নিউইয়র্ক ০১:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ঘুরে দেখা মেলবোর্ন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:১০:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ অক্টোবর ২০২০
  • / ৫১৩ বার পঠিত

হাবিব রহমান: বলা হয়ে থাকে মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ার এমন একটি শহর যে জাতি, বর্ণ, ভ্রমণের বাজেট নির্বিশেষে সবার জন্য কিছুনা কিছু নিয়ে বসে আছে ইয়ারা নদীর পাশে। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক মানুষ এই শহরে বসবাস করছে। উচ্চতর শিক্ষা, জীবিকা ও ঘুরবার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে থাকে। কসমোপলিটন এই শহরটি সহজ নেভিগেশন, রাস্তার ধারের মন জুড়ানো ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে এবং স্ট্রিট মার্কেটের জন্য টুরিস্টদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। আজ দুদিন ধরে মেলবোর্ন শহরটি চষে বেড়াচ্ছি। যেখানেই যাই সেখানেই দেখছি ট্যুরিস্টদের উপচে পরা ভীড়। এতেই প্রমান করে দেশটি দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে কতটা জনপ্রিয়।
আমি নিজে ‘একজন ট্যুর অপারেটর কাম ট্যুর গাইড’। ট্যুর গ্রæপ নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই।কোন দেশে ট্যুর নিয়ে যাবার আগে যথা সম্ভব হোম ওয়ার্ক করে যাই। তবে যে কোন দেশ ভ্রমণের সময় স্থানীয় গাইডের সহায়তা নেই সব সময়। কারন তারা এমন সব কিছু জানে যা বই পুস্তকে থাকেনা। এছাড়াও ট্যুরের সময় সে নিয়মিত যে ব্রিফ দেয় তার বাইরেও অনেক কিছু জানার থাকে যেগুলো একান্তভাবে আলাপ করে জেনে নিতে হয়। আর আমি তা সব সময় করিও।
তাই আজকে টি ব্রেকের সময় সবাই যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আমি গাইডের কাছে বসে একান্তভাবে জানতে চাইলাম মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে। দেখলাম আমি প্রশ্ন করার আগেই সে মিটি মিটি হাসছে। তার কারণ দুটি। এক-আমি সব সময়ই তাকে নানান প্রশ্নবানো জর্জরিত করছি। আমার জিজ্ঞাসাগুলোর জবাবও সে ভালোভাবে দিচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছেনা। দ্বিতীয়ত একজন সমঝদার লোক হিসাবে আমাকে পেয়ে সে তার জ্ঞান ভান্ডার উজার করে দিতে পেরে খুশীও হচ্ছিলো।
গাইড জানালো, মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ভারত নিয়মিত অংশগ্রহন করে। ১৭তম ফেস্টিভ্যালের প্রধান অতিথি ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনিই একমাত্র ভারতীয় চিত্র পরিচালক যার ছবি শুধু মেলবোর্ন নয়, সারা অস্ট্রেলিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হতো। শুধু তাই নয়, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে সত্যজিৎ রাতের একটা ভাস্কর্যও নির্মিত হয়েছে। শুনে খুবই ভালো লাগলো। সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ী আমার দেশের বাড়ীর একই ইউনিয়ন এবং পাশের গ্রামে। সেজন্য আলাদা একটা গর্বও ছিলো তার জন্য।
গাইড আরো জানায়, সত্যজিৎ রায়ের আগে আরো একজন বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও মেলবোর্নবাসীর আগ্রহ ছিলো। ১৯৩৪ সালে মেলবোর্নের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে কবিকে বিশেষ অতিথি হিসাবে দাওয়াত করা হয়। কিন্তু শেষ মুহুর্তে তাঁর আসা হয়নি।
সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বিদেশে বাঙালীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কত যুগ আগে। হোক না, তারা ভারতীয় কিন্তু বাঙালীতো! এখন বাইরের বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই। তাঁর প্রশংসা আমাদের আপ্লুত করে।
এরপর আমরা এলাম মেলবোর্ন সেন্ট্রাল বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট এলাকায়। এই এলাকা-কে সংক্ষেপে বলা হয় সি-বি-ডি। অস্ট্রেলিয়ার সব শহরেই একটা সিবিডি আছে। সিডনিতে আমার সিডনি হিল্টন হোটেলটিও ছিলো এই সিবিডি এলাকায়। প্রতিটি সিবিডি এলাকাই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি। অফিস পাড়া, বড় বড় দোকান পাঠ সবই এই এলাকায় থাকে। গাইড জানালো উত্তর থেকে দক্ষিণে বড় বড় সমান্তরাল বেশ কয়েকটি স্ট্রীট নিয়ে এই মেলবোর্ন সিবিডি। সবগুলি দিয়েই ট্রাম চলে। আর এই সিবিডিই হচ্ছে মেলবোর্নের প্রাণ কেন্দ্র। আর তাকে ঘিরেই বৃহত্তর মেলবোর্ন।
লেখক হাবিব রহমান
সিবিডি ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই আকাশ ভেঙে ঝম ঝম করে বৃস্টি নামলো। এতে আমার অবাক হবার পালা। কারণ একটু আগেও আকাশে রৌদ্রের খেলা ছিলো। আমি অবাক দৃস্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি দেখে গাইড বল্লো, মেলবোর্ন তথা সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতেই আকাশ ঘন ঘন রঙ বদলায়। এই রোদ, এই বৃস্টি। কখনো বা প্রচন্ড কুয়াশা। আবার ঘন্টা খানিকের মধ্যে দেখা গেলো কুয়াশার বুক চিড়ে সূর্য তার হাসিমুখ দেখাচ্ছে। মেলবোর্নের আকাশও তার প্রমান রাখলো। গাইডের কথা শেষ হতে না হতেই পরিস্কার আকাশে সূর্য হেসে উঠলো।
এরপর গাড়ী এসে থামলো রয়্যাল বিল্ডিং এর সামনে। গাইড জানালো এই ভবনটা অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। বারো হাজার বর্গমিটারের এই ভবনটি তৈরি হয় ১৮৮০ সালে। এই ভবনটিতেই অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিলো। পওে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়ান স্টেট গভর্নমেন্ট-এর কার্যক্রম চলে এখানে। বিরাট গম্বুজওয়ালা ভবনটার চারপাশে চমৎকার সাজানো বাগান। ঘাঁসে ঢাকা লন আর চারদিকে বড়গাছ- এক নজরেই পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
বেলা ক্রমেই নীচে নামতে শুরু করেছে। গাইড জানালো মেলবোর্নে দর্শনীয় জায়গা প্রচুর। একদিনে তা দেখা সম্ভব নয়। আজকে আর গাড়ী থেকে নামা সম্ভব নয়। তার ধারা বর্ননা আর গাড়ীর জানালা দিয়ে দেখেই আপাতত নয়ন মন স্বার্থক করতে হবে।
এবার গাড়ী চলছে হিলসভিল স্যাঙ্কচুয়ারির পাশ দিয়ে। ইয়ারা রেঞ্জের পাদদেশে অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীদের প্রায় ২০০ টি প্রজাতি ও নানা রকম গাছ গাছড়া নিয়ে এই স্যাংকচুয়ারিটি গড় উঠেছে। গাইড জানালো এমু, কোয়ালা, প্লাটিপ্লাস, তাস্মানিয়ান ডেভিল সহবেশ কিছু প্রাণী রয়েছে এখানে। প্রতিদিন বেলা ১২ টা এবং আড়াইটায় শিকারি পাখি নিয়ে একটি শো পর্যটকদের জন্য দেখানো হয়। সময়াভাবে আমাদের এ শো টি দেখানো সম্ভব হলোনা বলে দু:খ প্রকাশ করলো গাইড।
এবার আমাদের গাড়ী এসে থামলো ইউরেকা স্কাই ডেক ৮৮ এর সামনে। দক্ষিণে সবচেয়ে উঁচু এই জায়গাটি থেকে মেলবোর্ন শহরের প্রায় অনেকাংশ খালি চোখে দেখা যায়। স্কাই ডেকটি ৩০০ মিটার উঁচু। এবং এখান থেকে একটি আপাদ মস্তক কাঁচে ঘেরাঘর থেকে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কগুলো দেখবার সুযোগ পাওয়া যায়। আমার কাছে এধরনের স্কাই ডেকের অন্য একটি আকর্ষন থাকে। তাহলো এর প্রতিটিতে থাকে রিভলভিং (ঘুর্ণায়মান) রেস্টুরেন্ট। এত উঁচুতে বসে খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি ঘুরন্ত রেস্টুরেন্টে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখার আনন্দই আলাদা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এধরনের টাওয়ার আছে। কানাডা সাইড নায়াগ্রা ফলসের পাশে ২৮৮ ফুট উপরে স্কাইলন টাওয়ার, সিডনী টাওয়ার, নিউজিলাল্ডের অকল্যান্ডে স্কাই টাওয়ার, জার্মানীর বার্লিন টাওয়ার এর প্রতিটিতে আকর্ষনীয় ঘুর্ণায়মান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারেও টাওয়ার-৮৮ নামে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যদিও তা ঘুর্ণায়মান নয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এর প্রতিটিতে বসে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি উপর থেকে চারপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অবলোকনের। কিন্তু এবার সময়াভাবে মেলবোর্নের স্কাই ডেকে উঠতে না পারা এবং উঁচু রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে না পারার দু:খটা রয়েই গেলো। তবে মনে এই আশাবাদ পুষে রাখলাম যে অন্য একবার এলে তা অবশ্যই পুরণ করে নেবো।
এবার আমরা এলাম মেলবোর্নের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ইয়ারা ভ্যালিতে। এখানেই প্রচুর পর্যটকের ভীড়। গাইড জানালো এখানে আছে ওয়াইন তৈরির কারখানা, আঙুরের ক্ষেত, গ্রাম, বুটিক জিনিসের দোকান, ফসলের মাঠ। ভ্যালির মানুষজনের সহজ সরল জীবন দেখবার ও নিখাদ আতিথেয়তা পাবার সুযোগ মেলবোর্ন ঘুরতে আসলে কেউ হারাতে চায় না, আর তাই ইয়ারা ভ্যালির অমলিন সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে সকলে ছুটে যায় পৃথিবীর নানাকোণ থেকে। এই জায়গাটাও নাদেখার দু:খ বুকে চেপে আমাদের ফিরতে হলো।
গাইড ঘোষণা দিলো আজকের মত ভ্রমণের এখানেই সমাপ্তি। আগামী দিনের ভ্রমণ তালিকায় রয়েছে গ্রেট ওশান রোড ভ্রমণ, মেলবোর্ন হারবার টাউন পরিদর্শন, প্রাচীন শহর সোভেরেউন হিল, পেনিনসুলা হট স্প্রিং সহ অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইন্ড লাইফের এক অনন্য নিদর্শন পেঙ্গুইন প্যারেড দেখা।

হাবিবুর রহমান
সিইও, বাংলা ট্যুর।
ই মেইল: নধহমষধঃড়ঁৎঁং@মসধরষ.পড়স

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ঘুরে দেখা মেলবোর্ন

প্রকাশের সময় : ০২:১০:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ অক্টোবর ২০২০

হাবিব রহমান: বলা হয়ে থাকে মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ার এমন একটি শহর যে জাতি, বর্ণ, ভ্রমণের বাজেট নির্বিশেষে সবার জন্য কিছুনা কিছু নিয়ে বসে আছে ইয়ারা নদীর পাশে। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক মানুষ এই শহরে বসবাস করছে। উচ্চতর শিক্ষা, জীবিকা ও ঘুরবার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে থাকে। কসমোপলিটন এই শহরটি সহজ নেভিগেশন, রাস্তার ধারের মন জুড়ানো ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে এবং স্ট্রিট মার্কেটের জন্য টুরিস্টদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। আজ দুদিন ধরে মেলবোর্ন শহরটি চষে বেড়াচ্ছি। যেখানেই যাই সেখানেই দেখছি ট্যুরিস্টদের উপচে পরা ভীড়। এতেই প্রমান করে দেশটি দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে কতটা জনপ্রিয়।
আমি নিজে ‘একজন ট্যুর অপারেটর কাম ট্যুর গাইড’। ট্যুর গ্রæপ নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই।কোন দেশে ট্যুর নিয়ে যাবার আগে যথা সম্ভব হোম ওয়ার্ক করে যাই। তবে যে কোন দেশ ভ্রমণের সময় স্থানীয় গাইডের সহায়তা নেই সব সময়। কারন তারা এমন সব কিছু জানে যা বই পুস্তকে থাকেনা। এছাড়াও ট্যুরের সময় সে নিয়মিত যে ব্রিফ দেয় তার বাইরেও অনেক কিছু জানার থাকে যেগুলো একান্তভাবে আলাপ করে জেনে নিতে হয়। আর আমি তা সব সময় করিও।
তাই আজকে টি ব্রেকের সময় সবাই যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আমি গাইডের কাছে বসে একান্তভাবে জানতে চাইলাম মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে। দেখলাম আমি প্রশ্ন করার আগেই সে মিটি মিটি হাসছে। তার কারণ দুটি। এক-আমি সব সময়ই তাকে নানান প্রশ্নবানো জর্জরিত করছি। আমার জিজ্ঞাসাগুলোর জবাবও সে ভালোভাবে দিচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছেনা। দ্বিতীয়ত একজন সমঝদার লোক হিসাবে আমাকে পেয়ে সে তার জ্ঞান ভান্ডার উজার করে দিতে পেরে খুশীও হচ্ছিলো।
গাইড জানালো, মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ভারত নিয়মিত অংশগ্রহন করে। ১৭তম ফেস্টিভ্যালের প্রধান অতিথি ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনিই একমাত্র ভারতীয় চিত্র পরিচালক যার ছবি শুধু মেলবোর্ন নয়, সারা অস্ট্রেলিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হতো। শুধু তাই নয়, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে সত্যজিৎ রাতের একটা ভাস্কর্যও নির্মিত হয়েছে। শুনে খুবই ভালো লাগলো। সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ী আমার দেশের বাড়ীর একই ইউনিয়ন এবং পাশের গ্রামে। সেজন্য আলাদা একটা গর্বও ছিলো তার জন্য।
গাইড আরো জানায়, সত্যজিৎ রায়ের আগে আরো একজন বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও মেলবোর্নবাসীর আগ্রহ ছিলো। ১৯৩৪ সালে মেলবোর্নের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে কবিকে বিশেষ অতিথি হিসাবে দাওয়াত করা হয়। কিন্তু শেষ মুহুর্তে তাঁর আসা হয়নি।
সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বিদেশে বাঙালীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কত যুগ আগে। হোক না, তারা ভারতীয় কিন্তু বাঙালীতো! এখন বাইরের বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই। তাঁর প্রশংসা আমাদের আপ্লুত করে।
এরপর আমরা এলাম মেলবোর্ন সেন্ট্রাল বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট এলাকায়। এই এলাকা-কে সংক্ষেপে বলা হয় সি-বি-ডি। অস্ট্রেলিয়ার সব শহরেই একটা সিবিডি আছে। সিডনিতে আমার সিডনি হিল্টন হোটেলটিও ছিলো এই সিবিডি এলাকায়। প্রতিটি সিবিডি এলাকাই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি। অফিস পাড়া, বড় বড় দোকান পাঠ সবই এই এলাকায় থাকে। গাইড জানালো উত্তর থেকে দক্ষিণে বড় বড় সমান্তরাল বেশ কয়েকটি স্ট্রীট নিয়ে এই মেলবোর্ন সিবিডি। সবগুলি দিয়েই ট্রাম চলে। আর এই সিবিডিই হচ্ছে মেলবোর্নের প্রাণ কেন্দ্র। আর তাকে ঘিরেই বৃহত্তর মেলবোর্ন।
লেখক হাবিব রহমান
সিবিডি ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই আকাশ ভেঙে ঝম ঝম করে বৃস্টি নামলো। এতে আমার অবাক হবার পালা। কারণ একটু আগেও আকাশে রৌদ্রের খেলা ছিলো। আমি অবাক দৃস্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি দেখে গাইড বল্লো, মেলবোর্ন তথা সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতেই আকাশ ঘন ঘন রঙ বদলায়। এই রোদ, এই বৃস্টি। কখনো বা প্রচন্ড কুয়াশা। আবার ঘন্টা খানিকের মধ্যে দেখা গেলো কুয়াশার বুক চিড়ে সূর্য তার হাসিমুখ দেখাচ্ছে। মেলবোর্নের আকাশও তার প্রমান রাখলো। গাইডের কথা শেষ হতে না হতেই পরিস্কার আকাশে সূর্য হেসে উঠলো।
এরপর গাড়ী এসে থামলো রয়্যাল বিল্ডিং এর সামনে। গাইড জানালো এই ভবনটা অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। বারো হাজার বর্গমিটারের এই ভবনটি তৈরি হয় ১৮৮০ সালে। এই ভবনটিতেই অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিলো। পওে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়ান স্টেট গভর্নমেন্ট-এর কার্যক্রম চলে এখানে। বিরাট গম্বুজওয়ালা ভবনটার চারপাশে চমৎকার সাজানো বাগান। ঘাঁসে ঢাকা লন আর চারদিকে বড়গাছ- এক নজরেই পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
বেলা ক্রমেই নীচে নামতে শুরু করেছে। গাইড জানালো মেলবোর্নে দর্শনীয় জায়গা প্রচুর। একদিনে তা দেখা সম্ভব নয়। আজকে আর গাড়ী থেকে নামা সম্ভব নয়। তার ধারা বর্ননা আর গাড়ীর জানালা দিয়ে দেখেই আপাতত নয়ন মন স্বার্থক করতে হবে।
এবার গাড়ী চলছে হিলসভিল স্যাঙ্কচুয়ারির পাশ দিয়ে। ইয়ারা রেঞ্জের পাদদেশে অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীদের প্রায় ২০০ টি প্রজাতি ও নানা রকম গাছ গাছড়া নিয়ে এই স্যাংকচুয়ারিটি গড় উঠেছে। গাইড জানালো এমু, কোয়ালা, প্লাটিপ্লাস, তাস্মানিয়ান ডেভিল সহবেশ কিছু প্রাণী রয়েছে এখানে। প্রতিদিন বেলা ১২ টা এবং আড়াইটায় শিকারি পাখি নিয়ে একটি শো পর্যটকদের জন্য দেখানো হয়। সময়াভাবে আমাদের এ শো টি দেখানো সম্ভব হলোনা বলে দু:খ প্রকাশ করলো গাইড।
এবার আমাদের গাড়ী এসে থামলো ইউরেকা স্কাই ডেক ৮৮ এর সামনে। দক্ষিণে সবচেয়ে উঁচু এই জায়গাটি থেকে মেলবোর্ন শহরের প্রায় অনেকাংশ খালি চোখে দেখা যায়। স্কাই ডেকটি ৩০০ মিটার উঁচু। এবং এখান থেকে একটি আপাদ মস্তক কাঁচে ঘেরাঘর থেকে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কগুলো দেখবার সুযোগ পাওয়া যায়। আমার কাছে এধরনের স্কাই ডেকের অন্য একটি আকর্ষন থাকে। তাহলো এর প্রতিটিতে থাকে রিভলভিং (ঘুর্ণায়মান) রেস্টুরেন্ট। এত উঁচুতে বসে খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি ঘুরন্ত রেস্টুরেন্টে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখার আনন্দই আলাদা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এধরনের টাওয়ার আছে। কানাডা সাইড নায়াগ্রা ফলসের পাশে ২৮৮ ফুট উপরে স্কাইলন টাওয়ার, সিডনী টাওয়ার, নিউজিলাল্ডের অকল্যান্ডে স্কাই টাওয়ার, জার্মানীর বার্লিন টাওয়ার এর প্রতিটিতে আকর্ষনীয় ঘুর্ণায়মান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারেও টাওয়ার-৮৮ নামে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যদিও তা ঘুর্ণায়মান নয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এর প্রতিটিতে বসে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি উপর থেকে চারপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অবলোকনের। কিন্তু এবার সময়াভাবে মেলবোর্নের স্কাই ডেকে উঠতে না পারা এবং উঁচু রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে না পারার দু:খটা রয়েই গেলো। তবে মনে এই আশাবাদ পুষে রাখলাম যে অন্য একবার এলে তা অবশ্যই পুরণ করে নেবো।
এবার আমরা এলাম মেলবোর্নের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ইয়ারা ভ্যালিতে। এখানেই প্রচুর পর্যটকের ভীড়। গাইড জানালো এখানে আছে ওয়াইন তৈরির কারখানা, আঙুরের ক্ষেত, গ্রাম, বুটিক জিনিসের দোকান, ফসলের মাঠ। ভ্যালির মানুষজনের সহজ সরল জীবন দেখবার ও নিখাদ আতিথেয়তা পাবার সুযোগ মেলবোর্ন ঘুরতে আসলে কেউ হারাতে চায় না, আর তাই ইয়ারা ভ্যালির অমলিন সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে সকলে ছুটে যায় পৃথিবীর নানাকোণ থেকে। এই জায়গাটাও নাদেখার দু:খ বুকে চেপে আমাদের ফিরতে হলো।
গাইড ঘোষণা দিলো আজকের মত ভ্রমণের এখানেই সমাপ্তি। আগামী দিনের ভ্রমণ তালিকায় রয়েছে গ্রেট ওশান রোড ভ্রমণ, মেলবোর্ন হারবার টাউন পরিদর্শন, প্রাচীন শহর সোভেরেউন হিল, পেনিনসুলা হট স্প্রিং সহ অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইন্ড লাইফের এক অনন্য নিদর্শন পেঙ্গুইন প্যারেড দেখা।

হাবিবুর রহমান
সিইও, বাংলা ট্যুর।
ই মেইল: নধহমষধঃড়ঁৎঁং@মসধরষ.পড়স