দলবাজ সাংবাদিকদের কর্মকান্ডে সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে
- প্রকাশের সময় : ১১:১২:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ জুন ২০১৮
- / ৮০৮ বার পঠিত
আমীর খসরু: প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের তত্ত্বীয় ধারণার উদ্ভাবক দার্শনিক জন স্টুয়ার্ড মিল জীবনভর প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের জয়গান গাইলেও, তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্ধিহান ছিলেন যে, প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাও শেষ পর্যন্ত কতিপয়ের শাসনে পরিণত হয় কি না। গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কে নানাজন নানাকথা বহুবার বলেছেন; এ কারণে এ বিষয়টি নিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করলেও, দু’একটি কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশসহ যে সব দেশে গণতন্ত্রের চরম ঘাটতি বহুকাল ধরে আছে, সেসব দেশের মানুষের মনোজগতে শাসকদের পক্ষ থেকে সুকৌশলে এ ধারনাটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কোন মতে, যেনতেন পন্থায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামই হচ্ছে গণতন্ত্র। কিন্তু বাস্তব বিষয়টি হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের রাস্তায় ওঠার প্রথম ধাপ মাত্র, কোনক্রমেই একমাত্র ধাপ নয়। গণতন্ত্র চর্চার মুশকিলটি হচ্ছে এখানেই যে, বিদ্যমান শাসক শ্রেণীর মনোজগতে আসলে গণতন্ত্র নেই; কাজেই বাস্তবে রাষ্ট্রে ও সমাজে গণতন্ত্র চর্চা হবে- এটা সম্ভব নয়, সংগত কারণেই।
গণতন্ত্র যখন একেবারে তলানিতে বা পাল্লার নেতিবাচক দিকে যায়, ঝুলটা যখন বিপরীত হয়, তখন নির্বাচন নামক কর্মকান্ডেরও রকমফের দেখা দেয়। একথাটি বলতেই হবে যে, এ দেশে কখনোই সহি বা সঠিক নির্বাচন হয়েছে তা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না। দেশের ইতিহাসের প্রথম অর্থাৎ ১৯৭৩’র নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৌশলের সাথে এর বছর ছয়েক পরের হ্যাঁ না ভোটের কৌশলকে যেমন মেলানো যাবে না- তেমনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনকেও নয়।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়নের বিষয়টি যদি গণতন্ত্রের অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, স্থানীয় সরকারও এখন আর নির্বাচনের নামে ইতোমধ্যে যেসব রাজনৈতিক বিকৃতি ও বৈকল্য ঘটে গেছে তা থেকে কোনক্রমেই বাইরে নয়। এ কারণে ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও বহুকাল ধরে রেহাই দিচ্ছে না। এসব নির্বাচনকে গ্রাস করার নানা ধরন-ধারন পাল্টাচ্ছে। যেকারণে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অন্য সব নির্বাচনের সাথে মেলানো যাবে না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবী করছেন, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। বাস্তবে কি তাই? আসলে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ও প্রশাসনে যারা ছিলেন তারা। আর বিপর্যয় হয়েছে নির্বাচন কমিশনের। জনগণ বরাবরের মতো নিরব সাক্ষী হয়েছিলেন।
আর আরেকদফা সীমাহীন একটি ক্ষতি হয়ে গেছে সাংবাদিকদের ও গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতায়। সাংবাদিকদের সম্পর্কে জনমনে ধারণা গত কিছুকাল ধরে এমনিতেই ভালো নয়। একাংশ, অন্য অংশ বলে যে বিভাজন আগেই হয়ে রয়েছে তা আরো বিকট-প্রকট হয়েছে; পাল্টা দিয়ে তারা এখন দলীয় লেজুরবৃত্তিতে মগ্ন রয়েছে। আর এতে যে ক্ষতি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, তা কখনই সামাল দেয়া সম্ভব নয়, এ এক অপূরণীয় অনিবার্য বিপদ, কিছু সংখ্যক ‘আপদে’র কারণে। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অথবা গাজীপুরে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তথাকথিত সাংবাদিক নেতারা বক্তৃতাবাজি করে, মিছিল করে, দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট ভিক্ষা চায়- নিজ পেশার বদলে দলবাজিকে প্রাধান্য দেয়; যেসব সাংবাদিক সামান্য অর্থের কাছে নতজানু হয়, অতিসামান্য চাপেই মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়ে- তখন আর সবাই যা বলে বলুক, দলবাজ কথিত এইসব সাংবাদিকদের এই কর্মকান্ডে সাংবাদিক পরিচয় দিতে আমার অন্তত লজ্জা লাগে, ঘৃনাবোধ করি।
কাজেই খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল কি হয়েছে- তা নিয়ে আমার মতো অনেকেরই আসলে উদ্বিগ্ন নন। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, ইহজনমে হয়তো আর মন্দের ভালো একটি নির্বাচনও আর দেখে যেতে পারবো না। (আমাদের বুধবার)