে বেশরম বিচার বিভাগ অবিশ্বাস্য এক ভুয়া মামলায় সাজা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল। আমি আবারও বললাম আইনের পথে নেত্রীর মুক্তি নেই। বিচারক এবং পুলিশের মিলিত আয়োজনেই তো শেখ হাসিনা কোনরকম জন সমর্থন ছাড়াই দোর্দন্ডপ্রতাপে সরকার চালাচ্ছেন। করজোড়ে নেতাদের বললাম বিপ্লব অথবা আত্মসমর্পণ ছাড়া খালেদা জিয়া আর জেলের বাইরে আসবেন না।
জুলাইয়ের ২৩ তারিখে টিউলিপ সংক্রান্ত মামলার হাজিরা দিতে কুষ্টিয়া গেলাম। আওয়ামী নেতা হানিফের লাঠিয়াল বাহিনী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাকে হত্যার আয়োজন যে করে রেখেছে সেটা জানার কোন সুযোগ ছিল না। কুষ্টিয়ার আদালতে প্রবেশ করতেই সশস্ত্র ক্যাডারদের মহড়া শুরু হল। মেহেদি হাসান তখন কুষ্টিয়ার এসপি। পুলিশের পোশাকে এই আওয়ামী সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রিয় অফিস ভাঙ্গা হলে আমার দেশ পত্রিকায় কয়েক পর্বের অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। এ নিয়ে আমার উপর মেহেদি হাসানের প্রচন্ড আক্রোশ ছিল। কাজেই কুষ্টিয়ায় আমাকে শেষ করবার পরিকল্পনা করতে কোন সমস্যাই হয়নি। ওই দিনের সকল ঘটনা পাঠকদের অধিকাংশই টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন ধারনা করে পুনরাবৃত্তি করছি না। আল্লাহতালার অসীম করুনায় জীবন রক্ষা পাওয়ায় শুধু কায়মনোবাক্যে শোকরানা জানাচ্ছি।
রক্তাক্ত অবস্থায় কুষ্টিয়া থেকে যশোর হয়ে বিমানে ঢাকায় ফিরে ইউনাইটেড হাসপাতালে গেলাম। তাৎক্ষনিকভাবে ওটিতে নিয়ে মাথা এবং মুখের জখমে সেলাই করা হল। এক দিন পরেই আবার সুনামগঞ্জে হাজিরার তারিখ থাকলেও আমি অত দূরে যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম না। মাথা আর মুখে ব্যান্ডেজ নিয়ে এম্বুলেন্সে হাইকোর্টে আগাম জামিন চাইতে গেলাম। যথাসম্ভব অপমান সহকারে চার সপ্তাহের জামিন দিয়ে বিচারকের আসনে উপবিষ্ট শেখ হাসিনার পদলেহি ক্লাউনেরা সর্বসমক্ষে জানিয়ে দিলেন যে আমি যেন ভবিষ্যতে আর কখনো জামিন চাইতে হাইকোর্টে না যাই। কারণ আমাকে বিচারকেরা ঘৃণা করেন। অন্য যে কোন দেশে কোন বিচারক এমন সংবিধান এবং মানবাধিকারবিরোধী বক্তব্য দিলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাদের অপসারণ করা হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ পুরো বাংলাদেশটাকেই গিলে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম এর পরও বাংলাদেশে থাকা আর আত্মহত্যার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আগস্টের ২৪ তারিখে মালয়শিয়ায় নির্বাসনে যেতে বাধ্য হলাম।
তারপর এই প্রবীণ বয়সে কিছুটা লেখাপড়া আর অল্পবিস্তর লেখালেখি করে কেটেছে দুটো বছর। জেল থেকে ইংরেজিতে লেখা বই, দি পলিটিকাল হিস্ট্রি অব মুসলিম বেঙ্গল লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারী। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আগ্রাসন নিয়ে একাডেমিক গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছি কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটি মালয়শিয়ার ইতিহাস এবং সভ্যতা বিভাগ থেকে। এরই মধ্যে আল্লাহর গজবের মত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। আল্লাহর কাহহার রূপের কাছে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা, প্রাচুর্য্য এবং বিজ্ঞানের গর্ব যে কত অসহায় সেটাও পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে। করোনায় গৃহবন্দিত্তের মাঝেই আমার ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের একদল লন্ডন প্রবাসী সহযোদ্ধা ওখান থেকে আমার দেশ অনলাইন প্রকাশ করার উদ্যোগের কথা জানালেন। আমাকে সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব দিলে সানন্দে গ্রহণ করলাম।
আজ আগষ্টের ৩০ তারিখে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে বুক ফুলিয়ে স্বাধীনতার কথা বলা ‘আমার দেশ’ এর নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু হল। আজকের দিনটি দুটো কারনে অতি তাৎপর্যময়। আজ পবিত্র আশুরা। এই দিনে হযরত ইমাম হোসেন (রা:) জালিমের শাসকের বিরুদ্ধে মহান বিদ্রোহে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তিনি আজো প্রতিটি মুসলমানের বিপ্লবের অনুপ্রেরণা। আজ আবার গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ষ্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস। উভয় কারণে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি আমার দেশের যে তুমুল জনপ্রিয়তার মধ্যে ফ্যাসিষ্ট সরকার বাংলাদেশে পত্রিকা বন্ধ করেছিল এবারো সেই জনপ্রিয়তায় ব্যতিক্রম হবে না। তবে বাংলাদেশের পাঠকরা যাতে এই অনলাইন পড়তে না পারেন তার সর্বপ্রকার অপচেষ্টাই সরকার গ্রহণ করবে। আমাদের সীমিত সম্পদ এবং সামর্থ্য নিয়েই আমরা সেই বাধা অতিক্রমের চেষ্টা করব। দেশের বাইরে যে কোটিরও অধিক প্রবাসী বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী আছেন তারা অবশ্য বিনা বাধায় প্রতিদিন আমার দেশ পড়তে পারবেন।
আমার দেশ পুন:প্রকাশের দিনে মরহুম আতাউস সামাদ, স্বর্গীয় সঞ্জীব চৌধুরী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, জাহেদ চৌধুরী, আবদুল হাই সিকদারসহ সকল সহকর্মীর কথা মনে পরছে। তাদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাই আমাকে পরিণত করেছে। জানি না প্রবাসে একাকি এই গুরুভার বহন করতে পারব কিনা। আপনাদের সকলের দোয়া এবং সহযোগিতা আমাকে অনুপ্রেরণা দেবে। সর্বশেষে, একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঠকদের সতর্ক করছি। ২০১৬ সালে জালিম শেখ হাসিনার সরকার আমার দেশ অনলাইন বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে একাধিক সাইটে আমার দেশের লোগো ব্যবহার করে ভুয়া পত্রিকা চালান হচ্ছে। সেগুলোর পেছনে সরকারের এজেন্সিগুলোর মদদ আছে বলেই আমার ধারনা। অতএব আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।
এক এগার পরবর্তী চৌদ্দ বছরে দিল্লির মদদপুষ্ট শাসকশ্রেণি বাংলাদেশকে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র বানিয়েছে যেখানে মানুষের অধিকার নেই, প্রাণেরও কোন মূল্য নেই। সতের কোটি জনগণের আবাসভূমিকে একটি ইনসাফভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করবার সংগ্রামে কিছু অবদান রাখার স্বপ্ন নিয়ে লেখার সমাপ্তি টানছি।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ