নিউইয়র্ক ০৯:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:০০:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ মার্চ ২০১৫
  • / ৯৭২ বার পঠিত

ঢাকা: ১৮৭৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তখন ক্যাথরিন গ্রাহাম পত্রিকাটির প্রকাশক এবং কার্যত মালিক। মার্কিন সরকার যখন স্বাধীনতা সংগ্রামকে দেখছে ভারতের প্ররোচিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে, তখন মার্কিন জনগণ এবং গণমাধ্যম রক্তাক্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লি লেসাজের যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে তা বাংলায় ভাষান্তরিত হলো। (বিভাগীয় সসম্পাদক)
ঢাকা ১৬ ডিসেম্বর। আজ ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকায় প্রবেশ করল তখন হাজার হাজার বাঙালীর কণ্ঠে সানন্দ জয়ধ্বনি: ‘জয় বাংলা’।
মেজর জেনারেল গান্ধর্ভ নাগরার কমান্ডের অধীন ভারতীয় সৈন্য ও পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বাহিনী (অর্থাৎ বাংলাদেশের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা-বি. স.) যখন খুব ভোরে ঢাকার বাইরে একটি সেতু অকেজো করতে আক্রমণ চালালো, তখনি শুনতে পেল এখানকার পাকিস্তানী কমান্ড আত্মসমর্পণ করতে ভারতের দেওয়া শর্ত ও সময়সীমা মেনে নিয়েছে।
নাগরা বলেন, সকাল সাড়ে আটটায় (বুধবার ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম রাত সাড়ে ৯টা) তিনি শহরের ভেতর পাকিস্তানী সেনা সদর দফপ্তরে একটি বার্তা পাঠান। সাথে সাথেই জবাবও পেয়ে যান যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা আর বাঁধা দেবে না। তারপর তিনি দলবলসহ শহরে প্রবেশ করেন।
তিনি এখানকার পাকিস্তানী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ একে নিয়াজীর সাথে দশটার দিকে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন, ‘আমরা পুরোনো বন্ধু সেই কলেজ জীবন থেকে।’
ভারতীয় জেনারেল তারপর ঢাকা এয়ারপোর্টে চলে গেলেন, ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব হেলিকপ্টারে কোলকাতা সদর দফতর এলেন, তাকে রিসিভ করলেন।
এয়ারপোর্টে ভারতীয় জেনারেল অমসৃণ কাঠের ওয়াকিং স্টিক ঘুরাচ্ছেন, তাঁর সাথে মাত্র তিনজন সৈনিক, ওদিকে এয়ারপোর্টে দায়িত্বরত পাকিস্তানি এয়ারপোর্ট ডিফেন্স ইউনিট রানওয়ের দূরপ্রান্তে দল বেধে আছে, তারা আত্মসমর্পণের স্থানটির দিকে চলে যাবে।
বেশ কয়েক ঘন্টা ঢাকার রাস্তায় সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা ভারতীয় সৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি; কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি হয়েছে। বেশ ক’জন ভারতীয় ও পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে একজন ভারতীয় অফিসার নিহত হন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে।
মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন আর্মির লোকজন জনতার সাথে মিশে উৎসবমুখর জনতার অংশ হয়ে গেছে, আকাশে রাইফেলের গুলি ছুঁড়েছে।
জেনারেল নাগরা ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লেরকে রেড ক্রসের ঘোষিত নিরপেক্ষ অঞ্চল ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠালেন সেখানে আশ্রয় নেওয়া বিদেশি ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক বেসামরিক সরকারের সদস্যদের রক্ষা করতে।
রাস্তা দিয়ে এগোবার সময় ব্রিগেডিয়ার ক্লের-এর গাড়ি বাঙালীরা বারবার ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তারা গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলে ক্লের নিজেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন। বাঙালীরা তাকে ঘিরে ফেলে। একজন এক গোছা গাদাফুল তাঁর হাতে তুলে দেয়।
বাঙালীরা চিৎকার করে তাকে ধন্যবাদ জানায়।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ২ ব্রিগেডের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে নাগরা ও ক্লের উত্তর দিক থেকে পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে লড়াই করতে করতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসেন। মোটর গাড়ি চেপে, হেঁটে প্রতিটি শহরেই লড়াইর মুখোমুখি হয়ে তারা ১৬০ মাইল পথ পেরিয়ে আসেন।
এয়ারপোর্টে একজন সাংবাদিক নাগরাকে বলেন, ‘ক্রিসমাসে আমাদের বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দিতে আমরা আপনাদের উপর নির্ভর করছিলাম।’
নাগরা বললেন, ‘বেশ তো, আমরা কাজটা করেছি।’
নাগরা বললেন, তিনি যে পথে ঢাকায় এসেছেন সে পথের দু’পাশে পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব করুণ। আমরা এগুলো সমাহিত করতে পারিনি। আমাদের হাতে সময় ছিল না।’
নাগরা বললেন, ‘সারা পথ আনন্দ আর করতালির মধ্য দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, ময়মনসিংহে উৎফুল্ল জনতা আমার পোষাক থেকে ব্যাজ ও প্যাচ খুলে নিয়ে যায়।’
জ্যাকব বললেন, ‘আমি আশা করি সবকিছু শান্তিপূর্ণ ও শান্ত। আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি সৈন্য ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের আমরা রক্ষা করব; আমরা মনে করি তা অবশ্যই পালন করব।’
প্রায় ৮ জন বাঙালী জ্যাকবকে অভিনন্দন জানাতে এয়ারপোর্ট গেট থেকে রানওয়ের দিকে ছুটে আসে। একের পর এক তার কাছে এগিয়ে এসে বলতে থাকে, ‘আমি কি আপনার সাথে করমর্দন করতে পারি?’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে একজন বলল, ‘গত ন’মাস এরা আমাদের ইঁদুরের মত হত্যা করেছে।’
একজন সাংবাদিকের দিক ঘাড় ঘুরিয়ে একজন বাঙালী জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?’ ‘আমেরিকা’, সাংবাদিক জবাব দিলেন।
বাঙালী একথা শুনেই মাটিতে থুতু ফেলে করমর্দন করতে অস্বীকার করল, বলল, ‘আমরা আমেরিকার ব্যাপারে সšুÍষ্ট নই।’
গণযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থকের তীব্র নিন্দা জানাল; এ গণযুদ্ধ থেকেই ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা।
তারা যে বাংলাদেশের জন্মের জন্য প্রতীক্ষা করছিল তা এখন বাস্তব। জেনারেল নাগরার সহকারীদের একজন বাংলাদেশের একটি পতাকা নিয়ে তার কাছে এলেন।
জনগণ রাস্তায় পতাকা নাড়িয়ে চলমান গাড়ি আটকে যাত্রীর সাথে হাত মেলাচ্ছে, আনন্দে শ্লোগান দিচ্ছে।
রাস্তার এক পাশ দিয়ে জনতার উপেক্ষা-প্রাপ্ত পাকিস্তান সরকারের পরাজিত সৈন্য ও পুলিশ সারিবদ্ধভাবে তাদের অস্ত্র বহন করে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে তাদের নিরস্ত্র করা হবে।
আত্মসমর্পণ ও ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি হঠাৎ করেই ঘটল কয়েকটি বিবর্ণ সকাল কেটে যাবার পর মনে হল আত্মসমর্পণের পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে কেননা প্রবল যুদ্ধ এবং নতুন করে বিমান আক্রমণ বোমা বর্ষণ ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনবে এবং ঢাকায় বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
পূর্ব পাকিস্তানী সামরিক সদর দফতরে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক সভায় মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান, যিনি জেনারেল নিয়াজির পক্ষে য্দ্ধুবিরতি সমঝোতার চেষ্টা করছেন, তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা জানান। জাতিসংঘের বেতার ব্যবস্থায় বার্তাটি সকাল ৯টা ২০ মিনিটে দিল্লি পাঠানো হয়। আর দশ মিনিটের মধ্যে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে যাবার কথা।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে বিকাল ৫টায় (ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম সকাল ৬টা) রেসকোর্স ময়দানে চারদিকে আনন্দিত গুলিবর্ষণ ও উল্লসিত চিৎকারের মধ্য দিয়ে।
বাসভর্তি ভারতীয় সৈন্যদের থামিয়ে বাঙালীরা ধন্যবাদ দিচ্ছে, আর ২৫ মার্চের পর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্মম কর্মকান্ড চালিয়েছে তখন থেকে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকা বের করে আবার উড়িয়ে দিচ্ছে। (দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১)
সৌজন্যে: বিডিনিউজ২৪.কম

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

প্রকাশের সময় : ০৮:০০:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ মার্চ ২০১৫

ঢাকা: ১৮৭৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তখন ক্যাথরিন গ্রাহাম পত্রিকাটির প্রকাশক এবং কার্যত মালিক। মার্কিন সরকার যখন স্বাধীনতা সংগ্রামকে দেখছে ভারতের প্ররোচিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে, তখন মার্কিন জনগণ এবং গণমাধ্যম রক্তাক্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লি লেসাজের যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে তা বাংলায় ভাষান্তরিত হলো। (বিভাগীয় সসম্পাদক)
ঢাকা ১৬ ডিসেম্বর। আজ ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকায় প্রবেশ করল তখন হাজার হাজার বাঙালীর কণ্ঠে সানন্দ জয়ধ্বনি: ‘জয় বাংলা’।
মেজর জেনারেল গান্ধর্ভ নাগরার কমান্ডের অধীন ভারতীয় সৈন্য ও পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বাহিনী (অর্থাৎ বাংলাদেশের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা-বি. স.) যখন খুব ভোরে ঢাকার বাইরে একটি সেতু অকেজো করতে আক্রমণ চালালো, তখনি শুনতে পেল এখানকার পাকিস্তানী কমান্ড আত্মসমর্পণ করতে ভারতের দেওয়া শর্ত ও সময়সীমা মেনে নিয়েছে।
নাগরা বলেন, সকাল সাড়ে আটটায় (বুধবার ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম রাত সাড়ে ৯টা) তিনি শহরের ভেতর পাকিস্তানী সেনা সদর দফপ্তরে একটি বার্তা পাঠান। সাথে সাথেই জবাবও পেয়ে যান যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা আর বাঁধা দেবে না। তারপর তিনি দলবলসহ শহরে প্রবেশ করেন।
তিনি এখানকার পাকিস্তানী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ একে নিয়াজীর সাথে দশটার দিকে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন, ‘আমরা পুরোনো বন্ধু সেই কলেজ জীবন থেকে।’
ভারতীয় জেনারেল তারপর ঢাকা এয়ারপোর্টে চলে গেলেন, ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব হেলিকপ্টারে কোলকাতা সদর দফতর এলেন, তাকে রিসিভ করলেন।
এয়ারপোর্টে ভারতীয় জেনারেল অমসৃণ কাঠের ওয়াকিং স্টিক ঘুরাচ্ছেন, তাঁর সাথে মাত্র তিনজন সৈনিক, ওদিকে এয়ারপোর্টে দায়িত্বরত পাকিস্তানি এয়ারপোর্ট ডিফেন্স ইউনিট রানওয়ের দূরপ্রান্তে দল বেধে আছে, তারা আত্মসমর্পণের স্থানটির দিকে চলে যাবে।
বেশ কয়েক ঘন্টা ঢাকার রাস্তায় সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা ভারতীয় সৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি; কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি হয়েছে। বেশ ক’জন ভারতীয় ও পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে একজন ভারতীয় অফিসার নিহত হন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে।
মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন আর্মির লোকজন জনতার সাথে মিশে উৎসবমুখর জনতার অংশ হয়ে গেছে, আকাশে রাইফেলের গুলি ছুঁড়েছে।
জেনারেল নাগরা ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লেরকে রেড ক্রসের ঘোষিত নিরপেক্ষ অঞ্চল ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠালেন সেখানে আশ্রয় নেওয়া বিদেশি ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক বেসামরিক সরকারের সদস্যদের রক্ষা করতে।
রাস্তা দিয়ে এগোবার সময় ব্রিগেডিয়ার ক্লের-এর গাড়ি বাঙালীরা বারবার ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তারা গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলে ক্লের নিজেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন। বাঙালীরা তাকে ঘিরে ফেলে। একজন এক গোছা গাদাফুল তাঁর হাতে তুলে দেয়।
বাঙালীরা চিৎকার করে তাকে ধন্যবাদ জানায়।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ২ ব্রিগেডের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে নাগরা ও ক্লের উত্তর দিক থেকে পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে লড়াই করতে করতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসেন। মোটর গাড়ি চেপে, হেঁটে প্রতিটি শহরেই লড়াইর মুখোমুখি হয়ে তারা ১৬০ মাইল পথ পেরিয়ে আসেন।
এয়ারপোর্টে একজন সাংবাদিক নাগরাকে বলেন, ‘ক্রিসমাসে আমাদের বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দিতে আমরা আপনাদের উপর নির্ভর করছিলাম।’
নাগরা বললেন, ‘বেশ তো, আমরা কাজটা করেছি।’
নাগরা বললেন, তিনি যে পথে ঢাকায় এসেছেন সে পথের দু’পাশে পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব করুণ। আমরা এগুলো সমাহিত করতে পারিনি। আমাদের হাতে সময় ছিল না।’
নাগরা বললেন, ‘সারা পথ আনন্দ আর করতালির মধ্য দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, ময়মনসিংহে উৎফুল্ল জনতা আমার পোষাক থেকে ব্যাজ ও প্যাচ খুলে নিয়ে যায়।’
জ্যাকব বললেন, ‘আমি আশা করি সবকিছু শান্তিপূর্ণ ও শান্ত। আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি সৈন্য ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের আমরা রক্ষা করব; আমরা মনে করি তা অবশ্যই পালন করব।’
প্রায় ৮ জন বাঙালী জ্যাকবকে অভিনন্দন জানাতে এয়ারপোর্ট গেট থেকে রানওয়ের দিকে ছুটে আসে। একের পর এক তার কাছে এগিয়ে এসে বলতে থাকে, ‘আমি কি আপনার সাথে করমর্দন করতে পারি?’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে একজন বলল, ‘গত ন’মাস এরা আমাদের ইঁদুরের মত হত্যা করেছে।’
একজন সাংবাদিকের দিক ঘাড় ঘুরিয়ে একজন বাঙালী জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?’ ‘আমেরিকা’, সাংবাদিক জবাব দিলেন।
বাঙালী একথা শুনেই মাটিতে থুতু ফেলে করমর্দন করতে অস্বীকার করল, বলল, ‘আমরা আমেরিকার ব্যাপারে সšুÍষ্ট নই।’
গণযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থকের তীব্র নিন্দা জানাল; এ গণযুদ্ধ থেকেই ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা।
তারা যে বাংলাদেশের জন্মের জন্য প্রতীক্ষা করছিল তা এখন বাস্তব। জেনারেল নাগরার সহকারীদের একজন বাংলাদেশের একটি পতাকা নিয়ে তার কাছে এলেন।
জনগণ রাস্তায় পতাকা নাড়িয়ে চলমান গাড়ি আটকে যাত্রীর সাথে হাত মেলাচ্ছে, আনন্দে শ্লোগান দিচ্ছে।
রাস্তার এক পাশ দিয়ে জনতার উপেক্ষা-প্রাপ্ত পাকিস্তান সরকারের পরাজিত সৈন্য ও পুলিশ সারিবদ্ধভাবে তাদের অস্ত্র বহন করে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে তাদের নিরস্ত্র করা হবে।
আত্মসমর্পণ ও ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি হঠাৎ করেই ঘটল কয়েকটি বিবর্ণ সকাল কেটে যাবার পর মনে হল আত্মসমর্পণের পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে কেননা প্রবল যুদ্ধ এবং নতুন করে বিমান আক্রমণ বোমা বর্ষণ ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনবে এবং ঢাকায় বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
পূর্ব পাকিস্তানী সামরিক সদর দফতরে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক সভায় মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান, যিনি জেনারেল নিয়াজির পক্ষে য্দ্ধুবিরতি সমঝোতার চেষ্টা করছেন, তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা জানান। জাতিসংঘের বেতার ব্যবস্থায় বার্তাটি সকাল ৯টা ২০ মিনিটে দিল্লি পাঠানো হয়। আর দশ মিনিটের মধ্যে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে যাবার কথা।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে বিকাল ৫টায় (ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম সকাল ৬টা) রেসকোর্স ময়দানে চারদিকে আনন্দিত গুলিবর্ষণ ও উল্লসিত চিৎকারের মধ্য দিয়ে।
বাসভর্তি ভারতীয় সৈন্যদের থামিয়ে বাঙালীরা ধন্যবাদ দিচ্ছে, আর ২৫ মার্চের পর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্মম কর্মকান্ড চালিয়েছে তখন থেকে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকা বের করে আবার উড়িয়ে দিচ্ছে। (দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১)
সৌজন্যে: বিডিনিউজ২৪.কম