নিউইয়র্ক ০৪:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জাতীয় প্রেসক্লাব : জনতার আস্থা, জনতার অহংকার

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৫৩:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর ২০২০
  • / ২৭ বার পঠিত

সাইফুল আলম:
‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি এ আমার এক ধরনের অহংকার।
… … … … … … … … … … প্রলয়ে হইনি পলাতক,
নিজস্ব ভূভাগে একরোখা
এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার।’
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমানের লেখা এই পংক্তিমালা স্মরণে এলো। আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে।
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত সংবাদকর্মীরা সেই স্তম্ভেরই অংশ বটে। অনেক অধিকার, অধিকারহীনতা, পাওয়া, না-পাওয়ার বঞ্চনা, অনেক আশা-নিরাশার পাকেচক্রে বাঁধা এক জীবন। সব দুঃখ-বেদনা পেরিয়ে এসেও শেষ পর্যন্ত এ পেশাটি এক ধরনের অহংকারই বটে- টিকে থাকার। অস্তিত্ব রক্ষার। এ পেশায় সবচেয়ে বড় অহংকার শেষ পর্যন্ত মানুষ এবং মানুষের জন্য কাজ করার তৃপ্তি। এ পেশার ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত এসে মিলতে হয় সমষ্টির মোহনায়। তবে তা কিন্তু মোটেই গতানুগতিকতার গড্ডলিকা প্রবাহে নয়। সমষ্টিকে পরিচর্যা এবং তার সৃজনশীল-বিকাশের কাজের মধ্য দিয়ে দিতে হয় পথের দিশা- সঠিক পথে থাকার, সঠিক পথে চলার। যারা এ কাজে নিয়োজিত তাদের একটুখানি অবসরের দম ফেলার প্রাঙ্গণ জাতীয় প্রেসক্লাব। রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির সুলুক সন্ধানে যারা নিরন্তর ব্যাপৃত, তারা এ প্রাঙ্গণে আলাপে-আড্ডায় তত্ত¡-তথ্যের সাগর সেচে মুক্তোর সন্ধান করেন।
২.
এ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যে প্রতিষ্ঠান কখনও আপস করেনি, সেটি জাতীয় প্রেসক্লাব। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর থেকে আজ অবধি যাত্রায় যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, যাদের শ্রম-মেধা-ভালোবাসায় আজকের এ আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি, তাদের মধ্যে ছিলেন নমস্য ব্যক্তিত্বরা, সাংবাদিকতা ছিল যাদের জীবনের আদর্শ ও ব্রত- মুজিবুর রহমান খাঁ, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আবদুল গাফফার চৌধুরী, এবিএম মূসা, ফয়েজ আহমদ, এনায়েত উল্লাহ খান, গোলাম সারওয়ার, কামাল লোহানী, তোয়াব খান, আতাউস সামাদ প্রমুখ- এরা সবাই বাঙালী জাতির গৌরব। তাদের হাতে জ্বেলে যাওয়া মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার বাতিঘর জাতীয় প্রেসক্লাব।
৩.
বহু মত ও বহু পথের মানুষের এক বহুরৈখিক সমাবেশ ঘটে এ জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, জাতীয় প্রেসক্লাব গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার আধার; অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সব চেতনার ধারক জাতীয় প্রেসক্লাব এক বিশ্বাসের নাম, আস্থার প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। প্রেসক্লাব স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির লালন কেন্দ্র।
দেশের মূলধারার সব বড় এবং ছোট রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, কর্মচারী সংগঠন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রামের আংশিক তৎপরতা দেশের সব মানুষের দৃষ্টিপথে আনার এক উন্মুক্ত গবাক্ষও যেন জাতীয় প্রেসক্লাব। তাই বছরের ৩৬৫ দিনের প্রায় এমন একটি দিনও থাকে না, যেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরের মিলনায়তনে কিংবা সামনের সড়কে কোনো সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন কিংবা সভা-সমাবেশ থাকে না। এ যেন এক অলিখিত হাইড পার্ক- যেখানে সবাই নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে। পারে নিজেদের দাবি-দাওয়া অধিকারের কথা নির্ভয়ে বলতে। কখনও কখনও অনশনে, অবস্থান ধর্মঘটের জ্যামে নাগরিক জীবন ব্যাহত হলেও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতীকরূপে সে সমাবেশে উঁকি দিয়ে যান নগরের নাগরিকরাও। এভাবেই প্রেসক্লাব এক সেতুবন্ধ হয়ে উঠেছে সবার কাছে। এখানে ব্যানার হাতে ¯েøাগানে উচ্চকিত হন যেমন গার্মেন্ট শ্রমিকরা, তেমনি দেশের নদীভাঙনে সর্বস্বান্তরাও জোট বেঁধে এসে মানববন্ধনে ব্যানার বহন করে জানিয়ে যান তাদের প্রতিকার পাওয়ার অধিকারের কথা।
দেশের দুর্বল, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ মনে করেন ওখানে কথা বলতে পারলে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। দেশবাসী জানবেন, সরকারের দৃষ্টিতে পড়বে, সরকার আমলে নেবে। তাই এখনও সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী প্রতিনিধি, বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ মানুষ ছুটে আসেন প্রেসক্লাবের সামনে।
৪.
কেন মানুষের এ আস্থা জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতি, কেনই বা ভরসা এতটা? প্রেসক্লাব কি অনেক ‘ক্ষমতাধর’ যে তাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে? কোনো আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের অধিকারী এখানকার পেশাজীবী সাংবাদিকরা?
-না, কোনো ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতাধর দৈত্য এসবের কিছুই নয়; প্রেসক্লাব কেবলই এক বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসার প্রতীক মাত্র। এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা ন্যূনতম ক্ষমতার অধিকারীও নন এ কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্য এ পেশার মানুষের আছে কেবল একটি সহানুভূতিপূর্ণ সহমর্মী হৃদয়; যে হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়, প্রতিধ্বনি ওঠে অধিকার বঞ্চিতদের, অধিকার বঞ্চনার আর্তধ্বনি। তারা সহানুভূতিপূর্ণ হৃদয়ে সতথ্য প্রতিবেদনে তাদের কথা তুলে ধরেন পত্রিকার পৃষ্ঠায়, টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিও’র তরঙ্গে- আর তখন সেসব প্রতিবেদনে বোধকরি সঞ্চারিত হয় মজলুম মানুষের হৃদয়ের শক্তি। তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে পড়ে, কানে ঢোকে- তারাও সমব্যথী হয়ে ওঠেন মানুষের প্রতি আর তার ফলেই প্রশস্ত হয় প্রতিকারের পথ। মানুষের বঞ্চনার অবসান ঘটে।
এ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া- গণতন্ত্রের অন্তহীন সৌন্দর্য নিহিত এ প্রক্রিয়ায়ই। বলা যায়- ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’- এ বহুল প্রচলিত একটি বাক্য যে রয়েছে আমাদের দেশে; মূলত সেই জনগণের ক্ষমতাই- জনপ্রতিনিধিদের নিষ্ক্রিয় নিষ্পিষ্ট ক্ষমতাকেই- স্পৃষ্ট করে জনতার অধিকার, স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আদায় করে নেয় তা।
৫.
তাহলে কৌতূহলী এ প্রশ্ন জাগেই- প্রেসক্লাবের ‘শক্তি’ কোথায়? মূলত প্রেসক্লাবের শক্তি বহু মত ও বহু পথের মধ্যে বহুরৈখিক সমন্বয়ে, সমবায়ে, সেতুবন্ধে।
জনতা ছাড়া ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতা ছাড়া জনতা- দুটিই মূলত অকার্যকর। জাতীয় প্রেসক্লাব এ অকার্যকর ক্ষমতাকে এবং জনতাকে মিলিয়ে দেয় মাত্র। আর যখন এ দুইয়ের সম্মিলন ঘটে তখন অবসান ঘটে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দুঃশাসনের- ক্ষমতা এবং জনতা দুটিই কার্যকর শক্তি তথা যথার্থ ক্ষমতা হয়ে ওঠে তখন। জাতীয় প্রেসক্লাব মূলত মমতা দিয়ে বিচ্ছিন্নদের ঐক্যবদ্ধ করে- অর্থবহ করে তোলার ক্যাটালিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
আর এ কারণেই এ প্রতিষ্ঠান, এ পেশার মানুষের ওপর এখনও দেশের মানুষ তথা জনতা, জনপ্রতিনিধিদের আস্থা ও ভরসা।
৬.
শুরুতে দেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কবিতার যে ‘অহংকারের’ কথা লিখেছি সেই ‘অহংকার’ ব্যক্তির আত্মম্ভরিতাজনিত ‘অহংকার’ নয়। সেই অহংকার হচ্ছে সমষ্টির উপস্থিতি, দেশের মানুষের সার্বভৌম অধিকার। জাতীয় প্রেসক্লাব সেই অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক: সম্পাদক দৈনিক যুগান্তর ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

জাতীয় প্রেসক্লাব : জনতার আস্থা, জনতার অহংকার

প্রকাশের সময় : ০১:৫৩:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর ২০২০

সাইফুল আলম:
‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি এ আমার এক ধরনের অহংকার।
… … … … … … … … … … প্রলয়ে হইনি পলাতক,
নিজস্ব ভূভাগে একরোখা
এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার।’
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমানের লেখা এই পংক্তিমালা স্মরণে এলো। আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে।
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত সংবাদকর্মীরা সেই স্তম্ভেরই অংশ বটে। অনেক অধিকার, অধিকারহীনতা, পাওয়া, না-পাওয়ার বঞ্চনা, অনেক আশা-নিরাশার পাকেচক্রে বাঁধা এক জীবন। সব দুঃখ-বেদনা পেরিয়ে এসেও শেষ পর্যন্ত এ পেশাটি এক ধরনের অহংকারই বটে- টিকে থাকার। অস্তিত্ব রক্ষার। এ পেশায় সবচেয়ে বড় অহংকার শেষ পর্যন্ত মানুষ এবং মানুষের জন্য কাজ করার তৃপ্তি। এ পেশার ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত এসে মিলতে হয় সমষ্টির মোহনায়। তবে তা কিন্তু মোটেই গতানুগতিকতার গড্ডলিকা প্রবাহে নয়। সমষ্টিকে পরিচর্যা এবং তার সৃজনশীল-বিকাশের কাজের মধ্য দিয়ে দিতে হয় পথের দিশা- সঠিক পথে থাকার, সঠিক পথে চলার। যারা এ কাজে নিয়োজিত তাদের একটুখানি অবসরের দম ফেলার প্রাঙ্গণ জাতীয় প্রেসক্লাব। রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির সুলুক সন্ধানে যারা নিরন্তর ব্যাপৃত, তারা এ প্রাঙ্গণে আলাপে-আড্ডায় তত্ত¡-তথ্যের সাগর সেচে মুক্তোর সন্ধান করেন।
২.
এ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যে প্রতিষ্ঠান কখনও আপস করেনি, সেটি জাতীয় প্রেসক্লাব। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর থেকে আজ অবধি যাত্রায় যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, যাদের শ্রম-মেধা-ভালোবাসায় আজকের এ আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি, তাদের মধ্যে ছিলেন নমস্য ব্যক্তিত্বরা, সাংবাদিকতা ছিল যাদের জীবনের আদর্শ ও ব্রত- মুজিবুর রহমান খাঁ, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আবদুল গাফফার চৌধুরী, এবিএম মূসা, ফয়েজ আহমদ, এনায়েত উল্লাহ খান, গোলাম সারওয়ার, কামাল লোহানী, তোয়াব খান, আতাউস সামাদ প্রমুখ- এরা সবাই বাঙালী জাতির গৌরব। তাদের হাতে জ্বেলে যাওয়া মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার বাতিঘর জাতীয় প্রেসক্লাব।
৩.
বহু মত ও বহু পথের মানুষের এক বহুরৈখিক সমাবেশ ঘটে এ জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, জাতীয় প্রেসক্লাব গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার আধার; অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সব চেতনার ধারক জাতীয় প্রেসক্লাব এক বিশ্বাসের নাম, আস্থার প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। প্রেসক্লাব স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির লালন কেন্দ্র।
দেশের মূলধারার সব বড় এবং ছোট রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, কর্মচারী সংগঠন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রামের আংশিক তৎপরতা দেশের সব মানুষের দৃষ্টিপথে আনার এক উন্মুক্ত গবাক্ষও যেন জাতীয় প্রেসক্লাব। তাই বছরের ৩৬৫ দিনের প্রায় এমন একটি দিনও থাকে না, যেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরের মিলনায়তনে কিংবা সামনের সড়কে কোনো সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন কিংবা সভা-সমাবেশ থাকে না। এ যেন এক অলিখিত হাইড পার্ক- যেখানে সবাই নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে। পারে নিজেদের দাবি-দাওয়া অধিকারের কথা নির্ভয়ে বলতে। কখনও কখনও অনশনে, অবস্থান ধর্মঘটের জ্যামে নাগরিক জীবন ব্যাহত হলেও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতীকরূপে সে সমাবেশে উঁকি দিয়ে যান নগরের নাগরিকরাও। এভাবেই প্রেসক্লাব এক সেতুবন্ধ হয়ে উঠেছে সবার কাছে। এখানে ব্যানার হাতে ¯েøাগানে উচ্চকিত হন যেমন গার্মেন্ট শ্রমিকরা, তেমনি দেশের নদীভাঙনে সর্বস্বান্তরাও জোট বেঁধে এসে মানববন্ধনে ব্যানার বহন করে জানিয়ে যান তাদের প্রতিকার পাওয়ার অধিকারের কথা।
দেশের দুর্বল, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ মনে করেন ওখানে কথা বলতে পারলে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। দেশবাসী জানবেন, সরকারের দৃষ্টিতে পড়বে, সরকার আমলে নেবে। তাই এখনও সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী প্রতিনিধি, বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ মানুষ ছুটে আসেন প্রেসক্লাবের সামনে।
৪.
কেন মানুষের এ আস্থা জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতি, কেনই বা ভরসা এতটা? প্রেসক্লাব কি অনেক ‘ক্ষমতাধর’ যে তাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে? কোনো আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের অধিকারী এখানকার পেশাজীবী সাংবাদিকরা?
-না, কোনো ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতাধর দৈত্য এসবের কিছুই নয়; প্রেসক্লাব কেবলই এক বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসার প্রতীক মাত্র। এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা ন্যূনতম ক্ষমতার অধিকারীও নন এ কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্য এ পেশার মানুষের আছে কেবল একটি সহানুভূতিপূর্ণ সহমর্মী হৃদয়; যে হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়, প্রতিধ্বনি ওঠে অধিকার বঞ্চিতদের, অধিকার বঞ্চনার আর্তধ্বনি। তারা সহানুভূতিপূর্ণ হৃদয়ে সতথ্য প্রতিবেদনে তাদের কথা তুলে ধরেন পত্রিকার পৃষ্ঠায়, টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিও’র তরঙ্গে- আর তখন সেসব প্রতিবেদনে বোধকরি সঞ্চারিত হয় মজলুম মানুষের হৃদয়ের শক্তি। তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে পড়ে, কানে ঢোকে- তারাও সমব্যথী হয়ে ওঠেন মানুষের প্রতি আর তার ফলেই প্রশস্ত হয় প্রতিকারের পথ। মানুষের বঞ্চনার অবসান ঘটে।
এ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া- গণতন্ত্রের অন্তহীন সৌন্দর্য নিহিত এ প্রক্রিয়ায়ই। বলা যায়- ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’- এ বহুল প্রচলিত একটি বাক্য যে রয়েছে আমাদের দেশে; মূলত সেই জনগণের ক্ষমতাই- জনপ্রতিনিধিদের নিষ্ক্রিয় নিষ্পিষ্ট ক্ষমতাকেই- স্পৃষ্ট করে জনতার অধিকার, স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আদায় করে নেয় তা।
৫.
তাহলে কৌতূহলী এ প্রশ্ন জাগেই- প্রেসক্লাবের ‘শক্তি’ কোথায়? মূলত প্রেসক্লাবের শক্তি বহু মত ও বহু পথের মধ্যে বহুরৈখিক সমন্বয়ে, সমবায়ে, সেতুবন্ধে।
জনতা ছাড়া ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতা ছাড়া জনতা- দুটিই মূলত অকার্যকর। জাতীয় প্রেসক্লাব এ অকার্যকর ক্ষমতাকে এবং জনতাকে মিলিয়ে দেয় মাত্র। আর যখন এ দুইয়ের সম্মিলন ঘটে তখন অবসান ঘটে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দুঃশাসনের- ক্ষমতা এবং জনতা দুটিই কার্যকর শক্তি তথা যথার্থ ক্ষমতা হয়ে ওঠে তখন। জাতীয় প্রেসক্লাব মূলত মমতা দিয়ে বিচ্ছিন্নদের ঐক্যবদ্ধ করে- অর্থবহ করে তোলার ক্যাটালিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
আর এ কারণেই এ প্রতিষ্ঠান, এ পেশার মানুষের ওপর এখনও দেশের মানুষ তথা জনতা, জনপ্রতিনিধিদের আস্থা ও ভরসা।
৬.
শুরুতে দেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কবিতার যে ‘অহংকারের’ কথা লিখেছি সেই ‘অহংকার’ ব্যক্তির আত্মম্ভরিতাজনিত ‘অহংকার’ নয়। সেই অহংকার হচ্ছে সমষ্টির উপস্থিতি, দেশের মানুষের সার্বভৌম অধিকার। জাতীয় প্রেসক্লাব সেই অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক: সম্পাদক দৈনিক যুগান্তর ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা